X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মামা গাজীপুর কতদূর!

রেজানুর রহমান
২১ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৫:১৫আপডেট : ২১ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৫:২১

রেজানুর রহমান শীতের সকাল। ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই সাধারণত সাতটা/আটটা বেজে যায়। অথচ সিদ্ধান্ত নিয়েছি সকাল ৬টায় ঢাকা থেকে বাসে করে গাজীপুরের অদূরে শ্রীপুরের মাওনায় যাবো। সেখানে একটা কাজ আছে। ভাবনাটা ছিলো এরকম- খুব সকালে বাসে উঠলে মাওনায় পৌঁছাতে বড় জোর ৯টা বাজবে। যে কাজে যাচ্ছি তার জন্য সময় ব্যয় হবে বড় জোর ৩০ মিনিট। তার মানে সকাল ১০টার মধ্যেই আবার ঢাকার দিকে যাত্রা করতে পারব। ঢাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে হয়তো বেলা ১টা বেজে যাবে। বাজুক, ঢাকায় অফিসের কিছু কাজ তো করা যাবে।
সকাল ৬টার মধ্যেই মহাখালী বাস টার্মিনালে পৌঁছালাম। ধারণা করেছিলাম এতো সকালে বাস টার্মিনালে হয়তো তেমন ভিড় থাকবে না। কিন্তু বাস টার্মিনালের পরিবেশ দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না। এতো সকালেও বাস টার্মিনাল জুড়ে প্রচুর মানুষের ভীড়। কারও হাতে বড় ব্যাগ, কারও হাতে ছোটো ব্যাগ। কেউ বা খালি হাতেই বাসে ওঠার জন্য এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। মহাখালীর এই বাস টার্মিনাল থেকে প্রতি ৩০ মিনিট পর পর ময়মনসিংহ সহ বিভিন্ন এলাকার উদ্দেশ্যে বাস ছাড়ে। ভোর ৫টা থেকে যাত্রী পরিবহন কার্যক্রম শুরু হয়। একটা বাসে উঠে দেখি প্রায় সব সিটেই যাত্রী বসে আছে। বাসের কন্টাকডর বাসের মাঝের দিকে একটা সিট ম্যানেজ করে দিল। তাকে জিজ্ঞেস করলাম- ভাই মাওনায় যাবো। কতক্ষণ লাগতে পারে? কন্টাকডর দায় সারা ভঙ্গিতে উত্তর দিল- সেটা নিশ্চিত কইর‌্যা বলা যাবে না। বাসে উঠছেন। বইস্যা থাকেন। ট্রাফিক জ্যামের ওপর সব কিছুই নির্ভর করবে।
সকাল ৬টা ১৫মিনিটে মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে ময়মনসিংহের উদ্দেশে বাস ছেড়ে দিল। মহাখালী মোড় পর্যন্ত বাসটি একটানেই গেল। কিন্তু এরপর আর নড়ে না চড়েও না। নড়বে চড়বে কি করে? মহাখালী মোড়ে ট্রাফিক জ্যাম শুরু হয়েছে। এতো সকালেও ট্রাফিক জ্যাম? প্রশ্ন করতেই আমার পাশের সীটে বসা যাত্রীটি বলল- এইটাতো ভাই নতুন কিছু না। রোজকার দৃশ্য।

তাকে প্রশ্ন করলাম- ভাই কোথায় যাবেন?

গাজীপুর, বলেই লোকটি নড়ে চড়ে বসল।

জিজ্ঞেস কলাম- গাজীপুর যেতে কতক্ষণ লাগবে? তিনি যেন বিরক্ত হলেন। বললেন- এই ব্যাপারে ভাই এক্ষুনি বলা যাবে না। দেড় থেকে দুই ঘণ্টাও লাগতে পারে। আবার তিন, চার ঘণ্টাও লাগতে পারে। কোথায় দেড় থেকে দুই আর কোথায় তিন আর চার ঘণ্টা। সময়ের অনেক ব্যবধান। অবাক হয়ে জানতে চাইলাম- একবার বললেন দেড় থেকে দুই ঘণ্টা, আবার বললেন, তিন থেকে চার ঘণ্টা। সময়ের এতো...

আমার কথা কেড়ে নিয়ে লোকটি বলল- কেন বলেছি বুঝেন নাই?

না।

ট্রাফিক জ্যাম বলে একটা শব্দ আছে জানেন তো!

হ্যাঁ জানি।

এই ট্রাফিক জ্যামই নির্ধারণ করে দিবে আপনি কতক্ষণে গাজীপুরে যাবেন। তাছাড়া রাস্তা ভাঙ্গা। গাড়ি চলে আবার চলে না।

মহাখালী মোড় থেকে বাস ছেড়েছে। এয়ারপোর্ট রোডের খিলক্ষেত এলাকায় ওভারব্রিজের সামনে এসে আমাদের বাস আবার থামলো। ঘটনা কি? ঘটনা কিছুই না। শহরতলীর কিছু বাস এলোপাতাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সে জন্য ট্রাফিক জ্যামের সৃষ্টি হয়েছে। আশে-পাশে কোনও ট্রাফিক পুলিশ নাই। সে কারণে কেউ কাউকে মানছে না। পাশের ভদ্রলোক নিজেই প্রসঙ্গ তুললেন- এই যে দুর্ভোগ শুরু হলো, দেখবেন গাজীপুর পর্যন্ত যেতে আপনার চান্দি হট হয়ে যাবে।

প্রায় ৫ মিনিট পর খিলক্ষেতের সামনের রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম ছুটলো। গাড়ি একটানে এসে দাঁড়ালো বিমানবন্দরের সামনের রাস্তায়। ওভার ব্রিজের নীচে আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সামনে গাড়ি পেছনেও গাড়ি। নড়ে না চড়ে না। এক সময় গাড়ি চলা শুরু হলো। কিন্তু কচ্ছ্বপের চেয়েও ধীর গতি। বিমান বন্দরের সামনে থেকে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত যেতে সময় লাগলো পাক্কা ৩৫ মিনিট। অথচ এটি বড় জোর ৫ মিনিটের পথ।

টঙ্গী ব্রীজের একটু দূরে আবার বাসটি দাঁড়াল। সামনে পিছনে, ডাইনে বায়ে যেখানেই চোখ যায় শুধুই যান বাহন আর ব্যস্ত মানুষের পায়ে হাঁটা দৃশ্য দেখছি। গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে ড্রাইভার বিরস বদনে কারও সঙ্গে মোবাইলে কথা বলছে। গাড়ির ভিতরে যাত্রীদের অনেকে সকালের ঘুমে কাতর। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝলাম ঢাকা থেকে মাওনায় যাওয়া এবং আসার জন্য যে সময়ের অংক কষে ছিলাম তা মোটেই কার্যকর হবে না। সহযাত্রী লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম- এই যে যানজট... প্রতিদিনই এমন হয়?

হ্যাঁ। আজ তো একটু কমই দেখলেন। অন্যান্য দিন এর চেয়ে আরও বেশি হয়। বিশেষ করে বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে এমন যানজট হয় যে আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।

বৃহস্পতিবারে কেন যানজট বেশি হয়?

পরের দিন সাপ্তাহিক ছুটি থাকার কারনে অনেকে শহর থেকে গ্রামে যায়। কেউ কেউ বেড়াতে যায়...

যানজট কমার লক্ষণ নাই। সহযাত্রীর সঙ্গে কথা বলে বলে সময় কাটানোর কথা ভাবলাম।

ভাই আপনি কি রোজই এভাবে গাজীপুরে যান?

না, মাঝে মাঝে যাই।

গাজীপুরে কি করেন?

একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে কাজ করি।

সাধারনত ঢাকা থেকে গাজীপুরে যেতে কত সময় লাগার কথা?

সহযাত্রী ভেবে নিয়ে বললেন, ট্রাফিক জ্যাম না থাকলে বড় জোর এক থেকে সোয়া এক ঘণ্টা। অথবা ধরেই নেন দেড় ঘণ্টা। কিন্তু বাস্তবে সময় লাগে কখনও আড়াই ঘণ্টা অথবা ৩ ঘণ্টা।

এর কারণ কি? প্রশ্ন করতেই সহযাত্রী বিরক্ত হয়ে বললেন-এর অনেক কারণ আছে ভাই। অন্যতম কারণ হইল গাজীপুরের প্রতি উপর মহলের কোনও নজর নাই। বর্ষার সময় তো দেখছেন ঢাকা টু গাজীপুরের এই রাস্তায় হাটু সমান পানি জমতো। বর্ষা গেছে। আমরা ধারনা করেছিলাম রাস্তাটা ক্লিয়ার হবে। রাস্তা আর ভাঙ্গা চোরা থাকবে না। কিন্তু কিসের কি। রাস্তাটা সংস্কার হয় নাই। ইটের গুঁড়া দিয়া রাস্তা ভরাট করা হইছে। একটু বৃষ্টি হইলেই রাস্তার ভাঙ্গা অংশ বিখাউজের মতো দগদগে হইয়া উঠে। অনেক কষ্টে রাস্তায় গাড়ি চলে। গাড়ির ঝাকুনিতে শরীরের হাড় গোড়ও নড়াচড়া করে। গাড়ি ছাড়ুক, অবস্থা নিজেই টের পাইবেন।

২০ মিনিট পর টঙ্গী ব্রিজে উঠার সুযোগ পেল আমাদের গাড়ি। কিছুদূর ভালোই গেল। হঠাৎ দেখি সামনে প্রচন্ড জ্যাম। ঘটনা কি? ঘটনা হলো পুবাইলের দিকে যাবার জন্য সামনে রেল লাইনের ওপর যে ব্রিজ করা হয়েছে সেই ব্রিজে শুরু হয়েছে যানজট। সে কারণে কোনো দিকেই গাড়ি চলাচল করতে পারছে না। ২০ মিনিট অপেক্ষা শেষে আমাদের বাস আবার যাত্রা শুরু করলো। যতই যাচ্ছি ততই ভাঙ্গা চোরা রাস্তার মুখোমুখি হচ্ছি। রাস্তার দুরাবস্থার কারণে ড্রাইভার ইচ্ছে করেও বাসের গতি বাড়াতে পারছে না। বাস হেলে দুলে কোনও মতে সামনের দিকে থেমে থেমে যাচ্ছে। বোর্ড বাজার পার হয়েও একই অবস্থা।

হঠাৎ ফ্লাশব্যাকে একটা দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো। একবার ঈদের ছুটির আগে আমাদের মাননীয় সড়ক পরিবহন মন্ত্রী এলাকার রাস্তাঘাট পরিদর্শনে এসে রাস্তার বেহাল দশা দেখে যারপর নাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। টেলিভিশনে সেই দৃশ্য দেখে প্রত্যাশা করেছিলাম-অচিরেই হয়তো রাস্তাটির সংস্কার করা হবে।

হঠাৎ একজনের চিৎকারে চমক ভাঙ্গলো। দুই বাসের হেলপার মারামারি শুরু করে দিয়েছে। একজন অন্যজনের বাসকে কেন এগিয়ে নিচ্ছে এটাই মারামারির মূল কারণ। কিন্তু বাস এগিয়ে নিয়ে তো লাভ নেই। সামনে তো পা ফেলারও জায়গা নেই। গাজীপুরের আগে বাইপাস সড়কের সামনে আমাদের বাস ঐ যে দাঁড়িয়েছে আর নড়ার কোনওই লক্ষণ নাই। ড্রাইভার তার ইঞ্জিনে হেলপারকে বসিয়ে রেখে পাশেই কোথাও প্রাকৃতিক কর্ম সারতে চলে গেল। আমার সামনের সীটে বসা এক তরুণ দেখি কাচুমাচু হয়ে এদিক- ওদিক তাকাচ্ছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম- ভাই কোনও সমস্যা?

তরুণ কাচুমাচু হয়েই জবাব দিল সকাল ৯টায় গাজীপুরে আমার একটা ইন্টারভিউ আছে। পরিচিত জনেরা বলেছিল ঢাকা থেকে গাজীপুর যেতে বড় জোর দেড় কি দুই ঘণ্টা লাগবে। ঢাকা থেকে ৬ টায় আমাদের বাস ছেড়েছে। সকাল ৮টার মধ্যে গাজীপুরে পৌঁছার কথা। অথচ ইতিমধ্যে পৌঁনে ৯টা বেজে গেছে। বলেই ছেলেটি বাস থেকে নেমে সামনের দিকে দৌঁড়াতে থাকলো।

বাসের ভিতর নিশ্চুপ বসে আছি। একদিনেই আমার ধৈর্য্যরে বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। অথচ প্রতিদিন এই পথে এমন ভোগান্তির মধ্যেই হাজার হাজার লোক যাতায়াত করে। আহারে! প্রতিদিন তাদের কী অবস্থা হয়? পাশের দেশ ভারতের কলকাতার রাস্তাঘাটের চিত্র চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আমাদের দেশের রাস্তাঘাটের চেয়ে ওদের রাস্তাঘাট ততোটা প্রশস্থ নয়। কিন্তু ওদের রাস্তায় যানজটের বালাই নাই। রেল আর বাসে চড়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ কলকাতার বাইরে থেকে কলকাতায় আসে আবার কাজ শেষে ফিরে যায়। যাতায়াতের ক্ষেত্রে তারা আমাদের মতো এতো দুর্ভোগ পোহায় না। আমরা কী ওদেরটা দেখেও শিখি না।

ঢাকা শহর যেভাবে দিনে দিনে ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে তাতে সরকারের উচিৎ ঢাকার বাইরে বিভিন্ন মফস্বল শহরের সঙ্গে ঢাকার রেল ও সড়ক যোগাযোগ স্বস্তিদায়ক করা। তাহলে অনেকেই ঢাকার বাইরে থেকে ঢাকায় চাকরি ও ব্যবসা বানিজ্য করার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠবে। তখন ঢাকার ওপর কিছুটা হলেও চাপ কমবে।

সেদিন ঢাকা-গাজীপুরের পথ অতিক্রম করতে শেষ পর্যন্ত সময় ব্যয় হয় ৩ঘণ্টা ৫মিনিট। মাওনায় কখন পৌঁছলাম সেটা নাইবা বললাম। তবে একটা কথা বোধকরি বলাই যায়- ঢাকা টু গাজীপুর পথে মাননীয় মন্ত্রী, সাংসদসহ সরকারী কর্মকর্তারা নিশ্চয়ই যাতায়াত করেন। তাদের কি একবারও মনে হয় না এই পথের বিড়ম্বনা দূর হওয়া উচিৎ। মাঝে মাঝেই বাসের পিছনে একটা লেখা দেখি- মামা, ঢাকা কতদূর! এর সঙ্গে মিল রেখে আমার আজকের লেখার শিরোনাম দিতে চাই- মামা, গাজীপুর কতদূর!

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, পরিচালক, সম্পাদক আনন্দ আলো

/এফএএন/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বৈশাখী মেলায় গানের আয়োজন, কমিটির সঙ্গে দর্শকদের সংঘর্ষে নিহত ১
বৈশাখী মেলায় গানের আয়োজন, কমিটির সঙ্গে দর্শকদের সংঘর্ষে নিহত ১
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ