X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ফুরফুরা শরিফের ‘ভাইজান’ কীভাবে পশ্চিমবঙ্গের ভোটে আলোচনায়?

রঞ্জন বসু, দিল্লি
২২ এপ্রিল ২০২১, ২২:১৭আপডেট : ২৩ এপ্রিল ২০২১, ১৬:৩০

আব্বাস সিদ্দিকী বড়জোর মধ্য তিরিশের এক তরুণ মুসলিম নেতা। ছিলেন ধর্মগুরু, এখন একটি রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাতা। কয়েক মাস আগেও পশ্চিমবঙ্গে তাকে প্রায় কেউ চিনতেনই না, অথচ তিনি সহসাই এখন সে রাজ্যে রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে! পশ্চিমবঙ্গের ভোটে তিনি কীভাবে আর কতটা প্রভাব ফেলবেন, সেই বিতর্কেও সরগরম রাজ্য রাজনীতি।

হুগলি জেলার ফুরফুরা শরিফের এই পীরজাদা মাত্র মাস তিনেক আগেই নিজের রাজনৈতিক দল ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ) গঠন করেছেন। তারপর বামপন্থী ও কংগ্রেস জোটের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাজ্যের গোটা তিরিশেক আসনে ভোটে লড়ছেন। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ব্রিগেড ময়দানের ঐতিহাসিক জনসভায় আব্বাস যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তারপর থেকেই তাকে নিয়ে হুলুস্থূল পড়ে গেছে। তার পক্ষে-বিপক্ষে কার্যত দুভাগ হয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মহল।

ফুরফুরা শরিফের ‘ভাইজান’ কীভাবে পশ্চিমবঙ্গের ভোটে আলোচনায়?

রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল আর তাদের প্রধান চ্যালেঞ্জার বিজেপি, দুপক্ষেরই আক্রমণের নিশানায় এখন আব্বাস সিদ্দিকী। তিনি নিজে অবশ্য এসব নিয়ে মাথা না-ঘামিয়ে রাজ্যজুড়ে একের পর এক জনসভা, রোড শো করে যাচ্ছেন। বিশেষত মুসলিম প্রধান এলাকাগুলোতে। হাজার হাজার লোকের ভিড়ও হচ্ছে তাকে দেখতে, তার জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনতে।

‘আব্বাস সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে তৃণমূলের ক্ষোভের প্রধান কারণ তিনি তাদের কোর সাপোর্ট বেস, অর্থাৎ মুসলিম ভোটব্যাংকে ভাগ বসিয়ে অনেক আসনে হারিয়ে দিতে পারেন। আবার বিজেপিও খোলাখুলি তাকে সাম্প্রদায়িক বলে নিশানা করছে। কারণ, তাতে তাদের হিন্দু ভোট পোলারাইজ বা মেরুকরণ করতে সুবিধা হবে।’ কেন আব্বাস সিদ্দিকী দুই দলেরই আক্রমণের লক্ষ্য, সেটা ব্যাখ্যা করে বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক কল্যাণ গোস্বামী।

আতরের ব্যবসায়ী বদরুদ্দিন আজমল আসামে মুসলিমদের জন্য এআইডিইউএফ নামে ১৬ বছর আগে আলাদা একটি রাজনৈতিক দল গড়েছিলেন। এখন সেই রাজ্যে তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি। পশ্চিমবঙ্গে আব্বাস সিদ্দিকীর দল গড়ার মধ্যেও অনেকে সেটার ছায়া দেখতে পাচ্ছেন। যদিও আব্বাস নিজে বলেন, তার দলের নামেই সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি আছে এবং তারা একাধিক হিন্দু দলিত বা আদিবাসীকেও ভোটে প্রার্থী করেছেন।

ফুরফুরা শরিফের ‘ভাইজান’ কীভাবে পশ্চিমবঙ্গের ভোটে আলোচনায়?

আব্বাসের বিতর্কিত মন্তব্য

দক্ষিণবঙ্গে মুসলিমদের পবিত্র তীর্থস্থান ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী এ বছরের গোড়াতেও ছিলেন শুধুই একজন ধর্মগুরু। ওয়াজ মাহফিল বা সভা-সমাবেশে এই তরুণ নেতার বক্তৃতার সুবাদে তার জনপ্রিয়তা অবশ্য বাড়ছিল অনেক দিন ধরেই। অনুগামীদের কাছে তিনি তখন থেকেই ‘ভাইজান’ নামে পরিচিত। এখনও সে নামেই তাকে ডাকেন বেশিরভাগ লোক।

নানা ওয়াজ মাহফিলে দেওয়া তার পুরনো বক্তৃতার ভিডিও নতুন করে ভাইরাল হয়ে আব্বাস সিদ্দিকীকে আবার বিপাকেও ফেলেছে।

যেমন, তিনি করোনা মহামারির শুরুর দিকে কোনও এক জনসভায় বলেছিলেন, ‘ভারতে এত অন্যায় অবিচার হচ্ছে যে তার প্রতিকারেই আল্লাহ মারণ ভাইরাস পাঠিয়ে দেশের অন্তত ৫০ কোটি লোককে মেরে ফেলুক!’

টালিগঞ্জের জনপ্রিয় চিত্রতারকা ও তৃণমূলের এমপি নুসরাত জাহানকে সরাসরি ‘বেহায়া, নির্লজ্জা মেয়েছেলে’ বলে আক্রমণ করে বলেছিলেন, ‘যে দেহ বিক্রি করতে পারে, সে যে এমপি হয়ে দেশ বিক্রি করবে না তার গ্যারান্টি কোথায়?’

এসব চরম বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য তিনি আজ পর্যন্ত সরাসরি ক্ষমা চাননি। কখনও প্রচ্ছন্নভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। কখনও আবার দাবি করেছেন তাকে প্রসঙ্গ বহির্ভূতভাবে বা ‘আউট অব কনটেক্সট’ কোট করা হয়েছে। আজকাল অনেকে ভিডিও এডিট করে পুরনো জিনিস বাজারে ছেড়ে দেয়, সেটাও মনে করিয়ে দিয়েছেন।

ফুরফুরা শরিফের ‘ভাইজান’ কীভাবে পশ্চিমবঙ্গের ভোটে আলোচনায়?

ভাইজান থেকে নেতা

আব্বাস সিদ্দিকীর ক্যারিয়ারের দিকে যারা নজর রাখছেন, তারা জানাচ্ছেন বছর দেড়েক আগে পর্যন্ত নিজেকে ধর্মীয় সভা-সমাবেশের গণ্ডিতে আটকে রাখলেও ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে দেশে যখন নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ শুরু হয়, তখন থেকেই তিনি রাজনীতির দিকে ঝুঁকতে শুরু করেন। তখন থেকেই তিনি মুসলিমদের অধিকার আদায়ের দাবিতে বিভিন্ন সভায় সরব হতে শুরু করেন। দক্ষিণবঙ্গের মুসলিমদের মধ্যে ফুরফুরা শরিফের অনুগামীর সংখ্যা বিরাট। তাদের রাজনৈতিকভাবে একজোট করার চেষ্টাও শুরু করেন।

নিজস্ব রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য তিনি ফুরফুরা শরিফের আরেক পীরজাদা ও তার চাচা ত্বহা সিদ্দিকীর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতেও দ্বিধা করেননি। ত্বহা সিদ্দিকী বরাবরই তৃণমূল কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। ভাতিজার ভিন্ন পথে যাওয়াটা তিনি মানতে পারেননি।

এদিকে আব্বাস সিদ্দিকীর সঙ্গে রফা আলোচনা করতে ফুরফুরা শরিফে এসে রাত কাটিয়ে গেছেন ভারতের আর এক ডাকসাইটে মুসলিম নেতা ও হায়দারাবাদের এমপি আসাদউদ্দিন ওয়াইসিও। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে অন্তত ওয়াইসির সঙ্গে শেষ পর্যন্ত তার কোনও সমঝোতা সম্ভব হয়নি।

কোন স্বাধীনতার কথা বলছেন?

তবে আব্বাস সিদ্দিকীকে পশ্চিমবঙ্গের ঘরে ঘরে একটি পরিচিত নাম করে তুলেছে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি, রবিবার কলকাতায় ব্রিগেডের বিশাল জনসভা। সিপিএমসহ বামপন্থী দলগুলো ও তাদের জোটসঙ্গী কংগ্রেস ওই জনসভার ডাক দিলেও শেষ পর্যন্ত দেখা যায় সেখানে 'ভাইজান' আব্বাসই হয়ে ওঠেন প্রধান আকর্ষণ। তার দলের পতাকা, ফেস্টুন নিয়ে সেদিন লক্ষাধিক লোক সভায় জড়ো হয়েছিলেন। আবার তার বক্তৃতা শেষ হতেই মাঠ নিমেষে ফাঁকা হয়ে যায়।

জনতার তুমুল হাততালির মধ্যে আব্বাস সিদ্দিকী সেদিন তার বক্তৃতায় বলেন, "এই ব্রিগেডের জমিন থেকে আমার ভালোবাসার মানুষ প্রত্যেক বাঙালিকে বলবো, যেখানে যেখানে বাম শরিক দল প্রার্থী দেবে, আগামী নির্বাচনে মাতৃভূমিকে রক্ত দিয়ে হলেও স্বাধীন আমরা করবো।"

বিজেপি এই ‘স্বাধীনতার ডাক’কে তুলনা করছে দেশভাগের আগে মুসলিম লীগের পাকিস্তান গড়ার দাবির সঙ্গে। ছেচল্লিশ সালে কলকাতায় মুসলিম লীগ যেভাবে পাকিস্তান গড়ার আওয়াজ তুলেছিল, এই ডাকেও সেই ইঙ্গিত আছে বলে অভিযোগ করেছে তারা।

বিজেপির প্রবীণ নেতা এবং মেঘালয় ও ত্রিপুরার সাবেক রাজ্যপাল তথাগত রায় যেমন বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন, ‘আমাদের মাতৃভূমি তো সেই সাতচল্লিশ সাল থেকেই স্বাধীন। ফলে আব্বাস সিদ্দিকী কোন স্বাধীনতা চাইছেন সেটা পরিষ্কার করা দরকার!’

‘ইসলাম বলে, একটা হলো শান্তির দেশ বা দারুল ইসলাম। আর একটা হলো যুদ্ধবিগ্রহের দেশ বা দারুল হারব। কিন্তু কার্যত যে দেশগুলোর রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নয়, সেগুলোকেই দারুল হারব বলে চিহ্নিত করা হয়– যেমন ভারত। আব্বাস সিদ্দিকীর কথা শুনে মনে হচ্ছে, তিনি ভারতেও দারুল ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন’, বলছিলেন তথাগত রায়।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল কংগ্রেসের সুপ্রিমো মমতা ব্যানার্জিও তার নির্বাচনি জনসভা থেকে আব্বাস সিদ্দিকীকে সরাসরি আক্রমণ করা শুরু করেছেন। এপ্রিলের গোড়াতেই হুগলিতে এক জনসভায় মমতা আব্বাসের নাম না-নিয়েও বলেন, ‘ফুরফুরা শরিফের একটা চ্যাংরা কোটি কোটি টাকা খরচ করছে আর সাম্প্রদায়িক স্লোগান দিচ্ছে। আর হিন্দু-মুসলমান ভাগ করার চেষ্টা করছে। ওদের একটা ভোটও দেবেন না। ওদের একটা ভোট দেওয়া মানেই বিজেপিকে ভোট দেওয়া!’

রাজ্যজুড়ে নির্বাচনি প্রচারণায় ব্যস্ত আব্বাস সিদ্দিকী অবশ্য এসব গায়ে মাখছেন, এমন কোনও খবর নেই। তিনি শুধু চাইছেন যত বেশি সম্ভব আসনে ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টকে জিতিয়ে আনতে। আর রাজ্যে তৃণমূল বা বিজেপি কোনও দলই এককভাবে গরিষ্ঠতা না পেলে আব্বাস সিদ্দিকী পশ্চিমবঙ্গে ‘কিংমেকারে’র ভূমিকাতেও নামতে পারেন বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন।

/এফএ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
ভারতের লোকসভা নির্বাচনে দ্বিতীয় দফার ভোট কাল
সর্বশেষ খবর
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ