X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘পশুরা খায় কোরমা পোলাও, মানুষরা খায় ঘাস’

ড. জোবাইদা নাসরীন
০৬ জানুয়ারি ২০১৭, ১৪:১০আপডেট : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৫:৫৩

জোবাইদা নাসরীন এক
ছোটবেলায় আমরা একটি গান করতাম। সেটির কয়েকটি লাইন ছিল এই রকম ‘আজব দেশে যাই চলো, আজব দেশে যাই...পশুরা খায় কোরমা পোলাও, মানুষরা খায় ঘাস, সিংহ মামা সেথায় করে দালান কোঠায় বাস…’।  বাংলাদেশ সত্যিই এখন আমাদের ছোট্ট বেলায় শিখা গানের মতো হয়েছে। এখানে পাঠ্যবই অনুযায়ী ছাগল গাছে ওঠে আম খায়, শিশুরা ওড়না চায়। বিষয়টি আপাত হাস্যকর কিন্তু অপরাধ হিসেবে অত্যন্ত গুরুতর। কয়েকদিন আগে শিশুদের জন্য বিতরণ করা প্রথম শ্রেণির ‘আমার বাংলা বই’ এর বর্ণ শিখি অধ্যায়ে (পাঠ -১২) আছে বর্ণ শেখা। সেই বর্ণমালা শেখাতে 'ও' বর্ণ শেখাতে গিয়ে ছবি দেওয়া হয়েছে একটি মেয়ে শিশুর। তার গায়ে আছে ওড়না এবং নিচে লেখা আছে 'ওড়না চাই'। এছাড়া ২০১৩ সাল থেকেই আরও কয়েকটি ভুলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভুল ছিল পাঠ্য বইটির ১১ পাতায় আছে অ- তে অজ (ছাগল) বইয়ের লেখা ও ছবিতে দেখা যাচ্ছে ছাগল গাছে ওঠে আম খাচ্ছে। বাংলাদেশে শিক্ষার মান বাড়ছে, অন্তত পাশের হার তা নির্দেশ করে। তবে আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে শিক্ষার মান  ছাগলকে গাছে ওঠতে সাহায্য করছে এবং এবং ছোট্ট শিশুকে ওড়নার দাবির মিছিলে সামিল করছে।
বাংলাদেশে পাবলিক পরিসরে নারী বার বার করে ওড়না ঠিক করছে কিংবা শাড়রি আঁচল ঠিক করছে, এটিকে যদি কোনও নারীর মুদ্রা দোষ ভাবেন তাহলে ভুল করবেন। নারীর শরীরের প্রতি সামাজিক চোখ তার যে শরীর কেন্দ্রীক অনিরাপত্তার ইঙ্গিত দেয় তাতেই নারী ব্যস্ত হয়ে যায় ওড়না ঠিকঠাক করতে। বড় হতে হতে একটি মেয়ে বুঝে যায় তার শরীরই তার শত্রু। আর ওড়নাহীন নারী সমাজের কাছে আদৃত নয়। কিন্তু ছোট বাচ্চা মেযেরও রেহাই নেই? তাকেও পড়তে হবে ওড়না? নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে প্রাথমিক বইয়ে। সমাজের ‘ওড়না’ চাহিদার প্রতি নারীর বিশ্বস্ততা তৈরি করানোর পরিসর তৈরি করা হচ্ছে বর্ণমালা শেখানোর উছিলায়? আর তাই আট দশটা বিষয়ের মতো সমাজের চাহিদাকে নারীর চাহিদা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে বর্ণমালা শিক্ষার বইতে।

যে সমাজে এই নারী শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, তাকে যৌন বস্তু হিসেবে দেখা হচ্ছে, তখন সেই সমাজ ছোট বাচ্চাকে ওড়না পরাবে এটাইতো কাঙ্ক্ষিত। একটি সমাজের বিকলাঙ্গতা কিংবা পঙ্গত্ব এইভাবেই প্রকাশ পায কিংবা হয়তো আরও পাবে। পাঠপুস্তকে 'ওড়না' প্রসঙ্গটি কয়েকদিন আগের, কিন্তু এই বিষয়ে আলোচনাটি গুরুত্বপূর্ণ। কেন একটি শিশু এই ছোট বয়সে খেলনা না চেয়ে, খাবার না চেয়ে কিংবা অন্য কোনও বায়না না করে ওড়না চাওয়ার বায়না করছে বা করবে? এটি কি সমাজের সত্যিকারের নারী শিশুর চিত্র? আর যদি সত্যিকার চিত্র না হয় তাহলে কেন তার মুখ দিয়ে 'ওড়না চাই' স্লোগান জুড়ে দেওয়া হলো? একজন ৫/৬ বছরের বাচ্চার কাছে ওড়নার কী এমন মানে আছে যার কারণে সেটি চাইবে? মূল কথা হলো নারীকে ছোটবেলা থেকেই নারী হিসেবে দেখানোর সামাজিক সুড়সুড়ি টের পাওয়া গেছে পাঠ্যপুস্তকে। আমাদের ছোটবেলায় এই বর্ণমালার ছন্দটি ছিল এই রকম 'ওল খেয়োনা ধরবে গলা, ঔষধ খেতে মিছে বলা। ঔ তে ঔষধ ঠিক থাকলেও ওল এর জায়গায় স্থান পেয়েছে ওড়না।

দুই

দ্বিধাহীনভাবেই বলা যায় এ ওড়না চাওয়ার বায়না সমাজের, কোনও শিশুর নয়। যে সমাজ একটি ছোট শিশুকেও রেহাই দিচ্ছেনা হয়রানী থেকে, এটি সহজেই অনুমেয় যে, এই সকল সামাজিক বায়না থেকেও সে রেহাই পাবেনা। 'নারী হয়ে কেউ জন্মায়না কেউ কেউ মেয়ে ওঠে', বলেছিলেন সিম্যান দ্য ব্যভয়া তার সেকেন্ড সেক্স এ। আর কিভাবে তার মেয়ে হয়ে ওঠা? আমরা জেনেছি ছোট মেয়েদের বারবি পুতুল আর হাঁড়ি পাতিলের খেলনা এবং এর বিপরীতে ছেলেকে গাড়ি দিয়ে সমাজের চলমান লিঙ্গীয় রাজনীতির সঙ্গে পরিচয় করানো হয়। তবে এই বোঝাবুঝির যুগ অনেকটাই ঠেলে বেরিয়ে যাওয়া গেছে। সচেতন হয়েছে, হচ্ছে অভিভাবকরা। তবে তাতেই কি কমেছে সমাজের ইনসোমনিয়া? সমাজ একটি মেয়েকে কী শেখায় আর শেখায়না তার মধ্য দিয়েই চর্চিত হয় সমাজের লিঙ্গীয় রাজনীতি। নারী কিভাবে চলবে, কী পরবে, সেটি বিভিন্নভাবে সমাজ বুঝিয়ে দেয় নানাভাবে, নানা পরিসরে, এইবার এটি স্থান পেয়েছে পাঠ্য পুস্তকেও। পাঠ্যপুস্তকে নারীকে উপস্থাপণ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বাতচিত  এবং বিতর্ক জারি থাকলেও একটি শিশুর ছোট বয়স থেকে থেকে তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ওড়না তাকে পরতেই হবে। এখানে তার পোশাক নির্বাচনে কোনও স্বাধীনতার সুযোগ নেই। তাই বাংলাদেশে প্রথম শ্রেণির পাঠ্য বইতে বাংলা ভাষায় যেভাবে বর্ণ পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে সেটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। দাবি করা হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়নে এবং নারী শিক্ষায় বাংলাদেশ অনেকখানিই এগিয়ে। এবং এই এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত পোশাক নির্বাচনে তার স্বাধীনতার স্বীকৃতি। নারী কী পরবে, ওড়না পরবে কী পরবে না এটি তার একেবারে নিজস্ব সিদ্ধান্ত। আর শিশুর ক্ষেত্রেতো কথাই নেই।

তিন

শিক্ষার মানের সঙ্গে সম্পৃক্তরা যদি ছাগলকে আম খেতে দেখেন, কিংবা আম খাওয়ার জন্য ছাগলকে গাছে ওঠতে প্রলুব্ধ করতে পারেন, তাহলে সেই একই ব্যক্তিরা শিশুদের ওড়নার মিছিলে নেওয়াটা কোনোভাবেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা নয়। তাহলে এই বাস্তবতা বিরোধী তথ্য কিভাবে একটি বাচ্চার মনে ঢুকিয়ে দেওয়া প্রথমিক শ্রেণিতে সেটি বোধগময় নয় তবে এখানে যে একটি একটি রাজনীতি রয়েছে সেটি স্পষ্ট। আর সেই রাজনীতি হলো দেশটিকে একটি 'আজব' দেশ বানানো। কী প্রক্রিয়ায় এই বিষয়গুলো একের পর এক ঘটতে থাকে? এই ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতা কী ধরনের? যিনি ছাগলের গাছে ওঠার ছবিটি কষ্ট করে এঁকেছেন তার মাথায়ও এই প্রশ্ন আসেনি? না কী ক্ষমতা আমাদের সব বোধ নষ্ট করে দেয়। প্রশ্নের বিপরীতে তোষামোদের রাজনীতিই আমাদের দেশকে সেই 'আজব' দেশ এ নিযে যাচ্ছে। শিক্ষার মতো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয নিয়ে এই ঠাট্টা-তামাশা থামবে কবে?

ড.জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: [email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঢামেক হাসপাতালে কারাবন্দীর মৃত্যু
ঢামেক হাসপাতালে কারাবন্দীর মৃত্যু
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
ভোট গণনা প্রক্রিয়ায় কোনও পরিবর্তন হবে না: ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট
ভোট গণনা প্রক্রিয়ায় কোনও পরিবর্তন হবে না: ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ