X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দীপনবিহীন দুই বছর

আহসান কবির
৩১ অক্টোবর ২০১৭, ২০:০১আপডেট : ৩১ অক্টোবর ২০১৭, ২০:১১

আহসান কবির খুব সাধারণ কিছু প্রশ্ন ছিল দীপনের!
সব মেঘ কি বৃষ্টি হয়ে নামে? যদি না-ই নামে তাহলে এতো মেঘ কোথায় যায়? যতো ফুল ফোটে তার সবটা কি ঝরে যায়? ঝরুক কিংবা না-ই ঝরুক এতো ফুল কোথায় যায়? পৃথিবীতে কত মানুষ আসে, কোথায় যায় তারা? যারা যায় তারা ফিরে আসে না কেন?
দীপন নিজেই উত্তর দিত–সবাই রিপ ভ্যান উইংকল না। গল্পের রিপ ভ্যান উইংকলরা বিশ বছর পর হলেও ফিরে আসে। তবে গানের খোকারা কখনও ফেরে না। খোকার মার কান্না তাই গানের করুনতম সুরকে আরও বাড়িয়ে তোলে–
রেললাইনের ধারে মেঠোপথটার পাশে দাঁড়িয়ে
এক মধ্যবয়সী নারী রয়েছে দু-হাত বাড়িয়ে

খোকা ফিরবেই

খোকা ফিরবেই

খোকা ফিরবে কী ফিরবে না...

সবাই ফেরে না! যতোটুকু জল টেনে নেয় ভাটা তার সবটুকু ফেরে না জোয়ারে। একাত্তরের রুমি আর আজাদরা ফেরেনি। স্বাধীনতার পর লক্ষ মায়ের প্রতীক্ষা থামেনি, মায়েরা না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন, তবু ছেলেরা ফেরেনি।

রাজাকাররা ফিরেছিল ঠিক! তাদের দুঃসময়ে টয়লেটের গা ঘিন ঘিন করা তেলাপোকা হয়ে টিকেছিল। তারপর ফিরেছিল পাকিস্তানি প্রেতাত্মার এদেশীয় ভূত হয়ে।

দীপন ফেরেনি আজও! জানি না এই দুই বছরে সে কোথায় আছে, কেমন আছে!

দুই.

টেলিফোন নম্বর লিখে রাখতো দীপন ছোট্ট ডায়েরিতে। তারপর এলো মোবাইলের যুগ। মোবাইল সেট এবং সিম কার্ডের মেমোরিতে নম্বর সেভ করা যেত। এরই মধ্যে আজিজ মার্কেট থেকে সামান্য দূরে রেকর্ডিং স্টুডিও সাউন্ড গার্ডেনে মাঝরাতে গান শোনার নেশা চেপে গিয়েছিল আমাদের। আমরা সাউন্ড গার্ডেনে গেলেই রেকর্ড করা গান শোনাতো মবিন। অসাধারণ রেকর্ডিস্ট আর শব্দ প্রকৌশলী ছিল সে। গান শোনার পরে মাঝরাতে ঘুরতে বের হওয়ার সেইসব স্মৃতি এখনও রঙিন, সাদা-কালো হবে না কখনও। চট্টগ্রাম থেকে অনুষ্ঠান করে ফেরার পথে একদিন মারা গেলো মবিন। মাসখানেক পরে মোবাইল খুলে দেখালো দীপন। মবিনের নম্বরটা সেভ করা! পপ সম্রাট আজম খানেরও নম্বর ছিল দীপনের কাছে। আমার কাছ থেকে নিয়েছিল ক্ষণজন্মা অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদীর মোবাইল নম্বর। এই দুইজন মানুষ না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার বেশ কিছুদিন পর দীপনের মোবাইলে দেখলাম তাদের নম্বর রয়ে গেছে!

দীপন না ফেরার দেশে চলে গেছে দুই বছর হলো। ওর মোবাইল নম্বর আজও আমার মোবাইলে রয়ে গেছে!

তিন.

শীতের সকালের উষ্ণতা কিংবা সন্ধ্যার বিষণ্ন কুয়াশার নীরবতা হাতছানি দিত দীপনকে। ঠিক যেমন নবান্নের ঘ্রাণ, গরম ভাপা পিঠার স্বাদ মাদকতা কিংবা ইলিশ রান্নার আভিজাত্য, ঠিক তেমন একটা কিছু মুগ্ধ করেছিল তাকে। জীবনানন্দের সোনালি ডানার চিল, রবী ঠাকুরের বিশালতা, নজরুলের সার্বজনীনতা, লালনের অসাম্প্রদায়িক মুক্ত চেতনার গান কিংবা একাত্তরের নীরব কালজয়ী উদ্দীপনা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তাই সে বেছে নিয়েছিল অন্যরকম এক ঘ্রাণ। নতুন ছাপা হওয়া বইয়ের ঘ্রাণ তাকে পাগল করে তুলেছিল। হয়তো দীপন তার পিতা আবুল কাশেম ফজলুল হক স্যার কিংবা তার বোনের মতো শিক্ষক হতে পারতো। চলে যেতে পারতো বিদেশ। করতে পারতো ব্যবসা বা অন্য কোনও কিছু। কিন্তু নতুন বইয়ের ঘ্রাণ যাকে নেশাতুর করে তোলে তার কাছে অন্য যে কোনও পেশা নস্যি। এই নতুন বইয়ের নেশাই তাকে ঠেলে দিয়েছিল মরণের দিকে।

দীপনের জাগৃতি প্রকাশনী শুরু থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত যতো নতুন লেখকের বই প্রকাশ করেছে অন্য কোনও প্রকাশনী সেটা করতে পেরেছে কিনা সন্দেহ!

চার.

শিখ ধর্মের অন্যতম প্রাণপুরুষ গুরু নানকের দুঃখবোধ থেকেই নাকি একটা দর্শন জন্ম নিয়েছিল! সহজিয়া সেই দর্শন অনেকটা এমন- মানুষ পৃথিবীতে আসে এবং মরে যায় মানুষ হিসেবেই। বেঁচে থাকাকালীন সময়টাতে সে মানুষের দ্বারাই বিভাজিত হয়। ধর্ম, বিশ্বাস, দল, সম্প্রদায়, জাতির নামে মানুষই মানুষকে ক্রমাগত পৃথক করে। এমন কী পশু কিংবা গাছপালাও বিভক্ত হয়। শূকর পছন্দ করে না মুসলিমে, আর গরু খায়না হিন্দু ধর্মের লোকজন। মুসলিমদের জন্য আছে খেজুর গাছ, খ্রিস্টানদের আছে ক্রিসমাস ট্রি। বোধিবৃক্ষ নাকি বৌদ্ধদের, তুলসি গাছ নাকি হিন্দুদের প্রিয়। ধর্ম ও রাজনীতির কারণে গানও বিভাজিত হয়, সর্বজনীন কিংবা সব মানুষের থাকে না। আছে পূজা ও প্রার্থনার গান, আছে চার্চের গান, আছে নবী ও আল্লাহকে নিয়ে গান। ‘যদি জয় বাংলা বাংলার জয়’কে ভালোবাসে আওয়ামী লীগ, বিএনপি তখন খুঁজে বের করে আরেক গান- প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ/জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ। গান ছিল এরশাদ এবং জাতীয় পার্টির- নতুন বাংলাদেশ গড়বো মোরা নতুন করে আজ শপথ নিলাম!

দীপন মানুষ হিসেবেই বাঁচতে চেয়েছিল। বিভাজনের পৃথিবী তাকে মরণের মুখোমুখি করে তুলেছিল, ধর্মান্ধরা তাকে পরিকল্পনা করেই খুন করেছিল। জানি না দীপন যেখানে গিয়েছে সেখানে শুধু শুদ্ধ মানুষরা থাকে কিনা! শুধু জানি দীপনকে যারা খুন করেছিল তারা কেউ মানুষ ছিল না!

পাঁচ.

বহু আগে থেকে থেকেই বিশ্বাসের ভাইরাসে ভোগা এই পৃথিবীতে ধর্মান্ধতার আগুনে পুড়ে মারা গেছেন কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও কিংবা সক্রেটিস। তবু অনুসন্ধিৎসু মনের চিন্তামগ্নতা, বিজ্ঞানমুখীতা কিংবা মানুষ ও পৃথিবী সম্পর্কে জানতে চাওয়ার আগুন কখনও নেভেনি। এই আগুনের আলোই বাঁচিয়ে রাখতে পারে পৃথিবীকে। এই আগুনমাখা বই প্রকাশ করতো দীপন, মানুষকে নিয়ে যেতে চাইতো সেই আগুনের আলোয়। দীপন মরে যাওয়ার পরে দুই বছর কেটেছে পৃথিবীর। দীপন হত্যার বিচার কার্যক্রম এগিয়েছে কতোটুকু? আইন শৃংখলা বাহিনী দীপনের হত্যাকারী সন্দেহে ছয়জনকে চিহ্নিত করে তাদেরকে ধরিয়ে দিতে পুরষ্কার ঘোষণা করেছিল। এই ছয়জনের ভেতর দুইলাখ টাকা দামি আসামি সিফাতকে টঙ্গি থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। আগামী ২১ নভেম্বর দীপন হত্যা মামলার চার্জশিট দেওয়ার কথা রয়েছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রে জানা গেছে আনসার উল্লাহ বাংলা টিম তথা আনসার আল ইসলামের সঙ্গে জড়িত জঙ্গিরাই দীপনকে খুন করেছে। চাকরিচ্যুত সেনাবাহিনীর মেজর জিয়া এবং আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের কথিত সামরিক কমান্ডার সেলিমের নির্দেশেই নাকি এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতারকৃত তিন জঙ্গি নাকি তাদের ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে এমন তথ্য দিয়েছে।

ছয়.

দীপনের মৃত্যুর মতো, মৃত্যুর আগেই যে মৃত্যু সেটা মেনে নেওয়া যায় না। খুব সহজেই খুন করা শিখেছে মানুষ! রাষ্ট্র নিজে যখন বিশ্বাসের ভাইরাসে ভোগে, রাষ্ট্র নিজে যখন চালাকি করে, তখন সাময়িক সুবিধা পাওয়া গেলেও আরও বেশি চালাকির ফাঁদে পরে যায় রাষ্ট্র একদিন। আমাদের  সম্মিলিত উদাসীনতার কারণে সব কিছু নষ্টদের অধিকারে চলে যাচ্ছে, ক্রমাগত আরো বেশি যাবে। সেদিন আর কেউ নষ্টদের হাত থেকে রাষ্ট্রকে বাঁচাতে পারে না। যে পথে গিয়েছে আফগানিস্থান, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া কিংবা ইরাক, বাংলাদেশও কী সেই বধ্যভূমির দিকে হাঁটা শুরু করেছে? অভিজিৎ কিংবা দীপন হত্যা মামলার বিচার হওয়াটা বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্য ভীষণ জরুরি।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে লিখেছিলাম, মনে হলো আজও সেটা প্রাসঙ্গিক। তাই হুবহু তুলে ধরছি।

‘আজিজ মার্কেটের তিনতলায় যে রুমে দীপনকে হত্যা করা হয়েছিল সেই রুমের দেয়ালে আর সিলিংয়ে এখনও রক্তের দাগ লেগে আছে। দীপনের বন্ধু ওলি সেই রুমটা ভাড়া নিয়ে একইভাবে রেখে দিয়েছে। ওলির আশা দীপনের সব হত্যাকারীরা একদিন গ্রেফতার হবে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে। সে তখন গর্ব করে বলতে পারবে রক্তের দাগ শুকানোর আগেই দীপন হত্যার বিচার হয়েছে! জানি না ওলিকে আর কতোদিন এই রক্তের দাগ পাহারা দিতে হবে!’

লেখক: রম্যলেখক

 

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ