X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এক সম্পাদকের গল্প

ইকরাম কবীর
১১ জানুয়ারি ২০১৭, ১৭:৫৫আপডেট : ১১ জানুয়ারি ২০১৭, ১৭:৫৭

ইকরাম কবীর বেশ কিছুদিন আগে এক সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে এক হৃদরোগ ডাক্তারের পরিচয় হয়েছিল। তিনি এক নামকরা হৃদরোগ হাসপাতালের চিকিৎসক। তার বন্ধু আমার পরিচিত। বন্ধুর সঙ্গে এসেছিলেন আমাদের ক্লাবে। অনেক কথা হলো তার সঙ্গে। আমি আগে সাংবাদিকতা করতাম জেনে তিনি এক পর্যায়ে একটি বিজনেস কার্ড এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমিও কিন্তু একজন সম্পাদক’। চোখ বড়-বড় করে কার্ডটির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সেখানে লেখা আছে তিনি একটি অনলাইন পত্রিকার সম্পাদক।
উৎসুক চোখে তার দিকে চাইলাম। ‘আপনি হার্টের ডাক্তার, আবার সম্পাদক! ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না! আপনি সাংবাদিকতাও করছেন। কেন? শখে?’ আমি জানতে চাইলাম।
‘সে এক লম্বা ইতিহাস’, তিনি বললেন।
আমিও নাছোড়বান্দা। চেপে ধরলাম তাকে। বলতেই হবে কেন তিনি সম্পাদক হয়েছেন।
তিনি শুরু করলেন।
‘আমি ঢাকায় যেই ভবনে থাকি, যেই ভবনে আমি ফ্ল্যাট কিনেছি, সেখানে একজন পুলিশ অফিসার এবং একজন এনবিআর অফিসারও থাকেন। তারাও সেখানে ফ্ল্যাট কিনেছেন। এই ভবনের সোসাইটির প্রেসিডেন্ট আমি; বেশ কয়েক বছর ধরেই আমি প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমায় বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা তাদের পছন্দ ছিল না। পছন্দ না হলেই তারা আমায় হুমকি দেওয়া শুরু করতেন। পুলিশ অফিসার বলতেন আমায় গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যেতে তার দশ মিনিট লাগবে। এনবিআর-এর অফিসার বলতেন, তার কথা না শুনলে তিনি আমার ফাইলপত্র বের করে আমায় আদালতে নিয়ে যাবেন। মহাবিপদ! আমার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল; কিছুই ভালো লাগছিল না। ভয়ে-ভয়ে দিনানিপাত করছিলাম। একদিন আমার এক সাংবাদিক বন্ধুর কাছে গেলাম সাহায্যের জন্য। সব বললাম। সে কিছুক্ষণ চিন্তা করলো। তারপর জানতে চাইল, ‘আচ্ছা, মাসে-মাসে একলাখ টাকা খরচ করতে পারবি?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘পারব, কেন?’ সে বললো,  ‘শোনো, অনলাইন পত্রিকা বের কর, তুই সম্পাদক হয়ে যা; চারজন ছেলেকে চাকরি দিয়ে রাখ; ওরা সারাদিন বিভিন্ন অনলাইন বা হাইব্রিড অনলাইন পত্রিকা থেকে খবর নিয়ে একটু অন্যরকম করে পরিবেশন  করবে। পত্রিকা চলবে তোর সম্পাদনায়। তোর কিছু করতে হবে না। ওরাই করবে। এরপর এই পুলিশ ও এনবিআর-এর অফিসারদের তোর কার্ড দেখাবি। দেখ কী হয়।’

‘তারপর কী হলো?’ আমি জানতে চাই।

হৃদরোগ ডাক্তার উত্তর দিলেন, ‘ভাই, যখন ওই পুলিশ অফিসার ও এনবিআরের অফিসারকে জানালাম যে আমি সম্পাদক হয়েছি, তাদের ব্যবহার রাতারাতি বদলে গেল। আর তারা আমায় কোনও হুমকি দেন না। সবসময় আমার খবরা-খবর রাখেন। কোনও ব্যাপারে আমার সঙ্গে মতবিরোধ হয় না। আমি খুব খুশি। আমার একলাখ টাকা খরচ হচ্ছে, হোক; আমার শান্তি তো ফিরে এসেছে! কেমন হয়েছে ভাই কাজটা?’

আমি বললাম, খুব ভালো করেছেন ভাই।

আমি মনে মনে ভাবলাম, এমন ডাক্তার-সম্পাদক দেশে কতজন থাকতে পারে। দুই বছর আগে শুনেছিলাম বাংলাদেশে নাকি অনলাইন নিউজ-পোর্টালের সংখ্যা প্রায় পনেরো শ! এর মধ্যে গোটা দশেক পোর্টাল ছাড়া আর কারোই নিজের মতো করে সংবাদকর্মী নিয়োগ দিয়ে কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বেশিরভাগই কপিপেস্ট করে সংবাদ পরিবেশন করেন, এই ডাক্তার-সম্পাদকের পত্রিকার মতো।

আমাদের এই ডাক্তার-সম্পাদক চারজন ছেলেকে নিয়োগ দিয়েছেন যারা সারাদিন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশগুলোর ওয়েবসাইট ঘেঁটে সংবাদ কপি করে পেস্ট করে এবং তারপর মূল সংবাদের টেক্সটির ভাষা একটু এদিক-ওদিক করে মূল সংবাদের ছবি অথবা গুগল থেকে ছবি বের করে প্রকাশ করে দেয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সারা বাংলাদেশে যদি সত্যিই পনেরো শ অনলাইন সংবাদ পোর্টাল থাকে, তাহলে সেগুলোর সম্পাদক কারা? তারা কতদিন সাংবাদিকতা করার পর সম্পাদক হয়েছেন? তারা কি আমাদের এই ডাক্তার-সম্পাদকের মতো হঠাৎ করেই একদিন সম্পাদক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? এই পনেরো শ’র অর্ধেকও যদি তাই হয়, তবে আমাদের মাঝে প্রচুর এমন ডাক্তার-সম্পাদক, ব্যবসায়ী-সম্পাদক, আইনজীবী-সম্পাদক, এমনকি পুলিশ-সম্পাদকও থাকতে পারেন।

ঠিক আছে, সম্পাদক হতে অসুবিধে নেই, কিন্তু সম্পাদক হতে যে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়, তা কতজনের আছে? আর একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল খুলে কপি-পেস্ট করে খবর প্রকাশিত করলেই যদি সম্পাদক হওয়া যেত, তাহলে আমাদের আলমগীর হোসেন, তৌফিক খালিদী, জুলফিকার রাসেলরা তবে এতদিন কেন এত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলেন?

আমাদের মূলধারার পত্রিকাগুলোর অনলাইন সংস্করণগুলোর সম্পাদকরাই বা এতদিন কী করলেন? তারা এত কষ্ট করে অর্থ খরচ করে সংবাদকর্মী ও সাংবাদিক নিয়োগ দিয়ে সংবাদপত্র চালিয়ে যাচ্ছেন কেন?

প্রশ্ন আরও রয়ে যায়। যারা কপি-পেস্ট করে সংবাদ পরিবেশন করছেন, তাদেরই বা উদ্দেশ্য কী? শখ? শুধু শখের বসে এই কাজ বোধহয় সম্ভব নয়। অন্য কোনও উৎসাহ নিশ্চয়ই তাদের মনে কাজ করে। ছোটবেলা থেকে আমরা জেনে এসেছি যে পত্রিকা প্রকাশ করতে গেলে সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। এই অনলাইন পত্রিকাগুলো কি অনুমোদনপ্রাপ্ত?

কাগজে ছাপা পত্রিকায়—অথবা সাংবাদিকতার রীতিনীতি মেনে যে পোর্টালগুলো সাংবাদিকতা করছেন, যদি ভুলে কোনও খবর ছাপা হয়, তাহলে তা তাদের নজরে এনে প্রতিকারের একটি ব্যবস্থা করা যায়। আর এই কপি-পেস্ট করা পোর্টালগুলোর বেশিরভাগেরই কোনও খোঁজ পাওয়া যায় না। সংবাদ প্রতিনিধি না থাকার কারণে তাদের ভুলের সংখ্যা বেশি। সাংবাদিকতার রীতিনীতি না থাকার কারণে সংবাদের ব্যাকরণ মেনে চলার প্রয়োজন হয় না।

আমাদের এই ডাক্তার-সম্পাদক কিন্তু জানেন না তার সম্পাদিত পত্রিকায় কী প্রকাশিত হচ্ছে। তার শুধু প্রয়োজন ‘সম্পাদক’ লেখা বিজনেস কার্ডটি। এই ডাক্তার-সম্পাদকের গল্পটি বললাম একারণে যে, কষ্ট করে কাঠ-খড় পুড়িয়ে যারা পত্রিকা সম্পাদনা করছেন, তারা যেন এ ব্যাপারটির কোনও সুরাহা করতে পারেন।

লেখক: গল্পকার।

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
প্রচণ্ড গরমে দই-ফলের এই ডেজার্ট বানিয়ে খান
প্রচণ্ড গরমে দই-ফলের এই ডেজার্ট বানিয়ে খান
গরুবোঝাই ভটভটির সঙ্গে মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে নিহত ২
গরুবোঝাই ভটভটির সঙ্গে মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে নিহত ২
ইউক্রেনকে ৫৫০ কোটি ডলারের সহায়তা দেবে সুইজারল্যান্ড
ইউক্রেনকে ৫৫০ কোটি ডলারের সহায়তা দেবে সুইজারল্যান্ড
সবজির বাজার ঊর্ধ্বমুখী, তীব্র গরমকে দুষছেন বিক্রেতারা
সবজির বাজার ঊর্ধ্বমুখী, তীব্র গরমকে দুষছেন বিক্রেতারা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ