X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এদেশে বিউটিরা একা, বড্ড একা

জোবাইদা নাসরীন
৩১ মার্চ ২০১৮, ১৭:০২আপডেট : ৩১ মার্চ ২০১৮, ১৭:০৮

জোবাইদা নাসরীন আট বছর আগের কথা। এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত বাংলা পিডিয়াতে কাজ করি। সপ্তাহের পাঁচ দিন বিশ্ববিদ্যালয় শেষে বিকেলে এশিয়াটিক সোসাইটিতে যাই। এশিয়াটিক সোসাইটির বড় গেটের পাশেই রাস্তার ফুটপাতে একজন  ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ নারীকে বসে থাকতে দেখতাম। এলাকার লোকেরা তাকে ‘পাগলি’ বলে ডাকতো। মাঝে মাঝে আপন মনে কী যেন বলতেন। কখনও শুয়ে থাকতেন, কখনও দেখতাম কিছু খাচ্ছেন। সেই ফাঁকে দাঁত বের করে, প্রাণ খুলে হাসতেন। আসা-যাওয়ার সময় মাঝে মাঝে আমার সঙ্গেও হাসি বিনিময় হতো। টুকটাক দু’চারটা কথা হতো। একদিন খেয়াল করলাম, তার পেটটা উঁচু। অর্থাৎ এই সমাজের কেউ না কেউ তাকে ধর্ষণ করেছে, তার পেটে বাচ্চা এসেছে। আমি নিশ্চিতভাবেই জানি, তিনি কোথাও বিচারের জন্য যাননি, আর গেলেও তার মামলা নেওয়া হবে না। কারণ তিনি সমাজের কাছে চিহ্নিত ‘পাগলি’। তারপর আরও কয়েকমাস পর সেই ‘পাগলি’কে আমি আর দেখিনি সেখানে। হয়তো পাগলিকে মেরে ফেলা হয়েছে কিংবা অন্য কোথাও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। হয়তো এর আগেও এমনি কোনও ধর্ষণের শিকার হয়ে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। আমরা জানি না–সমাজ ও রাষ্ট্রের অনেক কিছুই আমাদের কাছে আড়াল করে রাখা হয়। আমাদের সামনে শুধু ক্ষতটাই হাজির করা হয়। তার উঁচু পেট দেখে আমার মনে হতো, তার আনমনে বিড়বিড় হয়তো সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে নালিশ ছিল। কারণ যখন কারও বক্তব্য, অবস্থান সমাজের বিপক্ষে যায়, তখনই সমাজ তাকে ‘পাগল’ বলে। এই সমাজে যখন একজন ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ নারীর শরীরও রক্ষা পায় না ধর্ষকদের চোখের থাবা থেকে।

মেয়েটির নাম বিউটি। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অসাধারণ সব সুন্দরের একটি। সহজেই ধারণা করতে পারি, আট-দশজন বাবা-মায়ের মতো মেয়েটির বাবা-মায়ের কাছে সে ছিল সবচেয়ে বড় সুন্দর, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাবা-মায়ের আদরের বিউটি জমিনে উপুড় হয়ে আছে। ‘বিউটিফুল বাংলাদেশ’  নিয়ে যখন আমাদের গর্বের শেষ নেই, দেশপ্রেমের অহঙ্কারে যখন আমাদের চোখ ভিজে যায়, আমরা ‘বিউটিফুল’ বাংলাদেশের রঙ-বেরঙের ভিডিও তৈরি করে পর্যটকদের আহ্বান করি, এদেশকে দেখার, ইতিহাসকে দেখার, সেই ‘বিউটিফুল বাংলাদেশ’-এ বিউটিরা ধর্ষণের শিকার হয়ে মরে পড়ে থাকে। যখন এবারের স্বাধীনতা দিবসে সবচেয়ে বেশি আনন্দ করেছে বাংলাদেশ, অনেক পত্রিকার হেডলাইন ছিল ‘এমন আনন্দ বাংলাদেশ আর কখনও দেখেনি’, আর সেই সময়ে, ঠিক সেই সময়ে সবুজ ঘাসের ওপর পড়েছিল লাল জামা পরা, দ্বিতীয় দফা ধর্ষণের শিকার হওয়া ষোড়শী বিউটি। দেহে প্রাণ নেই, শরীর বহন করছে পুরুষতন্ত্রের সবচেয়ে দাপটশালী নির্যাতন ধর্ষণের চিহ্ন। আর নিথর শরীর নির্দেশ করছে ধর্ষকের অপরিসীম ক্ষমতাকে। যখন এই সমাজে এক বছরের শিশুরও রক্ষা নেই, সেখানে বিউটিরা অরক্ষিত থাকবে, ধর্ষণের শিকার হবে, রাষ্ট্রের বিচারহীনতার সংস্কৃতির জিম্মায় পড়বে। এসব তো দেখা যাচ্ছে এখন ‘স্বাভাবিক’ হয়ে পড়ছে।

দুই.

এই সমাজে, রাষ্ট্রে বিউটিরা একা। একবারেই একা। প্রথমবার ধর্ষণের শিকার হয়ে, বিউটি রাষ্ট্রের কাছে গিয়েছিল বিচার চাইতে, কিন্তু রাষ্ট্র তার পাশে দাঁড়ায়নি। দ্বিতীয় দফা আবার ধর্ষণের শিকার হয়েছে, তাতেও ধর্ষণকারীর ক্রোধ কমেনি। বিউটিকে হত্যা করা হয়েছে। তাতেও হয়নি দফারফা, তার দেহকে টেনে-হিঁচড়ে মাঠের মাঝখানে ফেলে রাখা হয়েছে সবাইকে দেখানোর জন্য। এই দেখানো ‘সাধারণ’ নয়, ধর্ষণকারী জানান দিতে চেয়েছে, এই রাষ্ট্রে সে যেকোনও কিছু করতে পারে। সমাজ আর রাষ্ট্র তার পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতাকে নিশ্চিত করেছে। কারণ প্রথমবার ধর্ষণ করে সে রেহাই পেয়েছে বলেই দ্বিতীয়বার ধর্ষণ এবং হত্যার মতো কাজ করার বিশেষ ‘ক্ষমতা’ অর্জন করেছে।

বিউটির ধর্ষণের বিচার চাইতে কোনও নারী সংগঠনও এগিয়ে আসেনি। কারণ বিউটিকে আমরা চিনি না, বিউটি বাংলাদেশের অপরিচিত একটি গ্রামের সাধারণ উঠতি বয়সের মেয়ে। শুধু ফেসবুকে অনেকেই পোস্ট দিয়েছেন, প্রতিবাদ জানিয়েছেন। রাষ্ট্র এখন আসামিকে খুঁজছে, বিউটির লাশ মর্গে, ধর্ষণ হয়েছে কিনা, কীভাবে মৃত্যু হলো, সেটি নিয়ে রিপোর্টের জন্য। সেই পরীক্ষায় সমাজ আরও জানবে বিউটির আগে কোনও যৌন অভিজ্ঞতা ছিল কিনা, ধর্ষণের সামাজিক বৈধতা নিয়ে সমাজ তর্ক তুলবে।

পত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জের ব্রাহ্মণডোরা গ্রামের সায়েদ আলীর কন্যা ও স্থানীয় উচ্চবিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্রী বিউটি আক্তারকে গত ২১ জানুয়ারি প্রথমে অপহরণ করে এবং পরে ধর্ষণ করে একই গ্রামের বাবুল। এ ঘটনায় গত ১ মার্চ সায়েদ আলী বাদী হয়ে বাবুল ও তার মা ইউপি সদস্য কলম চাঁনের বিরুদ্ধে হবিগঞ্জে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে অপহরণ ও ধর্ষণ মামলা করেন। মামলাটি গত ৪ মার্চ শায়েস্তাগঞ্জ থানায় প্রেরণ করা হয়।

আমরা প্রকাশিত খবর থেকে আরও জানতে পারি যে, মামলা করার পর সায়েদ আলী ও তার মেয়েকে বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হয় বাবুলের পরিবার থেকে, কারণ তার মা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য। এই হুমকিতে ভীত হয়ে বিউটির বাবা গত ১৬ মার্চ বিউটি আক্তারকে লাখাই উপজেলার গুনিপুর গ্রামে তার নানার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন, মেয়েটিকে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু তার শেষ চেষ্টাও বিফলে যায়। কারণ ওই রাতেই বিউটি আক্তার নানার বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়। তাকে আবারও অপহরণ করা হয়। অনেক স্থানে খোঁজাখুঁজির পরও তিনি কোথাও তার মেয়েকে পাননি।  ১৭ মার্চ সকালে শায়েস্তাগঞ্জ হাওরে বিউটি আক্তারের লাশ পাওয়া যায়। সায়েদ আলীর অভিযোগ, ধর্ষণ মামলার আসামিই তার মেয়েকে পুনরায় ধর্ষণ শেষে হত্যা করেছে।

বিউটিরাই এদেশের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য হওয়ার কথা। প্রথম ধর্ষণের পরই বিউটি এবং তার পরিবার মাথা তুলে দাঁড়াতে চেয়েছিল। প্রতিবাদ করেছিল, মামলা করেছিল।কিন্তু রাষ্ট্র তাদের পাশে দাঁড়ায়নি, বিচার চেয়ে রাস্তায় মানুষ একত্রিত হয়নি। এদেশে বিউটিরা একা, বড্ড একা।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

[email protected]

 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
ভোট গণনা প্রক্রিয়ায় কোনও পরিবর্তন হবে না: ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট
ভোট গণনা প্রক্রিয়ায় কোনও পরিবর্তন হবে না: ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট
ঘোড়াঘাটে মালবোঝাই দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত
ঘোড়াঘাটে মালবোঝাই দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত
নির্বাচনের সময় জাপায় কী হয়েছিল, জানাবেন জিএম কাদের
শনিবার জাতীয় পার্টির বর্ধিত সভানির্বাচনের সময় জাপায় কী হয়েছিল, জানাবেন জিএম কাদের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ