কঠোর লকডাউনের মধ্যেও রাজধানীর শব্দ দূষণ সহনীয় মাত্রার মধ্যে নেমে আসেনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মানুষের শব্দ গ্রহণের সহনীয় মাত্রা ৪০-৫০ ডেসিবল। লকডাউনে রাজধানী ঢাকার সর্বনিম্ন শব্দের মাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে গুলশান আবাসিক এলাকাতে ৫৪ ডেসিবল। যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাত্রার চেয়ে খানিকটা বেশিই বটে। এই বাস্তবতার মধ্য দিয়ে এবার বাংলাদেশে আগামীকাল বুধবার (২৮ এপ্রিল) পালিত হবে আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনতা দিবস।
রাজধানীর প্রধান সড়কে স্বাভাবিক সময়ে দাঁড়ানোই কঠিন। লকডাউনের কারণে গণপরিবহন না চলায় সেই অবস্থার খানিকটা উন্নতি হয়েছে। তবে তা সহনীয় মাত্রার বাইরেই রয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই অবস্থায় সরকারি উদ্যোগই পারে শব্দ নিয়ন্ত্রণ করতে। মাঝে মধ্যে উচ্চ আদালত শব্দ নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিলেও তা খুব একটা কাজে আসেনি। বিশেষ করে রাজধানীতে উচ্চমাত্রার গাড়ির হর্নের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে নানা ধরনের হুইসেল। কেন এভাবে জ্যামের শহরে অ্যাম্বুলেন্সের মতো হুইসেল বাজিয়ে সাধারণ মানুষকে ছুটতে হয় এমন প্রশ্ন অনেকেরই।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘সেন্টার ফর হিয়ারিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন’ বা লিগ ফর দ্য হার্ড অব হেয়ারিং ১৯৯৬ সাল থেকে এই দিনটিকে শব্দ সচেতনতা দিবস হিসেবে পালন করছে। প্রতিবছরের এপ্রিল মাসের যে কোনও বুধবারকে তারা এই দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। চলতি বছর ২৮ এপ্রিল দিবসটি পালনের ঘোষণা দেয় তারা। অন্যদিকে ২০০৩ সাল থেকে বাংলাদেশে বেসরকারিভাবে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষে পরিবেশ অধিদফতর আগামীকাল বুধবার একটি ওয়েবিনারের আয়োজন করেছে।
অতিরিক্ত শব্দের দূষণে সৃষ্টি হয় স্বাস্থ্য সমস্যা। শব্দ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দিন দিন অযোগ্য বাসস্থানে পরিণত হবে এই ঢাকা।
শব্দ দূষণের মাত্রা
ঢাকায় জানুয়ারি আর ১৫ এপ্রিল লকডাউনের পর শব্দের যে মাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে তাতে দেখা গেছে পল্টন বাসস্ট্যান্ডে লকডাউনের আগে শব্দের মাত্রা ছিল ১১০ ডেসিবল, এখন ৬৫, মিরপুরে-১০ এ ১০৫ ছিল এখন ৬৪, শাহবাগ ছিল ৯৮ এখন ৬৮, কদম ফোয়ারাতে ছিল ৯৬ ছিল এখন ৬৫, জিরো পয়েন্ট ছিল ১১২ এখন ৭০, শিক্ষাভবন ছিল ৮৯ এখন ৫৮, সায়েন্স ল্যাবে ছিল ৯০ এখন ৬৫, ফামগেটে ছিল ১০৬ এখন ৮১, আব্দুল্লাহপুরে ছিল ১০৮ এখন ৭৫, গুলশান আবাসিক এলাকায় ছিল ৮৮ এখন ৫৪, প্রেসক্লাবে ছিল ৯৪ এখন ৬৪, তেজগাঁও ছিল ১০১ এখন ৬০, ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় ছিল ৯০ এখন ৫৫। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও বিশ্ববিদ্যালয়টির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)-এর গবেষণায় এই তথ্য পাওয়া যায়।
এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘আমাদের একেক এলাকায় গ্রহণযোগ্য শব্দ দূষণের মাত্রা একেক রকম। এরমধ্যে নীরব এলাকায় দিনের বেলা ৫০, আবাসিক এলাকায় ৫৫, মিশ্র এলাকায় ৬০, বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০ এবং শিল্প এলাকায় ৭৫। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে এখন লকডাউনের কারণে কম থাকলেও লকডাউন উঠে গেলেই এটি আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। কী করে শব্দ নিয়ন্ত্রণ করা যায় সেই উদ্যোগ সবার মিলে নিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারকে যেমন কঠোর হতে হবে তেমনি আমি শব্দ দূষণের কারণ হবো না, মানুষকে এমন অঙ্গীকার করতে হবে।’
শব্দ দূষণে স্বাস্থ্য ঝুঁকি
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, শব্দদূষণের কারণে যে স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে সে বিষয়ে সাধারণ মানুষের যেমন সচেতনতা অভাব রয়েছে তেমনি সরকারেরও নেই। শব্দ দূষণের কারণে যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় সেটিও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। অনেকের কাছেই এটি বোধগম্য নয়। যে কারণে শব্দ দূষণ নিয়ে যেসব আইন হয়েছে সেগুলো কার্যকর হয় না। উন্নত দেশগুলোতে শব্দদূষণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তারা সচেতনতার পাশাপাশি কঠোর আইন করে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
শব্দ দূষণের কারণে স্বাস্থ্যের কী পরিমাণ ক্ষতি হয় জানতে চাইলে ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, ‘প্রাথমিভাবে শব্দের যে গ্রহণযোগ্য মাত্রা সেটি অতিক্রম করলে কানের যে স্বাভাবিক কাজ তা ক্ষতিগ্রস্ত হ য়।ফলে মানুষ কানে কম শোনে এবং এই অবস্থা যদি সব সময় চলতেই থাকে তাহলে মানুষ এক সময় বধির হয়ে যায়। কানের স্নায়ুতন্ত্রে যখন অতিরিক্ত শব্দ আঘাত করে তখন স্নায়ুতন্ত্র উজ্জ্বীবিত হয়, এতে হার্টবিট বেড়ে যায়, ব্লাড প্রেসার বেড়ে যায়, এক ধরনের বিরক্তিকর মানসিকতা তৈরি হয়। যার কারণে মনোসংযোগের সমস্যা হতে থাকে। এই জিনিস ক্রমাগত হতে থাকলে মানুষটি খিটখিটে মেজাজের হয়ে যায় এবং তার মধ্যে মানসিক বৈকল্য দেখা দেয়। একসময় তা হতাশার জন্ম দেয়। ফলে মানুষের যে স্বাভাবিক জীবনযাপন তার বিঘ্ন ঘটে।’