X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চীন-ভারতের উত্তেজনায় প্রতিবেশীদের উদ্বেগ

আনিস আলমগীর
২৯ আগস্ট ২০১৭, ১৫:৩৭আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০১৭, ১৪:১৮

আনিস আলমগীর বিশ্বের দুই বৃহৎ রাষ্ট্র চীন-ভারতের প্রতিবেশী বাংলাদেশ, নেপাল, মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কা। হিমালয় পর্বতের উত্তরে চীন আর দক্ষিণে ভারতের অবস্থান। শুধু জনসংখ্যায় নয়, উভয় রাষ্ট্র বৃহৎ অর্থনীতির দেশও। চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। আগামী দুই দশকের মধ্যে ভারত বিশ্বের তৃতীয় অর্থনীতির দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। এ দুই বড় দেশের মাঝে কোনও বিরোধ উপস্থিত হলে পার্শ্ববর্তী চার ছোট রাষ্ট্রের জন্য মহাসংকট তৈরি হবে। কারণ এই উভয় রাষ্ট্র তাদের সমর্থন-প্রত্যাশী হয়ে দাঁড়ায়।
১৯৬০ সাল থেকে সাড়ে পাঁচ দশকব্যাপী মিয়ানমার ছিল সামরিকজান্তা শাসিত দেশ। পুরো বিশ্ব থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। তখন কিন্তু মিয়ানমার সামরিক জান্তাকে তার সব বিষয়ে দেখাশোনা করেছে চীন। মিয়ানমার সামরিক সরকারও ছিল সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শে বিশ্বাসী। সুতরাং চীন তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। এখন মিয়ানমার বেসামরিক অং সান সু চির সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের কোনও হেরফের হয়নি। বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার পরও অং সান সু চি দুই বার চীন সফর করেছেন।
সু চির কথাবার্তায় মনে হয়, তার সরকারের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ভালো, সেটা সামরিকজান্তার চেয়েও মজবুত। আর সু চির সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বন্ধুত্বও হয়েছে বলে কূটনৈতিক মহল বিশ্বাস করছে। এতে ভারত উদ্বিগ্ন হয়েছে এবং সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমার সফরে যাচ্ছেন। মোদির সফর ব্যাপক কোনও পরিবর্তন আনতে পারবে বলে কূটনৈতিক মহল মনে করছে না। কারণ মিয়ানমারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে চীন ব্যাপকভাবে জড়িয়ে আছে।

চীন গত জুলাই মাসে শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর লিজ নিয়েছে। সেখানে চীন সাবমেরিন ঘাঁটি স্থাপন করবে। চীনের সব সাবমেরিন থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এই আগস্ট মাসে ভারত এই বন্দরের পাশে কলম্বোর সঙ্গে চুক্তি করে একটি বিমানবন্দর দেখাশোনার দায়িত্ব নিচ্ছে। এ বিমানবন্দরটির অবস্থান চীনের নৌ-বন্দরের কাছাকাছি।
চীন-ভারতের এমন প্রতিযোগিতা পার্শ্ববর্তী ছোট দেশগুলোকে সংকটজনক অবস্থায় ফেলেছে ও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। চীন কলম্বো থেকে হাম্বানটোটা বন্দরটি কিনে নিয়েছে ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে। আর ভারত বিমানবন্দরটি নিয়েছে উন্নয়ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। বলার অপেক্ষা রাখে না চীনের কাছে নৌ-বন্দরটি বিক্রি করায় কলম্বো বাধ্য হয়েছে বিমানবন্দরটি ভারতকে দিতে।
এখন নেপালের প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে রয়েছেন। দার্জিলিং থেকে নেপাল পর্যন্ত একটা সেতু তৈরির একটি চুক্তি হয়েছে। এ সেতুটি তৈরি হলে সম্ভবত নেপালের সঙ্গে বাণিজ্যে ব্যবহৃত পথটি ছোট হয়ে আসবে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে নেপালের বাণিজ্য সহজতর হবে। জল বিদ্যুৎ, পরিকাঠামো উন্নয়নে সাহায্যের প্রস্তাব করেছে ভারত। নেপালের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক খুবই ভালো। চীনের সঙ্গে নেপালের পরিকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে প্রচুর।
মোদির সরকার ও রাজীব গান্ধীর সরকার নেপালকে দুই দুইবার অবরোধ করেছিল। এ অবরোধের সময় নেপাল প্রচুর ভোগান্তিতে পড়েছিল। এই দুই অবরোধের কারণে নেপালের মানুষ ভারতের প্রতি বিদ্বেষী রয়েছে। চীন যেহেতু অবরোধের সময় নেপালকে সাহায্য করেছে, নেপালের মানুষ চীনের প্রতি কৃতজ্ঞ এবং ভারতের চেয়ে চীনের প্রতি তারা দুর্বল বেশি।
ভারত যখন অবরোধ স্থাপন করেছিল বাংলাদেশও নেপালকে তখন মানবিক সাহায্য করার চেষ্টা করেছিল। সৈয়দপুর বিমানবন্দর বাংলাদেশ নেপালকে অবাধে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিল। দীর্ঘ চার মাস বিমান ছাড়া অন্য কোনও পথে মালামাল আনা-নেওয়া করার উপায় ছিল না তাদের।
নেপাল হচ্ছে বিশ্বে একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র যার সঙ্গে ভারত আশানুরূপ সুন্দর সম্পর্ক রক্ষা করে চলতে পারেনি। নেপালের সঙ্গে চীনের কোনও সামরিক চুক্তি এখনও সম্পাদিত হয়নি। আবার ভারতের সঙ্গেও তার কোনও সামরিক চুক্তি নেই। আসলে চুক্তি না থাকলেও চীন ভারতের যে কোনও যুদ্ধে নেপাল হবে বাফার স্টেট। জার্মানি ও ফ্রান্সের মাঝে যখনই যুদ্ধ লেগেছে বেলজিয়াম হয়েছে বাফার স্টেট। এটা হয় ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে।
সিকিম ছিল একটা দেশীয় রাজ্য। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ভারত সিকিমকে তার অন্তর্ভুক্ত করেছে। সিকিম ও ভুটানের মাঝখানে একটা ৩০০ বর্গমাইল এলাকা রয়েছে যার নাম ডোকলাম গিরিপথ। এ গিরিপথটা চীন ও ভুটান উভয়ে দাবি করে। ডোকলাম গিরিপথের মধ্য দিয়ে চীন একটি সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে তাতে ভারত সৈন্য সমাবেশ করে চীনের নির্মাণ কাজে বাধা দিয়েছে। এ গিরিপথ ভারতের না হলেও ভারত ভুটানের দেশ রক্ষার দায়িত্বে আছে বলেই সেখানে তারা সৈন্য সমাবেশ করেছে।
ডোকলাম গিরিপথের শেষ প্রান্ত থেকে ভারতের শিলিগুড়ি করিডোর খুবই নিকটবর্তী। কোনও কারণে ডোকলাম গিরিপথ চীনের দখলে চলে গেলে শিলিগুড়ি করিডোরের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। শিলিগুড়ি করিডোর বন্ধ হয়ে গেলে ভারতের পূর্বাঞ্চলের ৭টি রাজ্য মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। সুতরাং ভারত সহজে ডোকলাম গিরিপথ নিয়ে চীনের সঙ্গে এ গিরিপথের অধিকার ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে কোনও সমঝোতা করতে পারে না। ভুটানকেও কোনও সমঝোতা করতে দেবে না। ভুটান সম্ভবত চীনের সঙ্গে এখনই একটা সমঝোতায় পৌঁছতে রাজি বলে মনে হয়।
সম্প্রতি ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল চীন সফর করেছেন সমাধানের সন্ধানে। কিন্তু চীন বলেছে, ভারত সৈন্য প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত কোনও আলোচনা হবে না। বরং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সেনা পোশাকে পিপলস্ রিপাবলিক আর্মিকে বলেছেন, ‘স্বল্পমেয়াদি আঞ্চলিক যুদ্ধের’ জন্য প্রস্তুত থাকতে। ভারতেও এখন উগ্র-জাতীয়তাবাদের উৎকর্ষ হয়েছে। কোনও পরিণতির কথা চিন্তা না করে অনেকে বলছেন, ‘চীনকে উচিত শিক্ষা দেওয়া দরকার’। সেটা তো সত্য কিন্তু তা কতটুকু সম্ভব?
১৯৪৯ সাল থেকে ভুটানের সঙ্গে ভারতের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এখন চীন চাচ্ছে ভুটানের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন করতে। এরই মাঝে চীনের মন্ত্রী এবং উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা ভুটানও সফর করেছেন। ডোকলাম বিতর্কিত জায়গা। ভারত কখনও ডোকলামকে তার জায়গা বলে দাবি করেনি। ভারত বার বার বলছে, আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করতে। কিন্তু চীন তাতে কর্ণপাত করছে না। উল্টো সিকিমের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অস্ত্র দিতে সম্মত হয়েছে চীন। এটা সম্পূর্ণ ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল।
চীনে আগামী অক্টোবর মাসে পার্টি কংগ্রেস। বর্তমান প্রেসিডেন্ট পুনরায় পার্টি সেক্রেটারি ও প্রেসিডেন্ট হতে ইচ্ছুক। মানুষের মতামতের অভিমুখে ফিরে যায় অনুরূপ কোনও কাজ সম্ভবত শি আপাতত করবেন না।
ভারত-চীনের প্রতিবেশী দেশগুলোর মাঝে বাংলাদেশ আর পাকিস্তান উল্লেখযোগ্যভাবে বড় দেশ। পাকিস্তান আবার আনবিক বোমার অধিকারী। ভারতের সঙ্গে তার চিরবৈরিতা। পাকিস্তানের গোয়াদরে বন্দর নির্মাণ করে চীন সাবমেরিন ঘাঁটি তৈরি করেছে পাকিস্তানে। শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর চীন কিনে নিয়েছে সাবমেরিন ঘাঁটি স্থাপনের জন্য। কিন্তু বাংলাদেশ তার কোনও বন্দর বা কোনও এলাকা কোনও বড় প্রতিবেশীকে ঘাঁটি স্থাপন করতে দেয়নি। বরং বাংলাদেশ নিজেই ধীরে-সুস্থে নিজের দেশ রক্ষা ব্যবস্থাকে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে।

কিছুদিন আগে বাংলাদেশ দু’টি সাবমেরিন কিনেছে। এখন বিমান বাহিনীর জন্য মিগ ৩৫ কেনার জন্য রাশিয়াকে ইনডেন্ট দিয়েছে। আমরা ব্যথিত হই যখন দেখি প্রতিবেশী ভারতীয়রা আমাদের সামরিক সরঞ্জাম কেনার বিষয়ে উদ্ভট কথাবার্তা বলে। সাবমেরিন কেনার বিষয়ে ভারত বিভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। মিডিয়া এমনও প্রশ্ন উত্থাপন করেছে বাংলাদেশ কার সঙ্গে যুদ্ধ করবে?

কারও সঙ্গে বাংলাদেশের যুদ্ধ না হলেও বাংলাদেশ তো অরক্ষিত থাকতে পারে না। ১৯৬২ সালে আগস্ট মাসে চীনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ভারত সফর করেছিলেন। তখন চীন-হিন্দ ভাই ভাই স্লোগানে পালাম বিমান বন্দর মুখরিত ছিল অথচ সেপ্টেম্বর মাসে চীন ভারত আক্রমণ করে বসে। চীনের এ আক্রামণের পেছনে কোনও যৌক্তিক কারণ ছিল না।

চীনের প্রতিবেশী রাষ্ট্র উত্তর কোরিয়া আনবিক বোমা-মিসাইল সবই তৈরি করছে। কিন্তু চীন উত্তর কোরিয়ার এমন অগ্রগতিকে কোনও বাধা দিচ্ছে না। ভারতের উচিত বাংলাদেশের সামরিক শক্তি সঞ্চয়ে বাংলাদেশকে উৎসাহ দেওয়া। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত কাউকেই কোনও ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি দেয়নি। বাংলাদেশের মানুষ আশা করে সরকার তার এমন নীতিতে অটল থাকবে।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ