X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বেতনের সঙ্গে কর্মদক্ষতার কথাও উচ্চারিত হোক

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
০৪ জুলাই ২০১৮, ১৭:০৮আপডেট : ০৪ জুলাই ২০১৮, ১৭:০৯

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের বেতন প্রায় দ্বিগুণ হচ্ছে। এ সংক্রান্ত একটি আইনের খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। গত সোমবার (২ জুলাই) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় এ আইনের খসড়াটি নীতিগতভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়।
খবরটি একদিকে অভিনন্দন জানানোর মতো, অন্যদিকে কিছু প্রশ্ন তোলারও সুযোগ সৃষ্টি করে। শ্রমিকের জীবনমান বাড়লে আমরা খুশি হবো, এটা স্বাভাবিক। সরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো যখন কেবল লোকসানই দিচ্ছে, তখন কার অর্থে কার বেতন বাড়ানো হচ্ছে? বেসরকারি খাতেই বা এর প্রভাব কী পড়বে?
বেসরকারি খাতের ওপর চাপ আসবে, এ নিয়ে একটা পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হবে। সরকারি কলকারখানাকে লাভ করতে হয় না, লোকসান করলেও সমস্যা নেই। জনগণের পকেট থেকে অর্থ নিয়ে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা-ওভারটাইম-বোনাস—সবই দেওয়া হবে। বেসরকারি খাতকে এক বিরূপ বাজারে প্রতিযোগিতা করে, লাভ করে টিকে থাকতে হয়। তাদের জন্য এটি এক কঠিন লড়াই। 

সরকারি অফিসে কেউ কাজ করে না, এমন একটা ধারণা খুবই প্রচলিত। ধারণাটা অহেতুক নয়। এখন যারা কাজ করে না, তাদের জন্য যদি এভাবে ঢেলে দেওয়া হয়, তাহলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কাজ না করে বেতন পান, আবার বেতনের চেয়ে বেশি ওভারটাইম পান সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। একটি চক্র কাজ না করে ওভারটাইম নেওয়ার এই সংস্কৃতি চালু করেছে প্রায় সব সরকারি অফিসে। এ চক্রটির সঙ্গে অফিসগুলোর শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা জড়িত। তারা বিভিন্নভাবে প্রভাব খাটিয়ে কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করেন এবং এ সংক্রান্ত ফাইল অনুমোদনের জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে শ্রমিকদের অতিরিক্ত ওভারটাইম দেওয়ার জন্য হুমকিও দেন তারা।

সরকারি অফিসের কর্ম-সংস্কৃতিতে বড় সংকট আছে। একটা সাধারণ ধারণা হলো—আমাদের সরকারি কলকারখানা বা অফিসে কেউ কাজ করে না। কিংবা করলেও গুণগত মানের কাজ খুব কম। এসব ধারণা অহেতুক নয়। কর্ম-সংস্কৃতি সাধারণভাবে নিম্নমানের এবং এর সঙ্গে রাজনীতিরও যোগ আছে অনেক ক্ষেত্রে। এই সংস্কৃতিটা এমন যে, এখানে খুব কম কর্মীই অফিস বা প্রতিষ্ঠানকে নিজের মনে কাজ করেন।

বাইরে মহিমাময়, ভেতরে ভেতরে প্রায় সব দফতরে এই কর্ম-সংস্কৃতি ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। উদ্যোগ ও অভিযানের যে মানসিকতার জোর, সেই জোরটাই হারিয়ে যাচ্ছে। তার জায়গায় তৈরি হচ্ছে এক পরমুখাপেক্ষী সমাজ। সেই সমাজ জীবনধারণের এমন একটা মানকে নিজের প্রাপ্য বলে মনে করে, যার সংস্থান করার সাধ্য আসলে তার নেই।

সরকারি খাতে কর্মীদের বেতন বেড়েই চলেছে। বলা যায় সাধ্যের বাইরে চেষ্টা করছে সরকার। ফলে সরকারি কর্মীদের পেছনে খরচের লাগাম টানা যাচ্ছে না। সারাদেশের মানুষকে উপেক্ষা করে সরকারি কর্মীদের আরও সুখে বাঁচার স্বপ্ন দেখাতে এবং সরকারি টাকা যথেচ্ছ খরচ করতেই অভ্যস্ত করে তোলার প্রবণতা বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে।

আশা ছিল দ্বিগুণ বা তার চেয়েও বেশি বেতন বাড়ার পর সরকারি কর্মক্ষেত্রে ঘুষ-দুর্নীতি কমবে। কিন্তু বাস্তবতা বলে, তা হয়নি। প্রত্যাশা ছিল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভেতর অনেক বেশি প্রতিযোগিতার মানসিকতা আসবে। বরং যেসব বিশেষ সুবিধা ভোগ করে আসছিল, তা আরও বেড়েছে, কিন্তু এদের মধ্যে কাজের মানসিকতা ফিরিয়ে আনা গেলো না।

বাজার অর্থনীতির মূল কথা সরকারি ভূমিকার চেয়ে অনেক বেশি জোর দিতে হবে ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও স্বনির্ভরতার ওপর। রাষ্ট্রের এখতিয়ারকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকলেও এখন সবই দূরের শোনা গল্প।

কাজ না করার অভ্যাস থেকে বের হতে সরকারি অফিস-আদালতে কর্ম-সংস্কৃতি ফেরানোর তাগিদ মাঝেমধ্যে উঠে আসে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে। কিন্তু মৌলিক জায়গায় গলদ আছে এই চিন্তার। ভালো কর্ম-সংস্কৃতি মানে দশটা-পাঁচটা অফিসে হাজির থাকা? ঠিক তা নয়। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজটা কতটুকু করেন, কতটুকু মন দিয়ে করেন, কতটুকু উদ্যোগ নিয়ে করেন–প্রশ্ন সেখানেই।

যেকোনও মানুষকে জিজ্ঞাসা করলেই শোনা যায়, প্রায় একই ধরনের সব গল্প। সরকারি অফিসে মানুষের অভিজ্ঞতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেশ খারাপ। যে ধারণাগুলো পাওয়া যায় মানুষের সঙ্গে কথা বলে, সেসব অনেকটা এমন–সরকারি কর্মীদের একটা বড় অংশ কাজে খুব অবহেলা করেন, সিটে থাকেন না, অফিসে ব্যাগ রেখে বেরিয়ে যান ব্যক্তিগত কাজে, দীর্ঘদিন ফাইল আটকে রাখেন, কোনও প্রশ্নের সম্পূর্ণ উত্তর দেন না, প্রচুর ভুল করেন আর টাকা ছাড়া কাজ করেন না।

গোটা দুনিয়ায় যখন সমাজকে বিস্তর কর্মসাধনে বাধ্য করা হচ্ছে, তখন আমাদের এখানে তার উলটো স্রোত চলছে। সরকারি মালিকানায় বেতন বাড়ানো কোনও কর্ম-উদ্দীপনা সৃষ্টি করবে না। ভর্তুকি প্রত্যাহার করে এসব কলকারখানাকে বরং প্রতিযোগিতায় ফেলতে হবে, দেখতে হবে এরা টিকে থাকতে পারে কিনা। বহু মানুষ প্রথমে বেকার হবে, এটা ঠিক, কিন্তু তার পাশাপাশি অনেক শিল্প নতুন করে প্রতিযোগিতার শক্তি সংগ্রহ করবে ও উজ্জীবিত হয়ে উঠবে।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কঠোর পরিশ্রম, মিতব্যয় ও নিরন্তর আত্মোন্নতির মূল্যবোধ সরকারি কর্মক্ষেত্রে কখনও দেখা যায়নি। এদের জন্য ভর্তুকি, বেতন বাড়ানো নয়, প্রয়োজন ব্যবসায়িক উদ্যোগ, দূরদর্শিতা ও দক্ষতার গুণাবলির কথা উচ্চারণ করা।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা

 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ