X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নাস্তিক হলেই কি হামলা জায়েজ?

প্রভাষ আমিন
০৫ মার্চ ২০১৮, ২০:১৯আপডেট : ০৬ মার্চ ২০১৮, ০১:৪৭

প্রভাষ আমিন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর জঙ্গি হামলায় বেশিরভাগ মানুষ কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু অবাক হননি কেউই। সবাই জানতেন, জঙ্গিদের কাছে হিটলিস্ট আছে। সেই তালিকা ধরে ধরে তারা হামলা করবেই; আজ হোক, কাল হোক। আজ জাফর ইকবাল, কাল অন্য কেউ। জঙ্গিবাদের আদর্শ চিরতরে উপড়ে ফেলতে না পারলে নিছক গানম্যান দিয়ে বা নিরাপত্তা বাড়িয়ে কারও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। পুলিশ এবং শত শত ছাত্র-শিক্ষকের উপস্থিতিতেই কিন্তু জাফর ইকবালের ওপর হামলা হয়েছে। এ রকম প্রকাশ্য হামলা চালিয়ে জঙ্গিরা আবারও তাদের সক্ষমতার জানান দিলো।
ঘটনাস্থলেই হামলাকারী ধরা পড়েছে। কিন্তু এই ২০/২২ বছরের ফয়জুর রহমানই কি এ হামলার পুরো পরিকল্পনা করেছে? পেছনে কারা তার মগজ ধোলাই করে মাঠে নামিয়েছে? আসল সূত্রটা সেখানে। কারা আমাদের তরুণদের মগজে গেঁথে দিচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার বিষ, খুঁজে বের করতে হবে তাদের। সেটা না পারলে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ-নিন্দা জানিয়ে কাজ হবে না। হামলাকারী ফয়জুর রহমানকে ধরে ঘটনাস্থলেই গণধোলাই দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। যদিও আহত হওয়ার পরও জাফর ইকবাল হামলাকারীকে যেন না মারা হয়, তার অনুরোধ করেছিলেন। পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করেছে। র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে ফয়জুর রহমান জানিয়েছে, জাফর ইকবাল ‘ভূতের বাচ্চা সোলায়মান’ নামক উপন্যাস লিখে নবী সোলায়মান (আ.)-কে ব্যঙ্গ করায় অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। ফয়জুর রহমান আরও বলেছে, ‘জাফর ইকবাল ইসলামের শত্রু, তাই তাকে হত্যা করার জন্য হামলা করেছি। উনি নিজেও নাস্তিক এবং অন্য সবাইকেও নাস্তিক বানানোর জন্য প্রচার করে বেড়াচ্ছেন। তার লেখা পড়ে মানুষ বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ছে।’ ফয়জুর আরও জানিয়েছে, সে ‘ভূতের বাচ্চা সোলায়মান’ তো নয়ই, জাফর ইকবালের কোনও লেখাই পড়েনি। একজন লেখকের লেখা না পড়েই তাকে নাস্তিক বা ইসলামের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে তার ওপর হামলা চালানোকে জায়েজ করে ফেলার একটা সূক্ষ্ণ চেষ্টা আছে কারও কারও মধ্যে।

আমি জাফর ইকবালের একজন অনুরাগী পাঠক। বিশেষ করে তার সায়েন্স ফিকশন সমগ্র আমার অবসরের সঙ্গী। অন্য অনেক লেখাও পড়েছি। পত্রিকায় প্রকাশিত কলাম পড়ি গভীর আগ্রহ নিয়ে। কেউ কেউ অভিযোগ করেন, তিনি বিদেশি গল্প অবলম্বনে গল্প-উপন্যাস লেখেন। এ অভিযোগের ব্যাপারে আমার কোনও বক্তব্য নেই। কারণ বিদেশি সাহিত্য আমার খুব একটা পড়া হয় না। তাই জাফর ইকবালের লেখা আমি নতুন লেখা পড়ার আনন্দ নিয়েই পড়ি। তবে তার কোনও লেখায় আমি ইসলামবিরোধী কিছু পাইনি। তিনি নাস্তিক— এমন কোনও প্রমাণও পাইনি। তিনি কোথাও এমন ঘোষণাও দেননি। বরং যতটুকু লেখা পড়েছি, তাতে তাকে আমার নিষ্ঠাবান মুসলমানই মনে হয়েছে। তার বড় ভাই হুমায়ুন আহমেদ হযরত মোহাম্মদ (স.)-এর জীবনী লিখতে চেয়েছিলেন। অকালে চলে যাওয়ায় তার সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি।

ফয়জুর রহমান হামলার যুক্তি হিসেবে যে বইটির নাম উল্লেখ করেছে, সেই ‘ভূতের বাচ্চা সোলায়মান’ বইটি আমার পড়া হয়নি। তবে নাম শুনে বোঝা যাচ্ছে, এটি বাচ্চাদের জন্য লেখা একটি ভূতের বই। হযরত মোহাম্মদ (স.) শেষ নবী। কিন্তু তার আগে আদম (আ.) থেকে শুরু করে এক লাখ ২৪ হাজার পয়গম্বার আল্লাহর বাণী নিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশের নিষ্ঠাবান মুসলমানদের অনেকে নবী-রাসুলদের নামে সন্তানদের নাম রাখেন। বাংলাদেশে আদম, ইব্রাহিম, ইসমাইল, মোহাম্মদ, ইসা, মুসা, ইউনুস এসন অনেক নবীর নাম জনপ্রিয়। এই নামের অনেক মানুষ আছে। তাদের অনেকেই নামের মর্যাদা রাখতে পারেননি। নানা অপরাধ, অপকর্ম করে নামের মর্যাদাহানি করেছেন। এখন কি নবীর নামের অমর্যাদা করার দায়ে সেই ব্যক্তিদের ধরে ধরে কোপানো হবে?

‘ভূতের বাচ্চা সোলায়মান’ না পড়লেও যতটুকু জেনেছি, নামটুকু ছাড়া এই বইয়ে হযরত সোলায়মান (আ.)-এর কোনও প্রসঙ্গ নেই। জাফর ইকবালের স্ত্রী ড. ইয়াসমীন হক বলেছেন, হামলাকারী যদি জাফর ইকবালের লেখা পড়ত, তাহলে তার ভুল বুঝতে পারত। সমস্যা হলো— জেগে ঘুমালে তো আপনি কাউকে জাগাতে পারবেন না। কেউ যদি ভুলটাই বুঝে, তাহলে আপনি তাকে শুদ্ধ করবেন কিভাবে? কেউ হয়তো ফয়জুরের মগজ ধোলাই করে তাকে পাঠিয়েছে। অপরাধ হিসেবে এই বইয়ের কথা বুঝিয়েছে। জাফর ইকবাল নাস্তিক নন, জীবনে কখনও ইসলামের বিরুদ্ধে একটি লাইনও লেখেননি— এ কথা তারা বলেননি। তাহলে তার অপরাধ কী? তার আসল অপরাধ, তিনি মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেন, তিনি মুক্তচিন্তার কথা বলেন, তিনি যুক্তির কথা বলেন। তার লেখা তরুণদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। তার লেখা পড়ে পড়ে যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত একটা যুক্তিবাদী প্রজন্ম গড়ে ওঠে, তাহলে ধর্ম ব্যবসায়ীদের ব্যবসা লাটে উঠবে। এ কারণেই তারা জাফর ইকবালদের ওপর খ্যাপা। তাদের একে একে খুন করতে চায়।

আর এই হামলা জায়েজ করার জন্য তারা কারও ওপর নাস্তিক ট্যাগ লাগায়, কারও গায়ে ইসলামের শত্রুর সাইনবোর্ড লাগায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মহৎ আন্দোলনের একটি গণজাগরণ মঞ্চ। হেফাজতে ইসলাম সুকৌশলে সেই আন্দোলনের গায়ে নাস্তিকের ট্যাগ লাগিয়ে দেয়। সেই অন্ধকার শক্তি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে ইসলামবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা চালায়। কেউ মুক্তবুদ্ধির চর্চা করলে, যুক্তির কথা বললেই তাদের গায়ে জ্বালা ধরে যায়। গণজাগরণ মঞ্চে কোটি মানুষ সশরীরে এসেছেন, না আসতে পারলেও অনেকে সহমত পোষণ করেছেন। এই কোটি মানুষের মধ্যে কেউ কেউ নাস্তিক থাকতেই পারেন।

বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ যেমন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, তেমনি বিপক্ষেও আছে অল্পকিছু মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ— দুই পক্ষেই নাস্তিক থাকতে পারে। নাস্তিকদের মধ্যে জন্মসূত্রে মুসলমান যেমন আছে, হিন্দু আছে, খ্রিস্টান আছে, বৌদ্ধ আছে। আপনার ধর্ম পালন করার অধিকার যেমন আছে, তেমনি একজনের ধর্ম পালন না করা বা অবিশ্বাস করার অধিকারও আছে। যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ আইন হাতে তুলে না নিচ্ছে, ততক্ষণ তার বিশ্বাস চর্চায় বাধা দেওয়ার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে? এটা তো খুব সাধারণ চাওয়া, একজন আরেকজনের বিশ্বাসে-অনুভূতিতে আঘাত করবে না। কেউ যদি আঘাত করে, রাষ্ট্র তার ব্যবস্থা নেবে। আপনাকে কে চাপাতি দিয়ে ধর্ম রক্ষা করার দায়িত্ব দিয়েছে? নাস্তিক হলেই একজন মানুষকে হত্যা করা জায়েজ হয়ে যায় না। যেকোনও বিশ্বাস বা অবিশ্বাস লালন করার, তা প্রচার করার অধিকার আছে। আপনার সেটা পছন্দ না হলে, আপনি পাল্টা যুক্তি দেবেন, আপনার বিশ্বাস তুলে ধরবেন। আপনি তখনই চাপাতি হাতে তুলে নেবেন, যখন আপনার যুক্তি ফুরিয়ে যাবে। কিন্তু ইসলামের মতো একটি অসাধারণ ধর্মবিশ্বাসের পক্ষে বলার জন্য তো কখনও যুক্তি ফুরিয়ে যাওয়ার কথা নয়। শান্তির ধর্ম ইসলামকে যারা সন্ত্রাসের, জঙ্গিবাদের সমার্থক করে তুলতে চাইছেন; তারাই ইসলামের আসল শত্রু। ইসলাম কখনোই কারও ওপর হামলা সমর্থন করে না। ইসলাম শব্দের অর্থই শান্তি। ইসলাম শান্তির ধর্ম। কোনও হিন্দু তো কখনও কোনও নাস্তিক বা হিন্দু ধর্মের ‘শত্রু’র ওপর হামলা চালায় না। কোনও খ্রিস্টান তো কখনও কোনও নাস্তিক বা খ্রিস্টান ধর্মের ‘শত্রু’র ওপর হামলা চালায় না। তাহলে ইসলামের নামে হামলা চালানোর দায়িত্ব জঙ্গিদের কে দিয়েছে? আমার বিশ্বাস, ইসলামের অবমাননা করার জন্য, বদনাম করার জন্য ইসলামের শত্রু কেউ কেউ এই হামলাকারীদের মাঠে নামায়। এই জঙ্গি শত্রুদের কারণেই বিশ্বজুড়ে ইসলাম ধর্ম আজ কোনঠাসা।

যারা ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ইসলামকে হেয় করে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। ইসলামের সত্যিকারের চেতনা ছড়িয়ে দিয়েই সেটা সম্ভব।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/টিআর/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ