X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘জাগো মাতা, কন্যা, বধূ, জায়া, ভগ্নী! ’

মনিরা নাজমী জাহান
০৮ মার্চ ২০২১, ১২:৫৩আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২১, ১৪:৫৮

মনিরা নাজমী জাহান
নারী শত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে আজ ঘরে-বাইরে সর্বত্র পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলেছে। পৃথিবীর এমন কোনও প্রান্ত নেই, এমন কোনও ক্ষেত্র নেই, যেখানে নারী তার সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়নি। নিপুণ হাতে ঘর-সংসার সামলানোর পাশাপাশি নিজের বলিষ্ঠ হাতে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নারী কাজ করছে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে। ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্রীয় অর্জন, সব ক্ষেত্রেই রয়েছে নারীর অবদান। জ্ঞান-বিজ্ঞানের এমন কোনও শাখা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যেখানে নারীর অবদান নেই। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, নারীর সেই অবদানের নেই কোনও যথাযোগ্য স্বীকৃতি। শত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে নারীর এক একটি অর্জিত অবদানকে বিভিন্ন অজুহাতে স্বীকৃতি না দিয়ে বরং অস্বীকার করার এক ঘৃণ্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। বিভিন্ন অজুহাতে নারীর প্রতি নির্যাতন, নিপীড়নের মাধ্যমে নারীকে ঘরবন্দি করাই যেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য। নারীর নিরাপত্তা দিতে একবারেই নারাজ এই সমাজ ব্যবস্থা। নারীর আবার নিরাপত্তা হতে পারে এই ভাবনা ভেবে কেউ তার জীবনের সময় নষ্ট করতে রাজি নয়। বরং নারীকে ভোগ্যপণ্য ভাবার ক্ষেত্রে যে কুৎসিত আনন্দ পাওয়া যায়, তাই অনেকের স্বর্গসুখসম মনে হয়। সমাজ জীবনের এমন একটি জায়গা পাওয়া যাবে না যেখানে নারী নিরাপদ, যেখানে নারীকে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয় না। একজন নারীকে জন্মের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতিনিয়ত ভাবতে হয় তার নিরাপত্তার কথা। তাকে প্রতিনিয়ত আতঙ্কে দিন কাটাতে হয়।

করোনা নামক ভয়াবহভাইরাস যা স্তব্ধ করেছিল গোটা পৃথিবীকে। এই ভাইরাসের কবলে পড়ে পৃথিবীতে এমন কোনও সেক্টর নেই যেখানে চাকা থমকে যায়নি। কিন্তু এই ভয়াবহ করোনাভাইরাসও পারেনি নারী নির্যাতন থামাতে। করোনা নামক মহামারি বাতাসের সঙ্গে ছড়িয়ে নিভিয়ে দিচ্ছে মানব সভ্যতার আলো, মানুষ যখন প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রহর গুনছে, তখন থেমে থাকেনি নারী নির্যাতন। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে বাংলাদেশে ১৫৪৬ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এরমধ্যে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে ৫১ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১৪ জন। করোনার মতো ভয়াবহ ভাইরাস পৃথিবীর অনেক কিছুর গতিপথ বদলে দিলেও বদলাতে পারেনি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অমানুষিক আচরণ। নারীর প্রতি এই আচরণ যে শুধু ঘরের বাইরে ছিল তাও নয়, নারীর প্রতি এই নির্যাতন সমভাবে চলেছে চার দেয়ালের মধ্যেও। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে বাংলাদেশে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হন ৫৫৪ জন নারী, যাদের মধ্যে ২৪০ জনকে তাদের স্বামী হত্যা করে।

যাত্রাপথেও থেমে নেই এই নারীর প্রতি সহিংসতা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে গণপরিবহনে ৫২টি ঘটনায় ৫৯ জন নারী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, সড়ক পথে ৪৪টি, রেলপথে ৪টি ও নৌপথে ৪টি যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ১৬টি ধর্ষণ, ১২টি সংঘবদ্ধ, ৯টি ধর্ষণের চেষ্টা ও ১৫টি যৌন হয়রানির ঘটনা রয়েছে। 

বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে চরম উন্নতি করেছে। সবকিছুতে লেগেছে ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া। নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু এই ডিজিটাল দুনিয়াতেও নারীকে সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হতে হয়। বাংলাদেশ সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের ২০১৯ সালের গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের চেয়ে ২০১৯ সালে সাইবার অপরাধে ভুক্তভোগী নারীদের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। ২০১৯ সালে ভুক্তভোগী নারীদের হার ৬৭ দশমিক ৯ শতাংশ। যেটা ২০১৮ সালে ছিল ৫১ দশমিক ১৩ শতাংশ। এছাড়াও গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে পুলিশের সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন (পিসিএসডব্লিউ) সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর যাত্রা শুরু করে এখন পর্যন্ত বিশেষ ইউনিটের হটলাইনে প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি সাইবার অপরাধের শিকার নারী কল করেছেন। এরমধ্যে ফেইক ফেসবুক আইডি সংক্রান্ত অভিযোগ ২৩ শতাংশ, আইডি হ্যাক সংক্রান্ত ১৩ শতাংশ, ব্ল্যাকমেইলিং সংক্রান্ত ৮ শতাংশ, মোবাইল হ্যারাসমেন্ট সংক্রান্ত ৯ শতাংশ, অশ্লীল কন্টেন্ট পাঠানো সংক্রান্ত ৭ শতাংশ, অন্যান্য ৯ শতাংশ এবং অপ্রাসঙ্গিক অভিযোগ আসে ২৭ শতাংশ। 

এ তো গেলো জীবিত নারীদের সাথে ঘটা প্রতিহিংসার একটি ক্ষুদ্র চিত্র। সম্প্রতি সময়ে মৃত নারীদেহকে কেন্দ্র করে আরেক ভয়াবহ চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। দুই-তিন বছর ধরে মুন্না ভগত নামের এক ডোম মর্গে থাকা মৃত নারীদের ধর্ষণ করে আসছিল। এ অভিযোগের সত্যতা পেয়ে তাকে আটক করে সিআইডি। একটি মানুষের মস্তিষ্ক কতটা বিকৃত হলে এ ধরনের বীভৎস ঘটনা ঘটাতে পারে। জীবিত অবস্থায় তো বটেই, নারীর মৃতদেহের ও রেহায় নেই। একজন নারী তার জীবন দশায় তো নয়-ই, এমনকি মৃত্যুর পরও তার নিথর দেহটি ধর্ষকের করাল থাবা থেকে রক্ষা পায়নি।

তবে সমাজের এমন ভয়াবহ ও বীভৎস রূপ কিন্তু সমাজের বেশিরভাগ মানুষের মন গলাতে পারেনি; বরং আমরা দেখতে পাই এদের হয়ে দালালি এবং গলাবাজি করে যাচ্ছে বিভিন্ন কথা বলে। কখনও বলা হচ্ছে পর্দা না করার কারণে ধর্ষণ বাড়ছে, কখনও বলা হচ্ছে নারীর একা চলাফেরার কারণে ধর্ষণ বাড়ছে। অথচ এসব যুক্তিদানকারী বর্বররা এসব অসাড় যুক্তি দিয়ে নারীর প্রতি পৈশাচিক নির্যাতন সমাজে টিকে থাকতে সাহায্য করছেন। তারা চিন্তা চেতনায় ধর্ষণকে লালন করেন। এরা সমাজের বিষফোঁড়া।

যদি পর্দা না করাই হতো ধর্ষণের কারণ তাহলে তো শিশু ধর্ষণ হওয়ারই কথা নয়। পাঁচ বছরের শিশুরাও যেখানে ধর্ষণের লোলুপ থাবা থেকে রক্ষা পায় না, সেখানে পর্দার কথা বলা ধর্ষণকে জায়েজ করার প্রচেষ্টা আর কি-ই বা হতে পারে? 

আমরা দেখেছি স্বামীর সঙ্গে এমসি কলেজে ঘুরতে এসে সংঘবদ্ধ শিকার হয়েছেন এক গৃহবধূ কিংবা এক নারী তার স্বামীকে নিয়ে কালিহাতীতে বাবার বাড়ি থেকে মির্জাপুর কর্মস্থলে ফিরছিলেন। কালিহাতী বাস টার্মিনালে পৌঁছানোর পর ওই মহিলার স্বামীকে মারপিট করে এবং তার মোবাইল ফোন ও নগদ টাকা ছিনিয়ে নেয়। পরে ওই নারীর স্বামীকে আটকে রেখে  নারীকে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে সারা রাত সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে। এমন আরও অসংখ্য ঘটনা আমরা নিত্যদিন পত্রিকার পাতা খুললেই দেখতে পাই। তাই যারা নারীর একা চলার কারণে ধর্ষণ বাড়ছে বলে গলা ফাটান, বুঝতে হবে তারা এ ধরনের কথা বলে শুধু ধর্ষণকে বৈধতা দেবার অপচেষ্টায় লিপ্ত।

তার ওপর এখন শুরু হয়েছে নারীর প্রতি আরেক নির্যাতন, যেখানে ধর্ষকের সাথে ভিকটিমের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নারীর জীবন নিয়ে কুৎসিত খেলায় মেতে উঠেছে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা! এদের কুৎসিত ও নোংরা কথা শুনলে এবং কাজ দেখলে মনে হবে নারী হয়ে জন্মানোটাই যেন নারীর আজন্ম পাপ।

নারীর প্রতি যেকোনও ধরনের সহিংসতার উদ্দেশ্য হচ্ছে নারীকে ভয় দেখিয়ে নারীর ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো নারীর উন্নতির পথে প্রধান অন্তরায়। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীর ওপর সহিংসতা চালিয়ে নারীর উন্নতিকে বাধাগ্রস্ত করা হয়। নারীকে কুক্ষিগত করার এক প্রাণান্তকর চেষ্টা থাকে এই ঘুণে ধরা সমাজে। নারীর যেকোনও অর্জনে হিংসার আগুনে জ্বলে ওঠে এই সমাজ। এই অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করতে হেন কোনও কুকর্ম নেই যা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা করে না।

তাই এই নারী সমাজকে মনে রাখতে হবে, যে দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী, যে দেশে নারী প্রায় সকল উচ্চ পর্যায়ের পদ অলংকৃত করার যোগ্যতা রাখে, সেই দেশের নারীদের দাবিয়ে রাখার সাধ্য কারও নেই। শুধু চাই সকল ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, সকল প্রকার সহিংসতার বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ এবং নারীর সেই অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সকল বিবেকবান পুরুষদেরও উচিত নিজেদের শামিল করা।   

লেখক: শিক্ষক, আইন বিভাগ, ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।

 

  

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বাঘ ছাড়া হবে জঙ্গলে, তাই শেষবার ভোট দিলেন বাসিন্দারা!
বাঘ ছাড়া হবে জঙ্গলে, তাই শেষবার ভোট দিলেন বাসিন্দারা!
তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে যশোর, জনশূন্য রাস্তাঘাট
তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে যশোর, জনশূন্য রাস্তাঘাট
মুখোমুখি ইরান-ইসরায়েল, পরীক্ষার মুখে মার্কিন সামরিক কৌশল
মুখোমুখি ইরান-ইসরায়েল, পরীক্ষার মুখে মার্কিন সামরিক কৌশল
শহীদ মিনারে বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাসের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা
শহীদ মিনারে বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাসের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ