রাজনীতিবিদদের দুর্নীতির দায়ে জেলখাটা নতুন কিছু নয়। প্রধান সারির নেতাদের কথা যদি বলি, বাংলাদেশে বর্তমানে একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতির দায়ে জেল খাটছেন। এর আগে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও ৯০-এ ক্ষমতাচ্যুত হয়ে জেল খেটেছেন। কিন্তু দুর্নীতির দায়ে এই জেলবন্দি হওয়া কি তাদের জনপ্রিয়তাকে কমাতে পেরেছে? রাজনীতিবিদদের স্বাধীনতা উত্তর জেল আর স্বাধীনতা পরবর্তী জেলখাটার মধ্যে কোনও মৌলিক পার্থক্য কী দেখা যাচ্ছে, নাকি একাকার হয়ে আছে দুর্নীতি আর জনস্বার্থে জেল গমন–বর্তমান প্রেক্ষাপটে সে প্রশ্ন উঠতে পারে।
যদি আমাদের স্বাধীনতার আগে যাই, দেখি, এই বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ৫৪ বছর বয়সের জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে ছিলেন। যা তার মোট জীবনের সিকিভাগ বলা চলে। এরমধ্যে স্কুলের ছাত্র অবস্থায় ব্রিটিশ আমলে সাতদিন কারাভোগ করেছেন। উপমহাদেশের স্বাধীনতা উত্তর সময়ে গেলে আমরা দেখি তখনও রাজনীতিবিদরা জেল জুলুমের শিকার হয়েছিলেন।
মহাত্মা গান্ধী, জওহর লাল নেহরু, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ বছরের পর বছর জেলে ছিলেন। তারা জেলে ছিলেন ব্রিটিশ রাজকে উচ্ছেদ করে স্বরাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন বলে। পুনার জেলে গান্ধীর সঙ্গে তার স্ত্রী কস্তুরবাইও ছিলেন এবং অসুস্থ কস্তুরবাইয়ের মৃত্যু হয়েছিল পুনার জেলেই। এ কারণে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি দেশের মানুষের সহানুভূতি ছিল অপরিসীম। এখানে কোনও ছলচাতুরি ছিল না। ব্রিটিশরা তাদের জেলে নিয়েছিল তারা ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন বলে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জেলে যাওয়ার প্রেক্ষাপট কিন্তু পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন রাজনীতিবিদেরাই শাসক। এখন শাসনতন্ত্রের নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন হয়। কখনও শাসক বহাল থাকে কখনও পরিবর্তন হয়। এখন রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় থেকে দুর্নীতি করে। আর ক্ষমতা ছাড়ার পর বেরিয়ে আসে তাদের দুর্নীতির কিসসা কাহিনি। বেশিরভাগ ক্ষমতা ছাড়ার পর জেলেও যায়।
কিছু দিন আগে পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষমতাচ্যুত হলেন। আমরা সবাই বললাম নেপথ্যে মিলিটারি রয়েছে। আদালত আর মিলিটারিদের আঁতাতের ফলে নওয়াজ শরীফ ক্ষমতাচ্যুত হলেন। শুধু কি আঁতাতের কারণে জেল? আসলে আদালত দেখলেন অফশোর, পানামা পেপারস-এ নওয়াজের যে সম্পত্তির কথা প্রকাশ পেয়েছে তার বিবরণী তিনি নির্বাচনি মনোনয়নপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত সম্পদ বিবরণীতে দেননি। তখনই বিচারপতিরা তার সংসদের সদস্যপদ বাতিল করেছিলেন।
অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে তার দলের শহীদ খাকান আব্বাসীকে প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন। মুসলিম লীগ মিথ্যার অভিযোগ তোলেনি। নওয়াজ, তার মেয়ে এবং মেয়ের জামাই এখন জেলে। গত নির্বাচনে তার দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ পরাজিত হয়েছে। এখন ইমরান খানের তেহরিক-ই ইনসাফ দল ক্ষমতাসীন। তবে দুর্নীতির কারণে মুসলিম লীগ শেষ হয়ে যায়নি, সংসদে ভালো আসন নিয়ে বিরোধী দলে।
ভারতেও এখন রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে প্রতিনিয়ত দুর্নীতির নানা অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে নেহরু, শাস্ত্রী, ইন্দিরা স্বচ্ছ ভাবমূর্তি নিয়ে বিদায় নিয়েছেন। রাজীবের বিরুদ্ধে বোফোর্স কেলেঙ্কারির কথা উঠেছিল। কিন্তু বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং তা প্রমাণ করতে পারেননি। নরসীমা রাওয়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হয়েছিল, তা প্রমাণিতও হয়েছিল। আদালত তার বয়সের কথা বিবেচনা করে জেল দিয়েছিলেন ‘টিল দ্য রাইজিং অফ দ্য কোর্ট’। অর্থাৎ ভারতীয় আইন অনুযায়ী কয়েক সেকেন্ডের জেল।
এই উপমহাদেশে দুর্নীতি এখন সংস্কৃতি হয়ে গেছে। কোনও প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রী দুর্নীতিতে জড়িত হলেও জনপ্রিয়তা হারান না। তামিলনাড়ুর জয়ললিতা জয়রাম তার পালকপুত্রের বিয়েতে চেন্নাই স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠান করেছিলেন এবং কয়েক লক্ষ লোকের ভোজের আয়োজনও করেছিলেন। জনশ্রুতি আছে, এ অনুষ্ঠানে নাকি ২০/২৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। অনুষ্ঠানের সূত্র ধরে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। যেহেতু তিনি তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী সে কারণে চেন্নাই কোর্টে তার মামলা হয়নি।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তার মামলা হয়েছিল পার্শ্ববর্তী রাজ্য কর্নাটকের এক আদালতে। তার জেলও হয়েছিল। কিন্তু তার জনপ্রিয়তার কোনও হেরফের হয়নি। ২০১৪ সালে আদালতের নির্দেশে জয়ললিতাকে যখন জেলে পাঠানো হয়েছিল, তার পরের কয়েক মাসে প্রায় আড়াইশ’ জন আত্মহত্যা করেছিলেন।
এখন নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় ফ্রান্স থেকে রাফায়েল যুদ্ধবিমান কেনার কথা ছিল এবং একটা চুক্তিও হয়েছিল। কথা ছিল বিমান এসেম্বল না করে সাপ্লাই করা হবে এবং রাষ্ট্রীয় এরোনটিক কারখানায় ভারতীয় টেকনিশিয়ানরা পরিপূর্ণ বিমান তৈরি করবে। ফ্রান্সের টেকনিশিয়ানরা ভারতের টেকনিশিয়ানকে সহায়তা করবে।
নরেন্দ্র মোদি এ চুক্তি বাতিল করে রাফায়েল কেনার নতুন চুক্তি করেছেন প্রায় দ্বিগুণ মূল্য স্থির করে। আর বিমান এসেম্বিলিং হবে আম্বানিদের এক এরোনটিক কারখানায়। আম্বানিরা এখন এ কারখানা করছে রাফায়েল বিমান এসেম্বিলিং করার জন্য। তাদের এ কাজে পূর্ব কোনও অভিজ্ঞতা নেই। কংগ্রেস বলছে, ২০১৯ সালের নির্বাচনে পার্টি ফান্ড কালেকশন করার জন্য রাষ্ট্রের এ অপূরণীয় ক্ষতি করেছেন নরেন্দ্র মোদি।
বাংলাদেশের রাজনীতিও কলুষিত হয়ে গেছে দুর্নীতির কারণে। জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন বিএনপির সাত্তার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে। তিনি দীর্ঘ ৯ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তার বিরুদ্ধে সাহাবুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও খালেদা জিয়ার সরকার বহু মামলা দিয়েছিল। তিনি প্রায় সুদীর্ঘকাল কারাগারে ছিলেন। তিনিও কারাগার থেকে ৫ আসনে নির্বাচন করেছিলেন এবং ৫টি থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
খালেদা জিয়ার সরকার ২০০১ সালে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসেন। তখন তার বড় ছেলে তারেক রহমান বয়সপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তারেক বনানীর হাওয়া ভবনে নিজস্ব দফতর প্যারালাল সরকার চালু করেছিলেন। মাতৃস্নেহের কারণে বেগম জিয়া তারেক জিয়ার এমন কাজ প্রতিরোধ করতে পারেননি। যার কারণে দেশে বিদ্যুৎ ঘাটতি থাকার পরও কোনও বিদ্যুৎ প্রকল্প তারেকের কমিশন বাণিজ্যের কারণে হতে পারেনি। ৯০ মেগাওয়াট যে বিদ্যুৎ প্রকল্পটি টঙ্গিতে হয়েছিল তাও ছিল রং করা পুরনো যন্ত্রপাতি দিয়ে।
মামলার সময় এ প্রকল্পটির বাংলাদেশি এজেন্ট সালমা রহমান আদালতে সেটাই বলেছিলেন এবং সিঙ্গাপুরে যে অ্যাকাউন্টে সালমারা টাকা জমা দিয়েছিলেন তার কথাও প্রকাশ করেছিলেন। বাংলাদেশ সরকার সিঙ্গাপুর সরকারের সহায়তায় এ টাকা ফেরতও এনেছিলেন। তারপরও অনেকে বিশ্বাস করেন না তারেক দুর্নীতিবাজ। তার জন্যও আত্মহত্যা করার লোক পাওয়া যেতে পারে। রাজনীতিবিদেরা সবকিছুই সুকৌশলে ‘বৃহত্তম স্বার্থের’ কথা বলে কাজ করে। নিজের স্বার্থকে সর্বজনীন স্বার্থ হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চায়। তাদের নিজের স্বার্থকে একটা নৈর্ব্যক্তিকতা বা সর্বজনীনতার মোড়কে পুরে পেশ করে।
খালেদা জিয়া এখন যে মামলায় জেলে আছেন তাও এতিমের জন্য বিদেশি সরকার কর্তৃক পাঠানো টাকা আত্মসাতের বিষয়। এত ক্ষুদ্র হীন কাজ করার পরও রাজনীতিবিদের জনপ্রিয়তা কমে না। দুর্নীতির সাজাকে তারা সরকারি জুলুম হিসেবে চালিয়ে দিতে পারে। এই ব্যর্থ, অপদার্থ দুরাচারি রাজনীতিবিদরাই বারবার ভোটে জিতে আসেন, সংসদে যান, মন্ত্রী হন। একটি সরকার দেশের অর্থনীতির হাল ফেরাতে পারছে কিনা, ভোটের রাজনীতিতে তার কোনও বিচার হয় না। গণতন্ত্র এখানে সব সময় সুফল দিতে পারে না।
অর্থনীতির একটা বৃহৎ ও সামগ্রিক লক্ষ থাকে। ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ রাজনীতি সে লক্ষ্য পূরণের পথে তখন বাধা হয়ে দাঁড়ায়। নির্বাচন এলে সব দেশে রাজনীতিবিদেরা উতলা হয়ে ওঠেন। সত্য-মিথ্যা একাকার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে উঠেপড়ে লেগে যান।
গত দশ বছরে বাংলাদেশে উন্নয়নের একটা গতি এসেছে। তা ভণ্ডুল করার জন্য একটা চক্র নিজেদের সংগঠিত করছে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে জনদরদী সেজে, নানা জোটের নামে ভোটের রাজনীতি করছে। সাধারণ মানুষ সে চক্রের মাঝে যদি পা রাখেন তবে দেশের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে। রাজনৈতিক হত্যার রাশও খুলে যেতে পারে। নির্বাচনের আগে দেশের মানুষ এখন সেই সন্ধিক্ষণে আছে। আছে কঠিন অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট