X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচনের সমতল ভূমি আছে, নেই!

বিভুরঞ্জন সরকার
০৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৫:৩০আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৫:৩২

বিভুরঞ্জন সরকার ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। প্রার্থিতা চূড়ান্ত হবে ১০ ডিসেম্বর। এবার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এখন পর্যন্ত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার কোনও খবর নেই। ১৯৯১ সাল থেকে নির্বাচন হয়ে আসছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছিল। তবে ওই নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক আছে। নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক হয়নি। অধিকাংশ দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এবারের নির্বাচন তাই নানা কারণেই ব্যতিক্রমী। নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ-কৌতূহল স্বাভাবিকভাবেই বেশি।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে দলীয় সরকারের অধীনে। নির্বাচনে নিবন্ধিত ৩৯টি দলের সঙ্গে অনিবন্ধিত কয়েকটি দলও অংশ নিচ্ছে, অন্য দলের মার্কা নিয়ে অথবা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। নির্বাচন তাই হচ্ছে অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। তবে নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হবে কিনা সে প্রশ্ন আছে। নির্বাচনের পরিবেশ বাহ্যত শান্তিপূর্ণ থাকলেও নির্বাচনটি সুষ্ঠু ও অবিতর্কিত না-ও হতে পারে। গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো শান্তিপূর্ণ হয়েছে কিন্তু সুষ্ঠু হয়নি। নানা অনিয়ম হয়েছে, ফলাফল প্রভাবিত হয়েছে বলে অভিযোগও আছে।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেমন হবে তা নিয়ে আগাম মন্তব্য করা কঠিন। নানা কারণে মানুষের মধ্যেও শঙ্কা আছে। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সবার প্রত্যাশা হলেও অশান্তি তৈরির শক্তি নির্বাচনের মাঠে আছে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিবাদ-কোন্দলেও শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে। এরমধ্যেই একাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এক ধরনের টান টান উত্তেজনা আছে। এই অবস্থায় ভোটের দিনের চিত্র খুব স্বাভাবিক থাকতে পারে, আবার অস্বাভাবিকও হয়ে উঠতে পারে।
দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না বলে প্রচার করে আসছে বিএনপি। বিএনপির এই প্রচারণায় বিশ্বাস করেন এমন মানুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপরও আস্থা নেই বিএনপির। কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশনকে সরকার-অনুগত বলে বিএনপি মনে করে। যদিও একজন নির্বাচন কমিশনারও অন্তত আছে যার মতভিন্নতার কথা গণমাধ্যমে এসেছে। বিএনপির প্রচারণা যদি সত্য বলে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে তো এটা এখনই বলে দেওয়া যায় যে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না! কারণ, নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনেই হচ্ছে।
নির্বাচন ভালো হবে কী মন্দ হবে সেটা সরকার কিংবা নির্বাচন কমিশনের চেয়ে বেশি নির্ভর করে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ ভোটারদের ওপর। দল যদি প্রার্থী এবং তার সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে, কোনও ধরনের অপপ্রচারের আশ্রয় নিয়ে উত্তেজনা না ছড়ায় তাহলে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের সহায়ক পরিবেশ বজায় থাকে। আর সাধারণ ভোটাররা যদি তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগে দৃঢ় ও সৎ থাকেন তাহলেও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এতসব কিছুর সমন্বয় এবারের নির্বাচনে হবে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।
নির্বাচনের মাঠে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি। প্রথম থেকেই বিএনপির দাবি ছিল নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের। শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে কোনোভাবেই নির্বাচন নয়– এমন বক্তৃতা বিএনপি নেতারা বহু দিয়েছেন। পরে দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পর বিএনপির দাবি হয়, খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে নির্বাচন নয়। বর্তমান নির্বাচন কমিশনও বিএনপির কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। বিএনপির এই দাবিগুলো সরকার উপেক্ষা করায় কারও কারও মনে হয়েছিল বিএনপি হয়তো নির্বাচনে যাবে না।
আওয়ামী লীগ নেতারা অবশ্য বারবার বলে এসেছেন যে বিএনপি নির্বাচনে আসবে, নির্বাচনে আসতে তারা বাধ্য। বিএনপির সঙ্গে কোনও গোপন সমঝোতার ভিত্তিতে কি আওয়ামী লীগ নেতারা এমন কথা বলতেন? না, সেটা মনে হয় না। এটা ছিল সাধারণ রাজনীতির হিসাব। গত নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। পরেরটাতেও না নিলে বিএনপি নিবন্ধন বাতিলের হুমকির মধ্যে পড়তো। তাছাড়া গত নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিএনপি নির্বাচনে না গিয়ে সরকারকে চাপের মুখে ফেলতে পারবে বলে যে আশা করেছিল তা ভুল প্রমাণ হয়েছে। সরকার একতরফা নির্বাচন করেও দিব্যি পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু না সংসদে আছে, না আন্দোলনে আছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নেতৃত্ব সংকট। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জেলে। তিনি শারীরিকভাবেও পুরোপুরি ‘ফিট’ নন। তার গুরুতর অসুস্থতার কথা বিএনপির পক্ষ থেকেই বলা হয়। দলের দুই নম্বর নেতা বা দ্বিতীয় প্রধান তারেক রহমান বিভিন্ন মামলায় দণ্ডিত এবং লন্ডনে বসবাস করছেন। লন্ডনে বসে দল পরিচালনার কলকাঠি নাড়লেও ক্ষমতার পরিবর্তন না হলে তার পক্ষে দেশে ফেরা সম্ভব নয়। ফলে বিএনপির নেতৃত্ব কে দেবেন, বিএনপির মালিকানা জিয়া পরিবারের হাতছাড়া হবে কিনা সেসব প্রশ্নও সামনে আসছে।

দাবি আদায়ের জন্য বারবার আন্দোলনের হুমকি দিলেও বিএনপি কোনও আন্দোলন করতে পারেনি। বিএনপি প্রমাণ করেছে যে তারা আন্দোলনের দল নয়।  সরকার বিএনপির কোনও দাবি মানেনি। তারপরও একেবারে খালি হাতে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এখন বিএনপি বলছে, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই। নির্বাচন কমিশন মাঠ সমতল করতে ব্যর্থ হয়েছে।
বিএনপি ক্ষমতার বাইরে আছে একযুগ। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে টানা দুই মেয়াদে। প্রশাসন আওয়ামী লীগের সাজানো। ফলে নির্বাচনের মাঠ স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা আওয়ামী লীগের দিকে হেলে থাকার কথা। এই মাঠ যে সমতল হবে না– এটা কি বিএনপির অজানা? কিছুই বিএনপির অজানা নয়, অগোচরেও নেই। সরকার বা নির্বাচন কমিশন যা করছে তা প্রকাশ্যেই করছে। বরং বিএনপি তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে কি করছে তা নিয়ে রাখঢাক আছে। বিএনপি আসলে কী চায়, নির্বাচনে তাদের মূল টার্গেট কী– এটা অনেকের কাছেই অস্পষ্ট। বিএনপি কি মনে করছে যে আগামী নির্বাচনে জয়লাভ করে তারা সরকার গঠন করবে? সাধারণ কর্মী-সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীদের তেমন আশা থাকতে পারে, থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিএনপির যারা নীতিনির্ধারক তারা তো নিজেদের শক্তি-দুর্বলতা সম্পর্কে অবগত আছেন। তারা যদি এই নির্বাচনেই জিতে সরকার গঠনের আশা করে থাকেন তবে তারা ভুল অবস্থানে আছেন। তাদের এই আশা পূরণের বাস্তবতা দেশে নেই।
বিএনপির যদি লক্ষ্য হয়, নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত করা এবং এটা প্রমাণ করা যে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, তাহলে বরং তাদের লক্ষ্য পূরণের সম্ভাবনা দেখা যায়। বিএনপি নির্বাচনে জেতার থেকে নির্বাচনকে বিতর্কিত করার চেষ্টাই বেশি করছে বলে মনে হয়। তারা এখনও অভিযোগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীদের তালিকা নির্বাচন কমিশনে জমা দিয়ে তাদের নির্বাচনি কার্যক্রম থেকে দূরে রাখার দাবি জানিয়েছেন। প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের গায়ে রাজনৈতিক লেবল এঁটেও বিএনপি সুবুদ্ধির পরিচয় দিচ্ছে বলে মনে হয় না। তাদের তালিকাভুক্তরা যদি আওয়ামী লীগের পক্ষের হয়ে থাকে তাহলে তালিকার বাইরে যারা তারা কি আওয়ামী লীগ বিরোধী? এরকম সরল বিভাজন কি বিএনপিকে কোনও সুবিধা দেবে?
বিএনপিকে গণমাধ্যমে যতটা সক্রিয় দেখা যাচ্ছে ভোটের মাঠে তেমন দেখা যাচ্ছে না। কোনও প্রার্থী এলাকায় গিয়ে জনসংযোগ করছেন বলে খবর শোনা যায় না। কারণ, দলের আসল প্রার্থী কে সেটাই এখনও ঠিক হয়নি। নির্বাচনের মাঠ সমতল নেই, হওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা কম, তারপরও বিএনপিকে নির্বাচন করতে হবে। কারণ, বিএনপির সামনে এখন আর কোনও ভালো বিকল্প নেই। রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা যাদের হাতে তারা যা চায়, তা-ই হয়। বিএনপির হাতে কি রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা আছে? কেউ যদি এই প্রশ্নের হ্যাঁ সূচক জবাব দেন, তাহলে তার সঙ্গে তর্ক বা আলোচনা অর্থহীন। রাজনীতিতে ‘আকস্মিকতা’ বা ‘হঠাৎ’ ফ্যাক্টর কখনও কখনও কাজ দিলেও সব সময় তা ফল দেয় না। অন্য সবকিছুর মতো রাজনীতিও কার্যকারণ সম্পর্কহীন নয়।

লেখক পরিচিতি: গ্রুপ যুগ্ম সম্পাদক, আমাদের নতুন সময়, আমাদের অর্থনীতি এবং আওয়ার টাইম।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ