X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নিষ্ঠুরতা যখন সংস্কৃতি

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১০ এপ্রিল ২০১৯, ১৪:৫২আপডেট : ১০ এপ্রিল ২০১৯, ১৪:৫৪

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা শরীর ৮০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। সে বাঁচলেও যে জীবন সে পাবে তা ভাবনায় আনতে পারছি না। ফেনীতে এর আগে ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামকে নিজের গাড়ির ভেতরেই পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। 
এসব নিয়ে আমরা যখন টকশো করছি, সামাজিক মাধ্যম মাতিয়ে তুলছি তখন আরেকটি খবর শুনে শিউরে উঠতে হলো। রাজধানীর ডেমরার ডগাইর এলাকায় একটি মসজিদের ইমামের হাতে সাত বছরের শিশু মনিরকে প্রাণ দিতে হয়েছে। জানা যায়, সোমবার দুপুরে শিশু মনির ওই মসজিদে মক্তবে কুরআন পড়তে যায়। পড়া শেষে সব শিশু চলে গেলেও মনির বাসায় ফেরে না। বাবা-মা’ও বিকেল থেকে ছেলেকে খুঁজে না পেয়ে অস্থির হয়ে ওঠে। ওই দিনই বিকেল বেলা বাবার কাছে ফোন আসে, তিন লাখ টাকা মসজিদের খাটিয়ায় রেখে না যান তাহলে আগামীকাল সকালে লাশ পাবেন বলে জানায়। গরিব মানুষ হওয়ায় এত টাকা জোগাড় করতে পারেনি। পরে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়ে মসজিদের ওই খাটিয়ায় রেখে আসে। এরপরও সন্তানকে পায় না বাবা-মা। এদিকে মসজিদে টাকা রাখার বিষয়টি এলাকাবাসীর সন্দেহ হলে মসজিদের ইমামকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সে কিছুই বলে না। একপর্যায়ে থানা থেকে পুলিশ এলে সে দৌড়ে পালাতে শুরু করে। ধরার পর সে জানায়, মসজিদের দ্বিতীয় তলার সিঁড়ির পাশে রয়েছে। সেখানে গেলে দেখা যায় একটি বস্তায় শিশু মনিরের গলা কাটা লাশ। পুলিশ বলছে মনিরকে বলাৎকার করতে না পেরে ইমাম ও মুয়াজ্জিন মিলে তাকে হত্যা করেছে।

দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দুটিই ইসলামিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু কী ভয়ঙ্কর দুটি ঘটনা। এমন নিষ্ঠুরতা, এমন সহিংস উন্মাদনা শিক্ষকরা করতে পারেন, বিশেষ করে মাদ্রাসা শিক্ষকরা করতে পারেন, যারা সবসময় পরকালের ভয় দেখিয়ে চলেন, তা ভাবতে পারছে না মানুষ। তবে ভাবতে হয় বৈকি। ডাকসু নির্বাচন হয়ে গেছে, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতির একটা গুমোট ভাব আছে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় অচল উপাচার্য বিরোধী ছাত্র বিক্ষোভে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে সহিংসতার মঞ্চ বানিয়ে রেখেছে ছাত্রলীগ।

শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, কথায় কথায় জেলায় জেলায় খুনোখুনি। যারা আজকের নিষ্ঠুরতা দেখে, সহিংসতা দেখে অবাক হচ্ছেন, তাদের বলতে চাই, এদেশের হিংসা নতুন নয়। সহিংসতা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি। রাজনৈতিক দলগুলো এক সময় প্রতিপক্ষের সঙ্গে যে আচরণ করতো, তার চেয়ে অনেক বেশি সহিংস যখন নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়। অসংখ্য দৃষ্টান্ত দেওয়া যাবে। ২০১৪-১৫ সালের পেট্রোল বোমার আন্দোলনের সময় মানুষ পুড়িয়ে সরকার উৎখাতের যে আন্দোলন হয়েছিল, তখন একটা টেলিভিশন টকশোতে বলেছিলাম, জীবন্ত মানুষকে বারবিকিউ করে দেওয়া হয়তো একদিন থামবে, কিন্তু মানুষ জানলো এভাবে পুড়িয়ে দেওয়া যায় যদি কেউ তার প্রতিপক্ষ হয়, আজ  সেটাই যেন দেখছি চারদিকে।

অনেকেই বলছেন, মানুষ প্রতিবাদ করছে না কেন? করছে না, কারণ মানুষ জানে প্রতিবাদ করে, বিচার চেয়ে লাভ নেই। বিচার হবে না, যেমন হয়নি সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের, তনু হত্যার। মানুষ রাজনীতির কাছে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছ থেকে তার চাওয়াটা সরিয়ে নিয়েছে, আর রাজনীতি সুশাসনের অঙ্গীকারটুকু ভুলে গেছে।

কিন্তু কেন এমন হয় বা হচ্ছে? কেন এত সহিংসতা? কেন এত উন্মত্ততা? আসলে সামগ্রিক শাসনব্যবস্থাই আদিকাল থেকে সহিংসতার ফসল হলে তার মোকাবিলা করতেও পাল্টা সহিংসতা আমদানি হয়। মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা এমন উন্মত্ততা করার সাহস পেয়েছে, কারণ সে ধরে নিয়েছে তার কিছু হবে না, যেমন অনেক ঘটনারই শেষ পর্যন্ত দায়ীদের কিছু হয় না। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর মতো সর্বত্র একটা আধিপত্যকামিতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

সড়কে শৃঙ্খলা আনতে পারবে না, কারণ পরিবহন মালিক শ্রমিকদের নৈরাজ্য করার এক ভয়ঙ্কর ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারা আইন, আদালত, রাষ্ট্র, প্রশাসন সবাইকে তুচ্ছ করে সড়কে গুন্ডামি করেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে।

যারা নিষ্ঠুরতা করছে, যারা খুন করছে তারা নৈরাজ্যের প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন দেখে দেখে নিজেদের সেভাবে তৈরি করছে। জামায়াতের নেতা হয়ে সিরাজউদ্দৌলা কীভাবে এই আমলে এ কাজটি করে সেটা এক বড় প্রশ্ন। তবে এটা তো বোঝাই যায়, কোনও না কোনও একটি প্রভাবশালী মহলের সমর্থন তার দিকে আছে। আর তাই সোনাগাজী থানার ওসি বলতে চায় মেয়েটিই আত্মহত্যা করেছে, অধ্যক্ষের মুক্তির দাবিতে স্থানীয়ভাবে মিছিল হয়, মানববন্ধন হয়।

জেলায় জেলায়, পাড়ায় পাড়ায় সমাজকে অবৈধভাবে নিয়ন্ত্রণের জাল বিস্তার করেছে একটি পক্ষ। তারা রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে, নাসিরনগরে হিন্দু যুবক রসরাজকে যেমন টার্গেট করে, তাদেরই প্রতিনিধিরা আবার ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রীকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা চালায়। সিরাজউদ্দৌলার এমন কাণ্ডে একজন মাদ্রাসা শিক্ষকও রাস্তায় নামেননি। ভাবা যায় যদি কোনও সংখ্যালঘু শিক্ষক এই কাজটি করতেন, তবে কী হতো আজ সারাদেশে? গোষ্ঠীস্বার্থের এই মনোভাবের মধ্যেই আছে সহিংসতার সবথেকে বড় সম্ভাবনাময় উৎস। এখানে সব দল এক হয়ে যায়। সহিংসতাই হয়ে ওঠে রাজনৈতিক অনুশীলন ও সংস্কৃতির অঙ্গ। আজ  আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন বটে, কিন্তু সেই ঐতিহ্য থেকে বের হওয়া হয়ে ওঠে না তার।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
একসঙ্গে ৭৩ নেতাকে বহিষ্কার করলো বিএনপি
একসঙ্গে ৭৩ নেতাকে বহিষ্কার করলো বিএনপি
চীনে রুপা জিতে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সুকান্ত ও নয়ন
চীনে রুপা জিতে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সুকান্ত ও নয়ন
বাংলাদেশ ব্যাংকে সংবাদকর্মীদের প্রবেশে বাধা: উদ্বিগ্ন টিআইবি
বাংলাদেশ ব্যাংকে সংবাদকর্মীদের প্রবেশে বাধা: উদ্বিগ্ন টিআইবি
আপাতত গরমেই খেলতে হচ্ছে সাবিনা-সানজিদাদের
আপাতত গরমেই খেলতে হচ্ছে সাবিনা-সানজিদাদের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ