X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বড়দিন বড়দের নয়

দাউদ হায়দার
২৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৩:১১আপডেট : ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৮:০৫

দাউদ হায়দার দু’জনের একজনকেও কখনও আপাদমস্তক বোরখায় ঢাকা দেখিনি। দু’জনেই হিজাব পরেন। কেশবতী নারী কি-না, বোঝা দুষ্কর। দু’জনের পরনে শাড়ি বা সালোয়ার কামিজ। শীতে ভিন্ন বেশভূষা। সবই পশ্চিমা। কোট-প্যান্ট, হাতে দস্তানা। হিজাবের ওপরে ক্যাপ।
দু’জনেই বাংলাদেশের। একজন সিলেটের। একজন চট্টগ্রামের। আমেরিকায়-ব্রিটেনে যেমন, প্যারিস-বার্লিনেও, সিলেটিরা সাধারণত নিজেদের বাংলাদেশি বলেন না, বাঙালি মহলে, পরিচয় দেন, ‘সিলেটি’। মনে হওয়া স্বাভাবিক, সিলেট বাংলাদেশের বাইরে। ভাবেচক্করেও সেইরকম বোঝান। ভাষার আলাদা মেজাজ তো আছেই।
দু’জনের বয়স কত, কখনও জিজ্ঞেস করিনি, ৩০/৩২ হবে হয়তো। কিংবা কম। দু’জনের সন্তানের জননী। সিলেটির ছেলে, বয়স সাত। চট্টগ্রামীনের মেয়ে, বয়স ছয়। দু’জনেই কিন্ডারগার্টেনে ছাত্রছাত্রী। বড়দিন এলেই দুই মায়ের (সন্তানের পিতারও) মহাবিপদ। দু’জনের বাসই বার্লিনে। বার্লিনেই দুই নারীর সন্তানের জন্ম। সন্তানের বয়স যখন দেড়/দুই, তখন থেকেই ‘কিটা’-য় (শিশু স্কুল। মূলত শিশুসদন। লেখাপড়া নয়। শিশুদের খেলাধুলো, শিশুর জগত। দেখভালে ৪/৫ জন।) ভর্তি।

দুই নারী খুব বেশি লেখাপড়া শেখেননি, স্কুলের গণ্ডি পেরোননি দেশে। বিয়ে হয়েছে ২০/২১ বছর বয়সে। বিয়ের পরেই আসতে পারেননি, ২/৩ বছর সময় লেগেছে, জার্মান সরকার অভিবাসীর ঠাঁই পোক্ত করার ব্যাপারে, গত পনেরো বছর খুব কড়া। উপরন্তু যদি হয় ‘অ্যাসাইলাম’ (কবি আলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত’র বচন ‘আসিলাম’) রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থী। দু’জনের স্বামীই রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছেন, কাজ করার অনুমতিও। কাজ করলে নিয়মিত ট্যাক্স দিলে, স্বাস্থ্যবীমা প্রতিমাসে শোধ করলে, কোনও ক্রাইম না করলে রাষ্ট্রীয় কিছু সুবিধাও পাওয়া যায়, নিজের দেশে বিয়ে করে বউ আনতেও, তবে সময়সাপেক্ষ।

দু’জনের স্বামীই ভারতীয় রেস্তরাঁয় কর্মী। কার যেন লেখায় (বিদেশি লেখক) পড়েছিলুম, ‘শ্রমিক শ্রমিকই, বেশি শিক্ষার দরকার কী? গা গতরের শ্রমই তাঁর শিক্ষা। মেধা মগজের প্রয়োজন নেই।’

ফরিদপুরের একজন শ্রমিক (তিনিও একটি ভারতীয় রেস্তরাঁয় কর্মী), বলেন একবার, ‘এহ্যানে, এই টু পাইস ইনকাম করবার লাইগা আইছি, জার্মান কালচার শিখবার লাইগা আহি নাই’।

অধিকাংশ রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী-শ্রমিকের একই কথা। গ্যেয়টে কে, বিসমার্ক কে, বিটোফেন কে, মোৎসার্ট, বাখ কে, টোমাস মান, গ্রাস বা ব্রেখশট্ কে জানতে আসেনি। জানার ইচ্ছেও নেই। জেনে কী হবে। ‘হ্যারা (কারা) ক্যাঠায় (কে) জানলে কী টু পাইস বেশি পামু?’ বলেন ফরিদপুরের শ্রমিক। বলি, ‘হাঁচা (সত্যি) কথা। ঠিক কইছো।’

-যেমন বলেন দুই নারীর দুই স্বামী।

দুই স্বামীই পাক্কা মুসলিম। মাথায় টুপি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। (বৌদেরও পড়তে বাধ্য করেছেন। হিজাব পরাও)। মসজিদে যান জুম্মার নামাজে। হালাল মাংস ছাড়া খান না। এমন কী ফান্টা, কোলাও। ফান্টা, কোলায় নাকি অ্যালকোহল থাকে। বাড়িতে টিভি রাখেন না। দুই দম্পতি মহাবিপদে আছেন, গত তিন বছর ধরেই। এমনই বিপদ, সন্তানকে পেটাতে পারেন না (পেটালে, পুলিশ জানলে জরিমানা ও জেল)। সন্তানের সহপাঠী/পাঠিনী অধিকাংশই খ্রিস্টান। হিন্দু-বৌদ্ধ-ইহুদিও আছে। খ্রিস্টান সহপাঠী/পাঠিনী বন্ধুদের (ক্লাসের) বড়দিন উপলক্ষে নিমন্ত্রণ করে বাড়িতে। ঘরে ‘ক্রিস্টমাস ট্রি’ সাজানো। ট্রি-তে নানা আলোকসজ্জা, উপহার। বন্ধুদের দেয়, খাওয়াদাওয়াও হয় (নিকোলাস, অর্থাৎ সান্তাক্লজও যায়। ভারত-বাংলাদেশের বহু ছাত্রও- যারা মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে- বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পাঠানো হয়। টাকা পায়। বকশিশও)।

কার বাড়িতে কত বড় ‘ক্রিসমাস ট্রি’, কত বাহারি, কে কত উপহার পেল, কিন্ডারগার্টেনে, ছুটির পড়ে বিশদ আলোচনা। প্রত্যেকে বড়াই করে, জাহির করে।

বাংলাদেশের দুই যুগল/দম্পতি বললেন, ‘ভাইজান, বড়দিনের মাস বহুৎ খতরনাক। বড়দিন বড়দের নয়, পোলাপানের। ডিসেম্বরের শুরু থেকেই পার্ক-চত্বর-খোলা মাঠে হরেক কিসিমের মেলা। সন্ধ্যার আগেই শহর আলোয় ঝলমলে। মেলায় নানা খেলা, সার্কাস। পোলাপানের জন্যেই বাহারি আয়োজন। না লইয়া গেলে কান্না। গেলে কেনাকাটি। অনেক খরচ। এই বড়দিন পোলাপানের, আমাগো, বড়দের নয়।’

-এতেক কহিয়া চুপ নন। বলেন আরো, ‘হায় আল্লাহ, কী মুসিবত। আমরা হইলাম আল্লাহর খাস বান্দা, মোছলমান। আমাগো সন্তানের মুখ চাইয়া আল্লাহর কাছে মাফ চাই।’

-কেন? জিজ্ঞেস করি।

করুন মুখে বলেন, ‘ছেলে/মেয়ে স্কুলের বন্ধুদের বাড়িতে ‘ক্রিস্টমাস’, ওরা যায়, ছেলে/মেয়ের আবদারে আমাদেরও করতে হয়। না করলে ছেলে/মেয়ের কষ্ট। এইটা অসহনীয়। ছেলে/মেয়ের ব্যাজার মুখ দেখলে কোন বাপ মা সুখে থাকে? আল্লাহ আমাদের নিশ্চয় মাফ করবেন। কি বলেন ভাইজান?’

-বলি এটা গুনাহ নয়। বড়দিন বড়দের নয়। ছোটদেরই। ছোটরাই বেশি খুশি, ধর্মের নামে প্রত্যেকে শামিল। ছোটরা আরো। জাগতিক।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

 

/এসএএস/এমএনএইচ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ