X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভারতের সঙ্গে সামরিক চুক্তি প্রসঙ্গে

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
০৯ মার্চ ২০১৭, ১৬:৩৬আপডেট : ১০ মার্চ ২০১৭, ১৭:৩২

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর দুই-দুইবার পিছিয়েছে। তৃতীয় দফায় স্থির হয়েছে, তিনি এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ভারত সফরে যাবেন। গত দুই মাস ধরে প্রধানমন্ত্রীর এই সফর নিয়ে অনেক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সব সংবাদেই দেখেছি, সামরিক বা নিরাপত্তা চুক্তি নিয়ে একটি এজেন্ডা ঘুরে-ফিরে আসছে। কিন্তু এর কোনও বিস্তারিত তথ্য ছিল না। তবু এই এজেন্ডাকে ভারতের সামরিক চুক্তির অভিলাষ মনে করে দু’টি পত্রিকায় দু’টি কলাম লিখেছিলাম।
গত বৃহস্পতিবার (২ মার্চ) চীনের জাতীয় দৈনিক সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট এবং পরে বাংলাদেশের কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা এ সম্পর্কে বিস্তারিত প্রতিবেদন ছাপিয়েছে। এসব প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত সামরিক চুক্তি করতে উঠেপড়ে লেগেছে। তারা দীর্ঘমেয়াদি একটি সামরিক চুক্তি বাংলাদেশের সঙ্গে করার প্রস্তাব দিয়েছে। তবে, বাংলাদেশ এমন কোনও চুক্তি করতে অনাগ্রহ প্রকাশ করছে বলে প্রতিবেদনগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে। এর সঙ্গে হুমকি মোকাবিলায় যৌথ অভিযানের কথাও বলা হয়েছে। আবার সামরিক খাতে অস্ত্র কেনার জন্য ৫০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার আগ্রহের কথাও বলা হয়েছে। এই ঋণের টাকায় অবশ্য অস্ত্র কিনতে হবে ভারত থেকে। এমন প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ নাকি বলেছে, ভারত নিজে বিদেশ থেকে অস্ত্র কেনে। সে অস্ত্র আবার আমাদের কাজে বিক্রি করবে কেন? অস্ত্র কেনার ব্যাপারেও নাকি বাংলাদেশ কোনও আগ্রহ দেখায়নি।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবার ভারত সফরের সময় তারকা হোটেলে থাকবেন না। সফরের সময় প্রধানমন্ত্রীকে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভারত যেসব সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানকে সর্বোচ্চ সম্মান দেখায়, শুধু তাদেরই রাষ্ট্রপতি ভবনে রাখার ব্যবস্থা করে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে এমন সম্মান দেখানোর কথা জানায় বাংলাদেশের মানুষ ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুবই ভালো। সম্ভবত প্রণব মুখার্জিকে দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে প্রভাবিত করার জন্যই তাকে রাষ্ট্রপতি ভবনে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী কোনও সামরিক চুক্তি করলে দেশে কী অসুবিধা তাকে মোকাবিলা করতে হবে, তাও খোলামনে বলতে পারবেন। এরূপ একটি সুবিধা রাষ্ট্রপতি ভবনে থাকার ফলে ভোগ করতে পারবেন প্রধানমন্ত্রী। 

আমরা ইউরোপে বহু যুদ্ধ-বিগ্রহ হতে দেখেছি। একবার তো প্রায় ত্রিশ বছর ধরে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যুদ্ধ চলেছে। আবার প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনাও ইউরোপ থেকে। ইউরোপে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে সামরিক চুক্তি হতো। এখন কার সঙ্গে কার যুদ্ধ হবে যে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত সামরিক চুক্তি করতে চাচ্ছে? বাংলাদেশ সংলগ্ন রাষ্ট্র হচ্ছে ভারত, চীন, মিয়ানমার। বাংলাদেশের সঙ্গে সবার সম্পর্ক খুবই ভালো। কিন্তু ভারতের সঙ্গে তার প্রতিবেশী পাকিস্তান, চীন, নেপাল, শ্রীলঙ্কা— কারও সঙ্গেই সম্পর্ক ভালো নয়। নিকট ভবিষ্যতে ভারত যদি নেপালের বিরুদ্ধে কোনও অভিযান চালায় বা চীনের বিরুদ্ধে কোনও অভিযান চালায়, তাতে বাংলাদেশ কোনোভাবেই অংশ নিতে পারবে না। কারণ উভয় দেশ বাংলাদেশের বন্ধুদেশ। বরং বাংলাদেশ যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য উভয় দেশের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে পারে।

১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধ হয়েছিল। এ যুদ্ধে চীন এত দ্রুত অগ্রসর হয়েছিল যে, তারা দিব্রুগড় পর্যন্ত দখল করে ফেলেছিল এবং কাশ্মীরের লাদাখণ্ডও দখল করেছিল। তখন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শ্রীমাভো বন্দরনায়েক। তিনি যুদ্ধের সকালে পিকিংয়ে চীনের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বললে রাতে দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন। বন্দরনায়েকের দূতিয়ালি যে ব্যর্থ হয়েছিল তা নয়। ভারতের সঙ্গে কোনও বৈঠক ছাড়াই চীন ম্যাকমোহন লাইনের অন্য পাশে গিয়ে, অর্থাৎ সীমান্তে গিয়ে অবস্থান নিয়েছিল। তারা ভারতের অধিকৃত জায়গা ছেড়ে দিয়েছিল, শুধু লাদাখের অবস্থান ছাড়েনি। এখনও লাদাখের প্রায় অর্ধেক এলাকা চীনের দখলে রয়েছে।

চীন তখন জাতিসংঘের সদস্য ছিল না। সুতরাং চীন জাতিসংঘের কথা শুনতেও বাধ্য ছিল না। এখন চীন, ভারত, পাকিস্তান সবারই আণবিক অস্ত্র রয়েছে, ব্যালাস্টিক মিসাইল রয়েছে। এমন শক্তিশালী অস্ত্রসম্পন্ন রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সঙ্গ দিতে গেলে বাংলাদেশের অস্তিত্বই বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ছোট এলাকায় ১৬ কোটি মানুষের বাস। দুই-চারটা মিসাইল এসে পড়লে লাখ-লাখ মানুষ মারা যাবে। সুতরাং বাংলাদেশের পক্ষে মহাত্মা গান্ধীর ‘না গ্রহণ না বর্জন’ অবস্থানে থাকাই উত্তম হবে। সর্বোপরি বাংলাদেশ গরিব দেশ, ভারত চীন— সবাই আর্থিক সঙ্গতিসম্পন্ন দেশ। সবারই সাহায্যের প্রয়োজন রয়েছে বাংলাদেশের। না হয় একক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের পক্ষে ১৬ কোটি মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করা কখনও সম্ভব হবে না।

আমেরিকা আটলান্টিক থেকে তার অবস্থান পরিবর্তন করে প্রশান্ত মহাসগরে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার নৌশক্তির ৬০ শতাংশ প্রশান্ত মহাসাগরে নিয়ে এসেছে। ২৮০টি রণতরী, ১০টি বিমানবাহী জাহাজ নিয়ে আমেরিকা বিশ্বের বৃহত্তম নৌবাহিনী। চীন শঙ্কিত হয়ে আমেরিকার মতো বৃহৎ নৌবাহিনী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।  দ্রুত নৌ-শক্তি সম্প্রসারণের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। আমেরিকার সঙ্গে সামরিক চুক্তি করে ভারত তার নৌ ও বিমানঘাঁটি আমেরিকাকে ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে। বাংলাদেশকেও সামরিক চুক্তি করার প্রস্তাব দিয়েছে আমেরিকা। বাংলাদেশ আমেরিকার সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করেনি। চীনের সঙ্গেও বাংলাদেশের কোনও সামরিক চুক্তি নেই। এখন বাংলাদেশের পক্ষে আমেরিকা, চীন, ভারত— কারও সঙ্গেই কোনও সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া সম্ভব নয়।

এখন বিশ্বে ভারত প্রথম অস্ত্র ক্রয়কারী দেশ। অর্থবিত্তের কারণে তার পক্ষে তা করা সম্ভব এবং এ উদ্যোগও যৌক্তিক। কারণ চীন আর পাকিস্তানের সঙ্গে তার বৈরিতা রয়েছে। চীন বিশাল আর্থিক ও সামরিক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। চীনের কাছে বিশ্বের বৃহৎ সেনাবাহিনী রয়েছে। ১৯৫৩ সালে চীন আর আমেরিকার মধ্যে স্থল যুদ্ধ হয়েছিল। জেনারেল ম্যাকার্থে বাহিনী চীনের হাতে পরাজিত হয়েছিল। আবার ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধ হয়েছে। চীন-ভারতের উত্তর সীমান্তের জেনারেল কাউলকে পরাজিত করে ধরে নিয়ে গিয়েছিল।

চীন সীমান্ত বাংলাদেশ থেকে ৬০ মাইল দূরে। সুতরাং বাংলাদেশের মতো ছোট দেশ ছোট সমরসজ্জা নিয়ে কোন সাহসে ভারত আর মার্কিন সামরিক জোটে যোগদান করবে? নেপোলিয়ন বলেছিলেন, চীন এশিয়ার ঘুমন্ত বাঘ। সে যখন জেগে উঠবে, তখন দুনিয়াকে নাড়া দেবে। এখন চীন জেগে উঠেছে। সুতরাং আশপাশে বাংলাদেশের মতো ছোটখাটো দেশগুলোর সতর্ক হওয়া উচিত। অন্যাথায় এসব দেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। ভারতের পক্ষে, আমেরিকার পক্ষে চীনের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া সম্ভব; বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নিরাপদ দূরত্বে থাকা।

সুতরাং বাংলাদেশের পক্ষে কোনোভাবেই কারও সঙ্গে সামরিক চুক্তি সম্পাদন করা উচিত হবে না। ভারতের পক্ষে থেকে তাই এমন কোনও প্রস্তাব এলে প্রধানমন্ত্রীর বিনীতভাবে ‘না’ বলাটাই উত্তম হবে। হয়তো ভারত এতে মনক্ষুণ্ন হতে পারে। এর আগে নেপালের সঙ্গে যেমন করেছিল, তেমস অসংলগ্ন আচরণ বাংলাদেশের সঙ্গেও করতে পারে। কিন্তু সেটাও ভালো। আমেরিকার ৯০ মাইল দূরে অবস্থিত কিউবা এখনও শক্তিশালী বৈরিতার মুখেও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়ে টিকে আছে।

ভারত এর মধ্যে ভিয়েতনাম, সিসিলি, মরিশাসের মতো দেশের সঙ্গে সামরিক চুক্তি করেছে। সিসিলি ও মরিশাসের কথা না বললেও ভিয়েতনামের কথা উল্লেখ করতেই হয়। কারণ ভিয়েতনাম বড় একটি দেশ। সিসিলি ও মরিশাসে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভারতীয়দের বসবাস রয়েছে। তারা তাদের নিরাপত্তা বিষয়ে তাদের আদি পৈতৃক ভূমির সরকারের সঙ্গে সামরিক চুক্তি করতে পারে।

ভিয়েতনাম করেছে ‘শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’— এ নীতির ভিত্তিতে। ভিয়েতনামের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক কোনোভাবেই ভালো নয়। সীমান্তে সংঘর্ষ লেগেই আছে। ভিয়েতনামের সঙ্গে কোনও কারণে চীনের যুদ্ধ হলে কোনও না কোনও শক্তিশালী রাষ্ট্রের সাহায্যের প্রয়োজন। সুতরাং ভারতের সঙ্গে  ভিয়েতনামের সামরিক চুক্তি করাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে এমন কোনও পরিস্থিতি কারও সঙ্গেই বিদ্যমান নয়। বরং বাংলাদেশ সামরিক চুক্তি করলেই বৈরিতার সম্মুখীন হবে। বাংলাদেশের মানুষ কোনও সামরিক চুক্তির পক্ষে নয়। ভারতের সঙ্গে কোনও সামরিক চুক্তি করলেই শেখ হাসিনার সরকার ব্যাপক জনরোষের মুখে পড়বে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঘোড়াঘাটে মালবোঝাই দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত
ঘোড়াঘাটে মালবোঝাই দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত
নির্বাচনের সময় জাপায় কী হয়েছিল, জানাবেন জিএম কাদের
শনিবার জাতীয় পার্টির বর্ধিত সভানির্বাচনের সময় জাপায় কী হয়েছিল, জানাবেন জিএম কাদের
১০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগে অগ্রণী ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা আটক
১০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগে অগ্রণী ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা আটক
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ