X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

যে কারণে ‘ভারতীয় স্ট্রেইন’ নিয়ে উদ্বেগ

সাদ্দিফ অভি
২৫ এপ্রিল ২০২১, ২২:০০আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০২১, ২০:৫৯

ভাইরাসের স্পাইক জিনে যত বেশি মিউটেশন হয় ভাইরাস তত বেশি আক্রান্ত করার ক্ষমতা রাখে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। যার ফলে অ্যান্টিবডির কর্মক্ষমতা বিফলে যায়। যদি সঠিক পথে মিউটেশন হয় তাহলে পূর্বে আক্রান্ত ব্যক্তি পুনরায় আক্রান্ত হতে পারেন। আর মিউটেশনের তথ্যের জন্য দরকার জিনোম সিকোয়েন্স, যা কয়েক মাসে দেশে কমে গেছে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। তাছাড়া জনসমাগম আর ঘনবসতির দেশে দ্রুত শুধু ভ্যারিয়েন্ট নয়, যেকোনও ধরনের ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বলে মনে করেন তারা। আর ভারতের সঙ্গে সীমান্ত যোগাযোগ খোলা থাকলে তা যেকোনও সময়ে আসার সম্ভাবনা থেকেই যায়। ডাবল মিউট্যান্ট, ট্রিপল মিউট্যান্ট কিংবা সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের ‘বেঙ্গল ভ্যারিয়েন্ট’ নিয়ে এখন আলোচনা তুমুল, তবে বিস্তারিত তথ্য কম।

ডাবল মিউট্যান্ট, ট্রিপল মিউট্যান্ট কিংবা বেঙ্গল ভ্যারিয়েন্ট কী?

এ ধরনের ভাইরাসে দুটি মিউটেশন বা ডিএনএ পরিবর্তনের দুই ধরনের ক্ষমতা থাকে, যা শরীরের সাধারণ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে পাশ কাটিয়ে আক্রমণ করে বা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেয়। গত মাসে ভারতে এই স্ট্রেইন জিনোম সিকোয়েন্সের মাধ্যমে ধরা পড়ে। সেই সঙ্গে দেশটিতে ১০ হাজার ৭৮৭টি নমুনা পরীক্ষা করে করোনাভাইরাসের আরও ৭৭১টি ধরন শনাক্ত হয়েছে। তার মধ্যে ৭৩৬টি যুক্তরাজ্যে শনাক্ত হওয়া ভাইরাসের ধরন, ৩৪টি দক্ষিণ আফ্রিকায় পাওয়া ধরন আর একটি ব্রাজিলের ভাইরাসের ধরন পাওয়া গেছে।

বিজ্ঞানীদের মতে, কিন্তু কিছু মিউটেশনের কারণে ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিনে পরিবর্তন ঘটে। মানবদেহের কোষের সঙ্গে নিজেকে আটকে ফেলতে এবং ভেতরে ঢুকতে ভাইরাসটি এই স্পাইক প্রোটিন ব্যবহার করে । ভাইরাসের মধ্যে যখন এ ধরনের মিউটেশন ঘটে, তখন এর সংক্রমণ ঘটানোর ক্ষমতা সম্ভবত বেড়ে যায়। এধরনের ভাইরাসে মানুষ বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং এটি প্রতিরোধে টিকা আর কাজ করে না।

ভারতে এ মুহূর্তে করোনার তিনটি ভ্যারিয়েন্ট (B.1.617, B.1.617+S:V382L এবং B.1.618) নিয়ে এখন পর্যালোচনা চলছে। B.1.618 কে বলা হচ্ছে বেঙ্গল ভ্যারিয়েন্ট। কারণ এটা এখন পশ্চিমবঙ্গে বেশি পাওয়া যাচ্ছে। ভারতের গবেষকরা দাবি করছেন গত ৬০ দিনে সেদেশে আক্রান্তদের ১২ শতাংশ B.1618 ভ্যারিয়্যান্টের।

গত ১৬ এপ্রিল ভারত সরকারের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ডাবল মিউটেশনের এই ধরনটি আরও কয়েকটি দেশে যেমন অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, নামিবিয়া, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যেও পাওয়া গেছে। কিন্তু, এই ধরনটি দ্রুত হারে ছড়ানোর বিষয়টি এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

ভারতের করোনা পরিস্থিতি

ভারতে শনিবার ৩ লাখ ৪৬ হাজারের বেশি মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়েছেন আর মৃত্যু হয়েছে ২৬২৪ জনের। ভারতে চলমান করোনা পরিস্থিতির কারণে দেখা গেছেন চরম অক্সিজেন সংকট। ভারতের রাজধানী দিল্লির একটি হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে ২০ জন করোনা রোগীর মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার রাতে ২০ জন গুরুতরভাবে অসুস্থ রোগী অক্সিজেনের ঘাটতির কারণে মারা গেছেন। প্রত্যেকেই অক্সিজেনের চাপ কমে যাওয়ার কারণে মারা যান। সে সময় হাসপাতালের অক্সিজেনের মজুদ শেষ হয়ে যায়। শুক্রবারও দিল্লির গঙ্গারাম হাসপাতালে অক্সিজেন মজুত শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে ২৫ জন করোনা রোগীর মৃত্যু হয়েছিল। এর আগে ২১শে এপ্রিল মহারাষ্ট্রের নাসিক শহরের একটি সরকারি কোভিড হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ বিঘ্নিত হয়ে একসঙ্গে অন্তত ২২জন রোগী মারা যান।

ওই হাসপাতালের সামনে একটি ট্যাঙ্কার থেকে অক্সিজেন লিক হওয়ার জেরেই ওই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। সেসময় আধঘণ্টার মত হাসপাতালের অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ ছিল, যার ফলে ২২ জন রোগী প্রাণ হারান।

কমে গেছে জিনোম সিকোয়েন্স

চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, গত ৩ মাসে বাংলাদেশ থেকে সংগৃহীত অত্যন্ত নগণ্য সংখ্যক নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স জিসএইড ডাটাবেজে জমা হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টিতে ধারণা করা যায়, দেশের বিজ্ঞানীরা হয়তোবা জিনোম সিকোয়েন্সের প্রতি অনাগ্রহী হয়ে পড়েছেন। জিনোমিক নজরদারির ওপর ভিত্তি করে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে আর্থসামাজিক ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রেখে অগ্রগামী হওয়া সম্ভব হবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আদনান মান্নান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা এখনও নিশ্চিত না বাংলাদেশে ডাবল মিউট্যান্ট এসেছে কিনা। এটা বিশদ অনুসন্ধান করে দেখতে হবে। যত বেশি জিনোম সিকোয়েন্স হবে ততবেশি এই মিউট্যান্ট আর ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কে জানা যাবে। যে পরিমাণ আমাদের জিনোম সিকোয়েন্স করা দরকার সে পরিমাণে হচ্ছে না। পর্যাপ্ত পরিমাণে জিনোম সিকোয়েন্স না করলে কোনও ভ্যারিয়েন্ট রাজত্ব করছে তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না।

সীমান্ত খোলা থাকলে ভ্যারিয়েন্ট প্রবেশ অনিবার্য

দেশের জনস্বাস্থ্যবিদদের মতে,  সীমান্ত খোলা রাখলে ভ্যারিয়েন্ট প্রবেশ যেকোনও সময়ে করতে পারে। লোক না আসলেও পণ্য আসছে এবং তার সঙ্গে মানুষও আসছে। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, আমাদের এখন সব বিষয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত। ভারতে, বাংলাদেশে এমনকি ইউরোপে, আমেরিকা এবং আফ্রিকাতেও মিউটেশন হচ্ছে।  এগুলো হতেই থাকবে। এক্ষেত্রে আমাদের স্বাস্থ্যবিধি এবং বিদেশ থেকে আগত যাত্রীদের জন্য যে নিয়ম করে দিয়েছে সরকার সেগুলো মেনে চলতে হবে। কোয়ারেন্টিন সঠিকভাবে নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে যেকোনও দেশের ভ্যারিয়েন্ট আমরা মোকাবিলা করতে পারবো।

তিনি আরও বলেন, শুধু বিদেশ থেকে আগতদের কোয়ারেন্টিন নিয়েই আমরা ব্যস্ত। দেশের ভেতরে যদি ছড়াতে থাকে করোনা সংক্রমণ সীমান্ত কতদিন বন্ধ করা রাখা যাবে। কাজেই আমাদের স্বাস্থ্যবিধি সবজায়গায় মেনে চলতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে ভারতে ১৩৭ কোটি মানুষের বাস। আমাদের সঙ্গে তাদের যাতায়াত সবচেয়ে বেশি। আমাদের ল্যান্ড পোর্ট এবং এয়ারপোর্টের মাধ্যমে লোকজন যাতায়াত করে। এমনকি অনেক জায়গায় সীমান্ত অনেক পুরাতন সেখানে কোন পোর্ট নেই, লোকজন যাতায়াত করছে। আমাদের বাণিজ্যিক যোগাযোগ অনেক বেশি। আমাদের লোকজন ভারতে চিকিৎসা নিতে যায় বেশি। এই ফ্যাক্টরগুলোর কারণে ওখান থেকে ভ্যারিয়েন্টগুলো আসা এখন অবধারিত হয়ে গেছে। ভারতে দেখা যাচ্ছে প্রত্যেকদিন তাদের নিজেদেরই রেকর্ড ভাঙছে। বিশ্বে এখন সবচেয়ে বেশি আশঙ্কাজনক অবস্থা ভারতের। এখন যেই ভ্যারিয়েন্টের কারণে এই অবস্থা সেগুলো যদি আমাদের এখানে আসে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ এবং আমার মনে হচ্ছে অবধারিত।

তিনি আরও বলেন, যখন বেশি আকারে সংক্রমণ হবে তখন বেশি আকারে মিউটেশন হবে। যতবেশি মিউটেশন হবে আরও বেশি ভ্যারিয়েন্ট হবে। সব মিলিয়ে এটা আসলেই চিন্তার বাংলাদেশের জন্য।

সরকারের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য অধ্যাপক আবু জামিল ফয়সেল বলেন, নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলো আমাদের দেশে ঢোকার সম্ভাবনা অনেক। আমাদের দেশে ৩৬টি ল্যান্ড পোর্ট আছে। যেখান দিয়ে প্রতিদিন লোকজন আসা যাওয়া করে, বাণিজ্য হয়। সেখানে এগুলোর মধ্যে দিয়ে এই ভ্যারিয়েন্ট ঢুকতে পারে। কিন্তু মূল পয়েন্ট হচ্ছে –আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কথা মানছি না। তাদের প্রথম নির্দেশনা হচ্ছে প্রবেশমুখে নিয়ন্ত্রণ আরোপ। আমরা যদি এটা কন্ট্রোল করতে না পারি, তাহলে দ্বিতীয় ঢেউ কেন, তৃতীয় –চতুর্থ ঢেউয়ের পর ঢেউ আসতেই থাকবে।

তিনি আরও বলেন, যারা আসছে তাদের ম্যানেজ করার জন্য তিনদিনের কোয়ারেন্টিন কোনও কোয়ারেন্টিন হতে পারে না। এটা ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন হতে হবে এবং প্রবেশমুখে টেস্টের ব্যবস্থা থাকতে হবে। চিহ্নিত রোগীকে আইসোলেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। আইসোলেশনের ব্যবস্থা কি আছে আমাদের কোথাও? বেনাপোলের বর্ডার আউটপোস্ট থেকে ১৭ কিমি দূরে কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা। কেউ দেখার নেই এই বিষয়গুলো। দ্বিতীয় উদ্বেগের কারণ আমাদের এখানে আমরা যে অক্সিজেন উৎপাদন করি কিছু আমাদের দেশে তৈরি হয়, বেশিরভাগই আসে ভারত থেকে। ভারতেই অক্সিজেনের যে সমস্যা তাতে তো আমাদের এখানে সাপ্লাই বন্ধ করে দেবে। তরল অক্সিজেন আসা যদি বন্ধ হয়ে যায়, যেটি সব স্থলবন্দর দিয়ে আসে তাহলে আমরা কোথায় যাবো?

তিনি বলেন, আমাদের এখানে জিনোম সিকোয়েন্স বাড়ানোর প্রয়োজন এই কারণে, যাতে আমাদের এখানে কোনও ইউনিক মিউটেশন হচ্ছে কিনা সেই তথ্য আমাদের থাকা উচিত। কারণ ভারতের এখন ভ্যারিয়েন্টগুলো তাদের দেশেই মিউটেশন হয়ে এই অবস্থা হয়েছে।

/এমআর/
সম্পর্কিত
করোনার পর মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
আরও ৩৯ জনের করোনা শনাক্ত
১১ দিন পর করোনায় আবারও মৃত্যু
সর্বশেষ খবর
খাদে পড়া গাড়ি উদ্ধারের সময় বাসচাপায় প্রাণ গেলো ২ জনের
খাদে পড়া গাড়ি উদ্ধারের সময় বাসচাপায় প্রাণ গেলো ২ জনের
‘সেফ জোনে’ ২৩ নাবিক, নিরাপত্তায় ইতালির যুদ্ধ জাহাজ
‘সেফ জোনে’ ২৩ নাবিক, নিরাপত্তায় ইতালির যুদ্ধ জাহাজ
‘আজ থেকে শুরু হচ্ছে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী-২০২৪’
‘আজ থেকে শুরু হচ্ছে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী-২০২৪’
টিভিতে আজকের খেলা (১৮ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১৮ এপ্রিল, ২০২৪)
সর্বাধিক পঠিত
‘ভুয়া ৮ হাজার জনকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে’
‘ভুয়া ৮ হাজার জনকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে’
এএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
রেস্তোরাঁয় ‘মদ না পেয়ে’ হামলার অভিযোগএএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
হজ নিয়ে শঙ্কা, ধর্ম মন্ত্রণালয়কে ‍দুষছে হাব
হজ নিয়ে শঙ্কা, ধর্ম মন্ত্রণালয়কে ‍দুষছে হাব
এবার নায়িকার দেশে ‘রাজকুমার’ 
এবার নায়িকার দেশে ‘রাজকুমার’ 
‘আমি এএসপির বউ, মদ না দিলে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবো’ বলে হামলা, আহত ৫
‘আমি এএসপির বউ, মদ না দিলে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবো’ বলে হামলা, আহত ৫