X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জিপিএ-তে অগ্রযাত্রা, বিজ্ঞান চর্চায় পেছন যাত্রা!

চিররঞ্জন সরকার
০১ জানুয়ারি ২০১৮, ১৬:০৩আপডেট : ০১ জানুয়ারি ২০১৮, ১৬:০৬

চিররঞ্জন সরকার দেশে জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষায় বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী জিপিএ পাচ্ছে। কিন্তু আমরা ক্রমেই বিজ্ঞানবিমুখ জাতিতে পরিণত হচ্ছি। বিজ্ঞানের চর্চা নেই, প্রসার নেই, বিজ্ঞান চর্চায় উৎসাহও নেই। বিজ্ঞানের এই হালের জন্য দায়ী আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। অঙ্কে বা বিজ্ঞানে যারা একশোয় একশো পাচ্ছে, জিপিএ পাচ্ছে, তাদের একটু অন্য ধরনের প্রশ্ন করলে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ঠিক উত্তর দিতে পারে না। কারণ ছোটবেলা থেকে তারা মুখস্থ-শক্তির ওপর জোর দেয়। গণিত এবং বিজ্ঞানে যে প্রভূত কল্পনাশক্তির দরকার হয়, তা আমরা বুঝি না। তার ফলে ছোটবেলা থেকে ছাত্রদের স্বাধীন চিন্তা করার সুযোগ দেওয়া হয় না।
আর বিজ্ঞানের যে কদর নেই এ কথা একশো ভাগ সত্য। আমাদের সংবাদপত্রে বা টিভিতে বুদ্ধিজীবী হিসেবে সিনেমা-থিয়েটারের লোক এবং পলিটিক্যাল সায়েন্স বা ইতিহাসের অধ্যাপক ছাড়া আর কেউ পাত্তা পান না। বিজ্ঞানী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারদের সম্পর্কে ধরেই নেওয়া হয়, তারা তাদের বিষয়টার বাইরে কিছুই জানেন না। অথচ সবচেয়ে বুদ্ধিমান শিক্ষার্থীরাই এই সব সাবজেক্ট নেন। কোনও সমাজে বিজ্ঞানীদের যোগ্য সম্মান না দেওয়া হলে, মৌলিক বিজ্ঞানে ভালো কাজ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

এক সময়, এমনকি আমাদের ছোটবেলায়ও বিজ্ঞানচর্চার যে সমাদর ছিল, এখন তার ধারে কাছেও কেউ নেই। তার মানে এই নয়, যে এখন ভালো ছাত্রের অভাব দেখা দিয়েছে। এখন সবাই ছুটছে কমার্সের দিকে। হ্যাঁ, ভালো ছাত্রদের দেশের বাইরে পাঠানোর অসম্ভব স্পৃহা তৈরি হয়েছে বাবা-মায়ের। এদের সামান্য অংশ যায় উচ্চতর শিক্ষার জন্য, বেশিরভাগই সমৃদ্ধ জীবনযাপনের আকাঙ্ক্ষায়। এটাও ঠিক, বিদেশে টাকা তো বেশিই, সঙ্গে সুবিধা এবং স্বাধীনতাও বেশি।

দেশে মৌলিক বিজ্ঞানের গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়েনি। আমাদের দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বাজেট বিদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের তুলনায় কম। কোরিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম সহ অন্যান্য যে সব দেশ ৫০ বছর আগেও উন্নয়নের মাপকাঠিতে প্রায় আমাদের কাতারে ছিল, তারা জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিয়ে আকাশচুম্বী সাফল্য লাভ করেছে৷ অথচ উন্নয়ন ও উৎপাদনবিমুখ পরিকল্পনার কারণে আমরা পিছিয়ে আছি।  অতীতে জাপান, জার্মানি থেকে যে পণ্য আমদানি করা হতো এখন সেটি করা হচ্ছে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত কিংবা চীন থেকে। বিজ্ঞান চর্চা, বিজ্ঞান গবেষণায় আমরা ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছি। ফলে নতুন নতুন উদ্ভাবন ও আবিষ্কারেও আমাদের অবস্থান তলানিতে।  

একসময় প্রতিটি স্কুলের শ্রেষ্ঠ ছাত্ররা বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার জন্য রোমাঞ্চ অনুভব করতো, এখন বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্ররা পদার্থ  বিজ্ঞান কিংবা রসায়ন শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করে ব্যবসা শিক্ষায় ভর্তি হওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চেষ্টা করছে। এভাবে দেশের পয়সায় অর্জিত বিদ্যার সঠিক প্রয়োগের পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। ৩০-৪০ বছর পূর্বে এরকম প্রবণতা ছিল না। এতে বোঝা যায়, বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহী হওয়ার মতো প্রণোদনা শিক্ষার্থীরা দেখতে পারছে না। দেশে এত মোবাইল, কিন্তু মোবাইল তৈরির একটি কারখানা পর্যন্ত নেই। একই কথা প্রযোজ্য কম্পিউটারের জন্য। যদিও আমাদের ব্র্যান্ড দোয়েল ল্যাপটপ অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বাজার থেকে উধাও হয়েছে। বিজ্ঞান বিভাগগুলোতে স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থী সংখ্যাও কমেছে। অথচ দেশকে এগিয়ে নিতে হলে বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও কারিগরি শিক্ষার বিকল্প নেই। স্কুল, কলেজের পড়ালেখার মান যে কমেছে তার একটি প্রমাণ হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় বোর্ডের সর্বোচ্চ গ্রেডধারি ছাত্রদের অসহায় পরিণতি।

অথচ আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগেও বাংলায় বিজ্ঞানের কদর ছিল। বিজ্ঞানের জগৎসভায় বাংলা থেকে যে বিজ্ঞানচর্চা এবং আবিষ্কারের উৎকৃষ্টতা ছিল। মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রভৃতি বহু বিজ্ঞানী সারা পৃথিবীতে সমাদৃত ছিলেন। পরবর্তীকালে পি সি রায়, ড.কুদরাত-এ-খুদা, জামাল নজরুল ইসলামের মতো নামকরা বিজ্ঞানী জন্মেছেন এখানে। জন্মেছেন মাকসুদুল আলমের মতো বিজ্ঞানী ।

বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের মাধ্যমে দেশের বাইরে খ্যাতিমান হয়েছেন ডাক্তার শাহ এম ফারুক, ড. আনিসুর রাহমান, ড. জামালউদ্দিন, আবেদ চৌধুরী, আব্দুস সাত্তার খান, ড. আতাউল করিম, অধ্যাপক আবুল হুসসাম, রেজাউল করিম, শুভ রায়, ড. মুশফিক আহমদ ও ড. অধ্যাপক ওসমান গনি তালুকদার প্রমুখ বিজ্ঞানী।

মেঘনাদ সাহার ‘সাহা আয়নাইজেশান তত্ত্ব’ জগৎবিখ্যাত; এখনও পর্যন্ত এই সমীকরণ দিয়ে অনেক উঁচু মাপের কাজ হয়। রকেটগুলির আকাশে বিচরণ বোঝার জন্যে ‘সাহা সমীকরণ’ লাগানো হয়। আবার ব্রহ্মাণ্ডের আদি মুহূর্তে সৃষ্টির মাইক্রোসেকেন্ড পরেই কী করে পদার্থ এলো, হাইড্রোজেন, হিলিয়াম ইত্যাদি সৃষ্টি হলো, তাতেও ‘সাহা সমীকরণ’ লাগানো হয়। অন্য দিকে, সত্যেন্দ্রনাথ বসুর গবেষণা থেকে উৎপত্তি হয়েছিল বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়নের। বিরাট আবিষ্কার। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু শুধু রেডিয়ো তরঙ্গই আবিষ্কার করেননি, যে কল থেকে এই তরঙ্গ বেরিয়ে আসছে সেই কলটি সমস্তটাই নিজে হাতে তৈরি করেছিলেন, যেটা কিনা সারা পৃথিবীতে আলোড়ন তুলেছিল। আচার্য উদ্ভিদ নিয়েও নতুন নতুন আবিষ্কার করেছিলেন। সেই কাজে যে সব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেছিলেন, তারা অতি সূক্ষ্ম ও আধুনিক এবং এগুলো এখানেই তৈরি।

এই উদাহরণগুলো দিয়ে বোঝাতে চাইছি যে, ওই সময়ে বাংলায় শুধু বিজ্ঞানচর্চাই হতো না, তা ছিল শ্রেষ্ঠ মানের, কিন্তু আবিষ্কারগুলো যারা করেছিলেন তারা বাংলাতেই থাকতেন, যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সেগুলোরও পৃথিবীতে প্রচুর নামডাক হয়েছিল। বিদেশে এরা বহুবার গিয়েছিলেন, কিন্তু দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই তারা তা করেছিলেন।

বর্তমানে কেউ কেউ বিভিন্ন উন্নত দেশে গিয়ে নাম বিজ্ঞানে সুনাম ও সাফল্য অর্জন করেছেন। কিন্তু তারা তা করেছেন স্বদেশের সঙ্গে পুরোপরি বিচ্ছিন্ন হয়ে। সব রকম সম্পর্ক ছেদ করে।

বাঙালির মধ্যে এখন আশ্চর্য এক প্রবণতা কাজ করে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি বাবা-মা কোনোরকমে ছেলেপুলেদের ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া পাঠাতে পারলেই পরম শান্তিতে থাকে, বাংলাদেশে কী হলো না হলো, সেটা নিয়ে মাথাব্যথা করে না।

আর শিক্ষা ক্ষেত্রে অধঃপতন আমাদের দেশে চরম আকার ধারণ করেছে। এখন পরীক্ষা মানেই হচ্ছে প্রশ্নপত্র ফাঁস, তা সে প্রথম শ্রেণির শিশুদের পরীক্ষাই হোক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাই হোক আর চাকরিতে নিয়োগ পরীক্ষাই হোক। এদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মান ধাপে ধাপে নিচে নামতে শুরু করেছে। শিক্ষার যে একটা কৃষ্টি আছে, তার মধ্যে যে সভ্যতার আলো ফুটে ওঠে, সেটা এক কালে ছিল, এগুলি মুখস্থ করার কারখানা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাঙালি নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি করে, প্রতিষ্ঠানগুলোকে একশো ভাগ সরকারের হাতে সমর্পণ করেছে, আর তারা রাজনীতির ধাক্কায় শিক্ষার কতটা উন্নতি করতে পেরেছেন, সেটা বলা শক্ত। উল্টো শিক্ষার মান দিন দিন নিচে চলেছে। এর সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানের কদরও কমেছে আজকের বাঙালি সমাজে। ক্রিকেট, ফুটবল, সিনেমায় কারা নায়ক, বাঙালি যুবক খুব ভালো করে জানে বা জানতে ইচ্ছুক। কিন্তু বিজ্ঞানের জগতে কী হচ্ছে, এই বাংলায় সেটা জানবার কোনও স্পৃহা নেই।

বাংলায় মেধাবী ছাত্রছাত্রীর অভাব নেই, কিন্তু সে একা কাজ করবে, সম্মিলিত ভাবে কাজ করা তার ধাতে নেই। আর, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোটাই এমন হয়েছে যে সেই মেধা পালিয়ে বাঁচে। কোনও একজন মানুষকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।

প্রশ্নপত্র ফাঁস, পাঠ্যপুস্তকে যত্রতত্র ভুল, বোর্ডের মূল্যায়নে সর্বোচ্চ গ্রেড পেয়েও ছাত্রদের দক্ষতা প্রদর্শনে ব্যর্থতা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয়ে ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকদের নাভিশ্বাস অবস্থা এবং সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গ্রহণযোগ্য সমাধান দিতে ব্যর্থতা, ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সকলেরই কোচিং সেন্টারমুখী গতি, বেআইনি সহায়ক পুস্তকের শক্তিশালী অবস্থান, এগুলো সবই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার নেতিবাচক দিক, যার ফলে জনগণ আস্থা রাখতে পারছে না। বেশ কয়েক বছর পূর্বে শিক্ষা কমিটি ন্যূনতম সময়ে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিল, যেখানে দেশের আগ্রহী জনগোষ্ঠীর মতামতও গ্রহণ করা হয়েছিল৷ তবে এই শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের কাজ নজরে পড়ছে না৷

একসময় উন্নয়নের মাপকাঠিতে সমকাতারে দাঁড়িয়ে থাকা কোরিয়া, মালয়েশিয়া শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে অনেক উন্নত হয়েছে। আমাদের বিশ্বাস করতে হবে, দেশের মানুষের কায়িক পরিশ্রমে আমরা এমনকি মধ্যম আয়ের দেশও হতে পারবো না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পথটিই আমাদের উন্নয়নের পথ। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার এ দেশে একমাত্র মানবসম্পদ উন্নয়নেই আমাদের ভবিষ্যত নির্ভর করছে। তাই শিক্ষায়, বিশেষত বিজ্ঞান-শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ গড়ার সুকঠিন দায়িত্ব যারা নিয়েছেন দেশের উন্নয়নে শিক্ষার গুরুত্ব তারা অনুধাবন করবেন এবং শিক্ষাকে, বিজ্ঞান-শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে তারা আমাদের দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবেন, এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: কলামিস্ট

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ