X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিচারালয়ে যা হচ্ছে...

আমীন আল রশীদ
০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১২:০৭আপডেট : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৭:১৮

আমীন আল রশীদ দেশের বিচার বিভাগে গত তিন মাসে যে চারটি (তিনটি উচ্চ আদালতে, একটি বিশেষ জজ আদালতে) বড় ঘটনা ঘটলো, তার রাজনৈতিক তাৎপর্য অনেক। বিশেষ করে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আইনের শাসন নিশ্চিত করা এবং আইন ও নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের যে মাঝেমধ্যেই টানাপড়েন তৈরি হয়, সেই বাস্তবতায় প্রধান বিচারপতির পদ থেকে এস কে সিনহার ‘বাধ্যতামূলক’ পদত্যাগ, নতুন প্রধান বিচারপতি হিসেবে আপিল বিভাগের দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে নিয়োগ এবং তিন মাস প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে থাকা আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞার পদত্যাগ অনেক সমীকরণের জন্ম দেবে।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণার পর থেকেই দেশের প্রধান দুই দলের নেতারা যে রিঅ্যাকশন দেখিয়েছেন তা শোভনীয় ছিল না। বিচারকরা সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং নিজেদের কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে বিচার করেন এটা যেমন সত্যি, তেমনি যখন কোনও একটি বিশেষ মামলার ব্যাপারে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা অব্যাহতভাবে কথা বলতে থাকেন, সেটি আদালতের ওপর একধরনের প্রভাব বিস্তার করে। ফলে রায়ের ঠিক আগের দিন এই মামলার প্রধান আসামি খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন ডেকে যেসব কথা বলেছেন, তাতে মনে হয়েছে, তিনি ধরেই নিয়েছেন যে তার সাজা হচ্ছে। কিন্তু একজন আসামি, তার রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত পরিচয় যাই হোক না কেন, তিনি রায়ের আগের দিন এরকম সংবাদ সম্মেলনে নিজের প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেন কিনা, সেটি একটি প্রশ্ন বটে। তবে খালেদা জিয়ার এই রায় যে আগামীর রাজনীতি বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনকে যে প্রভাবিত করবে, সে বিষয়ে সন্দেহ কম। যদিও এখনও তার উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
তাই আপাতত খালেদা জিয়ার প্রসঙ্গটি পাশে রেখে আমরা বরং সেই উচ্চ আদালতের দিকে একটু নজর দিতে চাই। এখানে গত তিন মাসে, বিশেষ করে সদ্যবিদায়ী প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ছুটি ও পদত্যাগের পরে যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাবে দেশের সামগ্রিক শাসন প্রক্রিয়াকে। তাই এস কে সিনহা এবং ওয়াহহাব মিঞার এই পদত্যাগ ইস্যুতে দেশের বিচার বিভাগ যে কিছুটা অস্বস্তিতে পড়লো বা সর্বোচ্চ আদালত সম্পর্কে মানুষের মনে যে কিছুটা আস্থার সংকট তৈরি হলো বলে প্রতীয়মাণ হচ্ছে, সেটি মোকাবিলা করাই বোধ হয় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেবে নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতির সামনে। বিশেষ করে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর যে রায় নিয়ে দেশের বিচার বিভাগে পরপর এতগুলো ঘটনা ঘটে গেলো, সেই রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের রিভিউ আবেদনের শুনানিতে কী হয়, নতুন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগ বিষয়টি কীভাবে মোকাবিলা করেন, সেদিকে দেশবাসীর নজর থাকবে।

গত ৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গভবনে রাষ্ট্র্রপতি আবদুল হামিদ দেশের ২২তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ পড়ান সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে। বাস্তবতা হলো, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ছুটিতে যাওয়ার পরে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি হিসেবে ওয়াহহাব মিঞাকে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি করা হলেও তাকে যে শেষমেষ প্রধান বিচারপতির আসনে বসানো হবে না, তা মোটামুটি নিশ্চিত ছিল। কারণ সিনহাকে নিয়ে আওয়ামী লীগ যে ধরনের অস্বস্তিতে পড়েছিল, সেই একই ঝুঁকি তারা নির্বাচনের বছরে গিয়ে নিতে চায়নি। তাছাড়া যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে যেখানে সব বিচারপতি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন, সেখানে আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা সাঈদীকে বেকসুর খালাস দিয়েছিলেন। আপিল আবেদনের লিখিত রায়ে তিনি বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে আনীত কোনো অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি।’ আরেক যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনীত ৬টি অভিযোগে মধ্যে ৫টিতেই খালাস দেন ওয়াহহাব মিঞা। ফলে যে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করেছে এবং রাঘব-বোয়াল যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিতদের রায় কার্যকরও করেছে, তারা যে সাঈদীকে বেসকুর খালাস দেওয়া বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি বানাবে না, সেটি সহজেই অনুমেয়। তাছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়েও ভিন্ন অবস্থান নিয়ে ওয়াহহাব মিঞা এই ব্যবস্থা আরও দুই মেয়াদ রাখার সুপারিশ করেছিলেন।

প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে তাকে এস কে সিনহা ছুটিতে যাওয়ার পরে দায়িত্বপ্রাপ্ত করা হলো কেন? কারণ, এস কে সিনহার মেয়াদ ছিল ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। এই সময়টুকুতে সরকার কোনও ধরনের বিতর্কে যেতে চায়নি। তাই সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদের বিধান (প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য হইলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোন কারণে প্রধান বিচারপতি তাঁহার দায়িত্বপালনে অসমর্থ বলিয়া রাষ্ট্রপতির নিকট সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইলে ক্ষেত্রমত অন্য কোন ব্যক্তি অনুরূপ পদে যোগদান না করা পর্যন্ত কিংবা প্রধান বিচারপতি স্বীয় কার্যভার পুনরায় গ্রহণ না করা পর্যন্ত আপীল বিভাগের অন্যান্য বিচারকের মধ্যে যিনি কর্মে প্রবীণতম, তিনি অনুরূপ কার্যভার পালন করিবেন) মেনে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি হিসেবে তাকেই অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু যেহেতু প্রধান বিচারপতি করার ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতার নীতি মানার কোনও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নেই, অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি চাইলে আপিল বিভাগের যেকোনও বিচারপতিকেই প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব দিতে পারেন, সে কারণে সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে রাষ্ট্রপতি (মূলত সরকার) অধিকতর আস্থাভাজন মনে করছেন।

তবে নতুন প্রধান বিচারপতির সামনে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। দায়িত্ব নেওয়ার পরে তিনি বলেছেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের আইন, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমেই কেবল একটি দেশের উন্নয়ন হতে পারে। দায়িত্ব গ্রহণের দিন ৪ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ও অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট যেন সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে থেকে সংবিধান অনুসারে তার নিজ দায়িত্ব পালন করে, সেটিও আমি নিশ্চিত করতে চেষ্টা করবো।’ বিচার বিভাগের জন্য বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি, বিচারকদের জন্য দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, দেশে একটি ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমি প্রতিষ্ঠা, মামলা অনুপাতে বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিচার প্রক্রিয়ার গতি ত্বরান্বিত করতে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালানো ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণকে তিনি তার প্রাথমিক লক্ষ্য বলে ঠিক করেছেন।

এটা ঠিক যে, বিচারকদের অপসারণ সম্পর্কিত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রায় এবং অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধির গেজেট প্রকাশ ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে বিচার বিভাগের যে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে, সেই শূন্যতা পূরণ খুব সহজ কাজ নয়। তাছাড়া বিচার ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনা, মামলাজট নিরসন, আদালত অঙ্গনের অনিয়ম রোধ, বিচারক স্বল্পতা কাটানো এবং বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ ডিজিটালাইজ করার মতো চ্যালেঞ্জও রয়েছে নতুন প্রধান বিচারপতির সামনে।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ও অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, ‘আদালতের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বড় একটি অংশ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। এভাবে চলতে থাকলে যারা এখনও সততার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের পক্ষেও সততা বজায় রাখা কঠিন হবে।’ রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তাও যেখানে আদালতের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে এতটা উদ্বিগ্ন, তখন এর ভয়াবহতা সহজেই অনুমেয়। আদালতের রায় নিয়ে জালিয়াতির প্রবণতাও লক্ষ্যণীয়। আদালত থেকে জামিন দেওয়া হয়নি, অথচ জামিনের কাগজ তৈরি করে আসামিরা জেল থেকে বেরিয়ে গেছে–এরকম ঘটনা ঘটেছে। সুতরাং এসব অনিয়ম রোধে নতুন প্রধান বিচারপতি সক্ষমতার পরিচয় দেবেন বলে আশা করা যায়।

আমাদের বিচার বিভাগের একটা বড় চ্যালেঞ্জ মামলার জট। এর প্রধান কারণ প্রচলিত আইনের অস্বচ্ছতা। কারণ ত্রুটিপূর্ণ ও সেকেলে আইনের ফলে মামলার সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলছে। দেশের নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত মামলার ভারে জর্জরিত। এর আরেকটা কারণ বিচারক সঙ্কট। যুক্তরাষ্ট্রে ১০ লাখ মানুষের জন্য ১০৭ জন, কানাডায় ৭৫ জন, ইংল্যান্ডে ৫১ জন, অস্ট্রেলিয়ায় ৪১ জন এবং ভারতে যেখানে ১৮ জন বিচারক রয়েছেন, সেখানে বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য বিচারক মাত্র ১০ জন। অর্থাৎ এক লাখ মানুষের জন্য মাত্র একজন বিচারক। বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারক সঙ্কট রয়েছে। ফলে দ্রুতই এই সঙ্কট কাটাতে নতুন প্রধান বিচারপতি উদ্যোগী হবেন বলে আশা করা যায়।

বিচারকদের দক্ষতা নিয়ে নানা সময়েই প্রশ্ন উঠেছে। কারা কোন প্রক্রিয়ায় এবং কোন বিবেচনায় বিচারক হন, তা প্রশ্নাতীত নয়। আবার বিচারক নিয়োগে একটি আইন করার কথাও শোনা যাচ্ছে অনেক দিন ধরে। সুতরাং এই ক্ষেত্রে নতুন প্রধান বিচারপতি কী করবেন বা কতটুকু করতে পারবেন, সেদিকে দেশবাসীর দৃষ্টি থাকবে বলে মনে হয়।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে নতুন প্রধান বিচারপতির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সম্ভবত বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা। এখনও দেশের মানুষ তাদের সবশেষ ভরসার স্থল হিসেবে বিচার বিভাগকেই বিবেচনা করে। কেউ যদি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়, কেউ যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়, যদি সে রাষ্ট্রের কোথাও গিয়ে ন্যায়বিচার না পায়, শেষমেষ সে ভরসা করে উচ্চ আদালতের ওপর। নানা সময়ে উচ্চ আদালত বা বিচারপতিরা নানাভাবে বিতর্কিত করলেও, এখনও মানুষের আস্থার জায়গা এই সাদা ভবনটি। সুতরাং নতুন প্রধান বিচারপতি দেশের সাধারণ মানুষের আশা-ভরসার স্থল এই ভবনটিকে যেকোনও ধরনের রাজনীতি, দুর্নীতি আর পেশীশক্তির প্রভাবমুক্ত রাখতে সচেষ্ট হবেন, এটিই প্রত্যাশা।

একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘বিচার বিভাগের কর্ম দক্ষতার ওপর একটি দেশের সভ্যতার চরিত্র পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।’ তার মতে, কোনও দেশের সরকারের কৃতিত্ব পরিমাপ করার সর্বোত্তম মাপকাঠি হচ্ছে বিচার বিভাগের দক্ষতা ও যোগ্যতা।

লেখক: সাংবাদিক ও লেখক।

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাজধানীতে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় স্কুল শিক্ষার্থীসহ নিহত ২
রাজধানীতে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় স্কুল শিক্ষার্থীসহ নিহত ২
ঢামেক হাসপাতালে কারাবন্দীর মৃত্যু
ঢামেক হাসপাতালে কারাবন্দীর মৃত্যু
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ