X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আমেরিকার বিরুদ্ধে আমেরিকানদের রায়

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
১৭ নভেম্বর ২০১৬, ১৬:৩৫আপডেট : ১৭ নভেম্বর ২০১৬, ১৬:৩৬

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী মনে হয় মার্কিন বসন্ত আরম্ভ হলো। নাইন-ইলেভেনের বিপর্যয়ের ক্ষত এখনও শুকায়নি। আবার ইলেভেন নাইনের নির্বাচনি  ফল আরেক দুর্ভোগ এনে উপস্থিত করলো। আমেরিকায় বহুজাতি মিলে এক জাতি হয়েছে। শুরুতে গিয়েছিল ইউরোপ থেকে। পরে বিশ্বের প্রতিটি জাতির লোক মিলে কলেবর বৃদ্ধি করেছে এবং তারা ঐক্যবদ্ধ রয়েছে। এটাই ছিল বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য।
স্থপতিদের প্রজ্ঞা ও সুদূর প্রসারী বন্ধনের এই ঐক্য এত দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। এখানে অন্য কোনও ম্যাজিক কাজ করেনি। কিন্তু নাইন-ইলেভেনের নির্বাচনটা সব কিছুকে বেসুরো করে দিল। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসেও ‘অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিট’—একথা বলে একদল যুবক ওয়াল স্ট্রিটের সামনে অবস্থান নিয়েছিল কিন্তু তারা তাদের অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী করেনি।
অনেকে বলছেন, এবারের বিক্ষোভও দীর্ঘস্থায়ী হবে না। বিক্ষেভকারীরা ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে যাবে। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা বলেছে, তারা ২০ জানুয়ারি ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের দিন রাজধানীতে ১০ লাখ লোকের সমাবেশ করবে। আগের চেয়ে মানুষ মুখর হয়েছে বেশি। শুধু মুখর হয়নি তারা দাঙ্গাও করছে। তারা অসহযোগ আন্দোলনের কথা বলছে, একইসঙ্গে বলছে আইন অমান্য করে আন্দোলনের কথাও। 
ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথাও বলেছে। এখন যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছে তা মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন। সুতরাং তা সহজে বন্ধ হবে বলে মনে হচ্ছে না। নির্বাচনের সময় ট্রাম্প মুসলমান, লেটিনো, কৃষ্ণাঙ্গ, হিস্পানিক—সব সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তারা আমেরিকান সমাজে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় হলো শ্বেতাঙ্গরা। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও অভিবাসনবিরোধী অবস্থান নিয়ে ট্রাম্প আমেরিকাকে শ্বেতাঙ্গ-অশ্বেতাঙ্গ দু’ভাগে ভাগ করে বর্ণবিদ্বেষ সক্রিয় করে দিয়েছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্বেতাঙ্গদের সমর্থন আদায় করে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।
গত শতকের কু-ক্লিক এর নেতাকর্মীরা এখন খুব সক্রিয়। তারাই কৃষ্ণাঙ্গদের গাছে গাছে ঝুলিয়ে হত্যা করতো। কু-ক্লিক-এর সভাপতি ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, ট্রাম্প তাদেরই লোক। অনেকে অনেক সময় কোনও কাজ করে চিন্তা করে কাজটা ভালো করল কিনা। তেমন একটা চিন্তায় ছিল আমেরিকার শ্বেতাঙ্গরা। বারাক ওবামাকে দুই-দু’বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে। শ্বেতাঙ্গদের সে চাপা চিন্তাটাকে ট্রাম্প অনুসূচনায় রূপান্তরিত করতে পেরেছেন সফলভাবে। সুতরাং শ্বেতাঙ্গরা এখন হোয়াইট সুপ্রিমেসির মোহে মশগুল। একইসঙ্গে তাদের মধ্যে সুপ্রিমেসি হারানোর আতঙ্কও রয়েছে। সংখ্যালঘুরা নিজেদের অস্থিত্বের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এবং সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে উদ্ধত। সংখ্যাগরিষ্ঠরা নিজেদের আধিপত্য রক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তারাও পিছু হটবে না। বিভক্তি এতই যে, তা মীমাংসার কোনও পথ খুঁজে পাবে বলে মনে হয় না।
বিভক্তি যদি না মেটে, তাহলে তো আমেরিকার সমাজ ভেঙে যাবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এরকম একটি সংকটে পড়েছিল গত শতকের শেষ দশকে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিগ্যান আর ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী মার্গেরেট থেচার কলকাঠি নেড়ে সোভিয়েতের বিপর্যয়টাকে অনিবার্য করে তুলেছিলেন। অবশেষে সোভিয়েট ভেঙে যায়।

আমেরিকায় আরও একটা সংকট বিদ্যমান। এ সংকটে সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় উভয়ে জর্জরিত। বিরাজমান সংকটে উভয় সম্প্রদায়ের অভিন্ন স্বার্থ। কারণ অভাব কখনও সাদা-কালো হয় না। শোষকও কোনও রঙ্গে রঞ্জিত নয়। শোষক শোষকই। শোষণ করাই তার ধর্ম।

একচেটিয়া শোষণের স্বর্গ রাজ্য হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সুদীর্ঘ সময়ের একচেটিয়া শোষণের কারণে যুক্তরাষ্ট্রেও দরিদ্র শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে। রাষ্ট্রের সব সম্পদ গিয়ে পুঞ্জিভূত হয়েছে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হাতে। তারা সংখ্যায় এক শতাংশ। এখন আমেরিকায় কাজ জোটে না, লোকেরা হতাশায় মাদক ধরেছে, বিদ্যুতের বিল পরিশোধিত করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অবিকল তৃতীয় বিশ্বের দৃশ্য।

দুই বিপরীতমুখী সমস্যার মাঝে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। উপায় বের করা শুধু কঠিন নয়, সুকঠিনও। তার স্বল্প মনোযোগ ক্ষমতা, তার অজ্ঞতা, অনভিজ্ঞতা সব মিলিয়ে এত কঠিন, এত সমস্যা তার পক্ষে কি সমাধান করা সম্ভব? রিগ্যান থেকে ওবামা পর্যন্ত সবাই বিশ্বায়নের ফাঁপা বেলুনে বাতাস দিয়েছেন। তারা মনে করেছিলেন বিশ্বায়ন আলাউদ্দীনের অশ্চর্য প্রদীপ। বিশ্বায়ন যা দিয়েছে, তাতে তো সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে বিকলাঙ্গ করে ফেলেছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প এক শূন্যতার মাঝে এসে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। ট্রাম্পের মতো লোক এমন কঠিন সময়ের কান্ডারি হওয়া বিপজ্জনক ব্যাপার। আমেরিকার সংস্কৃতিতে শ্রমিক শ্রেণি, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তের জন্য খুব বেশি সহানুভূতি রাখা হয়নি। পুঁজিবাদের ‘সৃজনশীল ধ্বংস’ তত্ত্বের শিকার হয়ে তারা ক্রমাগতভাবে দারিদ্র্যের পথ থেকে দ্রারিদ্র্যতর পথে এগিয়ে যাচ্ছে। দিনে দিনে এ কাফেলা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। যারা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে রাস্তায় রয়েছেন, তারা কিন্তু এই কাফেলার লোক। যারা ট্রাম্পকে ভোট দিয়ে জিতিয়ে দিয়েছেন, তারাও ভবিষ্যতে এ কাফেলায় আসতে বাধ্য হবেন।

ক্ষুধার তো কোনও বর্ণ নেই। ১৯৩০-এর বিপর্যয়কর মন্দার সময় যে সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছিল, তাকে উত্তরণের জন্য প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ১৯৩৫ সালে সামাজিক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করেছিলেন। তাতে অনেক কিছু মিটমাট হয়ে গিয়েছিল। শ্রমিকদের যে মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল, তাতে শ্রমিকেরা জীবিকা নির্বাহ করে সঞ্চয় করতেও পেরেছিল। তখন মধ্যবিত্তের বিকাশ ও হয়েছিল।

কিন্তু রুজ ভেল্টের সময় তো আর এখন নেই। এখন আমেরিকার সমাজে শ্রমিক আছে, মালিকও আছে কিন্তু কারখানা নেই। মার্কিন কারখানাগুলো এশিয়ায় সস্তায় পণ্য উৎপাদকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে। শ্রমিকেরা বেকার হয়ে পড়েছে। কারখানাগুলো মেক্সিকোতে, চীনে সরিয়ে নিয়েছেন মালিকেরা।

তেল উৎপাদনকারী রাষ্ট্রগুলো ১৯৭৩ সালে ওপেক গঠন করে সুবিধাজনক অবস্থানে গিয়ে বসে আছে। প্রচুর অর্থ তাদের হাতে সঞ্চয় হয়ে গেছে। সুতরাং কোনও কিছুতেই আমেরিকার আর একক আধিপত্য নেই। বরং পরনির্ভরশীলতা দিন দিন বাড়ছে। আমেরিকাকে দৈনিক ৮০ কোটি ডলারের তেল কিনতে হয় সৌদি আরব, ভেনিজুয়েলা ও ইরাক থেকে। আমেরিকার তেলের মজুদ মাত্র তিন শতাংশ। আর তার তেলের প্রয়োজন ২৫ শতাংশ।

ট্রাম্প বড় ব্যবসায়ী। মালিকানায় মোহগ্রস্ত। মালিকানাভিত্তিক সমাজ বেশ মোহনীয় একটা ধারণা। কিন্তু এতে একটা সমস্যা রয়েছে। যারা ইতোমধ্যে অর্থনীতিতে পিছিয়ে পড়েছেন, তাদের জন্য এটা কাজ করবে না।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের চলার পথ খুব জটিল। জটিলতার মাঝে পথ চলতে গিয়ে ট্রাম্প  আপন লোক, বিরোধী লোক—কাউকেও সন্তুষ্ট করতে পারবেন না। সুতরাং তারা তাকে ত্যাগ করে যাবেন।

ট্রাম্পের জন্য আরও একটা অশনিসংকেত রয়েছে। আমেরিকার অঙ্গরাজ্য ৫০টি। সবার আর্থিক অবস্থা এক রকম নয়। ধনী রাজ্যগুলো এখন ফেডারেশনকে বোঝা বলে মনে করছে। ক্যালিফোনিয়ার অর্থবিত্ত ফ্রান্সের সমান। তারা এখন স্বাধীনতার দাবি তুলেছে। তাদের সম্পদ দিয়ে তারা যদি তাদের অধিবাসীদের সন্তুষ্ট রাখতে পারে, তারা অন্যের বোঝা কাঁধে নেবে কেন।

ক্যালিফোর্নিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর হচ্ছে লস অ্যাঞ্জেলেস, বিশ্ব চলচ্চিত্র জগতের রাজধানী হলিউডও এখানে। আইটি জগতের প্রধান কেন্দ্র সিলিকন ভ্যালিও এই রাজ্যে। আমার মনে হয় মানুষের দাবি মেটাতে গিয়ে যখন ট্রাম্প দিশেহারা হবেন, তখন আর্থিক শক্তিশালী অন্য রাজ্যগুলোও স্বাধীনতার কথা বলবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমেরিকার ভেতরে আমেরিকাকে ছিন্নভিন্ন করার ধারা তীব্রতর হচ্ছে। তা হলে গত নির্বাচনে কি আমেরিকা আমেরিকার বিরুদ্ধে রায় দিয়ে দিয়েছে বলে ধরে নিতে হবে?

গত ২২৩ বছর আমেরিকা ধনীবান্ধব অর্থনীতি লালন করে এসেছে। স্থপতিদের অন্যতম হ্যামিলটন এই ধারাটি সূচনা করেছিলেন। এখন সে ধারাটি চূড়ান্তভাবে বিকশিত হয়েছে। আর আমেরিকান সমাজটাতে হেভ নটস্ শ্রেণিও বিকশিত হয়েছে। কয়দিন পরে উভয় শ্রেণি দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হবে। তখন এ সমাজ টিকে থাকার কোনও সম্ভাবনা কি থাকবে?

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ