X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গিবাদ কতটুকু শেকড় গেড়েছে?

বিভুরঞ্জন সরকার
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৭:১২আপডেট : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৭:৩৮

বিভুরঞ্জন সরকার নিয়মিত বিরতি দিয়ে দেশে জঙ্গি আস্তানার খবর পাওয়া যাচ্ছে। জঙ্গিরা কৌশল বদল করছে। একবার রাজধানী তো পরের বার জেলা শহর, পরে আবার নিভৃত পল্লী, আবার ঢাকা। এক আস্তানা বা এক জায়গায় আস্তানা গাড়ছে না। ভিন্ন নাম ও পরিচয়ের জঙ্গি মাঝেমাঝেই গ্রেফতার হচ্ছে, মারা পড়ছে, আত্মঘাতী হচ্ছে। জঙ্গিবিরোধী অভিযান অব্যাহত আছে। সরকার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছে। তাদের কোনও ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। একটা জঙ্গিবিরোধী অভিযানের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে জানানো হয়, জঙ্গিদের শক্তি দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে। বড় ধরনের নাশকতা করার সক্ষমতা তাদের নেই। গত দেড় /দুই বছরে বেশ কয়েকজন শীর্ষ জঙ্গি নিহত অথবা আত্মঘাতী হওয়ার পরও তাদের তৎপরতা বন্ধ হয়নি। গত ১৫ আগস্ট ঢাকায় একটি বড় নাশকতার পরিকল্পনা জঙ্গিদের ছিল। আগেভাগে জানা না গেলে ভয়াবহ দুর্ঘটনার আশঙ্কা ছিল। কয়েকদিন আগে মিরপুর মাজার রোডের একটি বাড়িতে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে আত্মঘাতী হয়েছে কয়েকজন জঙ্গি। ওই বাড়িতে যে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক মজুদ করা হয়েছিল, তা থেকে তাদের অবস্থান দুর্বল হয়েছে – এমন ধারণা সত্য মনে হয় না। আমাদের দেশের মানুষ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে – এটা বলে আমরা এক প্রকার স্বস্তি বোধ করলেও সময় এসেছে এ বিষয়ে আরো বেশি অনুসন্ধানী হওয়ার। জঙ্গিবাদের শেকড় আমাদের সমাজের গভীরে কতটুকু প্রথিত হয়েছে তার নির্মোহ অনুসন্ধান প্রয়োজন। আর জঙ্গিবাদের মূল উৎপাটনের জন্য শুধু পুলিশি ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল না থেকে অন্য কিছু দিকেও জরুরি মনোযোগ দেওয়া দরকার।

কারা জঙ্গিবাদে জড়িত হচ্ছে, কেন হচ্ছে –এ ব্যাপারে ওপরভাসা ধারণা নিয়ে আমরা কাজ করছি। এখন এ নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা হওয়া উচিত। মনে করা হয় যে, বর্তমানে জঙ্গিবাদকে রাজনৈতিক আন্দোলন কিংবা আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের জন্য লক্ষ্যে পৌঁছানোর এক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যারা জঙ্গি তালিকায় নাম লেখাচ্ছে তারা একটা ভুল বিশ্বাস নিয়ে এই পথে পা বাড়াচ্ছে। তারা ধর্মের জন্য ও শোষণ-বঞ্চনা অবসানের লক্ষ্যে কাজ করছে বলে মনে করছে। আসলে তারা বড় দেশগুলোর স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সরাসরি সৈন্য নামিয়ে যুদ্ধ ঘোষণার পরিবর্তে এখন বৃহৎ দেশগুলো জঙ্গি লেলিয়ে দিচ্ছে। তাই দেশে দেশে জঙ্গি তৎপরতা থামছে না। নানা নামে নানা কৌশল প্রয়োগ করে জঙ্গিরা তাদের অপতৎপরতা চালিয়েই যাচ্ছে।

মূলত ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের দুটি উঁচু ভবন ‘টুইন টাওয়ার’-এ বিমান হামলার পর থেকে সন্ত্রাসবাদ গোটা দুনিয়ায় পরিচিতি পায়। সে সময় এই হামলার জন্য জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদা ও এর প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে দায়ী করা হয়। আমেরিকার সৈন্যরা আল-কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে ২০১১ সালে পাকিস্তানের এবোটাবাদে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে হত্যা করে হামলার প্রতিশোধ নিয়েছে।

এরপর আল-কায়েদার নেতৃত্বে পালাবদল ঘটলেও দুনিয়া থেকে সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধ হয়নি। নতুন নতুন নামে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হিসেবে বিশ্বে শান্তি বিনষ্টকারীদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটস বা আইএস-এর নাম। সিরিয়া ও ইরাকের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে প্রায়ই আইএস-এর সশস্ত্র যুদ্ধের সংবাদ পাওয়া যায়। খবর পাওয়া যায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল নেওয়ার। আইএসের দ্বারা আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চোরাগুপ্তা হামলা চালিয়ে নিরীহ মানুষ মারার সংবাদ আমরা প্রায়ই সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে দেখতে পাই।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের আমেরিকার টুইন টাওয়ারে হামলার পর সারা বিশ্বে জঙ্গিদের তৎপরতা লক্ষ্য করলে দেখা যায় আল-কায়েদার টার্গেট ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক, মার্কিন স্থাপনা কিংবা যেখানে মার্কিন স্বার্থ রয়েছে সেখানে তাদের আক্রমণ পরিচালনা করেছে এবং মার্কিন প্রশাসন জঙ্গি নির্মূলের নামে তাণ্ডব চালিয়েছে সারা বিশ্বে। কিন্তু বর্তমানে আইএস এক ভিন্ন মাত্রায় আবির্ভূত হয়েছে। তাদের আক্রমণের টার্গেট সাধারণ নাগরিক। আইএস ইরাক ও সিরিয়ার একটি অংশ দখলে নিয়ে তাদের তথাকথিত রাজধানী রাকা থেকে বিশ্বব্যাপী জঙ্গি হামলা পরিচালনা করছে।

গত কয়েক বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিয়মিত জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটছে। ২০১৬ সালের ১৪ জুলাই রাতে ফ্রান্সে নৃশংস ট্রাক আক্রমণে প্রাণ হারালেন ৮৪ জন এবং আরও অধিকসংখ্যক আহত হলেন। এক্ষেত্রে একজন ট্রাক-ড্রাইভার একটি ট্রাক ফ্রান্সের জাতীয় দিবসে দেশটির নিস নামক শহরে আনন্দ-উল্লাসকারী অসংখ্য মানুষের ওপর দিয়ে চালিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালায়। এটি একটি নতুন কৌশল, যেমনটি নতুন কৌশল ছিল বিমান হাইজ্যাক করে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখ নিউইয়র্কের টুইন-টাওয়ারে হামলা। আবার দেখা যায় এক ব্যক্তি গুলি চালিয়ে অনেককে হতাহত করে, যেমনটি দেখা গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওরল্যান্ডোতে একটি নৈশক্লাবে। তা ছাড়া কয়েকজন মিলে ১৩ নভেম্বর ২০১৫ তারিখে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটায় ফ্রান্সের প্যারিসে, ২০১৬ সালের ২২ মার্চ বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে এবং ২৮ জুন, ২০১৬ তারিখে তুরস্কের আতাতুর্ক বিমানবন্দরে। এছাড়া গত দুই বছরে ফ্রান্স, জার্মানি ও লন্ডনেও একাধিকবার জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে। ধরন ও বাস্তবায়ন পদ্ধতিতে ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্নতা থাকলেও এসব জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড একই সূত্রে গাঁথা। ইসলাম ধর্মের বিকৃত ও মনগড়া ব্যাখ্যাদানকারী উগ্রবাদীদের প্ররোচনা ও পরিকল্পনা রয়েছে এগুলোর পেছনে। যারা এ ধরনের সন্ত্রাসী হত্যাকাণ্ড পরিকল্পনা করছে, প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, অর্থায়ন করছে এবং বাস্তবে ঘটাচ্ছে এরা প্রায় সবাই দেখা যাচ্ছে ইসলাম ধর্মের অনুশাসনের অপব্যাখ্যাকারী ও বিকৃত ব্যাখ্যাদানকারী বিপথগামী ব্যক্তি। ‘ইসলাম’ মানে শান্তি এবং প্রকৃত ইসলামে অশান্তি, মানুষ হত্যা ও বর্বর হামলার স্থান নেই।

পৃথিবীর কয়েকটি জঙ্গিগোষ্ঠীর নাম তালেবান, আল কায়েদা, বোকোহারাম, আল শাবাব, ইসলামিক স্টেট বা আইএস। বাংলাদেশে এযাবৎ সংঘটিত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসমূহ দেশীয় জঙ্গিরাই ঘটিয়েছে। দেশে জামাআতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) এবং হিজবুত তাহরির নিষিদ্ধ হলেও এখনও তত্পর রয়েছে। তাছাড়া তত্পর রয়েছে অপেক্ষাকৃত নতুন জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম।

পৃথিবীর ধনী দেশগুলো (আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মান, ইতালি, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া) মধ্যপ্রাচ্য (ইরাক, ইরান, কুয়েত, সৌদি আরব, বাহরাইন, কাতার, সিরিয়া ইত্যাদি দেশ) দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের সম্পদ দখলের জন্য সেসব দেশে সরকারবিরোধী জঙ্গিগোষ্ঠী লালন শুরু করে। ধনী দেশগুলো অত্যন্ত গোপনে এই জঙ্গিদের টাকা-পয়সা, অস্ত্র, বোমা, প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করে। এই প্রশিক্ষিত জঙ্গিরা ইরাক, আফগানিস্তান ও সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আত্মঘাতী হামলার মাধ্যমে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে।

ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, সুদান, তিমুর, নাইজেরিয়া প্রভৃতি গরিব দেশে জঙ্গিবাদের কারণগুলোর মধ্যে ধর্মীয় কুসংস্কার ও মানুষের অভাব-অনটনকে পুঁজি করে একটি বিশেষ গোষ্ঠী ভুল বুঝিয়ে ধর্মীয় অপব্যাখ্যার মাধ্যমে তরুণ সমাজকে জঙ্গি মতবাদে আগ্রহী করে তুলছে। পাশাপাশি বিত্তবানদের ছেলে-মেয়েদের ধর্মান্ধতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে তরুণ প্রজন্মকে ভুল পথে পরিচালিত করছে।

জঙ্গিবাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বাধীন বিবেকের ঊর্ধ্বে গিয়ে অন্ধভাবে ধর্মীয় অপব্যাখ্যা সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করা। উদাহরণ হিসেবে আমরা দেখেছি, আফগানিস্তানে ও পাকিস্তানে তালেবান শরিয়া আইনের নামে ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা মানুষের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। যার পরিণতি ভোগ করতে হয়েছিল পাকিস্তানের সোয়াত ভ্যালির ছোট্ট কিশোরী শিক্ষার্থী মালালা ইউসুফজাই কিংবা আফগান নারীদের। বর্তমানে আইএস ইরাক ও সিরিয়ার ইসলামিক রাষ্ট্র হওয়ার পরও সেখানে উগ্রভাবে ইসলামিক স্টেট প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সুতরাং এদের উদ্দেশ্য হচ্ছে অবৈধভাবে চরমপন্থাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে চাপিয়ে দেওয়া।

জঙ্গিবাদীরা মানুষকে আবার অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নিতে চায়। বিশ্বব্যাপী ইসলামিক স্টেট, তালেবান ও আল কায়েদার মতো জঙ্গি গোষ্ঠী দেশে দেশে চোরাগোপ্তা হামলা করছে। প্রাচীন সভ্যতার পুরাকীর্তি, জাদুঘর, গ্রন্থাগার সব ধ্বংস করছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি সব ধ্বংস করে ওরা বিশ্বকে কোথায় নিয়ে যেতে চায়? এ সহজ কথাটা কী আমরা বুঝতে পারি না?

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জঙ্গিবাদীরা সক্রিয় হয়ে উঠছে। তারা ইসলামের অপব্যাখ্যা করে বেহেশতপ্রাপ্তি নিশ্চিত হবে এই ধারণা দিয়ে তাদের অনুসারীদের ‘ইসলাম রক্ষায়’ জঙ্গি-সন্ত্রাসী তত্পরতা এবং হত্যাকাণ্ড ঘটাতে অনুপ্রাণিত করে। কী মুসলিম কী অ-মুসলিম যাদেরই এই জঙ্গি-উগ্রবাদীদের ‘লক্ষ্য’ অর্জন এবং ‘বিকৃত বিবেচনার ইসলাম’ বিরোধী বলে চিহ্নিত করা হয় তাদের সবার বিরুদ্ধে জঙ্গি তত্পরতা ও হত্যাকাণ্ড চালাতে অনুসারীদের উদ্বুদ্ধ করা হয়। অর্থের লেনদেন থাকে পার্থিব প্রয়োজন মেটানোর জন্য এবং এই পথে মৃত্যু মানেই বেহেশতে প্রবেশ এই মন্ত্রে অনুসারীদের মগজ ধোলাই করা হয়। তাদের এমনভাবে অনুপ্রাণিত করা হয় যে, সন্ত্রাস ও জঙ্গি কর্মকাণ্ড চালাতে গিয়ে তারা আত্মঘাতী হতেও দ্বিধাবোধ করে না। এখন দেখা যাচ্ছে এই জঙ্গিবাদ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন দেশে ইসলাম ধর্মের এই বিকৃতির অনুসারী হয়ে মানুষ, বিশেষ করে অনেক তরুণ জঙ্গিবাদে এবং সাধারণ মানুষ হত্যায় লিপ্ত হচ্ছে।

ইসলাম শান্তির ধর্ম। প্রায় ১৪শ বছর আগে আরব জাহানে যখন জাহেলি যুগ ছিল। যখন মানুষে মানুষে হানাহানি-মারামারি এবং কন্যাসন্তান জন্ম নিলে জীবন্ত মাটি চাপা দেওয়া হতো, তখন মানবতার মহান দূত আল্লাহর রাসূল হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর আবির্ভাব হয়। যিনি দেখিয়েছেন ইসলাম কিভাবে নারীর অধিকার দিয়েছেন। ভ্রাতৃত্বের বন্ধন মানুষের প্রতি মানুষের দয়ামায়া ভালোবাসার বিনির্মাণ করা যায়। সুতরাং ইসলামে জঙ্গিবাদের কোনও স্থান নেই। আজকে যারা ইসলামের নামে জঙ্গিবাদের আশ্রয় নিয়েছে তারা হয়তো বিপথগামী, নয়তো জেনেশুনে তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য তরুণ মুসলমানদের চরমপন্থার দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।

ইসলাম শান্তির ধর্ম, মানবতার ধর্ম। পবিত্র কোরআন শরিফে উল্লেখ আছে একজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা মানেই সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করা। অথচ এই জঙ্গিবাদীরা আল্লাহর নামে স্লোগান দিয়ে পবিত্র রমজান মাসে এবং ঈদের নামাজ না পড়ে সেই সময় এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করতে দ্বিধাবোধ করেনি। ইসলাম ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ থাকতে রমজানের পবিত্রতা নষ্ট করে এই ঈদের জামাতকে চ্যালেঞ্জ করে এই ধরনের জঘন্য মানবতাবিরোধী অপরাধ তারা সংঘটিত করত না।

২০১৬ সালের ৪ জুলাই মদিনা শরিফের মসজিদে নববীতে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ প্রমাণ করে জঙ্গিরা ইসলামকে ধ্বংস করতে চায় এবং এর পেছনে ইসলামের ষড়যন্ত্রকারীরা সক্রিয়।

বাংলাদেশে আলোচিত জঙ্গি হামলা শুরু হয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তখনকার বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা ও ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট ৬৩ জেলায় জেএমবির সিরিজ বোমা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। সেই সময় দেশের আদালত চত্বর ও পুলিশ ফাঁড়ির সামনে বোমা বিস্ফোরণে বহু মানুষ হতাহত হয়।

দেশের আহমদিয়া মসজিদে হামলা, সংখ্যালঘু হত্যা, গির্জার পুরোহিতকে হত্যা কিংবা নোয়াখালীর এক মসজিদের ইমামকে গলা কেটে হত্যা এগুলোর সাথে ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে না।

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে ঢাকার গুলশানে অবস্থিত হলি আর্টিজান বেকারি ক্যাফেতে এবং ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে জঙ্গি হামলার ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে খুবই বেদনাদায়ক। এই দুই হামলায় যেভাবে নিরীহ মানুষদের হত্যা করা হয়েছে, তাতে মানুষ মাত্রই লজ্জিত হবেন। বিনা দোষে এভাবে মানুষ হত্যা করে যারা, তারা পশুরও অধম।

অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে, রুখে দাঁড়াতে হবে, বাংলাদেশে আজ পরিস্থিতি এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে, আমাদের চোখের সামনে কোনও অন্যায় হলে বা কারও ওপর জুলুম নির্যাতন অত্যাচার হতে দেখলেও, আমরা প্রতিবাদ করি না। আক্রমণকারী তার কাজ শেষ করে নির্বিঘ্নে চলে যেতে পারে, কারণ আমরা ভয়ে কেউ এগিয়ে গিয়ে তাদের প্রতিহত করি না। আমরা ভাবি তা করতে গিয়ে যদি আমরা নিজেদের বিপদ ডেকে আনি? কিন্তু যদি আজ অন্যের বিপদে আমি এগিয়ে না আসি, তবে আমার বিপদের দিনে কাউকে পাশে পাবো না।

অন্যের ধর্ম, ভিন্ন মতকে আমরা শ্রদ্ধা করতে পারছি না। সেক্ষেত্রে প্রশ্রয় পাচ্ছে দানবিক জিঘাংসা। পরমত সহিষ্ণুতা আমাদের সমাজ ও রাজনীতি থেকে আজ নির্বাসিত।

২০১৬ সালের ১৮ জুন বাংলাদেশের লক্ষাধিক মুফতি ও আলেম ‘জঙ্গিবাদ জাহান্নামের পথ’ বলে যে মতামত দিয়েছেন, তা অত্যন্ত সময়োপযোগী ও কার্যকরি পদক্ষেপ। তাঁরা বলেছেন, ইসলামের নামে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ হারাম। এতে আরো বলা হয়েছে, জঙ্গিদের জানাজা পড়া হারাম। যারা জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মারা যাবেন, তারা শহীদের মর্যাদা পাবেন। এই কথাগুলো আমাদের মনে রাখতে হবে। এতে করে ধর্মের অপব্যাখ্যাকারীদের মুখোশ উন্মোচিত হবে।

জঙ্গিবাদের প্রধান শক্তি ধর্মীয় গোঁড়ামি আর অর্থ। ধর্মীয় গোঁড়ামি, অন্ধত্ব আর কুসংস্কার দূর করতে পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে জঙ্গিবাদ নির্মূল করা যাবে না। সে সঙ্গে জঙ্গিবাদের অন্যতম শক্তি অর্থ জোগানের উৎস বন্ধ করতে হবে কঠোরভাবে। জঙ্গিবাদের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্তদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, জঙ্গিবাদের মদদ-দাতা, পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান যেই হোক, তাদের কঠোর শাস্তি প্রদানের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

কেবল সচেতনতা সৃষ্টি করে নয়। সন্তানের সঙ্গে রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে। আমরা যত বেশি তাদের সঠিক তথ্য দেব, তত বেশি তারা জানতে ও বুঝতে পারবে। আমাদের আরো বেশি বেশি সময় দিতে হবে। আমাদের বাচ্চাদের সঙ্গে অনেক গল্প করতে হবে। আমাদের মা-বাবারা যে সময়টা আমাদের দিতেন, আমাদেরও উচিত সন্তানদের সে পরিমাণ সময় দেওয়া। কিন্তু এখনকার প্রজন্ম তত বেশি সময় সন্তানদের দেয় না। মা-বাবারা যতদিন বাচ্চাদের তাদের বাহুতে মাথা নিয়ে গল্প করবেন না, একসঙ্গে গান শুনবেন না, তত দিন এ সমস্যা থেকে যাবে। মুখে মুখে ভালোবাসা নয়, সন্তানের অন্তরে জায়গা করে দিতে হবে। তার মনের মধ্যে নিজেকে প্রবেশ করাতে হবে। ক্লাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে একটি আন্তরিক সেতুবন্ধন তৈরি করতে হবে। আমাদের শিক্ষার্থীরা যাতে কু-শিক্ষার দিকে ধাবিত না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। একাডেমিক পাঠের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে ছাত্রছাত্রীদের বেশি পরিমাণে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী ছাত্রছাত্রীদেরকে ক্লাসে উপস্থিতি নিশ্চিতের পাশাপাশি অভিভাবক সম্মেলনের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।

নিচের কাজগুলো ধারাবাহিক ভাবে করা যেতে পারে:

* ধর্ম সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করা। ধর্মের মানবিক দিকগুলো চর্চার মাধ্যমে ধর্মান্ধতা ও ধর্মের অপব্যাখ্যা দূরীকরণ।

* নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও এলাকায় জঙ্গিবাদের কুফলগুলো তুলে ধরা এবং গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সভা, সেমিনার ও মানববন্ধন ইত্যাদির আয়োজন করা।

* গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল রাজনৈতিক চর্চার মাধ্যমে সুস্থ ধারার রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করা।

* আমাদের নিজস্ব বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা।

* শরীরচর্চা সহ দেশি ও আন্তর্জাতিক খেলাধুলায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করা।

* নিজ নিজ এলাকার জনপ্রতিনিধি এবং পুলিশ প্রশাসনকে জঙ্গিবাদ নির্মূলকরণে সহায়তা করা।

* মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা এবং অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে জঙ্গি ও সন্ত্রাস বিরোধী মতামত এবং সঠিক ধর্মীয় অনুশাসন সম্পর্কে জ্ঞাত করা।

লেখক: কলামিস্ট

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ