X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচনকালীন সরকার বলে কিছু আছে?

আমীন আল রশীদ
২১ জানুয়ারি ২০১৮, ১৪:১৩আপডেট : ২১ জানুয়ারি ২০১৮, ১৪:১৫

আমীন আল রশীদ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য হাতে আছে আরও অন্তত ১১ মাস। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের ২৪ দিন পরে, ২৯ জানুয়ারি শুরু হয় ১০ম সংসদের যাত্রা। সে হিসেবে ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচন হতে হবে। গত ১২ জানুয়ারি এই মেয়াদে সরকারের চার বছর পূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, চলতি বছরের শেষে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে এবং এর আগে গঠিত হবে নির্বাচনকালীন সরকার––যে সরকার নির্বাচন কমিশনকে সর্বোতভাবে সহায়তা দেবে। প্রশ্ন হলো, সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকার বলে আদৌ কিছু আছে কিনা? যদি না থাকে তাহলে প্রধানমন্ত্রী যে ধরনের সরকার গঠনের কথা বলেছেন, সেটি কিসের ভিত্তিতে হবে?

সংবিধানে অন্তর্বর্তী বা নির্বাচনকালীন সরকারের সুস্পষ্ট রূপরেখা না থাকলেও এ বিষয়ে কিছু ইঙ্গিত রয়েছে। ৫৬ (৪) অনুচ্ছেদে বলা আছে, সংসদ ভেঙে যাওয়া এবং সংসদ-সদস্যদের অব্যবহিত পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তীকালে কাউকে মন্ত্রী নিয়োগ করার প্রয়োজন দেখা দিলে সংসদ ভেঙে যাওয়ার অব্যবহিত আগে যারা সংসদ-সদস্য ছিলেন, তারা বহাল থাকবেন। ফলে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচন সামনে রেখে যদি সংসদ ভেঙে দেওয়া হয় অথবা সংসদ বহাল রেখেই একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হয়, তারপরও সংসদ সদস্যরা তাদের পদে বহাল থাকবেন। আর ওই অন্তর্বর্তী মন্ত্রিসভার সদস্য নিতে হবে সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকেই। একটা বিতর্ক এরকম আছে যে, সংসদীয় ব্যবস্থায় সংসদ ভেঙে দিলে সরকার থাকবে কিনা? এই প্রশ্নের জবাব আমাদের সংবিধানের এই ৫৬ অনুচ্ছেদ দিচ্ছে। অর্থাৎ নির্বাচনের তিন মাস আগে যদি সংসদ ভেঙেও দেওয়া হয় তারপরও সংসদ সদস্যরা স্বপদে বহাল থাকবেন। শুধু ওই সময়ে সংসদের অধিবেশন বসবে না। কিন্তু সংসদ সদস্য হিসেবে তারা যেসব সুযোগ-সুবিধা এবং প্রিভিলেজ (বিশেষ সুবিধা) ভোগ করেন, সংসদে ভেঙে দেওয়ার পরও সেগুলো অব্যাহত থাকবে কিনা, তা পরিষ্কার নয়।

আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি নির্বাচনকালীন সরকারের একটি রূপরেখা দেবে বলে এর আগে শোনা গেলেও এখনও সে বিষয়ে তারা খোলাসা করে কিছু বলেনি। বরং ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পর তারা বলেছে, এই ভাষণ দেশকে আবারও অস্থিতিশীল করে তুলবে। বিএনপির মূল আপত্তির জায়গাটা হলো নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার না থাকা। কিন্তু বর্তমান সংবিধানের আলোকে সেটি সম্ভব নয়। কেউ কেউ মনে করেন, নির্বাচনকালীন সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা থাকলেও যদি তারা নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেয়, তাহলেও বিএনপি নির্বাচনে আসবে। যদিও এ বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে একটি নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল। তখন বিএনপি সংসদে থাকলেও তারা এই সরকারে তাদের কোনও প্রতিনিধি দেয়নি। এমনকি তারা ওই নির্বাচন বয়কট করে। তবে আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে যখন আবার এই অন্তর্বর্তী বা নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি আলোচনায় এলেও সাংবিধানিকভাবে এবার আর বিএনপির কাছে প্রতিনিধি চাওয়ার সুযোগ নেই। কেননা, মন্ত্রিসভার আকার যাই হোক না কেন, সেখানে প্রতিনিধি আসতে হবে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দল থেকেই। সংবিধানের পরিষ্কার নির্দেশনা, সংসদ ভেঙে দেওয়ার অব্যবহিত পূর্বে যারা সংসদ সদস্য ছিলেন, তাদের মধ্য থেকেই মন্ত্রী নিয়োগ করতে হবে। আবার ৫৮-এর ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সংসদ ভেঙে যাওয়া অবস্থায় যেকোনও সময়ে কোনও মন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল করা যাবে।

এর উদাহরণ আমরা ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে দেখেছি। তখন সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা যেমন ছিলেন, তেমনি অনেকে মন্ত্রী ছিলেন। কাউকে কাউকে নতুন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তার মানে আনুষ্ঠানিকভাবে সংসদ না থাকলেও সরকার থাকবে এবং সরকারপ্রধান যেভাবে চাইবেন, সেভাবেই মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারবেন। সেখানে সর্বনিম্ন বা সর্বোচ্চ কতজন সদস্য থাকবেন, তার কোনও স্পষ্ট নির্দেশনা নেই।

তবে সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় নির্বাচন নিয়ে যাতে জটিলতার সৃষ্টি না হয় সেজন্য সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, একটি অধিবেশন শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে পরবর্তী অধিবেশন শুরুর বাধ্যবাধকতা থাকলেও নির্বাচনের পূর্ববর্তী (যে সময়কালকে বলা হচ্ছে নির্বাচনকালীন বা অন্তর্বর্তী সরকারের সময়) ৯০ দিনের মধ্যে সংসদের অধিবেশন বসবে না। অর্থাৎ আদতে সংসদ থাকলেও এর কার্যক্রম স্থগিত থাকবে। কিন্তু সরকার তার রুটিনকাজ চালাতে পারবে। 

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর সময়ে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়, তখন ওই সংশোধনীর জন্য গঠিত বিশেষ কমিটির সামনে অনেকগুলো সুযোগ ছিল। তারা বাহাত্তরের আদি সংবিধানের আলোকে চারটি মূলনীতি যেমন ফিরিয়ে এনেছিলেন, তেমনি পুরো সংবিধানে ব্যাপক রদবদল করেন। ফলে তারা যখন নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করেন, তখন তাদের সামনে এর বিকল্প হিসেবে নির্বাচনকালীন একটি অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা ঠিক করে দেওয়ার সুযোগ ছিল যা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ সুগম করতো। কিন্তু বিশেষ কমিটি তা করেননি। ফলে নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে সে বিষয়ে একটা ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। নানাজন এর নানারকম ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তাছাড়া সংবিধানে নির্বাচনকালীন/অন্তর্বর্তী/সহায়ক বা এরকম কোনও শব্দও উল্লেখ নেই।

১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পরে বিএনপির প্রতিক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ায় তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, ‘সংলাপে বসতে হলে বিএনপির পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট সাংবিধানিক প্রস্তাব আসতে হবে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট সাংবিধানিক কোনও প্রস্তাব পাওয়া যায়নি। রূপরেখাহীন কোনও প্রস্তাব নিয়ে সরকার আলোচনায় বসবে না।’ প্রশ্ন হলো, বিএনপি যদি নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট রূপরেখা বা প্রস্তাব দেয়, সেটি কি সরকার গ্রহণ করবে? নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে যেহেতু ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতায় আসার কোনও নজির বাংলাদেশে নেই, সুতরাং এমন কোনও বিধান সরকার কি সংবিধানে যুক্ত করবে যাতে নির্বাচনে সে হেরে যাবে? সেই ঝুঁকি সরকার কেন নেবে? আওয়ামী লীগের জায়গায় এখন বিএনপি থাকলে তারা কি সেটা করতো?

কথা হচ্ছে, জাতীয় নির্বাচনের প্রসঙ্গ এলেই কেন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের কথা আসে? আমাদের প্রতিবেশী ভারতে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই লোকসভা ও বিধানসভার নির্বাচন হয়। কিন্তু সেখানে ভোটে কারচুপি, ব্যালট ছিনতাই বা ফলাফল উল্টে দেওয়ার কোনও অভিযোগ ওঠে না। বিরোধী শিবির থেকেও ভোট বর্জনের আওয়াজ ওঠে না। কিন্তু স্বাধীনতার প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরেও আমরা কেন একটি সুষ্ঠু নির্বাচনব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলাম না? দীর্ঘ আন্দোলন আর রক্তপাতের পরে যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান যুক্ত করা হয়েছিল সেটি বাতিল করে কেন আবার নতুন করে রক্তপাতের সূচনা করা হলো? যদি ওই বিধানটি অসাংবিধানিকই হবে, তাহলে কেন ১৯৯৬ সালে এরকম একটি বিধান যুক্ত করা হলো? এটি যে অসাংবিধানিক সেটি বুঝতে আমাদের কেন আমাদের ১৫ বছর (২০১১ সালে বাতিল) লাগলো? যদি এই বিধান অসাংবিধানিক হবে তাহলে আমরা কেন এখনও সংবিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারছি না? কেন নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ধোঁয়াশা থেকে যাবে?

লেখক: সাংবাদিক 

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সবজির বাজার ঊর্ধ্বমুখী, তীব্র গরমকে দুষছেন বিক্রেতারা
সবজির বাজার ঊর্ধ্বমুখী, তীব্র গরমকে দুষছেন বিক্রেতারা
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কথা না বলতে আদালতের নির্দেশ
ইমরান খান ও বুশরা বিবিরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কথা না বলতে আদালতের নির্দেশ
বিতর্কিত আউটের ছবি পোস্ট করে মুশফিক লিখলেন...
বিতর্কিত আউটের ছবি পোস্ট করে মুশফিক লিখলেন...
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ