X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা কতটা আশা জাগায়

মোস্তফা হোসেইন
৩০ নভেম্বর ২০১৭, ১১:৫৯আপডেট : ৩০ নভেম্বর ২০১৭, ১২:২২

মোস্তফা হোসেইন প্রত্যাশা খুব বেশি ছিল না, তবে প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশের। দেশের ঘাড়ে চেপে বসা রোহিঙ্গা কাঁটা যদি সরানো যায়! আশা-নিরাশার মধ্যেই বাংলাদেশ তাকালো আসেম সম্মেলনের দিকে। সম্মেলন শুরুর আগে বাংলাদেশে সফরে এলেন চীনসহ ৫ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তারা নিজেরা দেখলেন, জানলেন রোহিঙ্গাদের প্রকৃত অবস্থা। তাদের মন্তব্য সঙ্গত কারণেই আমাদের হৃত আশাকে কিছুটা জাগিয়ে তুলেছিল। অন্তত ভাবনায় আসে, আসেম সম্মেলনকে কেন্দ্র করে যদি কিছু একটা হয়।
সম্মেলন হলো, অনেক দেশের পক্ষ থেকেই মিয়ানমারের দৃষ্টি আকর্ষণও করা হলো। পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের চাপ ছিল চোখে পড়ার মতো। অনেকেই ভাবতে শুরু করলো, এবার মিয়ানমার সামরিকতন্ত্র নিশ্চয়ই নরম হবে। বাস্তবতা হলো— রোহিঙ্গা সমস্যা, সমস্যা হিসেবেই থেকে গেলো।
সম্মেলনের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে যোগ দিলেন। কয়েক দফা বৈঠক হলো। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া সাংবাদিকরা জানতে চাইলেন, ফল কী? কূটনৈতিক কৌশলেই জবাব দিলেন। সবশেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়ে দিলে, দেশে গিয়ে তিনি সাংবাদিক সম্মেলন করে সবকিছু জানাবেন।
শনিবার জানালেন সেটাই। কিভাবে মূল্যায়ন করব সেই সম্মেলন ও বাংলাদেশের প্রাপ্তি সম্পর্কে? যোগ-বিয়োগ ইচ্ছেমতো করতে পারি, ফলটা নিজের পক্ষে আনাটা খুবই কঠিন মনে হচ্ছে। প্রাপ্তি হিসাব করতে গেলে কখনও মনে হয় একরাশ ব্যর্থতা। আর এর পরিণতিতে বাংলাদেশকে ১০ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে দীর্ঘকাল। আবার কখনও মনে হয়, হয়তো মিয়ানমারে কিছু রোহিঙ্গা ফেরতও যেতে পারে। কিন্তু যদি অতীতের উদাহরণ টানা হয়, তখন সেই আশাটাও ঘোলাটেই হয়ে যায়।
বাংলাদেশ সবসময় বলে আসছে, ১৯৯২ সালের চুক্তির ভিত্তিতে বিবেচনা করলে বর্তমান সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, ওই চুক্তি অনুসরণযোগ্য নয়। বাস্তবতা হচ্ছে— গত সপ্তাহে যে সমঝোতা স্মারকটি মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পন্ন করলো, তার মূল ভিত্তি ১৯৯২ সালের চুক্তি। মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি এটাই আগে থেকে বলে আসছিলেন।
মিয়ানমার স্বীকার করছে, তাদের কিছু অধিবাসী বাংলাদেশে আশ্রয় লাভ করেছে। তারা এই মন্তব্যও করেছে, তারা রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফেরতও নেবে। ইতিহাস কী বলে? ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালের চুক্তিতেও একই কথা বলা আছে। সেই স্বীকারোক্তি কি তারা কার্যকর করে? শুধু রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়াই নয়, ১৯৯২ সালের চুক্তিতেও ‘মিয়ানমারে বসবাসকারীরা যেন বাংলাদেশে পালিয়ে না আসে, তার জন্যও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিষয়ে মিয়ানমার সরকার সম্মত হয়েছিল’। ২০১৪ সালেও দুই হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে যাচাই-বাছাই করা হয় ফেরত নেওয়ার জন্য। এরপর গত ৩ বছরে একজনকেও তারা ফেরত নেয়নি। সুতরাং মিয়ানমার কি ২০১৭ সালের সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান করবে?
২০১৭ সালের সমঝোতা স্মারকটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সেগুলো আগের চুক্তিরই অনুরূপ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলনে বললেন, ‘এতে ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে, এটা নাই সেটা নাই— এসব বলে লাভ নাই।’ মাননীয় মন্ত্রীর এই বক্তব্য থেকে প্রশ্নটা আরও জোরালো হয় বৈকি। তাহলে তিনি কি ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে তা স্বীকার করে নিচ্ছেন?
বাংলাদেশ পক্ষ যে খুব একটা আশাবাদী নয়— এটা আরও বোঝা যায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আরেকটি মন্তব্যে। তিনি বলেছেন, ‘ফিরিয়ে নেওয়ার কোনও টাইমফ্রেম দেওয়া যায় না। প্র্যাকটিক্যাল ব্যাপার হলো, এরকম কোনও টাইমফ্রেম দিয়ে কোনও লাভও নেই।’ এক পর্যায়ে চুক্তির একটি অংশও উল্লেখ হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘যৌক্তিক সময়ের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে দুই পক্ষ সম্মত হয়েছে।’
এটাও একটা আন্দাজনির্ভর টার্ম। কারণ যৌক্তিক সময়টা কি উভয়ের একরকম হবে? হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু? আগে যেখানে মিয়ানমার যাচাই-বাছাই করার পরও তিন বছরে একজনকেও ফেরত নেয়নি, এখন তারা কত বছরে ফেরত নেবে?
চুক্তি হলেই কি সমস্যা সমাধান হবে? এই প্রশ্নটা আগে থেকেই সবার ছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের সেই সন্দেহকেই এক অর্থে সমর্থন করলেন। বললেন, ‘চুক্তির বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু আইন থাকলেও লঙ্ঘন হয়। আইন দিয়ে কিছু হয় না। মূল কথা হলো কোনও দেশ এটি মানছে কিনা।’ আমার মনে হয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যই বলে দেয়, এই চুক্তিতে বাংলাদেশের ঘাড় থেকে রোহিঙ্গা নামক এই দুর্ভোগ আদৌ নামবে কিনা।
এই সমঝোতা স্মারকটির বাস্তবতা নিয়ে যত প্রশ্নই করা হোক, তা মানা হলে বাংলাদেশের ওপর চেপে বসা এই সমস্যা কিছুটা হলেও লাঘব হবে। যেমন— রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাই করার ব্যাপারে যে সমালোচনা হচ্ছিল, তাও এতটা কঠোর নয়। যেমন ১৯৭৮ সালের চুক্তির প্রথম ধারায় (এ) বলা হয়েছে, ‘প্রত্যাবাসনের প্রথম পর্যায়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) বৈধ অধিবাসী, যাদের বার্মার জাতীয় নিবন্ধন কার্ড আছে তাদের পরিবারসহ ফিরিয়ে নেওয়া হবে। কার্ডধারীদের পরিবারের সদস্য, যেমন— স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা, শ্বশুর-শাশুড়ি, সন্তান, পালিত সন্তান, নাতি-নাতনি, ছেলে-মেয়ের জামাই এবং বিধবা বোনদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে।’ এটা প্রথম ধাপের কথা।
দ্বিতীয় ধাপেও ফেরত নেওয়া হবে— সেটাও উল্লেখ আছে। প্রথম ধারায় (বি) বলা হয়েছে, ‘দ্বিতীয় ধাপে যেসব নাগরিক বার্মায় তাদের বাসস্থানের জন্য রাষ্ট্রের ইস্যু করা কোনও দালিলিক প্রমাণ দেখাতে পারবে, তাদের পরিবারসহ ফিরিয়ে নেওয়া হবে। এছাড়া যেসব নাগরিক বার্মায় তাদের বাসস্থানের ঠিকানা বা অন্য কোনও প্রমাণ হাজির করতে পারবে, তাদেরও ফিরিয়ে নেওয়া হবে।’ চুক্তির দ্বিতীয় ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক পাঠানো বার্মার অধিবাসী দলগুলোকে সীমান্তে বার্মার সরকার গ্রহণ করবে।
চুক্তির শেষোক্ত ধারা অনুযায়ী কাজ করলে বাংলাদেশে অবস্থানরত প্রায় সব রোহিঙ্গার ফেরত যাওয়ার পথ উন্মুক্ত হয়। সুতরাং প্রমাণপত্র হাজির করা নিয়ে সম্প্রতি যে সংশয় তৈরি হয়েছে, তা আগের চুক্তির পর আর তেমন প্রতিবন্ধক বলে মনে নাও হতে পারে। আবারও বলে নেওয়া প্রয়োজন, এক্ষেত্রে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা আরোপিত স্বেচ্ছায় দেশে যেতে চাওয়ার যে বিধানটি সংযোজিত হয়েছে সেটি হয়তো কিছুটা সমস্যা তৈরি করতে পারে। যা এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের অনেকেই তাদের মনোভাব প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছে।
সুতরাং এই মুহূর্তে মিয়ানমারকে মানবিক আচরণে ফিরিয়ে আনাটাও বাংলাদেশের কূটনৈতিক কাজের আওতায় এসে যায়। আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখে এগিয়ে যাওয়ার কোনও বিকল্প নেই— এটা অন্তত বলা যায়। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে যে ভীতি ও আশঙ্কা রয়েছে, তা দূর করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। আর সেই অবস্থা তখনই তৈরি হবে যখন মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা নিপীড়ন বন্ধ করবে এবং এখনও যারা সেখানে রয়ে গেছে তাদের নিরাপত্তা বিধান করবে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক, ত্রাণকর্মী ও গণমাধ্যমকর্মীদের যদি সেখানে যাওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া হয়, তাহলে হয়তো রোহিঙ্গাদের মানসিকতা পরিবর্তন হতেও পারে। আর তখন হয়তো তারা নিজ দেশে ফিরে যেতে দ্বিধা করবে না।
পরিশেষে অন্তত এটুকু বলা যায়, চুক্তি খারাপ হয়েছে কি ভালো হয়েছে, এটা বলার চেয়ে মিয়ানমার মানবিক হবে, চুক্তি বাস্তবায়ন করবে— এই প্রত্যাশাই হতে পারে অধিকতর প্রযোজ্য। আর সেজন্য বাংলাদেশের যতটা কূটনৈতিক প্রচেষ্টা নেওয়া প্রয়োজন, তাও নিতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ের গবেষক

/টিআর/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঘোড়াঘাটে মালবোঝাই দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত
ঘোড়াঘাটে মালবোঝাই দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত
নির্বাচনের সময় জাপায় কী হয়েছিল, জানাবেন জিএম কাদের
শনিবার জাতীয় পার্টির বর্ধিত সভানির্বাচনের সময় জাপায় কী হয়েছিল, জানাবেন জিএম কাদের
১০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগে অগ্রণী ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা আটক
১০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগে অগ্রণী ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা আটক
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ