X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর কি সত্যিই ব্যর্থ?

চিররঞ্জন সরকার
১১ এপ্রিল ২০১৭, ১৪:৪০আপডেট : ১১ এপ্রিল ২০১৭, ১৪:৪২

চিররঞ্জন সরকার বাংলাদেশের মানুষের একটা বড় অংশ মনে করে, ভারত আমাদের এক নম্বর শত্রু। ওরা সব কিছুতে আমাদের ঠকায়। বাণিজ্য করতে দেয় না। আমরা তাদের সিনেমা-টিভি-চ্যানেল দেখলেও ওরা আমাদেরগুলো দেখে না। আমরা ওদের বই পড়লেও ওরা আমাদেরগুলো পড়ে না। নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা দেয় না। সীমান্তে আমাদের মানুষদের নির্মমভাবে হত্যা করে। সব কিছুতে ভারতের একটা স্পষ্ট ‘দাদাগিরি’ আছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কোনওসরকার প্রধান যখন ভারত সফর করেন, তখন সবাই আশা করে এইবার ‘একটা কিছু’ হবে। এই বার পানি আসবে, সাহায্য আসবে, সহযোগিতা আসবে। ‘দাদাগিরি’ বন্ধ হবে। আরও অনেক কিছু হবে।
এই ‘আশাবাদের’ পেছনে রাজনীতিও কাজ করে। আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন এই দলের নেতারা এমন একটা ভাব দেখায় যেন, তারা ইচ্ছে করলেই ‘দিল্লি’র সবগুলো ‘লাড্ডু’ আনতে পারবে। অন্য কারও পক্ষে কিছু আনা সম্ভব নয়, তাদের পক্ষেই সম্ভব! পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনীতিবিদরা তো আওয়ামী লীগকে সব সময় ভারতের ‘তাঁবেদার’ বা ‘দালাল’ হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়। ভারতের সঙ্গে যে কোনওযৌক্তিক চুক্তি বা সমঝোতাকেই ‘দেশের স্বার্থ বিরোধী’ বা ‘দেশ বিক্রির ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দেখেন। এবারও বিএনপির নেতানেত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ভারতের কাছে ‘দেশ বিক্রি’র অভিযোগ এনেছেন। এই অভিযোগ তারা অতীতেও বহুবার এনেছেন! একটাই দেশ (বাংলাদেশ), একটাই ‘বিক্রেতা’ (আওয়ামী লীগ) একই ‘ক্রেতা’ (ভারত)-র কাছে কতবার বিক্রি করতে পারে সে প্রশ্ন কেউ তাদের করে না। তারা নিজেরাও এটা উপলব্ধি করে না!
আসলে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কটা বাহ্যত ‘মধুর’ হলেও ভেতরে ভেতরে অনেকটাই অবিশ্বাসের। এ জন্য দুদেশের রাজনীতিবিদরাই মূলত দায়ী। রাজনীতিবিদরা প্রতিবেশী দুদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পারেননি। বাংলাদেশে বরং ভারত-বিরোধী রাজনীতিকে সব সময়ই পরিচর্যা করা হয়েছে। দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাস্তবতাকে কখনওই বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। যে কোনওসম্পর্ক তৈরি হয় শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-সহমর্মিতা ও সহযোগিতার ওপর। দেবে আর নেবে মেলাবে মিলিবে। সকলের তরে সকলে আমরা। কেউ কারও স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে অন্যকে সাহায্য করবে না। কিন্তু নিজের স্বার্থের জন্য অন্যকে পথেও বসাবে না। কিছু ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। কিছু পেতে হলে কিছু দিতেও হবে। এই খানে উভয় দেশের নেতৃত্ব চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
একথা ঠিক যে আওয়ামী লীগের শাসনামলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কন্নোয়নের আন্তরিক কূটনৈতিক উদ্যোগ লক্ষ করা গেছে। কোনওকোনওক্ষেত্রে সাহায্য-সহযোগিতার পরিবেশও উন্নত হয়েছে। কিন্তু ধারাবাহিক চেষ্টা, অধ্যাবসায় আর পরিচর্যার মাধ্যমে সেই সম্পর্ককে একটা ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ারব্যাপারে আন্তরিক উদ্যোগের অভাব সব সময়ই অনুভূত হয়েছে। তাতে বন্ধুত্বের বদলে সন্দেহ-অবিশ্বাস আর বৈরিতাই বেড়েছে। আর এ ক্ষেত্রে ভারতীয় নেতৃত্ব কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করেননি। বাংলাদেশের স্বার্থকে সব সময়ই কোনওনা কোনওকারণ দেখিয়ে উপেক্ষা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরও তাই বিশেষজ্ঞদের কাছে ‘সফল’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে না। অথচ ভারতীয় পত্রপত্রিকাই আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে ‘ভারতের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য বন্ধু’ হিসেবে অভিহিত করেছে। সাত বছর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গিয়ে বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে বড় আবেগ ও স্পর্শকাতর বিষয় তিস্তার জলবণ্টন চুক্তি সই নিয়ে কোনও আশার আলো দেখাতে পারলেন না। কারণ? আপাত দৃষ্টিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের বেঁকে বসা! কিন্তু অনেকের মতে, পেছনের কারণ- ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উদ্যোগহীনতা!

তিস্তা নিয়ে মমতার বক্তব্য— সিকিমে অসংখ্য জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ও ৮টি বড় বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। সিকিম এ ভাবে অপরিকল্পিত ভাবে যথেচ্ছ বাঁধ দেওয়ায়, শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় জল থাকছে না। আবার বর্ষায় বাঁধ বাঁচাতে সিকিম জল ছাড়লে ভেসে যাচ্ছে উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা। সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী পবন চামলিঙের কাছে এ নিয়ে অভিযোগ করেছিলেন মমতা। প্রধানমন্ত্রী, সুষমা, রাজনাথকেও বিষয়টি জানিয়েছিলেন। রাজ্য সরকারের অভিযোগ, ঢাকার সেই সফরের পরে এক বছরের বেশি কেটে গেলেও সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে এক সঙ্গে বসিয়ে তিস্তা নিয়ে কোনও বৈঠক করেনি কেন্দ্র। সিকিমকেও এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়নি। দ্বিতীয়ত, শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় জল সঙ্কটের জন্য উত্তরবঙ্গে জলের সমস্যা যাতে না হয়, সে জন্য ছোট ছোট জলাধার গড়ার কথা বলা হয়েছিল। মমতা নিযুক্ত নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রের কমিটিই এই প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু এখনও কেন্দ্র এ নিয়ে উদ্যোগী হয়নি। উত্তরবঙ্গে বিকল্প জল প্রকল্পের জন্য বিশেষ আর্থিক প্যাকেজও বরাদ্দ হয়নি। তাই তিনি তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে ‘রাজ্যের স্বার্থের’ বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে ‘অপরাগতা’ জানিয়েছেন।

তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেছেন, ‘আপনার তো জল দরকার। তোর্সা ও আরও যে দু’টি নদী উত্তরবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে গিয়েছে, তার জলের ভাগ ঠিক করতে দু’দেশ কমিটি গড়ুক। শুকনো তিস্তার জল দেওয়াটা সত্যিই সমস্যার।’তিস্তার জল দিতে না-পারার বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যাতে ভুল না-বোঝেন, সে জন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ পাঠানোর প্রস্তাবও দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি জানিয়েছেন, ১০০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ বাংলাদেশকে দিতে পারে পশ্চিমবঙ্গ।

ভারতীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ‘একথা বলে মমতা তিস্তা প্রসঙ্গে একটি কুশলী মোচড় দিয়েছেন!’ তবে তোর্সার জলবণ্টন নিয়ে মমতার প্রস্তাব ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন। কারণ বাংলাদেশ চায় তিস্তার ব্যাপারে ভারতের ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। তিস্তার কোনও সুরাহা না হলেও, ‘শিগগিরইসমাধান সূত্র মিলবে’ বলে আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

উল্লেখ্য, দীর্ঘ আলোচনার শেষে তিস্তা চুক্তি সই হওয়ার কথা ছিল ২০১১-র সেপ্টেম্বরে, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময়। সব ঠিক থাকলেও, মমতা ব্যানার্জির আপত্তিতে শেষ মুহূর্তে আটকে যায় সেই চুক্তি সই। মমতা ব্যানার্জি ২০১৫-তে ঢাকা এসে ‘আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখুন’ বলে বাংলাদেশের মানুষকে আশ্বস্ত করলেও, এখনও সেই অবস্থানে অনড়। যদিও মোদিবলেছেন, মমতা ব্যানার্জির সম্মতি নিয়েই হবে তিস্তা চুক্তি। কিন্তু সত্যি কি হবে? এ ব্যাপারে মোদির সামনে এখন তিনটি পথ খোলা। মনমোহনের মতো তিস্তা চুক্তি রূপায়ণে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকেবোঝানো। মমতার প্রস্তাব মেনে অন্য নদীর জল বণ্টনের প্রস্তাব নিয়ে এগুনো। অথবা মমতার আপত্তি অগ্রাহ্য করেই তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নের পথে যাওয়া। শেষের পথটি ধরলে মোদির বিরুদ্ধে সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ভাঙার অভিযোগ উঠবে। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি বিপাকে পড়বে। বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব জোরদার করতে মোদিকি পারবেন ‘কঠিন’ কোনওসিদ্ধান্ত নিতে? এ জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

চার-দিনের ভারত সফর শেষে সোমবার দেশে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী। এই সফরকালে প্রতিরক্ষা থেকে বেসামরিক পরমাণু ক্ষেত্র— দু’দেশের মধ্যে অন্তত ২২টি চুক্তি সই হয়েছে। শেখ হাসিনার সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পরে মোদিবাংলাদেশের জন্য সহজ শর্তে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। সেইসঙ্গেই জানিয়েছেন, দেওয়া হবে ৫০ কোটি ডলারের ঋণ, সামরিক সরঞ্জাম কেনার জন্য। পাশাপাশি, মৈত্রী এক্সপ্রেসের পর দুই প্রধানমন্ত্রী চালু করেছেন কলকাতা ও খুলনার মধ্যে একটি ট্রেন ও বাস সেবা। এই সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্কের ভিত আরও মজবুত হয়েছে সন্দেহ নেই। এখন দরকার যথাযথ পরিচর্যার মাধ্যমে এই সম্পর্ককে তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নের পথে নিয়ে যেতে ধারাবাহিক উদ্যোগ অব্যাহত রাখা।

মনে রাখতে হবে, তিস্তা বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু। কিন্তু এর বাইরেও বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকূল অনেকগুলো অর্জন রয়েছে। একটিকে খুব বড় করে দেখে অন্য সব অর্জনকে তুচ্ছ করে দেখার অবকাশ নেই। আর ভারতের মতো বৃহৎ প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ধারাবাহিক আলাপ-আলোচনা, বন্ধুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক উদ্যোগের মাধ্যমেই অমীমাংসিত সমস্যার সমাধানে পৌঁছতে হবে। ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা করে, ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে আখেরে আমাদের জন্য কোনওলাভ হবে না।

লেখক: কলামিস্ট

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ