X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আসুক দুঃখ যত, হাসুন মন্ত্রীর মতো!

আহসান কবির
০১ আগস্ট ২০১৮, ১৬:০২আপডেট : ০১ আগস্ট ২০১৮, ১৬:১১

আহসান কবির একজন মানুষ দাঁত কেলিয়ে হাসছে আর আমাদের শামসুর রাহমানের কবিতা মনে পড়ছে। শামসুর রাহমান লিখেছিলেন-‘দুঃখ তার লেখে নাম’।
আমাদের বারান্দায় ঘরের চৌকাঠে
কড়িকাঠে, চেয়ারে, টেবিলে আর খাটে
দুঃখ তার লেখে নাম!
এ সময়ে বেঁচে থাকলে হয়তো লিখতেন-বাসের রেসে আর চাকায়, পিচঢালা রাস্তায়, মৃত্যুর মতো অবিরাম, দুঃখ তার লেখে নাম!
দুঃখ নাম লিখেছে জাহাঙ্গীর আলমের পরিবারে। ত্রিশ বছর ধরে ঢাকা-রাজশাহী রুটে দূরপাল্লার বাসের চালক ছিলেন তিনি। বাসের ইঞ্জিনের সাথে যে জীবন সেই জীবনের সাথেই বাজি ধরেছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। অনেক কষ্টে বড় মেয়েটাকে এসএসসি পাস করিয়ে রমিজউদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজে ভর্তি করিয়েছিলেন। জাহাঙ্গীরদের দুঃখ থাকবে, স্বপ্ন থাকতে নেই। তাই দুই পরিবহনের বাসের রেস আর রেষারেষিতে বাসের চাকার নিচে মরে পড়ে থাকে জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে দিয়া খানম মীম (ঘটনাটা ২৯ জুলাই ২০১৮-এর)।জানি না মেয়ের মৃত্যুর পর বাসের চালক হওয়ার কারণে কোন গ্লানি জাহাঙ্গীর আলমকে কুরে কুরে খাচ্ছে কিনা! জানি না টেলিভিশনে নৌপরিবহন মন্ত্রীর দাঁতাল হাসিটা কান্নাকাতর জাহাঙ্গীরের চোখে পড়েছে কিনা! মন্ত্রী শাজাহান খান হাসছেন আর জাহাঙ্গীর আলম কাঁদছেন! আমরা যারা আম-জনতা তারা এই দৃশ্য কিছুতেই মেলাতে পারছি না!

 (মোগল  সাম্রাজ্যের  চতুর্থ সম্রাটের নাম ছিল জাহাঙ্গীর। আর সম্রাট জাহাঙ্গীরের তৃতীয় পুত্রের নাম ছিল শাহজাহান! সম্রাট শাহজাহান একালে জন্মালে তাঁর নাম হয়ে যেত ‘তাজমহল শাহজাহান’। একালের মন্ত্রী শাজাহান কোন বাড়ি বানালে তার নাম দিতে পারেন ‘ বাসমহল’!)

প্রিয় পাঠক ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এ কারণে, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত কয়েকজন মানুষের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য, যারা মারা গিয়েছেন তাদের স্বজনদের সেই দুঃখ আবারও জাগিয়ে তোলার কারণে। কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে? ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি পুরনো লেখার রেফারেন্স আবারও উল্লেখ করতে হচ্ছে বলে!

দুঃখ তার লেখে নাম তুহিনের জীবনযাপনে। চাচার মৃত্যু সংবাদ শুনে টাঙ্গাইল মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তুহিন টাঙ্গাইল থেকে ঈশ্বরগঞ্জের মাইজবাগে  গিয়েছিল মাকে নিতে। এরপর চাচাকে শেষবারের মতো দেখতে তাদের যাওয়ার কথা ছিল আব্দুল্লাহপুর। ইজিবাইকে যাচ্ছিল তুহিন জন্মদাত্রী মাকে নিয়ে। ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার বৈরাটি গ্রামে দ্রুতগামী বাস ধাক্কা দেয় ইজিবাইককে, ছিটকে পড়েন তুহিনের মা। বাস তাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে। তুহিন তারপরও মাতম করে মানুষ ডাকে, নিজেই বাস ঠেলে মাকে বাসের চাকার নিচ থেকে বের করে আনতে! তুহিন তার মৃত মা শিউলি আক্তারকে যখন বের করে আনতে পারে, তখনই পালিয়ে যায় বাস ড্রাইভার। উত্তেজিত মানুষ বাসে আগুন দেয়, তারপর পোড়া বাসকে ফেলে দেয় পথের পাশের ডোবায়! পরাজয়ের আগুনে পোড়ে বাস, তবু তুহিনের দুঃখ পোড়ে না।

এপ্রিলের চার তারিখ (২০১৮) ঢাকার কাওরান বাজারের কাছে সার্ক ফোয়ারার অদূরে বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনের দুই বাসের রেসের সময়ে দুই বাসের মাঝখানে পরে প্রথমে থেঁতলে যায় হাত, অতঃপর হাত কাটা পড়ে রাজীবের। চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় মারা যায় রাজীব। খুব ছোটকালে রাজীব ও তার ভাইরা বাবাকে হারিয়েছিল। তারপর তাদের মাও মারা যান। টিউশনি আর ছোটখাটো কাজ করে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছিল রাজিব। তাঁর এতিম দুই ভাই আছে যাদের ঠাঁই হয়েছিল এতিমখানায়। জানি না রাজীবের মৃত্যুর পর তাঁরা এখন কোথায় আছে, কার কাছে গিয়ে সাহায্যের হাত পাতছে! রাজীবের মতো আরেক দুঃখী আর নিঃস্ব মানুষের নাম আবদুল করিম ওরফে রাজীব ওরফে  রাজু। ছেলেটা বাবাকে হারিয়েছিল আগেই। খালাত ভাইয়ের বাসায় থেকে পড়ালেখা করতো ছেলেটা। দিয়া খানম মীমের মতো বাসের চাকার নিচে শেষ হয়ে গেছে রাজুর দুঃখের জীবন! ভাগ্যিস নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান হাসতে হাসতে বলেননি যে আল্লাহর মাল আল্লায় নিয়ে গেছেন! বলেননি যে বিধাতা যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন! যদিও তাঁর কথাবার্তার অন্যরকম রেকর্ড আছে, যা স্মরণ করিয়ে দেয়া পারে।

খান সাহেব খুব সুন্দর করে হাসেন আর কথা বলেন। একসময়ের নৌপরিবহন মন্ত্রী কর্নেল (অব.) আকবরের মতো তিনিও কোনও লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটলে ডুবে মরা মানুষের জন্য টাকা আর ছাগল বরাদ্দ করতে ভোলেন না। ভোলেন না সত্য এবং মজার কথা সুন্দর করে বলতে। যেমন তিনি বলেছিলেন যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সবসময়ে যোগ্য লোককেই ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়! অথচ ত্রিশ বছর ধরে যিনি দূরপাল্লার বাস চালান (নিহত মীমের বাবা) সেই জাহাঙ্গীর আলম সাহেব বলেছেন যে মালিকদের আত্মীয়-স্বজন আর নেশাখোরদের  হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে স্টিয়ারিংয়ের ভার! মন্ত্রী সম্ভবত নেশাখোরদেরই যোগ্য মনে করেন!

সড়ক দুর্ঘটনায় মিশুক মুনীর এবং চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ নিহত হওয়ার পর খান সাহেব বলেছিলেন সড়ক দুর্ঘটনার জন্য চালকরা দায়ী নন! চালকদের যে তিনি খুব বেশি ভালোবাসেন তা তিনি তাঁর কথা দিয়ে বুঝিয়ে দেন। যেমন চালকদের লেখাপড়া ও অভিজ্ঞতা এবং অবৈধ লাইসেন্স নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তিনি অবলীলায় বলতে পারেন-রাস্তায় নেমে গরু ছাগল চিনতে পারলেই তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া যাবে!

তবে তাঁর ভালো কথা অনেকেই বুঝতে পারেন না এবং ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বর্ষবরণ উৎসবে নারী নিপীড়নের ঘটনাকে তিনি তেমন কোনও ব্যাপার না বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এটা একটা টুকিটাকি ঘটনা হতে পারে, সংবাদ হওয়ার মতো কোনও ঘটনাই না! তার বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠলে তিনি তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন! ২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বরে ছাপা হওয়া দৈনিক সমকাল পত্রিকার খবর অনুযায়ী বায়তুল মোকাররম মসজিদের মুসল্লিদের কয়েকজন নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানকে জুতা ছুড়ে মেরেছিলেন। আগের দিন বায়তুল মোকাররম মসজিদে অনুষ্ঠিত হওয়া এক কেরাত অনুষ্ঠানের অতিথি ছিলেন শাজাহান সাহেব। অতিথির বক্তৃতায় বলেছিলেন-হজরত মোহাম্মদ (সা.) ইসলাম ধর্ম প্রচার করেছেন। কোনও রাজনীতি করেননি!

 শাজাহান সাহেব মনে করেন সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে চালকদের বড়জোর তিন থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড  হতে পারে। তাই কিছুদিন আগে আদালত যখন মাত্র দুজন চালককে শাস্তি দেয় তখনই পরিবহন সংগঠনগুলো ধর্মঘট ডাকে এবং শাজাহান সাহেব তাদের সমর্থন দেন। আদালত যে চালককে ফাঁসির দণ্ড দেয় সেই চালক সম্পূর্ণ ঠান্ডামাথায় এক মহিলার গায়ে ট্রাক তুলে দিয়েছিল! আরেক চালক জমিরের কারণে প্রাণ হারিয়েছিলেন তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর। আদালত জমিরের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল। নৌপরিবহন মন্ত্রী এসব খুনি চালকদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, পথচারীদের গরু ছাগলের সাথে তুলনা করতে তার বাধেনি। মন্ত্রী সাহেবের তখন মনে হয়েছিল  সড়ক দুর্ঘটনায় কারও যাবজ্জীবন বা মৃত্যুদণ্ড হলে  চালকরা এমন শাস্তির হাতছানি মাথায় নিয়ে গাড়ি চালাবেন না। আর তাই পরিবহন ধর্মঘটকে শাজাহান সাহেব ধর্মঘট না বলে বলেছিলেন স্বেচ্ছা অবসর! তাই তিনি অবলীলায় বলে ফেলতে পেরেছিলেন- ট্রাক বা বাস চালকদের সাবধান করা যাবে, উত্তেজিত করা যাবে না।

শাজাহান সাহেব গণমান্য মানুষ। আমরা তার কথার বাইরে যেতে পারি না। তাই একটা গল্প বলে বিদায় নেই। দেশের বিখ্যাত এক হাজাম অবসরে গেছেন। তিনি কোনও কিছুই ফেলেননি। অবসরে যাওয়ার আগে এক মুচিকে দিয়েছেন এতদিন যা জমিয়ে রেখেছিলেন। মুচি হাজাম সাহেবের জমানো জিনিস দিয়ে তাকে সুন্দর একটা মানিব্যাগ বানিয়ে দিলো। মানিব্যাগ নিয়ে হাজাম সাহেব মাঝেই মাঝেই প্রবলেমে পড়তেন। উত্তেজনা ভর করলেই তার মানিব্যাগটা ব্রিফকেস হয়ে যেত!

তবে এটাও ঠিক যে পাবলিককে উত্তেজিত করা উচিত না! তারা মানিব্যাগকে ব্রিফকেস বানিয়ে দিতে পারে। ভিখারিকে বানাতে পারে রাজা আর রাজাকে বানিয়ে দিতে পারে ভিখারি! আর তাই বইতে পড়ানো হয়- যত হাসি তত কান্না/বলে গেছে রাম শর্মা!

বিশেষ দ্রষ্টব্য : রাজীব, রাজু আর মীমের মতো দুঃখের তালিকায় আরও নাম আছে শাহরিয়ার সৌরভের। বসুমতি পরিবহনের বাসের চাপায় নিহত হয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র সৌরভ। নাম আছে  বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাসুদ রানার। দিশারী পরিবহনের একটি বাসের চাকায় পিষ্ঠ হয়ে মারা যান মাসুদ রানা। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্র পায়েলকে হত্যার পরে তার লাশ নদীতে ফেলে দেয় হানিফ পরিবহনের কর্মীরা। গৃহকর্মী রোজিনা দুর্ঘটনায় পা হারানোর পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। দুঃখ যাদের জীবনে নাম লিখছে সেই তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে!

তালিকায় নতুন নতুন নাম যুক্ত হবে আর মন্ত্রী সাহেব হাসতেই থাকবেন। জানতে চাইলে বলবেন-আমি তো এমনি এমনিই হাসি! হাসি কি অপরাধ!

লেখক: রম্যলেখক

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
স্নাতক অনুষ্ঠান বাতিল করল ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভস্নাতক অনুষ্ঠান বাতিল করল ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
বৈশাখী মেলায় গানের আয়োজন, কমিটির সঙ্গে দর্শকদের সংঘর্ষে নিহত ১
বৈশাখী মেলায় গানের আয়োজন, কমিটির সঙ্গে দর্শকদের সংঘর্ষে নিহত ১
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ