X
বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫
১৭ আষাঢ় ১৪৩২

স্তব্ধতা, তোমার স্বরলিপি ।। যোযে লুইশ পেইশোতো

তর্জমা : রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী
৩০ এপ্রিল ২০২১, ০০:১১আপডেট : ৩০ এপ্রিল ২০২১, ০০:২৮

[খোদ যোযো সারামাগো যার তারিফ করে গেছেন সেই যোযে লুইশ পেইশোতো (জন্ম ১৯৭৪) সমসময়ের পোর্তুগালের অন্যতম সেরা লেখক। তার জন্ম মধ্য পোর্তুগালের আলেনতেযো’র গালভেইয়াশ্-এ। কবিতা, উপন্যাস, ভ্রমণকথা, নাটক, অন্যান্য গদ্যরচনা এবং শিশুতোষ কাহিনি মিলিয়ে এ পর্যন্ত তার ২১টি বই বেরিয়েছে, যার অনেকগুলোই অনেকগুলি ভাষায় তরজমা হয়েছে। বলা দরকার যে যোযে লুইশ একটি হেভি মেটাল দলেরও সদস্য। বেস্টসেলার হওয়ার পাশাপাশি বড় বড় সাহিত্য পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছে তার কয়েকটি উপন্যাস, দেশে-বিদেশে। বাংলায় এটিই তার কোনো রচনার প্রথম তরজমা। ‘মোরেস্তে-মে’ নামের এই স্মৃতিগদ্যটি প্রথম প্রকাশিত হয় আজ থেকে একুশ বছর আগে, ২০০০ সালে। বইটি প্রথম বেরিয়েছিল স্বয়ং লেখকের উদ্যোগে, পরের বছর প্রকাশিত হয় কেৎযাল এদিতোরিয়াল থেকে। আজ পর্যন্ত পোর্তুগিয দুনিয়ায় এ-বই দেড় লাখ কপি বিক্রি হয়েছে। এরপর এ-বইয়ের বহু পোর্তুগিয সংস্করণ বেরিয়েছে, পোর্তুগাল ও ব্রাসিল থেকে।
সদ্য প্রয়াত বাবার স্মৃতিতে যোযে লুইশ এ-বইটি লিখেছিল ২১ বছর বয়সে, ১৯৯৮ সালে। আমার সাথে যোযে লুইশের চেনা-জানা-বন্ধুত্বের সুবাদে যোযে লুইশ আমাকে এ-বইটি দিয়েছিল ২০১৬ সালে, চীনের শিনচিয়াঙ-এ, যেখানে এক কংগ্রেসে আমাদের প্রথম মোলাকাত। নেনুয়াম ওলিয়ার (২০০০, শূন্য দৃষ্টি), সেমেতেরিয়ো দে পিয়ানো (২০০৬, পিয়ানোর গোরস্থান), গালভেইয়াশ্ (২০১৪), আউতোগ্রাফিয়া (২০১৯, আত্মজীবনী) তার সেরা উপন্যাস হিসেবে সমাদৃত। তার বেশিরভাগ উপন্যাসে প্রেক্ষাপট হিসেবে থাকে পোর্তুগালের গ্রামীণ সমাজ। যেমন নেনুয়াম ওলিয়ার (বাংলায় তরজমার কাজ চলছে), যা যোযে সারামাগো পুরস্কার অর্জন করেছিল এবং ব্রাজিলের ওসেয়ানোস্ পুরস্কারপ্রাপ্ত তার গ্রামের নামে নাম দেয়া উপন্যাস গালভেইয়াশ্, যা শুধু পোর্তুগালেই ৩০,০০০ কপিরও বেশি বিক্রি হয়েছিল। ‘মোরেস্তে-মে’ (স্তব্ধতা, তোমার স্বরলিপি)-ও পোর্তুগালে বহু বছর ধরে বেস্টসেলার তালিকায় ছিল।
পোর্তুগালের মতো ছোট এক দেশে যোযে লুইশের সদ্য বেরুনো উপন্যাস ‘আলমোসো দো দোমিঙ্গো’ (রবিবাসরীয় লাঞ্চ) এপ্রিলের প্রথম দুই সপ্তাহেই বিক্রি হয়েছে ৩০ হাজার কপি। ভূমিকা : অনুবাদক]



আজ ফিরলাম এই ভিটেতে যা এক্ষণে নিষ্ঠুর। আমাদের ভিটেমাটি, বাবা। আর সবকিছু তেমনই আছে, যেমনটা ছিল। আমার সামনে, ঝাট-দেয়া সাফসুতরা রাস্তা, মেঘে ঢাকা আলোয় পরিচ্ছন্ন হচ্ছে বাড়িঘর, দেয়ালের চুনকে সফেদ করে; আর সময়টা মনখারাপ করা, সময়টা থমকে থাকা, সময়টা মনখারাপ করা এবং আরও বেশি দুঃখকর তখনকার চেয়ে যখন তোমার দুচোখ, কুয়াশা ও দূর সমুদ্রের হিম জোয়ারের মতো আবছা, টেনে নিয়েছিল, এক্ষণে নিষ্ঠুর এই আলোকে, যখন তোমার দুচোখ কথা বলেছিল উঁচুস্বরে আর পৃথিবীটা চেয়েছিল শুধু রহিতে। এবং তারপরও, সবকিছু তেমনই আছে। নদীর মতো নিশ্চুপ, জীবনটা নিষ্ঠুর জীবন বলে। হাসপাতালে যেমন। বলব কোনোদিনই ভুল না, না, আর আজ মনে পড়ছে। অপরিচিত হয়ে ওঠা চেহারাগুলো, তোমাকে হারানোর অবশ্যম্ভাবিতায় দোমড়ানো, আমার নৈরাশ্যে নির্বেদ। হাসপাতালে যেমনটা। আমার মনে হয় না তুমি সেটা ভুলতে পারো। আমি যখন আমার মা ও বোনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, লোকজন আমার পাশ দিয়ে এমনভাবে হেঁটে গেল যেন যে বেদনা আমাকে গ্রাস করেছিল তা দরিয়াসম নয় এবং তাদেরকে আলিঙ্গনও করল না। মহিলারা কথা বলছিল, পুরুষেরা সিগারেট খাচ্ছিল। আমার মতো, অপেক্ষা করছিল; মৃত্যুর জন্য নয়, যার জন্য আমরা, বিশ্বাসপ্রবণ সত্তারা, সবসময় চোখ বন্ধ করে রাখি এই ক্ষীণ আশায় যে, তাকে যদি আমরা না দেখি, সে আমাদেরকে দেখবে না। তারা অপেক্ষা করছিল। বেশ দ্রুতগামী এক গাড়িতে, আমার মা, তার যা ছিল সব হারিয়ে ন্যুব্জ, আর আমার বোন। পুরুষ আর নারীরা তখনো কথা বলছিল এবং সিগারেট খাচ্ছিল আমরা যখন উপরে গেলাম। ঘরটায়, একটা খাটে যা তোমার নয়, তোমার শরীর, বাবা। হয়তো দূরে চলে যাওয়া আধখোলা ও হলদে চোখে, তুমি শ্বাস ফেলছিলে হা করে। যে হাওয়ার সাথে তুমি লড়াই করছিলে, লড়াই করেছিলে সবসময়, তার পথটায় ঘড়ঘড় করে আর্তনাদ করছিল। তোমার নাকে, একটা টিউব ঢোকানো যা তোমাকে ধরে রেখেছে। খাটের পায়ে, আমার নিস্তব্ধ মা, শোকাতুর। খাটের পাশে, আমার বোন, আমি। প্লাস্টিকের পর্দা, ফোল্ডিং স্ক্রিন আমাদেরকে অন্য খাটগুলো থেকে আলাদা করেছে। তোমার দুর্বল কাঁধে আমি হাত রাখলাম। সমস্ত শক্তি বিলীন হয়ে গেছে তোমার দুবাহু থেকে, তোমার ত্বক থেকে যা এখনো জীবন্ত। এবং তোমাকে মিথ্যা বলেছিলাম। এমন একটা কথা বলেছিলাম যা আমি বিশ্বাস করিনি। তোমার হলদে, হা-করা দৃষ্টিকে বলেছিলাম যে তোমার এবং আমাদের সব কিছু আগের মতো হয়ে যাবে। এবং তোমাকে মিথ্যা বলেছিলাম। বলেছিলাম চলো বাড়ি ফিরে যাই, বাবা; চলো ভ্যানগাড়িটা আমি চালাব, বাবা; তুমি যখন পারবে না, বাবা; আসো, এখন তুমি দুর্বল তাহলে থাক্ পরে, বাবা, পরে, বাবা। তোমাকে মিথ্যা বলেছিলাম। আর তুমি, আন্তরিক, শুধু এক অজুহাতের দৃষ্টিতে জবাব দিয়েছিল, যে-দৃষ্টি আমি কোনো দিন ভুলতে পারব না। বাবা। সময়টা যখন আসল, ওরা আমাদেরকে বের হয়ে যেতে বলল। আমরা যখন বের হচ্ছিলাম, নৌকাডুবি মানুষদের মতো গায়ে গা সেঁটে, অফুরন্ত আলো আমাদেরকে গিলে খেল।

এবং এই বিকেলে এখানে এই ভিটেমাটিটা এক্ষণে নিষ্ঠুর। আমাদের রাস্তায়, আমাদের বাড়ি। উঠোনের দরজাটা আমার সামনে থমকে আছে, বন্ধ, বেপরোয়া। বলেছিলাম তোমাকে কখনো ভুলব না, এবং এই বিকেলে মনে পড়ছে। তোমার মতো নড়াচড়ায়, পকেট থেকে তোমার চাবির গোছা বের করলাম এবং যেমনটা তুমি করতে, সবগুলি কসরত শেষে সঠিক চাবিটা বাছলাম, প্রত্যেকটাতে নজর বুলিয়ে, প্রত্যেকটাতে গর্ব ভ’রে। এবং, তালায়, সাফল্য। সবকিছু চলছে যেমনটা হওয়ার কথা। জং-পরা কব্জায় একটা আর্তনাদ হয় দীর্ঘশ্বাস বা ঘড়ঘড় শ্বাসের মতো। শ্বেতপাথরের কানায় অ্যালুমিনিয়াম ঘষটে গেল, পিচগাছের পাতার ঘন আবরণে একটা স্পষ্ট এবং সাদা নকশাকে মুছে দিয়ে। এক শীতের দীর্ঘ বিস্তারে পরিত্যক্ত, আমার বালকবেলার উঠোনটা, যে উঠোনটা তুমি বানিয়েছিলে, বাবা। ব্যথিত ব্যথিত নতুন ফুল এবং গাছের ডালে নতুন পাতা, চিরহরিৎ, থানকুনি পাতা, সবুজ ঔষধি গাছে চিত্রিত কেয়ারি, আমার বালকবেলার সবুজ এবং তুমি আসতে এবং আমাকে শেখাতে বড়দের কাজগুলো। মন দিয়ে দ্যাখ্, আব্বু। মন দিয়ে দেখছি, বাবা। চিন্তা কোরো না। আমিও জানি, আমি পারব। মন দিয়ে দেখছি, বাবা। দুশ্চিন্তা কোরো না। কাজ করতে আমি ভয় পাই না। শান্ত হও, বাবা। নতুন ফুল আর গাছের ডালে নতুন পাতা, চিরহরিৎ, থানকুনি পাতা, সবুজ ঔষধি গাছে চিত্রিত কেয়ারি এই ব্যথিত বসন্তের সবুজ।

যদি তোমাকে ধরে রাখা যেত। আমাকে নাম ধরে ডাকতে, আমাকে আব্বু বলে ডাকতে, আর তোমার কণ্ঠস্বরে আমার নামটা শোনা, আর তোমার কণ্ঠস্বরের উষ্ণ তন্তুতে আব্বু ডাকটা শোনা ছিল এক গভীর অনুভূতি। যদি তোমাকে ধরে রাখা যেত। আশা, বাবা। প্রতি তিন সপ্তাহে, পরপর পাঁচ সকালে তোমাকে দেখা যেত চিকিৎসার জন্য যাচ্ছ; আমি, তোমার ছেলে, দেখতাম তুমি চিকিৎসার জন্য যাচ্ছ এবং কষ্ট দিত আমাকে জীবনটা, কষ্ট দিত আমাকে জীবনটা যে তোমাকে নাকচ করেছে, যে জীবনটা তোমাকে নিঃশেষ করেছে, তাকে তুমি ভালোবাসো তা সত্ত্বেও, যে জীবনটা তোমাকে অতলে নিয়ে গেছে, তাকে তুমি ভালোবাসো তা সত্ত্বেও। চিকিৎসা। তুমি ওকে নিয়ে কথা বলতে, শব্দটা উচ্চারণ করতে, বলতে আমি চিকিৎসার জন্য যাচ্ছি এবং আমরা যারা জানতাম, একটা অনপনেয় তিক্ততা আমাদেরকে ভ’রে তুলত, আমাদের ভেতরের চামড়ায় অপূরণীয়ভাবে খোদিত হয়ে যেত। তোমার মনোবলের কারণে, কখনোই তুমি দেরি করতে না। বলতে আমি চিকিৎসার জন্য যাচ্ছি, আমাকে তাড়া দিতে, আমার মাকে তাড়া দিতে, যেন কিছু একটা তোমাকে সারিয়ে তুলবে, যেন কিছু একটা তোমাকে দিনগুলি ফিরিয়ে দেবে। হাসপাতালে, অসাড় সময়ের নিশ্চল অপেক্ষাগার আর বসে থাকা আমার মা, একা, আমাদের বাড়ি এবং আমাদের জায়গাগুলি থেকে দূরে, একটি ভীরু বাচ্চা মেয়ের মতো, বিব্রত। তুমি চলে যেতে, জীবনের উদ্যমী এক ছোকড়ার মতো যে সবসময় চেয়েছ আমি যেন ওরকম হই, তুমি চলে যেতে, সবচেয়ে নতুন শার্ট এবং সবচেয়ে নতুন প্যান্ট এবং তোমার জন্মদিনে আমার বোনের উপহার দেওয়া সোয়েটারটা পরে, তুমি চলে যেতে, ছাইরঙে ম্লান টিমটিমে আলোর করিডোর ধরে, তুমি চলে যেতে, আর ভয়ংকর অনুভূতিটা যে তুমি আর কখনো ফিরবে না।

বাড়িতে ঢুকলাম। শুধু ঠান্ডা আগুনপোহানো চুল্লি, বন্ধ জানালাগুলি অন্ধকারে পাতলা ছায়া তৈরি করছে। নিস্তব্ধতায়, আঁধারে, ভূত-প্রেত আবির্ভূত হয়, স্মৃতিরা? না, আঁকিবুকি নকশারা যা হতে চায় না স্মৃতি, কিংবা হয়তো মাংস এবং আলো বা ছায়ার সংমিশ্রণ। আর আমি তোমাকে দেখলাম ভাবলাম স্মরণ করলাম, টেবিলে, তোমার জায়গায়। এখনো বসে আছ তোমার জায়গায়, আর আমি, আমার মা, আমার বোনও, বসে আছি, তোমাকে ঘিরে। ঠিক আগের মতো আমরা। ওভাবে আমরা অনেকক্ষণ বসে রইলাম, বিস্মৃত পরিত্যক্ত হয়ে সেই দিন থেকে যেদিন সবকিছুর সচলতা থমকে গেল আমাদের সহজ সরল সুখে। একটা আনন্দের উচ্ছ্বাসের মতো, যেন এইমাত্র আমরা একসাথে রাতের আহার সেরেছি বা একটা বিশেষ ভূড়িভোজের অপেক্ষায় আছি, আমরা বসে আছি। সুখী। আমাকে কিছু বলা হয়নি, কিন্তু আমি, তাকিয়ে আছি, জানতাম সব, যেন তা অনিবার্য, যেন তা অন্যরকম হওয়ার নয়। তুমি, নির্ঘাৎ, কাজ থেকে ফিরলে, তোমার একটা ভালো দিন গেছে, আর এজন্য তুমি খুশি, লোকজন তাদের বেতনটা ঠিকঠাকমতো পেয়েছে এবং এটা একটা ভালো খবর। আমার বোন স্কুলে গেছে, এবং তার ফলাফল খুবই ও যথেষ্ট ভালো, এবং সে বুদ্ধিমতী, এবং এর জন্য হাসছে। আমি দূরশিক্ষণে প্রথম বর্ষের ছাত্র, এবং ফলাফল নিয়ে কোনো চিন্তা নাই, এবং আমার ফুটবল খেলা ছিল, এবং খেলায় জিতেছি, এবং হারলেও কোনো ক্ষতি ছিল না। আর আমার মা, আমাদের সকলের সত্যিকারের মা, আমাদেরকে দেখত এবং হাসত এভাবে এবং হাসত ওটার জন্য। সুখী। এই আঁধারকালো শীতের ভারী বৃষ্টি থেকে দূরে, তোমার হিম শরীর থেকে দূরে। মোমবাতির নিবু নিবু আলোয় পাণ্ডুর, পরিপাটি, পানি দিয়ে আঁচড়ানো চুল, স্যুটে সুসজ্জিত যা তুমি আমার বোনের বিয়েতে পরেছিলে: তোমার হিম শরীর। আর সাওঁ পেদ্রো গির্জায় একঝাঁক লোক আমাকে আলিঙ্গন করল, একঝাঁক লোক যারা আমাকে বলল বেচারা এবং শোক প্রকাশ করল এবং বলল আমি খুবই দুঃখিত, একঝাঁক লোক যারা আমার খোঁজ করল এবং চাইল আমাকে জড়িয়ে ধরতে এবং ওভাবে ধরে রেখে বলতে বেচারা এবং চাইল শোক প্রকাশ করতে এবং এই কথা বলতে আমি খুবই দুঃখিত। বাবা। তোমাকে হারানো। তোমার মৃত ঠোঁটের না-সমাহিত হাসিটাকে আমি মনে মনে ভাবলাম। আর আমাদের ছায়ারা, যেন নিছক এই ভাবনাগুলোর অপেক্ষায় নিজেরা হারিয়ে যাওয়ার আগে, কালোতে মিলিয়ে গেল। জনমনুষ্যহীন অনেক অনেক ঘণ্টার ধুলোর আস্তরে ঢাকা পড়েছে আসবাবপত্র আর তাদের মধ্যকার আবদ্ধ জায়গাটায়। দেয়ালগুলি আবারও নৈশকালীন শীতকালকে আলাদা করেছে, বাড়িতে যা স্থায়ী আর দিবস ও দুনিয়ার পালাবদল থেকে, আমাদের চেয়ে ভিন্ন, আমাদের থেকে দূরে। আমার সাথে, বাড়িটা আরও খালি। ঠান্ডা ঢুকল এবং, আমার মধ্যে, ঘনীভূত হলো। আমার ছায়ার বিচিত্র ছায়া, স্থির, শরীর থেকে শরীরে ঘোরাফেরা করল, কারণ এর সবগুলো, আমার সব শরীর, একইসাথে ছিল কালো ও ঠান্ডা। এবং আমি জানালা খুললাম। আমার অনুভব, আমার সত্তা, আমার আপন আমির শোক থেকে অনেক দূরে, আমাদের বন্ধ বাড়ির ক্ষণিক সুগম্ভীর ভোরে প্রবেশ করল সূর্যাস্ত, বাবা। আর আমি ভাবলাম দিনগুলি যেভাবে মারা যায় সেভাবে কেন মানুষ মরতে পারে না? এভাবে, পাখিদের শান্ত গান এবং সবকিছুতে টলটলে জলজ স্বচ্ছতা এবং স্নিগ্ধশীতল কোমল স্নিগ্ধশীতল, গাছেদের ছোট ছোট পাতায় নাচন লাগানো মৃদু হাওয়া, নিশ্চল জগৎ বা শান্তভাবে নড়াচড়া করা এবং পড়ন্ত প্রাকৃতিক প্রাকৃতিক নিস্তব্ধতা, আকাঙ্ক্ষিত নিস্তব্ধতা, অবেশেষ সঠিক, অবেশেষে উপযুক্ত।

বাবা, সন্ধ্যা নামল ভিটেতে, আমাদের বাড়িতে। আমাদের মুখে আকাশ একটা প্রশান্ত হাওয়া আলগা করে দেয়। চাঁদ দেখা যায়। উষদচ্ছ, দৃষ্টিতে একটা উষ্ণ স্বপ্ন ঘুমায়। ধীরে ধীরে রাত হয়। বলেছি কখনো ভুলব না, এবং স্মরণ করছি। রাত নেমেছিল ধীরে ধীরে এবং এই সময়ে, বছরের এই মৌসুমে, তুমি হোসপাইপটাকে মনোযোগের সাথে একটু একটু করে খুলতে এবং, নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে, উঠোনের গাছ আর ফুলে পানি দিতে; এবং এর সবটা আমাকে শেখাতে, এর সবটা আমাকে বুঝিয়ে বলতে। এখানে এসে দ্যাখ্, আব্বু। এবং আমাকে দেখাতে। বাবা। সবকিছুতে তুমি আছ। এই পৃথিবীর উদাসীন দুঃখকে অংশত ঢেকে রেখে যা চলমান থাকার ভান করে, দেখি তোমার চলাচল, তোমার অঙ্গভঙ্গির নিষ্প্রভতা। এবং এই সবকিছু এখন তোমাকে ধারণ করবার জন্য অল্প। এখন, তুমি নদী এবং কূল এবং উৎস; তুমি দিন, এবং দিনের মধ্যে বিকেল, এবং বিকেলের মধ্যে সূর্য; তুমি সমগ্র পৃথিবী কারণ তুমি তার ত্বক। বাবা। তুমি কখনো বুড়ো হওনি, এবং আমি তোমাকে বুড়ো অবস্থায় দেখতে চেয়েছিলাম, একটা বুড়োটে লোক এখানে আমাদের উঠোনে, গাছে পানি দিচ্ছে, ফুলের পরিচর্যা করছে। তোমার কথাবার্তা খুব মনে পড়ছে। মন দিয়ে দ্যাখ্ আব্বু। হ্যাঁ। আমি মন দিয়ে দেখছি, বাবা। এবং থাকছি। আছি। গোধূলিবেলা, আলোর ঢেউয়ের সাথে, চরাচরজুড়ে বিস্তৃত হয় যা তোমাকে সম্ভাষণ জানায় এবং রক্ষা করে। উজ্জ্বল শুভ্র বৃষ্টির অশ্রুপাত হয় আমার ওপর। এবং আমি শুনি তোমার কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি, তোমার কণ্ঠস্বরের যা আর কোনো দিন শুনতে পাব না। চিরদিনের জন্য স্তব্ধ তোমার কণ্ঠস্বর। এবং, যেন তুমি ঘুমিয়েছ, দেখলাম তোমার দুচোখের ওপর পাপড়িগুলি বন্ধ করছ যা আর কোনো দিনই খুলবে না। চিরদিনের জন্য বন্ধ তোমার দুচোখ। এবং একবার, শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ করে দিলে। চিরদিনের জন্য। আর কোনো দিন নিশ্বাস ফেলবে না। বাবা। তোমার যা কিছু বেঁচে আছে তা আমাকে আঘাত করে। বাবা। তোমাকে কোনো দিন ভুলব না। (অংশ)

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বৈষম্যবিরোধী নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ-লাঠিপেটা, আহত ১০
বৈষম্যবিরোধী নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ-লাঠিপেটা, আহত ১০
৯ কোটি টাকা অনুদান পাচ্ছে ৩২টি চলচ্চিত্র
৯ কোটি টাকা অনুদান পাচ্ছে ৩২টি চলচ্চিত্র
মানুষের কাছে ভোট দেওয়ার মতো নির্ভরযোগ্য বিকল্প বিএনপি ছাড়া অন্যটি নেই: মান্না
মানুষের কাছে ভোট দেওয়ার মতো নির্ভরযোগ্য বিকল্প বিএনপি ছাড়া অন্যটি নেই: মান্না
রংপুর-৪ আসনে এনসিপির এমপি প্রার্থী হিসেবে আখতারের নাম ঘোষণা
রংপুর-৪ আসনে এনসিপির এমপি প্রার্থী হিসেবে আখতারের নাম ঘোষণা
সর্বাধিক পঠিত
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন কমিটি
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন কমিটি
যারা ফেসবুক লাল করেছিল, তাদের জীবন লাল করে দেবে আ.লীগ: পার্থ
যারা ফেসবুক লাল করেছিল, তাদের জীবন লাল করে দেবে আ.লীগ: পার্থ
বেসরকারি শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা যোগদানের দিন থেকে শুরু করতে হাইকোর্টের রুল
বেসরকারি শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা যোগদানের দিন থেকে শুরু করতে হাইকোর্টের রুল
যশোরে নির্মাণাধীন ভবনের বারান্দা ভেঙে দুই প্রকৌশলীসহ ৩ জনের মৃত্যু
যশোরে নির্মাণাধীন ভবনের বারান্দা ভেঙে দুই প্রকৌশলীসহ ৩ জনের মৃত্যু
এনবিআরের আরও ৫ শীর্ষ কর্মকর্তার দুর্নীতি অনুসন্ধান করছে দুদক
এনবিআরের আরও ৫ শীর্ষ কর্মকর্তার দুর্নীতি অনুসন্ধান করছে দুদক