X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এবারও ‘সরকারি’ বিরোধী দল?

আমীন আল রশীদ
০২ জানুয়ারি ২০১৯, ১৭:২৬আপডেট : ০২ জানুয়ারি ২০১৯, ১৭:৩৫

আমীন আল রশীদ একাদশ জাতীয় নির্বাচন কেমন হলো, নির্দলীয় সরকারের অধীনে ভোট হলে আওয়ামী লীগ-বিএনপির আসনের অনুপাত কত হতো, ভোটে কতটা অনিয়ম হয়েছে—এসব নিয়ে তর্ক হয়তো আরও কিছুদিন চলবে। কিন্তু এসব তর্ক ছাপিয়ে যে প্রশ্নটি এখন সামনে আসছে তা হলো, দশম সংসদের মতো এবারও কি তাহলে দেশবাসী আরেকটি ‘সরকারি’ বিরোধী দল দেখতে যাচ্ছে?
এবার ২৯৮টি (একটিতে নির্বাচন স্থগিত, অন্যটিতে ফলাফল স্থগিত) আসনের মধ্যে এককভাবে ২৫৯টিতেই জয় পেয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি জিতেছে মাত্র ৫টিতে, তার শরিক গণফোরাম ২টিতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২০টি আসন পেয়েছে আওয়ামী লীগের শরিক জাতীয় পার্টি। তারা মহাজোটের অংশ। তাহলে এবার বিরোধী দল কে হবে? ধরে নেওয়াই সঙ্গত যে, গোটা বিশেক আসন নিয়েই এবার বিরোধী দলের ‘ভূমিকা’ পালন করবে জাতীয় পার্টি। দশম সংসদে তারা যেমন বস্তুত ‘সরকারি বিরোধী দল’ ছিল, বোধ হয় এবারও সেই একই পথে হাঁটবে জাতীয় সংসদ।

বিএনপির পাঁচজনসহ ঐক্যফ্রন্টের যে মাত্র ৭ জন প্রার্থী জয়ী হয়েছেন, তারা শপথ নেবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। কারণ, তারা ভোটের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছেন। ফলাফল প্রত্যাখ্যানের পরে শপথগ্রহণ স্ববিরোধী। সুতরাং ওই সাতটি আসনে উপনির্বাচন হবে এবং এই আসনগুলোতেও আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা জয়ী হবেন বলেই ধরে নেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে এককভাবে আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা দাঁড়াবে ২৬৬টিতে।

আওয়ামী লীগ এককভাবে এত বেশি আসন পেয়েছিল ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। ওই বছর তাদের আসন সংখ্যা ছিল ২৯৩। ফলে প্রথম সংসদে বিরোধী দল বলে কিছুই ছিল না। ছিল না বলে পরবর্তীতে এর সমালোচনা করে আবুল মনসুর আহমদ তাঁর ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইতে লিখেছেন, ‘পার্লামেন্টারি পদ্ধতির ভিত্তি স্থাপন মানে বিরোধী দলের যথেষ্ট সংখ্যক ভালো মানুষ নির্বাচিত হবেন, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা।… কাজেই নির্বাচনে (১৯৭৩) সরকারি দল আওয়ামী লীগের বিরোধী দলের প্রতি উদার হওয়া উচিত ছিল। উদার হইতে তারা রাজিও ছিলেন। রেডিও টেলিভিশনে বিরোধী দলসমূহের নেতাদের বক্তৃতার ব্যবস্থা করিতেও তাদের আপত্তি ছিল না।…আমি আওয়ামী নেতৃত্বকে পরামর্শ দিয়াছিলাম বিরোধী পক্ষের অন্তত জনপঞ্চাশেক নেতৃস্থানীয় প্রার্থীকে নির্বাচনে জয়লাভ করিতে দেওয়া উচিত। তাতে পার্লামেন্টে একটি সুবিবেচক গণতন্ত্রমনা গঠনমুখী অপজিশন দল গড়িয়া উঠিবে। আমার পরামর্শে কেউ কান দিলেন না।’

এই ‘কানে না নেওয়া’টাই গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। কেননা, এবারও নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকে দলমত নির্বিশেষে সবারই প্রত্যাশা ছিল, একটি অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, যার মধ্য দিয়ে একটি স্থিতিশীল সরকার ও কার্যকর সংসদ গঠিত হবে। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে অন্য দলগুলোর আসনের ব্যবধান এতটাই আকাশ-পাতাল হয়ে গেলো যে, সংসদে চেক অ্যান্ড ব্যালান্স বা ভারসাম্য বলে কিছু থাকবে না—যেটি গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য খুব প্রয়োজন। ১৯৭৩ সালে আবুল মনসুর আহমদ যেমন অন্তত জনাপঞ্চাশেক নেতৃস্থানীয় প্রার্থীকে জয়ের সুযোগ দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন, এবারও রাজনীতি সচেতন মানুষের প্রত্যাশা ছিল, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসাটা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সংসদ কার্যকর রাখা এবং বিএনপির মতো একটি বড় দলের ন্যূনতম প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। কিন্তু ভোটের ফলাফল দেখে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন বলে আমি মনে করি।

ফলে এবার একাদশ জাতীয় নির্বাচনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হলো, দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিরোধী দলে যাওয়ার মতো আসনও পেলো না। এবং তারা শপথও নেবে না। দল হিসেবে এই ঘটনাটি ভবিষ্যতে বিএনপিকে আরও কতটা খাদের কিনারে নিয়ে যাবে কিংবা দলে ভাঙন তৈরি হবে কিনা, সেই আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ, দলীয় সরকারের অধীনে, বিশেষ করে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে বিএনপির অভ্যন্তরেই বিরোধ ছিল। কিন্তু মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট শেষতক নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও এখন দলের ভেতরে মির্জা ফখরুলের অবস্থান কী হবে, তাকে সন্দেহ করা হবে কিনা, ড. কামাল ভেতরে ভেতরে আওয়ামী লীগের পারপাস সার্ভ করেছেন কিনা, এসব অভিযোগও উঠতে পারে। তবে সেই প্রশ্নগুলো একান্তই বিএনপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়।

২.

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশের রাজনীতিতে মোটা দাগে দুটি নতুন ঘটনার জন্ম দিয়েছিল–

১. বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অর্ধেকের বেশি সংসদ সদস্যের নির্বাচিত হওয়া এবং ২. প্রথমবারের একটি ‘সরকারি বিরোধী দল’ গঠন।

শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দশম সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ হয়ে থাকবে। ২০১৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদও জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনায় যে আত্মসমালোচনা করেছেন, যে গ্লানিবোধের কথা বলেছেন, সেটিকে দশম সংসদের ‘সেরা আকুতি’ হিসেবেও বিবেচনা করা যায়। তিনি বলেছিলেন, ‘জাতীয় পার্টির এমপিরা বিরোধী দল হিসেবে পরিচয় দিতে পারেন না। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা পান। কারণ, তারা সরকারি দল না বিরোধী দল– সাংবাদিকরা তা জানতে চান।’ ফলে প্রশ্ন উঠেছে, এবারও জাতীয় পার্টি যদি বিরোধী দলে যায় (আওয়ামী লীগের পরে সর্বোচ্চ ২০টি আসন পেয়েছে তারা), তাহলে এবারও দশম সংসদেরই পুনরাবৃত্তি হবে কিনা? যদিও মাত্র ২০টি আসন নিয়ে যারা বিরোধী দলের চেয়ারে বসবে, তারা আসলে কী ধরনের বিরোধিতা করবে বা করতে পারবে—সেটি একটি বড় একাডেমিক তর্কের বিষয়।

বিরোধী দল এক অর্থে সরকারেরও অংশ। কেননা, বিরোধী দলীয় নেতা মন্ত্রীর মর্যাদা পান। তাছাড়া বিরোধী দলকে ছায়া সরকারও বলা হয়। কিন্তু আদর্শিক বিরোধী দল বলতে যা বুঝায়, অর্থাৎ সরকারি দল যখন গণবিরোধী কোনও বিল পাস করতে চায় বা এমন কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করে যাতে রাষ্ট্রের কোনও একটি অংশেরও ক্ষতির কারণ হতে পারে, বিরোধী দল তখন এর বিরুদ্ধে প্রথম সংসদে এবং প্রয়োজনে রাজপথে প্রতিবাদ গড়ে তোলে। একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকার মানেই হলো সরকার ও সরকারি দল সব সময়ই এক ধরনের চাপের মধ্যে থাকে। যেকোনও সিদ্ধান্ত বা বিল নির্বিবাদে পাস হয়ে যায় না। সেখানে আলোচনা-তর্ক-বিতর্ক হয়। একটি আদর্শিক বিরোধী দল শুধু হ্যাঁ-না ভোটের মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখে না। বরং তারা জাতীয় বাজেটেও নিজেদের চিন্তা ও দর্শন মানুষের সামনে তুলে ধরে। কিন্তু দশম সংসদে জাতীয় পার্টির কর্মকাণ্ড বস্তুত সরকারি দলেরই অনুরূপ ছিল। কালেভদ্রে তারা দুয়েকবার ওয়াকআউট করলেও সেগুলোকে অনেকেই লোক দেখানো বলে মনে করেন। যদিও সংসদ নেতা বিভিন্ন সময়ে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির প্রশংসা করেছেন এই বলে যে, অতীতে বিরোধী দলগুলো বিরোধিতার নামে হরতাল-অবরোধ-সহিংসতা চালিয়ে মানুষের জানমাল ও রাষ্ট্রের সম্পদ নষ্ট করেছে, গত ৫ বছরে অন্তত জাতীয় পার্টি সে রকম কোনও কর্মসূচি দেয়নি। দেয়নি কারণ তারা একইসঙ্গে সরকারেরও অংশ। আর দিতে পারেনি কারণ তাদের সেই সক্ষমতা নেই। তৃতীয়ত তারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটেরই অংশ। ফলে নিজের জোটের বাইরে গিয়ে বড় কোনও কর্মসূচি দেওয়া তার রাজনৈতিক অবস্থানের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। যে কারণে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের পদ থেকে এরশাদ বারবার পদত্যাগ এবং মন্ত্রিসভা থেকে তার দলের সদস্যদের বেরিয়ে আসার কথা বললেও তা কথা কথাই থেকে গেছে।

বস্তুত এই ধরনের বিরোধী দলকে সরকার বা সরকারি দল কখনও ভয় করে না। বরং আড়ালে তাদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করে। সরকারি দল জানে, তারা যেকোনও বিলই আনুক না কেন, তা পাস করতে তাদের কোনও ধরনের বিরোধিতার মুখে পড়তে হবে না। আবার সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ এমপিদের এমন ভয়ের মধ্যে রাখে যে, অনাস্থা ভোট ছাড়া অন্য যেকোনও ইস্যুতে, বিশেষ করে বিল পাস ও সংশোধনের বিরুদ্ধে ভোট দিলে তার সদস্যপদ যাওয়ার আশঙ্কা না থাকলেও তারা ওই ভীতির কারণে দলের সকল সিদ্ধান্তেই হ্যাঁ বলে সায় দেন। ফলে বিরোধী দলের আকার বড় না হলে এবং সরকারি দলের দখলে দুই-তৃতীয়াংশ আসন থাকলে সেই সংসদ কখনোই প্রাণবন্ত হয় না। এবং সেই সংসদে যেকোনও বিল অনায়াসে পাস করিয়ে নেওয়া যায়। আর সংসদে যখন এরকম ‘ওয়ান ম্যান শো’ বা সংসদ নেতার কথাই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হতে থাকে, সেই সংসদ বস্তুত সরকারের নির্বাহী বিভাগেরই সাংবিধানিক সংস্করণে পরিণত হয়। যে কারণে সারা বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশেই একটি শক্তিশালী ও কার্যকর বিরোধী দল প্রয়োজন। না হলে সরকারের পক্ষে স্বৈরাচার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল হয়।

বস্তুত বিরোধী দলের শক্তির ওপরেই নির্ভর করে সরকার কতটা সংযত ও সতর্ক থাকবে। ক্ষমতা প্রয়োগে সে কতটা জনবান্ধব হবে কিংবা স্বেচ্ছাচারী হবে। অর্থাৎ সরকারকে জবাবদিহিমূলক ও দায়িত্বশীল রাখার ক্ষেত্রে বিরোধী দলের ভূমিকাই প্রধান। কিন্তু দশম সংসদের মতো এবার একাদশ সংসদেও যদি জাতীয় পার্টি বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে, তাহলে তারা প্রায় পৌনে তিনশ’ আসনে জয়ী আওয়ামী লীগকে কতটা জবাবদিহির মধ্যে রাখতে পারবে, তা বলাই বাহুল্য। গণতন্ত্রে কেন বিরোধী দল দরকার—এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তাঁর ‘গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘যতদিন না আমরা অপর পক্ষের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনতে এবং তা গ্রহণ করি বা না করি, সৎভাবে বিবেচনা করতে শিখবো, ততদিন দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না।’

লেখক: সাংবাদিক

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ