X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘একুশ মানে মাথা নত না করা’

লীনা পারভীন
২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৪:০১আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৪:০৮

লীনা পারভীন শিরোনামের কথাটির একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে।  এই একটি স্লোগানের মর্ম যদি আমরা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারি তাহলে জাতি হিসাবে আমরা কেমন, তার একটি সুস্পষ্ট ধারণা সহজেই করা যায়।
বর্তমান সময়ে যখন ক্রমশ পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে মোকাবিলা ও মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি তখন ভাষাটা অনেকের কাছেই হয়ে যাচ্ছে কেবলমাত্র লিখে বা বলে মনের ভাব প্রকাশের একটি মাধ্যম।  ভাষার ব্যাকরণগত অর্থ কিন্তু তাই।  কিন্তু আমরা যদি বলি বাংলা ভাষা আমাদের মাতৃভাষা তাহলে এর সঙ্গে চলে আসে- কেমন করে আজকে বাংলা আমাদের মাতৃভাষা হয়ে উঠলো এবং আমাদের এই বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে কেমন করে এই ভাষা ভূমিকা রেখেছে এসব প্রশ্ন এবং উত্তরের বিষয়।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে পেতে কিন্তু আমাদের দাবি করতে হয়েছে, লড়াই করতে হয়েছে, রক্ত দিতে হয়েছে। জনসংখ্যার বিচারে কেউ আমাকে এটা উপহার হিসাবে দেয়নি। 

১৯৪৮ সালে যখন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে উত্থাপন করেছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা হিসাবে বাংলাকে করা হোক রাষ্ট্রভাষা, তখন কি তার এই দাবিকে সাধুবাদ জানানো হয়েছিলো? তা কিন্তু হয়নি বরং তিনি কেবল পাকিস্তানি নয় নিজ অঞ্চলের নেতাদের কাছ থেকেও বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন।  তিনি ঠিক অনুধাবন করেছিলেন যে ভাষাকে যদি জয় করা যায় তাহলে এ অঞ্চলের স্বাধীকার আন্দোলন অনেকখানি এগিয়ে যাবে।  ৭ কোটি জনগণের মধ্যে তখন ৪ কোটি লোক বাংলায় কথা বলতো।  কিন্তু তারপরও পাকিস্তানি সরকার বাংলাকে স্বীকৃতি দিতে চায়নি। কেন চায়নি? এই প্রশ্নের জবাবের ভেতরেও কিন্তু রয়েছে একটি বিরাট রাজনৈতিক অবস্থান।

তার মানে বাংলা ভাষা তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য ছিল একটি বিরাট মাইলফলক। একটি রাষ্ট্রের বা জাতিসত্তার নিজস্ব পরিচয় স্থাপনের জন্য নিজস্ব একটি ভাষা থাকা হচ্ছে একটি স্তম্ভ। 

এ কথাটি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বুঝেছিলেন আর বুঝেছিলো কিছু মুক্তিপাগল ছাত্র।  মুক্তির নেশায় জেগে ওঠা একদল তরুণ কিন্তু ঠিক বুঝেছিলো যে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে যাওয়া সেই সময়কার পশ্চিম পাকিস্তানি শাসন ও শোষণের হাত থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের নিজস্বতাকে আগে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
যার ফলশ্রুতিতেই কার্জন হলে জিন্নাহ সাহেবকে প্রত্যাখ্যান।  উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা সেই ঘোষণাকে যখন ছাত্র জনতা না না বলে উড়িয়ে দিয়েছিলো সে দিনটি ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর জন্য নিদ্রা তাড়ানোর মতো একটি দিন। 

পাকিস্তানিরা বুঝেছিলো যে পূর্ব পাকিস্তানে গড়ে উঠছে তাদের সর্বনাশের সবরকম আয়োজন। এদেরকে নরম ভাষায় দমন করা যাবে না।  বেছে নিয়েছিলো দমনের রাজনীতি।
৫২ সালের একুশ তারিখ সেই দমনের এক নিষ্ঠুর সাক্ষী হয়ে রইলো।  প্রাণ দিলো আমাদের সূর্য সন্তানেরা। বিনিময়ে আমরা পেলাম আমাদের মুখের ভাষা। 

তাই আমার কাছে বাংলা ভাষা মানে কেবল কিছু বর্ণমালা নয়।  আমার কাছে বাংলা মানে সালাম, রফিক, জব্বারের রক্তের নাম।

এই ৫২' ই আমাদেরকে শক্তি দিয়েছিলো।  আমাদের মধ্যে একধরনের আত্মবিশ্বাস জন্ম দিয়েছিলো যে আমরা পাবো একটি স্বাধীন, স্বার্বভৌম রাষ্ট্র।  কেবল ভৌগলিক অর্থে নয়। তার সঙ্গে পাবো আমরা আমাদের একটি নিজস্ব পরিচয়, পাবো এমন একটি রাষ্ট্র যা হবে আমার আত্মপরিচয়, যেখানে থাকবে সকল ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সবার সমানভাবে বেঁচে থাকার অধিকার।  যে রাষ্ট্র আমাকে আমার ধর্ম দিয়ে, আমার লিঙ্গ দিয়ে বিবেচনা করবে না। সেখানে সবাই বাঁচবে একটি পরিচয়ে সে হচ্ছে আমরা সবাই বাঙালি বাংলাদেশ আমাদের দেশ।

তাই একুশ মানে আমার কাছে বাংলাদেশ।  একুশ আমাকে শিখিয়েছে কেমন করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়।  একুশ আমাকে শিখিয়েছে কেমন করে নিজের মর্যাদা সবার সামনে স্থাপন করতে হয়।

একুশ আমাকে শিখিয়েছে কেমন করে সকল ষড়যন্ত্রকে যুক্তি দিয়ে মোকাবিলা করতে হয়।  একুশ মানে আমি বুঝি একটি চেতনার নাম।  একুশ মানে আমার কাছে বোধ ও বুদ্ধি দিয়ে চলার নাম।

কিন্তু আফসোসের কথা হচ্ছে বর্তমান সময়ে আমরা সেই চেতনাকে হারাতে বসেছি।  পৃথিবীর আর কোনও জাতি রক্ত দিয়ে নিজের ভাষা পেয়েছে কিনা আমার জানা নেই।  তাই বাংলা ভাষা আজকে যেভাবে আক্রান্ত হচ্ছে তার একটাই কারণ আর তা হচ্ছে বোধের ঘাটতি, চেতনার ঘাটতি, উপলব্ধির ঘাটতি।

আমরা আজকাল বাংলা শিখাকে সেকেন্ডারি করে ফেলেছি।  দুই লাইন সঠিক বাংলা লেখার চেয়ে দুই লাইন বেঠিক ইংরেজি লিখতে পারাকে দক্ষতা মনে করি।

ইংরেজিতে কথা বলা বা ভাব প্রকাশকে আমরা একধরনের স্ট্যাটাস হিসাবে বিবেচনা করি। দশজনের মধ্যে যদি দু বা তিনজন একটু ফটফটানি ইংরেজি বলতে পারে তাদেরকে আমরা একটু অন্য চোখেই দেখি। অন্য ভাষা শেখার মধ্যে অন্যায় কিছু নাই কিন্তু সেটা কেন নিজের ভাষাকে ছোট করে? নিজের ভাষার বুনিয়াদ দুর্বল করে আর যাই হোক জ্ঞানী হওয়া যায় না।

আমাদের শিক্ষা মাধ্যম আজকে বহু ধারায় বিভক্ত।  ইংরেজি মাধ্যমে শিখছে ভিনদেশি ভাষায় রচিত ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি।  আরেকধারায় শিখছে আরবিতে আরেক ধারায় শিখছে বাংলায় তাও ভুলে ভরা সব পাঠ্যসূচি। বাংলা নিয়ে নেই কোনও গবেষণা, নেই কোনও প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম। হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও বাংলাকে প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা করায় নেই কোনও কার্যকর উদ্যোগ।  শিক্ষাসহ প্রতিটা ক্ষেত্রে চলছে অপরিকল্পিতভাবে।  রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকগণ কী চায় সেটাও আমাদের কাছে অপরিষ্কার। 

এতসব অরাজকতার মাঝে আমরা হারাতে বসেছি আমাদের আসল চেতনার জায়গাটি।  ভাষাকে আমরা যদি সংকীর্ণ করে বুঝতে চাই তাহলে আমরা হারিয়ে ফেলবো আমাদের রাষ্ট্রের জন্মের পেছনে কোন চেতনা বা ভাষার কী ভূমিকা ছিলো সেই ঐতিহাসিক পর্বটি।

তাই আমাদেরকে ভাবতে হবে, ধারণ করতে হবে একুশের চেতনাকে।  আপোস করে কখনও কিছু প্রতিষ্ঠা হয় না, নীতি বিসর্জন দিয়ে কিছু অর্জন করা যায় না; এ কথাটি আমাদের রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে আমাদেরকে বুঝতে হবে।

চারদিকে আজ সংকীর্ণতার জয়গান। দেশ নিয়ে ভাবার মতো লোকের সংখ্যা ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে।  প্রতিবাদের কণ্ঠ আজকে রুদ্ধ। একটি গোষ্ঠী সরকারের ভোটের রাজনীতির প্রতি দুর্বলতার সুযোগে ঢুকে পড়ছে আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে।  খুব পরিকল্পিতভাবে পরিবর্তন করে ফেলছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে, আঘাত হানছে আমাদের উন্মুক্ত সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে।

চারদিকের এই দম বন্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে আমাদেরকে একুশ মানে মাথা নত না করা এই উপলব্ধিকে ধারণ করার কোনও বিকল্প নাই।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কোনও রান না দিয়ে ৭ উইকেট, টি-টোয়েন্টিতে ইন্দোনেশিয়ার বোলারের বিশ্ব রেকর্ড
কোনও রান না দিয়ে ৭ উইকেট, টি-টোয়েন্টিতে ইন্দোনেশিয়ার বোলারের বিশ্ব রেকর্ড
রাজধানীতে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় স্কুল শিক্ষার্থীসহ নিহত ২
রাজধানীতে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় স্কুল শিক্ষার্থীসহ নিহত ২
ঢামেক হাসপাতালে কারাবন্দীর মৃত্যু
ঢামেক হাসপাতালে কারাবন্দীর মৃত্যু
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ