X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কথা না রাখার রাজনীতি ও বিএনপি

চিররঞ্জন সরকার
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১২:৫১আপডেট : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৩:০০

চিররঞ্জন সরকার আমাদের দেশে কারা সবচেয়ে বেশি কথা দেয় এবং সবচেয়ে কম কথা রাখে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কারণ, এ বিষয়ে তেমন কোনও গবেষণাকর্ম চোখে পড়েনি। তবে আমাদের চারপাশের মানুষগুলোকে পর্যবেক্ষণ করলে খুব সহজেই চোখে পড়ে রাজনীতিকদের কথা দেওয়া এবং কথা না রাখার বিষয়টি।
যদিও এর কারণ আছে। আমাদের দেশের মানুষের চাহিদা ও দাবি-দাওয়ার কোনও শেষ নেই। কেবলই দাও দাও। রাজনীতিবিদরা যখন সাধারণ মানুষের সমর্থন পেতে চান তখন তাকে নানা প্রতিশ্রুতি দিতে হয়। কারণ, রাজনীতিবিদদের কাছে সাধারণ মানুষ অনেক রকম দাবি-দাওয়া নিয়ে হাজির হন। প্রতিশ্রুতি বা কথা না দিয়ে রাজনীতিবিদদের কোনও উপায় থাকে না। তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ। প্রতিশ্রুতি প্রদানেও যদি ব্যর্থ হন তাহলে তো তাদের কোনও যোগ্যতাই থাকে না। তাই তারা উদারচিত্তে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান। এই প্রতিশ্রুতি পালনের দায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থাকে না। প্রতিশ্রুতি পালনের বাধ্যবাধকতা যদি না থাকে তাহলে প্রতিশ্রুতি রক্ষার বিড়ম্বনা পোহায় কোন পাগল?

কথার খেলাপ করা যদিও রাজনীতির অন্যতম অলংকার, তবুও দীর্ঘমেয়াদে দেখা গিয়েছে কথা না রাখার প্রবণতাই প্রিয় রাজনৈতিক দল বা নেতাদের জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সোজা কথায় পতনেরও অন্যতম অনুঘটক। একটি কোনও আদর্শ অথবা প্রতিশ্রুতি কিংবা উজ্জ্বল অবস্থানকে সামনে বিজ্ঞাপন হিসাবে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো জনমনে স্থান পেতে উদ্যোগী হয়। কিন্তু ক্ষমতায় এসে তারা সেই নিজেদের ঘোষিত অবস্থান থেকে হয় সরে আসছে অথবা মানুষকে বোকা বানানোর জন্য হাস্যকর যুক্তির অবতারণা করে চলে। এটা সর্বকালে সর্বদেশে দেখা গিয়েছে। আমরা সর্বকালে সর্বদেশের গভীর ইতিহাস চেতনায় ঢুকবো না। আমরা বরং দেখি আমাদের দেশে কী কী হচ্ছে। এদেশে মৌলবাদী উত্থান নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার চেয়েও আজকাল বেশি যে চর্চাটি শোনা যায় তা হলো পরস্পরকে সকলেই একটি কমন প্রশ্ন করে। প্রশ্নটি হলো, আচ্ছা তোমার কি মনে হয় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে পারবে? কেউ বলে, না না প্রশ্নই ওঠে না। ইলেকশন যদি হয়, সে ইলেকশনে যদি বিএনপি অংশগ্রহণ করে, তাহলে আওয়ামী লীগ ভোট পাবে না। তাহলে কি বিএনপি আসবে? কারও কারও মত হচ্ছে, আসতে পারে, তবে এই ফরম্যাটে হয়তো নয়। কোন ফরম্যাটে? সে সম্পর্কে অবশ্য বক্তার কোনও সম্যক ধারণা নেই।

আসলে আমরা যদি চারপাশে তাকাই তাহলে লক্ষ্য করবো বিএনপি নামক দলটাকে আজকাল কেউ সিরিয়াসলি নেয় না। ওই যে একজন বিএনপি নেতা, আচ্ছা দেখি তো উনি আজ কী বলেন? কোনও নতুন তথ্য অথবা বিকল্প কোনও পথের ঘোষণা করেন কিনা দেখি! এভাবে আজকাল কেউ বিএনপি সম্পর্কে আগ্রহ দেখায়? নিজেদের দলের কর্মী সমর্থকরা পর্যন্ত নয়।

বিএনপির নেতারা কী বলবেন? আজ কী বলেছেন? শেখ হাসিনা বা ওবায়দুল কাদেরের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে রিজভী কিংবা মির্জা ফখরুল কী জবাব দিলেন? টিভিটা চালানো যাক। খবরের কাগজে খোঁজা যাক বিতর্কটা। এই যে সাধারণ মানুষের মধ্যে আগ্রহের কেন্দ্র হিসাবে থাকা এটার অর্থ একটি দল বা নেতানেত্রীর কথা মানুষ শুনতে চায়। জানতে চায়। অর্থাৎ সিরিয়াসলি নিচ্ছে তাদের। এখানেই বিএনপি হেরে যাচ্ছে। বিএনপি নেতারা হয়তো স্বীকার করবেন না অথবা ভাবতে পারেন এটা বিএনপি বিরোধিতার একটা অসত্য প্রচার, কিন্তু তারা চোখকান খোলা রাখলে বুঝবেন আজকাল যে কোনও ঘটনা বা দুর্ঘটনায় বিএনপি নেতার প্রতিক্রিয়া কী এসব জানার মানুষের কৌতূহল থাকে না। এটা সবচেয়ে বিপজ্জনক একটি পার্টির পক্ষে। অর্থাৎ আগ্রহ কমে যাওয়া। গুরুত্ব হারানো। এর প্রধান একটি কারণ হলো ওই যে শুরুতেই যা বললাম। বিএনপি কথার খেলাপের রাজনীতি করে এসেছে। বিএনপি শুরু থেকেই মুখে এক, মনে একের রাজনীতিকেই হাতিয়ার করে গোড়াতেই মানুষ ঠকানোর একটি প্রক্রিয়ায় ব্রতী হয়েছিল। এটার অর্থ এই নয় যে তারাই শুধু কথা খেলাপের রাজনীতি করেছে, অন্যরা সবাই কথা দিয়ে কথা রেখেছে। রাজনৈতিক দলগুলো বেশিরভাগই হয়তো কথা দিয়ে কথা রাখেনি, মানুষের স্বার্থ দেখেনি বা সেই লক্ষ্য পূরণে রাজনীতি করেনি। কিন্তু বিএনপি করেছে সবেচেয়ে বেশি।

তারা দিনের পর দিন মিথ্যাচার করেছে। বাসে পেট্রোল বোমা মেরে সরকারের ওপর দায় চাপিয়েছে। ভারতের কাছে আওয়ামী লীগ দেশ বিক্রি করে দিয়েছে, এমন কথা জোরেশোরে প্রচার করেছে। আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে দেশের মসজিদ থেকে উলুধ্বনি শোনা যাবে এমন ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক অপপ্রচারেও নাম লিখিয়েছে।

তারা খুন এবং সহিংসতার রাজনীতি চালু করেছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলটিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে শামিল হয়েছে। আহসান উল্লাহ মাস্টার, এএসএম কিবরিয়া, মঞ্জুরুল ইমামের মতো জনপ্রিয় নেতাদের হত্যা করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন করার চেষ্টা করেছে।

সরকারের প্যারালাল আরেকটি অদৃশ্য সরকার হাওয়া ভবন গঠন করেছে। একাধিকবার সরকার পরিচালনা করে, ভোটে জেতা একটি দল নিজেদের ন্যূনতম সততার পরিচয় দিতে পারেনি। তাদের কথায় ও কাজে এতটাই গরমিল যে কেউ আর বিশ্বাস করে না ওই দলটি সাধারণ মানুষের ন্যূনতম কল্যাণে কাজ করবে।

মানুষ যতটা বিরক্ত হয়, সেটা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দাপট ও ক্ষমতার অপব্যবহার দেখে, দীর্ঘদিন ধরে তাদের একই রকম কর্মকাণ্ড দেখতে দেখতে মানুষ ক্লান্ত ও বিরক্ত। কিন্তু বিএনপির নেতানেত্রীদের কাজকর্ম দেখে তাদের ওপর আস্থা স্থাপিত হয়েছে,এমন মানুষও দেশে খুব বেশি নেই।

একটি দল মানুষকে বীতশ্রদ্ধ করেছে মুখোশের রাজনীতি করে। আর অন্য অংশটি হত্যা, সন্ত্রাস, অস্থিরতার জন্ম দিয়ে মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত করে ফেলেছে।

সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের দেশের বামপন্থী দলগুলোও জনমানুষের উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারেননি। বামপন্থা মানে আধুনিকতা, প্রগতিশীলতা, সামাজিক ন্যায়, সাম্যবাদী একটা ভাবনা। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এখন তাবৎ দক্ষিণপন্থী দলগুলোই তথাকথিত বামপন্থাকে বিক্রি করেই জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। হাসিনা, খালেদা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেন্দ্র মোদি, ডোনাল্ড ট্রাম্পদের রাজনীতির প্যাটার্নটা একই। তারা সকলে গরিবের সমর্থন পেয়ে চলেছেন। এটাই বামপন্থী দলগুলোর কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বামপন্থী আদর্শের প্যাটেন্ট বলে আর কিছু থাকছে না। যে যে পদক্ষেপগুলো একটি কমিউনিস্ট পার্টি বা সরকারের থেকে আশা করা যায়, সেগুলোই দক্ষিণপন্থী নেতানেত্রীরাই করে দিচ্ছেন। ঠিক এই কারণে এদেশে বামপন্থী রাজনীতির কোনও ভ্যাকুয়াম নেই। যেটা একমাত্র বামরাই পূরণ করতে পারে। বামপন্থীরা সময়ের সঙ্গে নিজেদের রাজনৈতিক সফটওয়্যার আপডেট করতে পারেনি। তাই আউটডেটেড হয়ে পড়ছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সিপিএমের উদাহরণটি এ ক্ষেত্রে সামনে চলে আসে।

গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে ক্ষমতার রিমোট কন্ট্রোল ভোটার বা জনগণের হাতে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে সেই রিমোটটাই যেন লুকিয়ে ফেলা হয়েছে। দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এখন জেলে আছেন। এই দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি বলেছেন, বেগম জিয়াকে ছাড়া বিএনপি আগামী নির্বাচনে যাবে না। ২০১৪ সালেও বিএনপি নির্বাচনে যায়নি। তাতে কিন্তু আওয়ামী লীগের খুব একটা সমস্যা হয়নি। আওয়ামী লীগ অত্যন্ত দাপটের সঙ্গে ক্ষমতায় টিকে আছে। দলটিকে এখন প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের জন্য কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। যেমন করতে হয় না বিএনপিকে।

বিএনপি আগামী দিনে কেমন পার্টিতে পরিণত হবে? আওয়ামীবিরোধী ভোট কাটা পার্টিতে? ধীরে ধীরে কি মৌলবাদীরা আওয়ামীবিরোধী ভোটে ভাগ বসাবে? যা এতদিন বিএনপি বসাতো। দেখে-শুনে মনে হচ্ছে বিএনপি হবে আগামী দিনের ভোটকাটা পার্টি। এটা সুসংবাদ নয়। কারণ, বিএনপি নামক দলটা নিজেরা গুরুত্বহীন হয়ে গেল বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ভুল নেতৃত্বে, মাত্র ১০ বছরের মধ্যে।

আগে সবাইকে বলা হতো, কথা দিলে তা রক্ষা করো। কারণ, কথা না রাখলে রিমোট মানুষের হাতেই আছে। চ্যানেল বদলাতে সময় লাগে না।

কিন্তু মানুষ এখন সত্যিই যদি চ্যানেল বদলানোর সুযোগ পায়, সেটাও কি কাজে লাগাতে পারবে? চ্যানেল যদি হয় কেবল ‘বিটিভি’ তাহলে রিমোট নিয়ে বসে থেকে কী লাভ? চ্যানেল বদলানোর সুযোগ কোথায়? অন্য চ্যানেলগুলো যে ক্রমেই ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে!

লেখক: কলামিস্ট

 

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
১০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগে অগ্রণী ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা আটক
১০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগে অগ্রণী ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা আটক
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা
পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চীনকে যা করতে হবে
পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চীনকে যা করতে হবে
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ