ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট অধিবেশনকে কেন্দ্র করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। হ্যাঁ, ভুল পড়েননি, শিক্ষার্থী- শিক্ষক সংঘর্ষ। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয়েছেন, শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের আঙুল ভেঙে দিয়েছেন। আঙুল ভেঙে ‘মজা’ও পেয়েছেন। কারণ তাদের ন্যায্য দাবির প্রেক্ষিতে ঘাড়ে ধাক্কা দেওয়ার প্রতিশোধ আকারেই আঙুল ভাঙার কথা ভাবছেন তারা। শিক্ষকদের এই অঙুলি নির্দেশ নিয়ে লেখার পরের অংশে কথা বলবো।
ঘটনাটি যেদিন ঘটলো সেদিন কল্পনায় এই দৃশ্য দেখতে বলেছিলাম শিক্ষকতা শেষ করে সদ্য অবসরে যাওয়া আমার মা-কে। ঘটনাটি যখন সংবাদ আকারে নিউজরুমে পেলাম তখন থেকে খোঁচাচ্ছিল, শিক্ষার্থীরা লাঞ্ছিত করতে গেলো শিক্ষককে? কিভাবে সম্ভব? রাতে ফিরে মাকে বললাম, কল্পনা করো, একজন শিক্ষক গলা ধাক্কা দিয়ে তোমার শিক্ষার্থী সন্তানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইছে। আর তোমার সন্তান সেই শিক্ষকের আঙুল ভেঙে দিয়ে এলো। সদ্য শিক্ষকতা থেকে বিদায় নেওয়া আমার মা বললেন, এরা শিক্ষকও না, এরা শিক্ষার্থীও না। সব বদলে গেছে। যদি প্রকৃত শিক্ষকই হতেন তবে এমন ঘটনা আজ আমাকে কল্পনা করতে হতো না।
একজন ছোটবেলা থেকে পড়ালেখা করছে, পাস করছে, কেউ কেবল পড়া শেষে চাকরি করবে বলে পড়ে যাচ্ছে, কেউ একটু বেশি জানতে চায় বলে হয়তো পড়ছে এবং পাস দিচ্ছে। তারা সকলেই শিক্ষার্থী। কিন্তু শিক্ষক। এমনি হওয়া যায়? এমনি? না, শিক্ষক হয়ে ওঠার বিষয় আছে। একসময় যদি শিক্ষকদের মর্যাদা দিতে পারতো শিক্ষার্থীরা, এখন কেন পারছে না? এটি একপাক্ষিক নৈতিক স্খলন হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। ভাবার সময় এসেছে, নিয়োগপত্র কাউকে শিক্ষকের মর্যাদা দেয় না।
এখনই প্রশ্ন উঠবে তবে কী করতে হবে শিক্ষকদের! সেটি আরেকটু পরের আলাপ। শঙ্কার জায়গাগুলো একটু বিবেচনায় নেই আগে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের নানা ঘটনা আজকাল প্রায়ই শোনা যায়, দেখা যায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি দুই সহপাঠীর মরদেহ ক্যাম্পাসে নেওয়া ও জানাজা পড়তে না দেওয়াকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হওয়া সংঘর্ষের ঘটনায় ছাত্ররা যে আশ্রয় হিসেবে উপাচার্যের মুখাপেক্ষী হন। উপাচার্য তখন নিরাপত্তা বেষ্টনী টেনে শিক্ষার্থীদের থেকে দূরে সরে যান। একদিকে সহপাঠীর লাশ, আরেকদিকে টিয়ারসেলবিদ্ধ বন্ধু তারপরও প্রশাসনের কাছে থেকে নেই কোনও সদুত্তর। আপনি আশা করছেন সেই ছাত্রদের মাথা ঠাণ্ডা থাকবে, থাকা উচিত। কিন্তু সেসময় শিক্ষকরা কোন দায়িত্বটা পালন করেছেন? এই ছাত্ররা যখন ‘গালিগালাজ’ করেছে বলে অভিযোগ করছেন, তখন শিক্ষকরা পাল্টা পুলিশে না দিয়ে কেন বলতে পারেননি, ‘এটি শিক্ষার্থীসুলভ আচরণ না’। বলতে পারেননি কারণ, শিক্ষকসুলভ আচরণ তারাও করে দেখাতে পারেননি।
বন্ধু নির্ঝর মজুমদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের সামনের ঘটনার পর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, ‘কোন অজুহাতই শিক্ষকদের উপরে হাত তোলার জন্য যথেষ্ট না। কোন পরিস্থিতিতেই না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাস্তায় নেমে গাড়ি ভাংচুর করাটাও হয়ত বাস্তব পারস্পেকটিভ থেকে আন্দোলনের একটা অংশ হইতে পারে, পুলিশের দিকে ঢিল, বোতল, জুতা ছুঁড়ে মারার ব্যাপারটাও বৈধ বিবেচিত হতে পারে ছাত্র আন্দোলনে। কিন্তু শিক্ষকের শরীরে হাত দেয়াটা ক্ষমার অযোগ্য, খুনের সমতুল্য অপরাধ। যে বা যে সমস্ত ছাত্র সংগঠন এই ন্যক্কারজনক কাজটা ঘটালো, তারা তাদের নৈতিক বল চিরদিনের জন্যই হারালো। যে কোন দাবির বৈধতা বা ন্যায্যতা থাকলে, সেটি অর্জনের জন্য উল্টাপথে আন্দোলন করা লাগে না। শিক্ষক পিটানো লাগে না, বা উল্টাপাল্টা কাজ করা লাগে না। এই সমস্ত কাজ করলে যেটি হয়, সেটা হলো আন্দোলনের ন্যায্যতা বা বৈধতা নষ্ট করা।’
আমি হাজারো বার নির্ঝরের এই কামনা আকাঙ্ক্ষা পড়েছি গত দুইদিনে। শিক্ষকদের মারার কোনও বৈধতা আমিও দেই না। কিন্তু মূলেই আমার প্রশ্ন ‘তারা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, শিক্ষক হয়ে উঠতে পারেনি’। এখানেই বারবারই আটকে গেছি, শিক্ষকরা শিক্ষকের মর্যাদায় আছেন কি? দিনের পর দিন দলীয় নিয়োগ, নিয়োগের আগে পরে নানা সুবিধা পেতে গবেষণা পড়ালেখার বাইরে কেবলই ‘জ্বি স্যার’ বলে প্রশাসনের কাছে থাকা মানুষদের কেন শিক্ষক বলবেন, ছাত্ররা কি সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন না? নাকি শিক্ষার্থীদের সেসব খুঁজতে নেই। যে শিক্ষক নিজের ক্ষমতা চর্চার জন্য একটি ছাত্র সংগঠনের ছাত্রনেতাকে ‘সম্মান’ করে এবং তার শিক্ষার্থীরা সেটা দেখে সেই শিক্ষককে আসলে তারা সম্মান করবেন?
উত্তর হলো, শিক্ষক হওয়ার 'রাজনৈতিক ধান্দাবাজি'র প্রক্রিয়া যেদিন থেকে ছাত্রদের সামনে স্পষ্ট হয়ে গেছে। শিক্ষকরা যেদিন থেকে প্রশাসনের ও দলের লোক হয়েছেন সেদিন থেকে ছাত্ররাও শিক্ষার্থী না হয়ে ‘ক্যাডার’ মানসিকতার হতে শুরু করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে থাকেন সাধারণত সংশ্লিষ্ট বিভাগের ‘মেধাবী শিক্ষার্থীরা’। কিন্তু শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এর সাথে লাগে দলীয় পরিচয়, ভোট বাড়ানোর রাজনীতির কারণে লবিংকে গুরুত্ব দিয়েই নিয়োগে ব্যস্ত থাকে প্রশাসন। শিক্ষক হিসেবে তার ব্যক্তিগত পছন্দ, দলীয় আনুগত্য প্রাধান্য দেওয়ায় গত দুই দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ‘প্রায়োরিটির’ জায়গা বদলে গেছে। একদল শিক্ষক রাজনীতি করে কিছু সুবিধাভোগের মধ্য দিয়ে কাটাচ্ছেন, আরেকদল এসব রাজনীতিতে না থেকে কিছু সুশীল ছায়ায় কনসালটেন্সি আর ‘দায়িত্ব পালনের ক্লাস’ নিচ্ছেন, কিছু শিক্ষক চেষ্টা করছেন আলাদা কিছু করতে (এই সংখ্যা চোখে পড়ে কম)। এই শেষপক্ষকে চিনতে কষ্ট হয় বলেই শিক্ষার্থীরা আঙুল ভেঙে মজা নেন। এ আঙুল নির্দেশ করে: সাবধান না হলে মর্যাদার দাবি থাকবে না, শিক্ষক হয়ে ওঠার ধাপগুলোর ধরন বদলাতে হবে নিশ্চিতভাবেই। এখন আপনারা ভুল পথে।
লেখক: সাংবাদিক, বাংলা ট্রিবিউন