X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

টেলিভিশনের গন্তব্য হোক ‘মান’

তুষার আবদুল্লাহ
০৪ ডিসেম্বর ২০১৬, ১২:৪৩আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০১৬, ১২:৫৫

তুষার আবদুল্লাহ সস্তার তিন অবস্থা বলতে কী বুঝায়? কেউ যদি উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিতে বলেন, তাহলে তাকে বাংলাদেশের টেলিভিশন মাধ্যমের দিকে তাকাতে বলবো। তিন অবস্থার বিশৃঙ্খল, বিপন্ন এবং নিজস্বতা হারা আমাদের টেলিভিশন মাধ্যম।
স্মৃতির সড়কে ফিরে তাকিয়ে নিশ্চিত ভাবেই মনে পড়ছে বাংলাদেশে প্রথম বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের ঘোষণা আসলো যে সংবাদ সম্মেলনটি থেকে, সেখানে উপস্থিত ছিলাম আমি। পত্রিকার সংবাদকর্মী হিসেবে সেই ১৯৯৮ সালেও ভাবনায় আসেনি পরবর্তীতে নিজেও এই মাধ্যমে ডুব দেবো। কারণ ওই মুহূর্তে বেসরকারি টেলিভিশন মানে এক অনিশ্চিত যাত্রা। তবে বাংলাদেশ টেলিভিশনে তখন সিকিখানেক বেসরকারি হাওয়া বইছিল। ‘প্যাকেজ’ নামে মুক্ত নির্মাতারা অনুষ্ঠান তৈরি করে বিটিভিতে সম্প্রচার করছিলেন। বিটিভির মূল সুরের বাইরে ভিন্ন স্বাদ আসতে শুরু করেছিল ‘প্যাকেজ’ অনুষ্ঠানের  মাধ্যমে। মূলত প্যাকেজ অনুষ্ঠান শুরুর পর থেকেই টেলিভিশন মাধ্যমকে কেন্দ্র করে বেসরকারি উদ্যোক্তা এবং নতুন কলাকুশলী তৈরি হতে শুরু করেছিল। প্যাকেজই মূলত বেসরকারি টেলিভিশন নিয়ে আত্মপ্রকাশে প্রচ্ছন্ন সাহস জুগিয়েছিল উদ্যোক্তাদের।
এটিএন বাংলা, চ্যানেল আই সেভাবেই নিজেদের সংগঠিত করেছিল। পরবর্তীতে টেরিস্টোরিয়াল একুশে টেলিভিশন যাত্রা শুরু করেছিল সেই প্যাকেজের কলাকুশলীদের ওপর ভরসা করেই। সঙ্গে শুধু যুক্ত হয়েছিল পত্রিকা থেকে আসা কয়েকজন সংবাদকর্মী। একুশে টেলিভিশন আসার আগেই নিরবে প্যাকেজ অনুষ্ঠানেই একটি রোগ সংক্রমিত হতে শুরু করে। সেখানে রোগের প্রথম লক্ষণ ছিল কম খরচে নাটক বা অনুষ্ঠান তৈরি করে বেশি লাভ করা। বিটিভি, চ্যানেল আইয়ে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু একুশে টেলিভিশন এসে সেই স্বস্তার দিকে যায়নি। তারা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত মান ধরে রাখার চেষ্টায় ছিল এবং অনুষ্ঠান নির্মাণে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করেছে। পরবর্তীতে এনটিভি, বাংলাভিশন, চ্যানেল ওয়ান সেই ধারা অনুসরণ করতে থাকে। বেসরকারি টেলিভিশনের সংখ্যা যখন দ্বৈত সংখ্যা ছাড়িয়ে যেতে থাকে তখন বাজারে নাটক  ও অনুষ্ঠানের চাহিদা বেড়ে যায়। বিশেষ করে নাটক ও সিরিয়ালের চাহিদার প্রবৃদ্ধি বাড়তে থাকে। চাহিদা অনুসারে জোগানের সামর্থ তখনও এই শিল্পের তৈরি হয়নি। পাণ্ডুলিপি লেখক, পরিচালক, ক্যামেরাম্যান, অভিনেতা-অভিনেত্রী বলতে যা বুঝায় তার ঘাটতি ছিল। কিন্তু সেই ঘাটতি নিয়েতো আর ক্ষুধার্ত টেলিভিশন বসে থাকতে পারে না। তাদের জোগান দেওয়ার জন্য একপ্রকার নির্মাতার অনুপ্রবেশ ঘটলো। সঙ্গে সেইমনা প্রযোজক নামধারী কিছু মানুষ। তারা চ্যানেলগুলোতে স্বস্তায় নাটক সরবরাহ করতে শুরু করে। এই স্বস্তার নাটক এবং সিরিয়ালে গল্প-কাহিনির থাকার প্রয়োজন নেই। ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে যে কাউকে বা কোনও একজন জনপ্রিয় শিল্পী নির্ভর নাটক, সিরিয়াল তৈরি হতে থাকে। যেখানে একক তৈরির জন্য বরাদ্দ এক লাখ টাকার নিচে নেমে আসে। এই টাকায় আবার সিরিয়ালের একাধিক পর্ব তৈরি হতে থাকে। নাটক ও সিরিয়াল যখন গল্প ও অভিনয় যুক্ত হয়ে যায়, তখনই কিন্তু দর্শকরা দেশীয় চ্যানেল থেকে মুখ সরিয়ে নিতে থাকে।

আগেই বলেছি সস্তায় অনুষ্ঠান তৈরি করে বেশি মুনাফার রোগের লক্ষণ দেখা দিয়েছিল আগেই। সেই ধারাবাহিকতায় বিজ্ঞাপনের আধিক্য বাড়লো। বিজ্ঞাপন দেখার মাঝে নাটক, সিরিয়ালের বিরতি শুরু হলো। দর্শক বেচারা কী করবেন? হাতের রিমোট দিয়ে তারকাঁটার বেড়া পেরিয়ে গেলেন। সেখানকার অনুষ্ঠানে বুঁদ হয়ে থাকার অভ্যাস তৈরি হলো। এখন পণ্যের যারা বিপণন করেন, তারা দেখলেন স্থানীয় চ্যানেল যেহেতু লোকে দেখেনা তখন তারা যে চ্যানেল দেখেন সেখানেই বিজ্ঞাপন দেবেন। মুক্তবাজারের তকমাতো আছে। তারা সেদিকে গেলেন। এদিকে আবার নির্মাণ বাজেট এতো তলানিতে এসে ঠেকলো যে, নির্মাতার অনুষ্ঠান প্রধানের চেয়ে বিজ্ঞাপন এজেন্সির কাছেই ধরণা দিতে থাকেন। তারা বিজ্ঞাপন নিশ্চিত করেই চ্যানেল দখল করতে চাইলো। সম্পর্ক ও উদ্দেশ্য যখন কেবলই বিপণন তখন আর চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠান পরিকল্পকরা এনিয়ে ভাবনা বাদ দিলেন।

অনুষ্ঠানের মান নিয়ে যখন ভাবনাই বাদ, তখন বিজ্ঞাপনও বাদ হতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে চ্যানেলগুলো আবার দর্শক ফিরিয়ে আনার ফন্দি করে। তারা ডাবিং অনুষ্ঠান আমদানি করে। সফলকামও হয় কোনও কোনও চ্যানেল। তাই দেখে অন্যরাও ডাবিং অনুষ্ঠানে জোয়ারে ভাসতে শুরু করেছে। ফলাফল স্থানীয় নির্মাতাদের অনুষ্ঠান বাদ যেতে শুরু করে। নির্মাতা ও শিল্পীদের রুটি-রুজি এবং চ্যানেলের রুটি-রুজির টান এক সঙ্গে পড়াতেই এখন সবাই প্রতিবাদে নেমেছেন। শিল্পীরা তাদের মতো দাবি তুলছেন। চ্যানেল মালিকরা বিদেশি চ্যানেলের ডাউনলিংক, বিদেশে বিজ্ঞাপন পাচার হয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার এখন সবাই।

দেরিতে হলেও সবাই এখন নিজ নিজ স্বার্থে মাঠে নেমেছেন। কিছু কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়িও দেখা যাচ্ছে। এটি ভালো লক্ষণ নয়। কাঁদা নিজেদের শুভ্র পোশাককেই নষ্ট করবে। তারচেয়ে একাট্টা থেকে নিজেদের শিল্প রক্ষায় রাষ্ট্রের যে উদ্যোগগুলো নেওয়া প্রয়োজন, রাষ্ট্রের কাছ থেকে সেটি আদায় করে নিতে হবে এক জোট হয়ে। আর একটি কথা মনে রাখতে হবে নিজেদের কাজের মান না বাড়িয়ে, দরজা জানালা বন্ধ করে লাভ হবে না। যে কাজের জন্য যতটুকু বিনিয়োগ দরকার ততোটুকু করতেই হবে। ভরসার জায়গা হচ্ছে-আমাদের দর্শকরা কিন্তু বালুকাবেলা থেকে ঠিক হীরেটি তুলে নিতে জানেন। তাই মানহীন অনুষ্ঠান তৈরি থেকে আমাদের সরে আসতে হবে। এটিই হোক প্রথম পদক্ষেপ।

লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ