X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘ইরান যুদ্ধে’র পাঁয়তারা

আনিস আলমগীর
০৮ মে ২০১৮, ১৭:০০আপডেট : ০৮ মে ২০১৮, ১৭:০৩

আনিস আলমগীর ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনের সময় যা যা বলেছেন একে একে সেসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। এবার তিনি হুমকি দিয়েছেন, ১২ মে’র মধ্যে ইরানের সঙ্গে করা চুক্তির কিছু ত্রুটি সংশোধন না করা হলে তা থেকে সরে আসবেন। এর আগে ট্রাম্প প্যাসিফিক থেকে বের হয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন, ঠিক তা-ই তিনি করেছেন। সম্ভবত চুক্তি স্বাক্ষরকারী অপর পাঁচ শক্তি রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স, ব্রিটেন ও জার্মানির অনুরোধ উপেক্ষা করে তিনি আগামী ১২ মে ইরানের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি থেকে আমেরিকার বের হয়ে যাওয়ার কথাই ঘোষণা দেবেন। ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে চুক্তিটি হয়েছিল।
পরমাণু অস্ত্র না বানানোর এই চুক্তির ফলেই তুলে নেওয়া হয়েছিল ইরানের বিরুদ্ধে অবরোধ। কিন্তু ক্ষমতার আসার পর থেকেই বহুবার এর বিরোধিতা করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এটি এককভাবে আমেরিকার সঙ্গে ইরানের মধ্যে স্বাক্ষরিত কোনও চুক্তি নয়। এ চুক্তির দুই পক্ষের মধ্যে আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স, ব্রিটেন ও জার্মানি এক পক্ষ, আর দ্বিতীয় পক্ষ হচ্ছে ইরান। চু্ক্তি সম্পাদনের পর জাতিসংঘ এটি অনুমোদন করেছে।
চুক্তিটি বহুজাতিক আবার জাতিসংঘ অনুমোদন দেওয়ার পর বিশ্ব সংস্থাও চুক্তি সম্পাদন ও কার্যকর করার দায়িত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে। এখন আমেরিকা একতরফা চুক্তি বাতিল করতে যাচ্ছে। অথচ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী, জার্মানির চ্যান্সেলর তাকে চুক্তি বহাল রাখার পক্ষে তাদের অবস্থানের কথা জানিয়ে এসেছেন। চীন রাশিয়াও চুক্তির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।

চুক্তি সম্পাদনের পর ইরানের ওপর থেকে স্থাপিত বাণিজ্য অবরোধ জাতিসংঘ প্রত্যাহার করেছে। ইসরায়েল কখনও এ চুক্তিটি সম্পাদনের পক্ষে ছিল না। ইরাক এবং সিরিয়ার আণবিক কেন্দ্র দুটা যেভাবে ইসরায়েল আক্রমণ করে ধ্বংস করেছে, ইরানের আণবিক কেন্দ্রও ধ্বংস করার চেষ্টা করছে ইসরায়েল বহুদিন থেকে। আমেরিকা এ চুক্তিটি বাতিল করলে ইসরায়েলের পক্ষে আক্রমণ করার পথ সৃষ্টি হবে।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ এবং জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল ওয়াশিংটন সফর করে ট্রাম্পকে বোঝানোর চেষ্টা করে এসেছেন, কিন্তু ট্রাম্প তাদের কথায় সম্মত হননি। সম্ভবত ১২ মে তিনি ইরানের সঙ্গে সম্পাদিত কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন বাতিল করবেন। ইসরায়েল এবং সৌদি আরব অব্যাহতভাবে আমেরিকার পেছনে লেগে আছে যেন এ চুক্তি বাতিল করে ইরান আক্রমণের পথ সৃষ্টি করে দেওয়া হয়।

৩০ এপ্রিল ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু টেলিভিশন ব্রিফিং করে বুঝিয়ে দিয়েছেন ম্যাক্রঁ বা মেরকেল নন, আমেরিকাকে প্রভাবিত করার শক্তি শুধু তারই রয়েছে। ফ্রান্স, ব্রিটেন জার্মানির সেই শক্তি নেই, তাদের উচিত তাকে অনুসরণ করা। নেতানিয়াহু টেলিভিশন শো’র মাধ্যমে শুধু একজনকে বুঝানোর চেষ্টা করেছেন, তিনি হচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

নেতানিয়াহুর সব চেষ্টার একটি মাত্র অভিমুখ আর তা হচ্ছে ইরানকে আক্রমণ করা এবং এ বিষয়ে নেতানিয়াহু আমেরিকাকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছেন। এখন নেতানিয়াহুর সঙ্গে সৌদি আরবও সহযোগিতা করছে।

ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্র আক্রমণ করার ব্যাপারে ইসরায়েলের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট বলেছেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় আক্রমণ করে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা সম্ভব নয়। বরং হামলা সাফল্যের চেয়ে অনেক বেশি বিপদ ডেকে আনবে।

নিউ ইয়র্কে জেরুজালেম পোস্টের উদ্যোগে আয়োজিত এক সম্মেলনে এহুদ ওলমার্ট বলেন, আমিই ২০০৭ সালে সিরিয়ার আণবিক স্থাপনা আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছিলাম। তিনি বলেন, তিনিই ইরানের স্থাপনা আক্রমণের সিদ্ধান্ত কার্যকর করেননি। কারণ, ইসরায়েলের আক্রমণের কারণে ইরানের এ কর্মসূচি হয়ত দু’বছর পেছাবে কিন্তু সম্পূর্ণ বন্ধ হবে না। কারণ, ইরানের স্থাপনা এক জায়গায় নয়। বহু জায়গায় ইরান এ স্থাপনা গড়ে তুলেছে এবং সব ইউনিট গভীর মাটির নিচে। ওলমাট বলেন, সিরিয়ার স্থাপনা ছিল প্রাথমিক পর্যায়ের কিন্তু ইরানের স্থাপনা পরিপূর্ণতা পেয়েছে এবং ইরান যেকোনও সময় বোমা উৎপাদনে যেতে সক্ষম।

নেতানিয়াহু দাবি করেছেন, ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ২০১৬ সালে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্রের সন্ধান পায় এবং এক ভবনের দেয়াল ভেঙে আধা টন বোমার উপকরণ এবং কাগজপত্র চুরি করে নিয়ে আসে। নেতানিয়াহু বলছেন, পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ব্যাপারে ইরান মিথ্যা বলছে। নেতানিয়াহু বারবার দাবি করছেন ইরান বোমা বানাতে সক্ষমতা অর্জন করেছে। ইরানের পররাষ্ট্র উপমন্ত্রী সায়েদ আব্বাস বলেছেন, নেতানিয়াহু যেসব কাগজপত্র দেখাচ্ছেন তা জাল ও ভুয়া। কিন্তু নেতানিয়াহু এ কাগজপত্র দেখিয়ে ফায়দা লুটার তৎপরতায় ব্যস্ত।

ট্রাম্পের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন এবং নতুন পররাষ্ট্র সচিব মাইক পম্পেওকে নিয়োগ দেওয়ার ফলে বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে সামরিক শক্তি প্রয়োগের পক্ষপাতি একটি টিম জন্ম নিয়েছে। নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং পররাষ্ট্র সচিব উভয়ে ২০১৫ সালে এ চুক্তি সম্পাদনের সময় বিরোধিতা করেছিলেন এবং চুক্তিটি পূর্ণাঙ্গ নয় বলে উল্লেখ করেছিলেন। এখন ট্রাম্প ঠিক সেই কথাই বলছেন।

ইরাকের মতো একটি সমৃদ্ধশালী দেশের বিরুদ্ধে ‘উইপন অব ম্যাস ডেস্ট্রাকশন’-এর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার আগেই দেশটা আমেরিকার আক্রমণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। এতে ব্রিটেনও অংশগ্রহণ করেছিল। যুদ্ধশেষে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার স্বদেশে চূড়ান্ত সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন এবং বিদায় নিয়েছিলেন। ইরানের ব্যাপারে অনুরূপ কোনও পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে ধারণা করেই ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানি ইরানের সঙ্গে সম্পাদিত ‘কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন’-এর উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল।

অন্যায় কাজেও আমেরিকার লেজুড়ভিত্তি করতে হয়। সুতরাং আগেভাগেই একটা সমাধানে পৌঁছানো দরকার এই ভেবেই ইউরোপীয় এ তিন শক্তি চুক্তিটি সম্পাদনের ব্যাপারে সক্রিয় ছিল। এখন আবার তিন শক্তিই চুক্তিটি রক্ষার ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। এই তিন শক্তির উচিত ট্রাম্প যদি ১২ মে চুক্তিটির প্রতি তার পুনঃসম্মতি ব্যক্ত না করেন তবে তারা যেন চুক্তিটি অব্যাহত রাখেন। আমেরিকার লেজুড়ভিত্তি করে যেন বিশ্বব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে না তোলেন।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ইরান আক্রমণ করতে উদগ্রিব হয়ে বসে আছেন। সৌদি আরবও তাতে তাল দিচ্ছেন। সুতরাং ট্রাম্প চুক্তিটি বাতিল করলেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি তাতে কোনও পক্ষভুক্ত না হন তাহলে আমেরিকা হয়ত একলা চলো নীতি অনুসরণ নাও করতে পারেন। আবার তারা যে চীন-রাশিয়াকে উপেক্ষা করবে তাও তো না। রাশিয়ার পরমাণু বিস্তাররোধ এবং অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বিভাগের প্রধান ইয়ারকামোভ বলেছেন, আমেরিকা চুক্তিটি বাতিল করলে রাশিয়া ইরানের পাশেই থাকবে।

গত দুই সপ্তাহে মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের জেনারেল জোসেফ ভোটেল, পররাষ্ট্র সচিব মাইক পম্পেও ইসরায়েল সফর করেছেন। ওয়াশিংটনে ইরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিব্যারম্যান যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সিএনএন বলেছে, অনুরূপ পরিস্থিতিতে সৌদি আরব ইসরায়েলের ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছে। সব পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি খুবই উত্তপ্ত, যেকোনও সময় যুদ্ধের দামামা বেজে উঠতে পারে।

লেখক: সাংবাদিক

[email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
১০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগে অগ্রণী ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা আটক
১০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগে অগ্রণী ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা আটক
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা
পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চীনকে যা করতে হবে
পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চীনকে যা করতে হবে
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ