X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিভ্রম

মঈনুল হাসান
০১ মে ২০২১, ১১:৫৮আপডেট : ০১ মে ২০২১, ১২:০৪

হাসান সাহেব রাশভারী লোক। সবকিছুতে নির্মোহ থেকে সোজাসাপটা কথা বলতে পছন্দ করেন। কেউ তার সাথে কোনো ধরনের কপটতা করুক সেটা তিনি পছন্দ করেন না। সোনালি চিকন ফ্রেমের চশমার ফাঁক দিয়ে তিনি যখন স্থির চোখে কারও দিকে তাকিয়ে থাকেন, তখনই আশপাশের সবাই ভেবে নেন তার সিদ্ধান্তই অটল। কারণ, অপ্রয়োজনীয় কথা বলা তার স্বভাবের ঠিক উল্টো। মিতভাষী হাসান সাহেবকে টলানো তখন সত্যিই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

ব্যাপারটা সেরকম কিছু নয়। নিসর্গপ্রেমী হাসান সাহেব মনস্থির করেছেন ‘নয়নতারা’র পরিসর বৃদ্ধি করবেন। ‘নয়নতারা’ তার দোতলা বাড়ির নিজের দেওয়া নাম। পরিসর বৃদ্ধি মানে পুরাতন নোনাধরা পাঁচিলের স্যাঁতসেঁতে অংশ ভেঙে ফেলে বাগানটা খানিক প্রশস্ত ও প্রাণবন্ত করার পরিকল্পনা।

ছিমছাম দোতলা বাঙলোর চারপাশটায় কেমন গুমোট, বাড়ন্ত অন্ধকার। বড় বড় ঝাঁকালো গাছের কারণে একটা ছায়াঘন শীতল পরিবেশ বিরাজ করে সবসময়। রোদের আনাগোনা কম বলে শিশিরভেজা মাটিও হয়ে থাকে পিচ্ছিল, সোঁদা গন্ধময়। ছোট্ট বাড়ির নিচতলার এ অপ্রশস্ততার কারণে তার কেমন যেন দমবদ্ধ হয়ে আসে মাঝে মাঝে। সেটা ভেবেই তার এ চকিত সিদ্ধান্ত।

সকালের সূর্য উঁকি দিলেই রাশভারী মনের রাশ টেনে ধরেন তিনি। প্রতিদিনই ভাবেন সকালের নরম হাওয়ায় শ্বাস নিয়ে মিঠে রোদ গায়ে মেখে নিজেকে উজাড় করে দেবেন ইচ্ছামতো। কিন্তু, সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামলেই তার মেজাজ অন্যরকম হয়ে যায়। বরাবরই তার ইচ্ছা হয় বাগানের বিশালতায় নিজেকে হারিয়ে খুঁজে নেবেন নতুন করে। কিন্তু, তা আর হয়ে ওঠে না। নিচতলার বারান্দা থেকে দুপা হাঁটলেই প্রধান ফটক। সেখান দিয়ে বের হলে গেটের ডান পাশে একটা শিউলির গাছ আছে। ভালো লাগা বলতে ব্যস ওইটুকুই।

সূর্যের আলো গাছের প্রাচীর ডিঙিয়ে ছোট্ট উঠানে ঠিকমতো প্রবেশ করতে পারে না। মোটা মোটা দৈত্যের মতন সব গাছের ফাঁক দিয়ে বাগান পর্যন্ত এক আধটু আলোর রেখা পৌঁছে দিতে যথেষ্ট কসরত করতে হয় বৈকি! তাই সূর্যকে দোষ দিয়ে আর লাভইবা কী? চারধারের পাঁচিল ঘেঁষে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো অতিকায় সব আম-কাঁঠালের গাছগুলো আলোর অনুপ্রবেশে বিঘ্ন ঘটায় প্রতিদিন। অদ্ভুত ছায়াচ্ছন্ন এ পরিবেশের কারণে একটু অন্ধকার হলেই কেমন ভৌতিক মনে হয় চারপাশে। তার ওপর বাড়ির পিছনটায় রয়েছে মস্ত ঘন এক লিচুবাগান।

হাসান সাহেবের আবার একটু বাগান করার শখ। নাম না জানা হরেক লতা-গুল্মের সমাহার ঘটিয়েছেন তার বাগানে। বাগানের পাঁচিল ঘেঁষে পায়ে হাঁটার সরু পথ তৈরি করেছেন তিনি। মাঝে মাঝে সময় পেলেই বিকালে একটু পায়চারি করেন ওখানে। তবে সৌখিন ইচ্ছার তো আর সীমানা নেই। কেবলই ডানা মেলে উড়ে যেতে চায় আকাশে। দিনরাত্রির পালাবদলে ইচ্ছাটাকে আশকারা দিতে গিয়েই ঘটছে বিপত্তি। 

হাসান সাহেবের সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী সুব্রত কুমার চক্রবর্তী। একই অফিসের প্রকৌশল শাখার একাউন্ট্যান্ট তিনি। অফিসের হিসাবের কাজে পোকা বাছার মতো কাজ করেন বলে এই লোকটার ওপর তিনি প্রথম থেকেই মহাবিরক্ত। যদিও কাজের পরিবেশকে তিনি ব্যক্তিগত জীবনে টেনে আনতে মোটেই রাজি নন। অথচ, এ সুব্রত বাবুই তার ইচ্ছাকে দমিয়ে বাগানের কাজে বাধ সাধছে বারবার।

দুই

হাসান সাহেব অনেকদিন থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলেন। এই তো গত শীতে বাড়ি মেরামত করাতে গিয়ে যখন চুন-বালির প্রলেপ দিচ্ছিলেন, পুরানো দেয়াল ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ছিল প্রতিদিন। তখন বিষয়টি একবার মাথায় এলেও ঝামেলা ভেবে করেননি। আর যখনই তিনি মনে মনে ভাবেন, তখনই মুখ কালো করে মাথা নুয়ে সামনে হাজির হয়ে যান সুব্রত বাবু। লোকটার কি কোনো ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা আছে নাকি? ভেবেই আশ্চর্য হন তিনি।

দুদিন আগে ব্যাপারটা আবারও ঘটল। সেদিন বিকালে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আসায় ইজিচেয়ারে বসে পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছিলেন তিনি। দোতলার বারান্দায় বসামাত্রই চোখ চলে গেল সামনের মধুমঞ্জরী লতার দিকে। জমাট লাল-সাদা রঙের লতার বিস্তারে কী দারুণ ছেয়ে আছে সম্পূর্ণ ফটক। ফুলের অমন নজরকাড়া ঢঙ দেখে তিনি আনমনা হয়ে গেছিলেন কিছুক্ষণের জন্যে। গোধূলির নরম আলোও মাখামাখি হয়ে ছিল সেখানে। কিন্তু, এতসবের পরেও তার দৃষ্টি চলে যায় শিউলি গাছটার তলায়। সুব্রত বাবু যেখানে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে।

অকারণ বিরক্তিতে মুখটা কুঁচকে ওঠে তার। প্রবল জলতেষ্টা পেলেও বিরক্তি নিয়েই ঠায় বসে রইলেন বারান্দায়। সূর্যটা দূরের জোড় তালগাছের ফাঁক দিয়ে ঝুপ করে নেমে গেল হঠাৎ। তার চোখের সামনে দিয়ে সবুজ চরাচরে সন্ধ্যা নেমে এল ক্লান্ত পায়ে। বাইরে তখনও কমলা রঙের আলো একদম মিলিয়ে যায়নি। ঘন হয়ে সন্ধ্যা নামার আগ মুহূর্তে গুটি গুটি পায়ে সুব্রত বাবু চলে এলেন।

বারান্দায় বসে তিনি দেখছেন বাড়ির প্রধান ফটক হাঁ করে খোলা। তার বাসায় ফুট-ফরমায়েশের কাজ করা ছেলেটা কোথায় লাপাত্তা হলো কে জানে! এসব কিছুর খেয়াল তো তারই রাখবার কথা!

মামুন, এই মামুন?

না, কোনো সাড়া শব্দ নেই। আরও কয়েকবার হাঁকডাক করে সিঁড়ি বেয়ে নিজেই সোজা নেমে গেলেন নিচে। ফ্যাকাশে চেহারার সুব্রতবাবুকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন।

আপনি আবার এসেছেন সুব্রত বাবু?

একটু কথা ছিল স্যার।

আবার কী কথা? আমি তো যা বলার বলে দিয়েছি।

স্যার আপনি নতুন করে কী সিদ্ধান্ত নিলেন?

কই, আমি তো কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি।

শুনলাম, পাঁচিলের ওই অংশটা ভেঙে ভেতরে নিয়ে নেবেন। আঙুল দিয়ে পশ্চিমের দেয়ালের দিকে নির্দেশ করে সুব্রত বাবু।

সন্ধ্যার এ সময়টায় তারস্বরে ঝিঁঝি ডেকে যায়। হাসান সাহেবের চোখের সামনে আবছা অন্ধকারের পর্দা নেমে আসলে তার কাছে মনে হয় মাথার ভেতরেই বুঝি বেহাগসুরে ডাকছে ঝিঁঝির দল। তিনি ওদিকে তাকিয়ে দেখেন, হলুদ অলকানন্দার ফুলগুলো আলো করে ফুটে আছে এখনও। প্রেমনলিনীর ঝাড় কেবল নুইয়ে পড়েছে, ঝরে পড়েনি; তবে জীর্ণ বাড়িটায় বিশাল একটা অন্ধকার বাদুড়ের মতো চেপে বসে আছে। কাঁঠালগাছের পাতার ঝোপে আদিম বুনো অন্ধকার ঘনীভূত রহস্যের মতো তাকিয়ে রয়েছে তার দিকেই। সুব্রত বাবুর কথায় মৌনতা ভাঙে।

স্যার, জীর্ণ বাড়িটাও নাকি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবেন? আমার স্ত্রী অর্চনার স্মৃতি মিশে আছে ওখানে। আমি স্যার পরিবারসহ আরও কিছুদিন থাকতে চাই। গভীর একটা মায়া পড়ে আছে ওখানে আমার।

সুব্রত বাবু এসব কথা বলে লাভ নেই। পুকুরের ধারের কোয়ার্টারগুলো খালি পড়ে আছে। আপনি সেখানে চলে যান। তাছাড়া গত বছর ইঞ্জিনিয়ার সাহেব নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ‘পলাশে’র দোতলা ঠিক করলেন। আমি নিজে অনুমতি দিলাম। আপনি সেখানে যাচ্ছেন না কেন?

বিরক্তির সাথে রাগের ঝাঁঝ মিশিয়ে এবার কথাগুলো বলেন হাসান সাহেব। আগের মতোই ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকে সুব্রত বাবু। যেন তিনি নন, কোনো ছায়ামানুষের সাথে কথাগুলো বলছেন হাসান সাহেব।

সুব্রত বাবু, আপনি এখন যান। আমি বিষয়টি পরে ভেবে দেখব।

সিঁড়িতে দুপদাপ শব্দ তুলে গটগটিয়ে দৃঢ়চেতা মানুষটি একতলা থেকে দোতলায় উঠে আসেন। পরে বারান্দা থেকে চেয়ে দেখেন, সুব্রত বাবু তার কাঁঠালগাছ তলায় নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় তার চোখ ছলছল করছে। পরীর মতো দুটি মেয়ে এসে তার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যায়। সুব্রত বাবুর মেয়ে দুটি বড় মায়াবী। আগে মাঝে মাঝে ভোরবেলায় শিউলি ফুল কুড়াতে তাদের দেখতে পেতেন তিনি। হাসান সাহেব আনমনে চেয়ে থাকেন সেদিকে।

 

সকালের হিমেল বাতাসে কখনই মেজাজ খারাপ হয় না হাসান সাহেবের। ছুটির দিনের সকালটা তিনি দারুণ উপভোগ করেন। আজ অনেক সকালে ঘুম ভেঙেছে তার। আর জেগেই গতসন্ধ্যার ঘটনাগুলো মনের পর্দায় ভেসে উঠছিল এক এক করে। সুব্রত বাবুর এ অযাচিত আবদারে রাগটা গিয়ে পড়ে মালির ওপর। এ নিশ্চয় তার মালি শফির কাজ। কাঁটামেহেদীর অবাধ্য ডালগুলো সেদিন ছেঁটে দিচ্ছিল শফি। নীলকণ্ঠের ঝাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে মুখ ফসকে দেয়াল ভাঙার কথাটা আপনমনে একবার শুধু তিনি বলেছিলেন। ব্যস, অমনি রটে গেল চারপাশে? বিশেষ করে সুব্রত বাবুর কানে?

হাসান সাহেব বড় সরকারি চাকুরে। তার পদমর্যাদা অনুযায়ী পাওয়া সরকারি বাড়িখানা মোটেই ধোপদুরস্ত নয়। আলো হাওয়ার কমতি আছে সেখানে। বছরখানেক আগে তিনি যখন প্রথম বদলি হয়ে এসেছিলেন তখন কোয়ার্টারের একটি ভবনে দু-একটি পরিবারকে বসবাস করতে দেখেছিলেন। সেটাও অনেক আগের কথা। বর্তমানে বাড়িগুলোর অবস্থা বেজায় সঙ্গীন, প্রায় সবগুলোই পরিত্যক্ত। পরিত্যক্ত হলেও ‘পলাশে’ দু-একটি পরিবার বসবাস করে মাসিক অল্প ভাড়া গোনে। এরা অবশ্য বিভিন্ন অফিসের অধস্তন কর্মচারী সব। বাকিরা সবাই একে একে সরকারি বাসায় থাকার সুবিধা ছেড়ে চলে গেছে আশপাশের অলিগলিতে। বাহারি নামের নিচে দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা ঢাকা পড়লেও স্মৃতি আঁকড়ে পড়ে রইল ওই সুব্রত বাবু। 

নদীর গা ঘেঁষা অফিসের ক্যাম্পাসটা সবুজে ঘেরা ছিমছাম, পরিবেশটা বেশ মনোরম। সকাল-বিকালে কয়েক দণ্ড সময় বের করে হাঁটতে তার খুব ভালো লাগে। তবে জরাজীর্ণ বাড়িগুলো দেখলেই মন খারাপ হয়ে যায় হাসান সাহেবের। বন্দি ঘরগুলোর চুন-সুড়কির ফাঁকে, কাঠ-কড়ি-বর্গার ভাঁজে কিংবা ইটের দেয়ালে নিশ্চয় হাজারো কথা স্মৃতিবন্দি হয়ে জমে আছে এখনও। হাঁটতে গিয়ে একা ভাবতে ভাবতে সেসব কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পান যেন তিনি। একটা প্রচ্ছন্ন বিষাদমাখা অনুভূতি তাকে মাঝে মাঝে গ্রাস করে শূন্য করে দেয়।

তিন

একদিন বৈকালিক হাওয়া গায়ে মেখে বাসায় ফিরে আসেন হাসান সাহেব। সন্ধ্যার ঠিক আগে বারান্দার ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে বসেছেন মাত্র। হঠাৎ কী মনে হওয়ায় নিচে নেমে গেলেন দ্রুত পায়ে—সোজা বাগানের বেলগাছের তলায়। বেলফুলের তীব্র সুগন্ধে বাতাস ভারী হয়ে আছে। অনেকদিন পর এই সুবাস বুকে ভরে নিতে গিয়ে তার মাথা ঝমঝম করে উঠল।

আজ তার মালি কিংবা আর্দালি কেউ আসেনি। ঘরে আলো জ্বালাবারও কেউ নেই। আজ কি শনিবার নাকি? হঠাৎ মনে হয় ছেলেটা সাপ্তাহিক ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে গেছে। আজ আর কেউ আসবে না। ছোট্ট এক টুকরা বাগানে একা পায়চারি করতে করতে সন্ধ্যা নেমে আসে ধীর পায়ে। বেলফুলের গন্ধ ছাপিয়ে মোহনীয় ধূপ-ধোঁয়ার গন্ধ ভেসে আসে।

বাড়িটা কেমন পোড়াবাড়ির মতো। বিশাল কাঁঠাল গাছটা তার শতবর্ষী ডালপালা ছড়িয়ে দিয়ে কেমন ঢেকে রেখেছে পুরোটা জায়গা। জীর্ণ দেয়ালের এখানে ওখানে পলেস্তারা খসে বেরিয়ে আছে লাল গেরুয়া ইট। তার ওপর ভেজা দেয়ালের নোনা গন্ধ নিয়ে হাওয়ায় দুলছে সতেজ বুনো ফার্ন। জানালার কার্নিশের ফাঁকে ফাঁকে দু-এক জায়গায় পাতা মেলেছে নবীন অশ্বত্থ-বটের চারা। শ্যাওলার সবুজ চাদরে ঢাকা বাড়ির আদি রঙের আন্দাজ করা বেশ কষ্টসাধ্য বটে। কী ভীষণ গা ছমছমে একটা ব্যাপার। আর এসব কারণে বহু পূর্বেই বাড়িটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। তাও এক বছরের বেশি হতে চলল সময়টা।

মনে আছে সেই সময় একদিন সকালে হাসান সাহেব ইঞ্জিনিয়ারকে ডেকে বললেন, ক্যাম্পাসের সব জীর্ণ ভবনগুলোকে চিহ্নিত করুন কাশেম সাহেব। কোনদিন যে একটা দুর্ঘটনা ঘটবে তার ঠিক নেই।

সামনের বছরটা অন্তত মেরামত করে চালিয়ে দেওয়া যায় স্যার। কিছু আয়ও হলো।

বাদ দিন তো ওসব। কেউই তো থাকে না ক্যাম্পাসে। আর ওই যৎসামান্য আয়ের জন্যে খরচের বহর তো একেবারে কম নয়। তার ওপর উপরের অনুমোদন, পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি, ঠিকাদারের কার্যাদেশ, তদারকি ও সবশেষে কাজ ঠিকমতো বুঝে নেওয়া ইত্যাদি নানান হাঙ্গামা রয়েছে। অযথা পয়সা খরচ করার দরকার কী? পরিত্যক্ত ঘোষণার জন্যে একটা পূর্ণাঙ্গ প্রাক্কলন করে প্রস্তাব দিন। সব ভেঙে ফেলে নতুন ভবন তৈরির উদ্যোগ নিন। ব্যস।

ঠিক আছে স্যার, বলে উঠে যেতে যেতে আবার ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন কাশেম সাহেব।

কিছু বলবেন নাকি?

তেমন কিছু নয়। তবে সমস্যা আমাদের একাউনট্যান্ট সুব্রত বাবুকে নিয়ে। পুরানো স্টাফ হওয়ায় সহজে যেতে চাইবেন বলে মনে হয় না। উনি স্যার আপনার পাশের ওই জীর্ণ ভবনেই থাকেন।

তাহলে সমস্যা কী?

ওই বাড়িতে উনার স্ত্রী স্বর্গীয়া হয়েছেন। শুনেছি তার বড় মেয়েকেও এক সময় সাপে কেটেছিল ওখানে। বেঁচে নেই। অতৃপ্ত একজন মানুষের মতো ছোট দুই মেয়ে নিয়ে বেঁচে আছেন সুব্রত বাবু।

তাতে কী? বাড়িটার অবস্থা তো খুবই শোচনীয়। আমি প্রতিদিন তাকিয়ে দেখছি। যদি কোনো অঘটন ঘটে যায়!

তা তো হতেই পারে স্যার।

তারচেয়ে বরং এক কাজ করুন কাশেম সাহেব। ‘পলাশ’ ভবনের দোতলা আপনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মেরামত করে দিন। একমাত্র তিনিই তো থাকেন ক্যাম্পাসে।

ঠিক আছে স্যার, বলে কাশেম সাহেব বেরিয়ে যান। ঠিক সেই সময় আবার তাকে ডেকে বসান হাসান সাহেব।

আরেকটু কথা আছে, বসুন আবার।

বলুন, স্যার।

আমি ভেবে রেখেছি পশ্চিমের পাঁচিলের অংশ ভেঙে ফেলে কাঁঠালগাছ তলায় একটা গাড়ির গ্যারেজ করতে পারলে ভালো হয়। গ্যারেজ না থাকায় গাড়ি পড়ে থাকে এখানে সেখানে। সরকারি গাড়ি ব্যবহারের নানান ঝক্কি। আমি এখন আর সেই ঝক্কি পোহাতে চাই না। সুব্রত বাবুর জীর্ণ একতলাটা ভেঙে ফেললে প্রশস্ত জায়গায় চমৎকার একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আগে থেকে তাকে কিছু জানানোর প্রয়োজন নেই। দোতলার মেরামত শেষেই বরং জানালে ভালো হয়। আপনি দ্রুত সে ব্যবস্থাও করুন।

অনেকদিন ধরে আর কোনো সাড়া-শব্দ ছিল না। কাজের চাপে বিষয়টি বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলেন হাসান সাহেব। মাত্র কদিন আগে এ নিয়ে একটু দৌড়ঝাপ শুরু করেছেন তিনি। তিনি মানে ইঞ্জিনিয়ার কাশেম সাহেব।

বাগানের সরু রাস্তায় সন্ধ্যার অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে এমনটাই ভাবছিলেন তিনি। নিঃসঙ্গ পথচারীর মতো বিষণ্ন মায়ায় ডুবে যাচ্ছিলেন বারবার। ধূপ-ধোঁয়ার তীব্র গন্ধটা এখনও নাকে এসে লাগছে। হঠাৎ প্রধান ফটকের গায়ে মৃদু আওয়াজের মতো মনে হলো। অশরীরী অন্ধকারের মধ্যে দেহ ধরে দাঁড়িয়ে আছে কেউ। মনে হলো কেউ একজন ভেতরে প্রবেশের অপেক্ষায় আছে যেন।

কে ওখানে?

স্যার, আসব ভেতরে? 

কে?

আমি সুব্রত।

কী ব্যাপার সুব্রত বাবু? সেদিন সন্ধ্যায় তো কথা হলো আপনার সাথে। আবার কী মনে করে?

আমার কথাটা আরেকবার বিবেচনা করুন, স্যার। না শুনেই তাড়িয়ে দেবেন না।

আশ্চর্য, কী বলছেন আপনি? তাড়ানোর প্রশ্ন আসছে কেন? আপনার জন্যে তো আরও ভালো ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি। কাশেম সাহেব সেই দায়িত্ব নিয়েছেন। এখানে গাড়ির গ্যারেজ করা হবে, ফুলের চমৎকার বাগান হবে; দোলনচাঁপা, নিশিগন্ধার ঝাড় বাগান ছুঁয়ে যাবে। এমনিতে তো বাইরে থেকে দেখলে প্রেতপুরি মনে হয়।

আমার তো স্যার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না এখানে।

অযথা কেন কথা বাড়াচ্ছেন সুব্রত বাবু? আপনার হচ্ছে না, কিন্তু আমার হচ্ছে। বাঙলো ঘিরে সুদৃশ্য বাগান করতে অনেক জায়গা প্রয়োজন। খামাখা বিরক্ত করছেন কেন?

হঠাৎ আবার নাকে আসে ধূপের তীব্র গন্ধটা। সেই সাথে ভেসে আসে মৃৎগন্ধি মানুষের পবিত্র একটা ঘ্রাণ। হাসান সাহেবের মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে। ঘোরলাগা কণ্ঠে প্রশ্ন করেন, কীসের গন্ধ সুব্রতবাবু?

আমার স্ত্রী ধূপকাঠি, লোবান-আগরবাতি জ্বালিয়েছে অনেকদিন পর। আমরা দুজনে মিলে আজ বিকালটা কাটিয়ে দিলাম একসাথে এখানে। অনেকদিন ধরে আছি তো, একদম যেতে মন চাইছে না। একসাথে থাকার বড্ড মায়া। তাই আর কোথাও যেতে চাই না এই মায়া ছেড়ে।

চার

আজ ছুটির দিন নয়। কর্মব্যস্ত দিনের প্রথম সকাল। কিন্তু, তারপরেও বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙে হাসান সাহেবের। গতকাল সন্ধ্যার ঘটনা তার ঠিক মনে পড়ছে না এখন। তীব্র কোনো কিছুর গন্ধে হঠাৎ সংজ্ঞা হারিয়েছিলেন—এমনটাই আবছা মনে পড়ছে তার। তাকে ঘিরে সকলের ভিড় দেখে আরও হকচকিয়ে গেছেন তিনি, তবে কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না। অফিসের লোকজনে তার ঘর লোকারণ্য হয়ে আছে। গতকাল সন্ধ্যায় কিছু একটা ঘটনা যে ঘটেছে তা তিনি বেশ বুঝতে পারছেন।

মালি, আর্দালি সকলেই এসেছে। তবে সবচেয়ে ঘাবড়ে আছে বৃদ্ধ নাইটগার্ড খালেক। পাংশু মুখে সেও তার সামনে দাঁড়িয়ে। এত বেলা পর্যন্ত তার দাঁড়িয়ে থাকার কথা নয়। কাঁদো কাঁদো গলায় সেই প্রথম জড়তা ভাঙে।

আপনি ঠিক আছেন তো স্যার? রাতে ডিউটি করতে এসে দেখি আপনি গাছতলায় পড়ে আছেন। সারা রাত কোনো হুঁশ ছিল না আপনার।

মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুধু শুনলেন হাসান সাহেব। তারপর বললেন, কাশেম সাহেবকে একটা খবর দিন কেউ। আমি একটু কথা বলব তার সাথে। একজন সহকারীর দিকে চেয়ে ঠান্ডা দৃঢ় গলায় নির্দেশ দেন তিনি। তারপর কানখাড়া করে ভিড়কে উদ্দেশ্য করে আবার জিজ্ঞাসা করেন, বাইরে এত চেঁচামেচি হচ্ছে কীসের? কীসের আওয়াজ হচ্ছে ওখানে?

খবর দেওয়ার আগেই ভিড় ঠেলে ঘরে এসে প্রবেশ করেন কাশেম সাহেব। চোখে-মুখে তার উৎফুল্ল স্বস্তির ছাপ স্পষ্ট।

আপনি তাহলে এসেছেন? আপনাকেই খুঁজছিলাম মনে মনে। সুব্রত বাবুকে একটু ডেকে আনুন। আমি কথা বলতে চাই তার সাথে।

ঘরের ভেতর একটা চাপা গুঞ্জন ছাড়া কারও মুখে কোনো কথা সরে না। হতবাক হয়ে সবাই একে অন্যের দিকে তাকিয়ে। কাশেম সাহেব সুব্রত বাবুর প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলে উঠলেন, স্যার আপনার নির্দেশে দেয়াল ভাঙার কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। দুদিন আগেই সব প্রস্তুতি শেষ করে এনেছিলাম প্রায়। আপনার অসুস্থতা দেখে আগে থেকে জানানো হয়নি।

পাঁচিল ভাঙার দরকার নেই। সব এখনই বন্ধ করুন। আর ডেকে আনুন সুব্রত বাবুকে। প্রয়োজন হলে আমি নিজেই বলব তাকে।

চোখ কপালে তুলে কাশেম সাহেবই বললেন, স্যার আপনি এসব কী বলছেন? গত মাসে আপনি যখন চিকিৎসার জন্য বাইরে ছিলেন সেই সময় একটা মর্মান্তিক লঞ্চডুবিতে... এই বলে থেমে গেলেন তিনি।

দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদ হামাগুড়ি দিচ্ছে বাইরে। ঘরময় লোকের উপস্থিতি কিছুটা হালকা হতে শুরু করলে নির্মল এক টুকরা রোদ জানালা গলে প্রবেশ করে হাসান সাহেবের একেবারে মাথার কাছে। তপ্ত হাওয়ার একটা নরম ঝাপটা ঘরের গুমোট পরিবেশকে উলট পালট করে দেয় মুহূর্তে। খুব বড় করে নিশ্বাস নিতে গিয়ে হাসান সাহেব টের পেলেন গতকালের ধূপসন্ধ্যার পবিত্র গন্ধটা এখনও তার নাকে লেগে আছে।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা