X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সত্যগুলো গল্প বলে

আশরাফ জুয়েল
০৪ মে ২০২১, ১৬:০০আপডেট : ০৪ মে ২০২১, ১৬:০০

ন্যান, মাক্স কিন্না মসজিদে যান, মাক্স পইরা গ্যালে করোনা হইবো না, ন্যান ন্যান... দশ ট্যাকা... দশ ট্যাকা… দশ… 

বয়স কতই আর হবে। সাত-আট...। কিন্তু বড়লোক এমনকি মধ্যবিত্তের ছায়ায় থাকা সাত-আট আর রাস্তার সাত-আটে তফাৎ বিস্তর। হ্যাঙলা শরীরে একটা গোলগলা গেঞ্জি। অনেকদিন ধরে মাথা ঢোকানো এবং বের করার ফলে গেঞ্জির গোলগলা বড় হয়ে গেছে। আর শরীরের তুলনায় ছেলেটির মাথা তুলনামূলক বড়। এর দুটো কারণ হতে পারে, আসলেও তার মাথাবড় অথবা স্বাভাবিকের চেয়ে সে শুকনো বলে তার মাথাবড় দেখাচ্ছে।

তার মাস্ক বেচার ধরন, মানুষের আগ্রহ, হুজুরের বয়ান ইত্যাদি পরিবেশটার প্রতি উৎসাহী করে তোলে আমাকে। জুম্মায় বরাবরই লেইট পার্টি আমি। আজ আবার অন্য এলাকার মসজিদ, তাই রাস্তাই আমার জায়নামাজ।

দেখছিলাম। ছেলেটির হাতে প্রায় বিশটা মাস্ক। মাস্কের ফিতার একদিকে তর্জনী ঢুকিয়ে আঙটার মতো ঝুলিয়ে রেখেছে সেগুলো।

বলার ভঙির কারণে হোক বা সাধারণ মানুষের সচেতনতা বাড়ার কারণেই হোক সবকটা মাস্ক বিক্রি হয়ে গেছে।

নামাজ শেষ, মুনাজাত করার আগেই হুড়মুড় করে বের হচ্ছে মানুষ। আমিও উঠে দাঁড়ালাম। দেখি সেই ছেলেটি, খিকখিক করে হাসছে।

ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং ঠেকল। দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম তাকে। ভিড় কমলে তার কাছে গেলাম।

—কী রে? অনেক লাভ হয়েছে?

—কিয়ের লাভ? তেরছা চোখে আমার দিকে তাকালো সে।

—এই যে মাস্ক বিক্রি করে?

—তো আপ্নের কী? কোন ধরনের পাত্তা দেওয়ার কোনো লক্ষণ নেই তার ভাবসাবে।

—না, হাসছিস খুব যে খুব!

—আপ্নের কী মনে হয় মনে সুখ থাকলেই খালি হাসে মানুষ।

—না! তা না…

—তো!

—বিরক্ত হচ্ছিস!

—না।

—তো এভাবে কথা বলছিস যে?

—ইচ্ছা হইছে তাই হাসি! আমগোর কান্দোনের সময় কই থাহেন?

কথাটা সে খারাপ বলেনি। মানুষের হাসি-আনন্দে ভাগ বসাতে খুব উদগ্রীব মানুষ কিন্তু কান্না-দুঃখ! কাউকেই পাওয়া যাবে না।

—না, আমি তো আর তখন দেখিনি।

—য্যান দেখলেই দৌড়াই আইসা খুব কান্তেন আমার লগে?

বুঝলাম সহজে একে বাগে আনা যাবে না। কিন্তু কথা বলতে ভালো লাগছিলো। আর তেমন বিশেষ কাজও নেই আমার।

—না, তোর হাসিটা...

—গরিবের হাসি তো উপহাস করার লাইগা ভালো মাল।

অবাক হচ্ছি। খুব। এরই মধ্যে বছর তিন বা একটা ছোটমেয়ে এসে ছেলেটার হাত ধরে টানাটানি করছে।

—এ আমার বোইন বুচ্ছেন। এরে এহন দোকান থে পাউরুটি কিইনা খাওন লাগবো।

—ও এইজন্য হাসছিলি, মাস্ক বিক্রি করে ভালোই লাভ হয়েছে! তাই না!

—আপ্নেগো তো খালি লাভ লসের হিসাব। চল বোইন...

ইগোতে লাগল খুব। ছোট্ট বস্তির ছেলে কথায় কথায় আহত করছে আমাকে!

—তাহলে অমন হাসলি যে!

—হুনবেন?

—হ্যাঁ।

—ওই দোহানে চলেন, আমার বইনরে পাউরুটি কিইনা দিয়া কইতাছি, চলেন।

একটা বনরুটি সামান্য একটা বনরুটি। কী আনন্দ বাচ্চাটার চোখেমুখে। বাড়িতে খিচুড়ি আর গরুর মাংস রান্না হয়েছে আজ। কিন্তু আমার ক্ষুধা মরে গেল।

—কেন হাসছিলি?

—কাইল আমার মায়েরে কেউ দ্যাহে নাই। বিশ্বাস করেন কেউ দ্যাহে নাই... জ্বর শরীল নিয়া আমি মায়ে আর বোইনে, যে যেহানে যাইতে কইছে গেছিলাম... কেউ নেই নাই, হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরচে মায়ে... তারপর ঘরেত চইলা আসছিলাম...

—আহারে...

—হাসতাছিলাম ক্যা! বিশটা মাক্স বেচ্চি না? সবকটা মায়ের মুখে পরাইছি, আমি পরছি, বোনেরে পরাইছি, তারপর নিয়া আসছি... সব কুত্তার বাচ্চার করোনা হোকগা, সব মরুক শুয়োরের বাচ্চারা... আমার সইলেও জ্বর, বোইনের সইলেও...

—তোর মা কই? মুখের মাস্ক ঠিক করতে করতে ছিটকে দূরে সরলাম আমি।

—মায়ে, বস্তিত, আমগো ঘরে, মইরা পইরা আছে, আরাম পাইছে... কী টান যে উঠছিলো... ভালা কাম করছি না, হালাগো করোনায়ালা মাক্স বেইচা...

২.

—এই মাগি, ভালো কোইরা চুলকিয়্যা দে...

—দিছি তো! দেখতে প্যাছেন না নাকি?

—কমে না কেনে বাল? মনে হোছে আগুনে ঘি ঢালছিস...

—হামি কোহিবো ক্যানকোর‍্যা। চুলক্যাতে চুলক্যাতে কী অবস্থা দ্যাখাছেন?

—চুতমারানি আরও ভালো কইরা চুলকা।

মমদদ চেয়ারম্যানের তৃতীয়পক্ষের বউ সলিসার গায়ের জোরের কাছে চেয়ারম্যান ছিপে আটকানো পটকা মাছ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকে, কিন্তু সামান্য চুলকাতে গিয়ে নিজের এই কাহিলদশা সলিসা নিজেও মেনে নিতে পারছে না৷ সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগের পরেও চেয়ারম্যানের চুলকানি কমে না দেখে হতাশ হয়ে সে বলে ওঠে,

—হামি আর পারব না কোহিনু, মানুষ দ্যাখেন এব্যার...

দমে যাবার পাত্র নয় মমদদ, কতিবর মেম্বোরকে ফোন দেয় সে।

—মেম্বোর কুণ্ঠে আছ?

—হামি আছি তো... বাড়ির দিকেই আছি উস্তাদ... কেনে?

—হামার বাড়িতে আসো তো একটু...

—কেনে উস্তাদ কী হোয়্যাছে?

—অ্যাসো তো একবার...

—আচ্ছা আসসসি।

মমদদ কতভাবে যে চেষ্টা করল, একবার ডান হাত দিয়ে একবার বাম হাত দিয়ে, নাহ কোনোভাবেই জায়গাটায় পৌঁছুতে পারল না। মনে মনে নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করে ‘বউও তো ম্যালা চেষ্টা কল্ল! ঐ শালির গতরে যা জোর! ওর জোরের ঠ্যালায় তো শালা র‍্যাতে হাঁকে বিলাই হোয়্যা থাকতে হয়, সে-ও ফেল মাল্লো?’

এমনই চুলকানি! হয়তো মরবে না। কিন্তু চুলকানি কমছেই না। বড়বউ, মেজবউ চেষ্টা করে গেছে। ভেবেছিলো ছোটবউ চুলকিয়ে দিলে চুলকানি কমবে কিন্তু না কিছুতেই কমেনি।

—কী হোয়্যাছে চিয়্যারম্যান?

—আর কোহিস না ব্যাড়া, এমনই চুলক্যাছে। দুই হাত দিয়া শালা কত চেষ্টা কোচ্ছি, জাগাটা হাতে পাচ্ছিই ন্যা। ডাহিন হাত বা হাত কুনু হাত দিয়াই শালা জাগাটা চুলক্যাতে পাইচ্ছি ন্যা।

—কাহুকি দিয়্যা চুল্কিয়া লেন না জি! আপনি চিয়্যারম্যান, এত্ত বোকাচোদা নাকি কী আপ্নি?

—ধুর সালা, তিন বহু কে দিয়্যা চুলকিয়া লিনু। কুনু কামই হলো না। বাড়ির সভ্যাই কে দিয়্যা চুলকিয়া লিনু। উহু, কাম হোছেই না।।

—কই কুণ্ঠে? দেখি, হামি চুলকিয়া দি দেখি...

—দ্যাও তো দেখি, যুদি কোমে একটু।

যতভাবে পারে মেম্বার চেষ্টার কমতি রাখলো না। কিন্তু কোনোভাবেই চুলকানি কমে না।

—নারে ভাই কমে না। কী করব কহ্যা তো!

—এক কাম করি? ঝড়ু ডাক্তারকে ড্যাক্যা লিয়া আসি।

—ঐ ফারমেশির ডাক্তার, যাকে পারবি লিয়া আয়। হামার চুলকানির ল্যাগ্যা মোর‍্যা যাবো বে হামি?

চেয়ারম্যান অনেক চেষ্টা করেও পিঠের ওই জায়গাটায় কোনোভাবেই হাত নিতে পারে না। ছোটবউকে ডাকে আবার, বড়বউকে, মেঝবউ, কাজের মেয়েটা, রাখাল, সবাইকে দিয়ে চুলকিয়ে নিয়েছে কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।

শুধু কী বাড়ির লোক! জায়গীর, মসজিদের ইমাম, প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার, মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল—কেউই বাদ যায়নি। সবাই চেষ্টা করেছে, কিন্তু কোনো ফল হয়নি৷

ইউনিয়ন সাব-সেন্টারের ডাক্তার ফেইল, কিন্তু, নাহ। এমনই চুলকানি, কিছুইতেই কমে না। চুলকানির চোটে চেয়ারম্যানের উথালপাথাল অবস্থা। ইতোমধ্যে ইউনিয়নের গ্রামে গ্রামে, পাড়ায় পাড়ায় রটে গেছে চেয়ারম্যানের এই কাহিল দশার কথা। আড়ালে আবডালে মানুষ হাসাহাসিও করছে।

অনেকেই আসছে, দেখে যাচ্ছে, পরামর্শ দিচ্ছে, সবকিছুই চেষ্টা করে দেখছে সে, জায়গাটায় ঘা হয়ে গেছে রীতিমতো।

পিঠের জায়গাটার এমনই চুলকানি, চেয়ারম্যানের অবস্থা খুবই খারাপ। এরমধ্যে সদর, এমনকি ঢাকা থেকেও চিকিৎসা নিয়ে এসেছে, কিন্তু নাহ কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।

আরাম পাওয়া তো দূরের কথা, দিনকে দিন বাড়তেই আছে। ঝাড়ফুঁকও করিয়েছে, কবিরাজ, তাবিজ হারবাল, হোমিওপ্যাথি—সবকিছুই করা শেষ।

এলাকার বুজুর্গ-হুজুরদের পরামর্শে কোরআন খতম, মিলাদের আয়োজন, ফকির মিসকিন খাওয়ানোও হয়েছে।

কিন্তু এ চুলকানি এমনই, কিছুতেই কমে না। হতাশ, এলাকার গণ্যমান্য সবাই মিলে বসে একটা উপায় বের করার যত রকমের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু উন্নতির কোনো উপায় দেখছে কেউ।

—হুজুর, হ্যার মোনে হয়, আপনার নিজ হাত দিয়া যুদি চুলক্যাতে পাত্তেন! তাহিলে মনে হয় চুলকানি কমত।

চেয়ারম্যান ভাবে, এটাই বাকি। পিঠের এমনই বেকায়দা জায়গায় চুলকাচ্ছে, কোনোভাবেই ডান বা বাম হাত দিয়ে চুলকাতে পারেনি সে।

—ঐ গরু জভ্যাই করা ছোরা খান লিয়্যা আয়।

চেয়ারম্যানবাড়ির ফুটফরমায়েস খাটা সুকুদ্দি ধারালো ছোরাটা নিয়ে আসে। চেয়ারম্যান ডান হাতে ছোরা নিয়ে এক কোপে নিজের বাম হাতের কনুই পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন করে ফ্যালে! সুকুদ্দিকে নিজের বিচ্ছিন্ন হাতটা তুলে দিয়ে পিঠের যে জায়গাটায় নিজের কোনো হাত কোনোভাবেই পৌঁছাচ্ছিল না সেই জায়গাটা চুলকাতে বলে।

—হ্যাঁ, বে চুলকানি কিছুটা কোম্যাছে মোনে হোছে। কিন্তু পুরাপুরি সারে না যে বে...

—হুজুর হ্যার মোনে হয় ডাহিন হাত দিয়া চুলক্যালে আপনার চুলকানি পুরাপুরি স্যার‍্যা য্যাবে।

চেয়ারম্যান রক্তাক্ত ছুরিটা তুলে দেয় সুকুদ্দির হাতে, দিয়ে বলে মার... আবে মার কোপ... হামি কোহোছি কোপ মার...

মৃত মায়ের কথা মনে পড়ে পিতৃপরিচয়হীন সুকুদ্দির।

৩.

মাথাভর্তি জ্বর নিয়ে রিকশার প্যাডেলে পা রেখে বের হয়েছিল, বিড়ি খেত, কাশিও ছিলো-জ্বর সিগারেট আর কাশি মিলে বর্ষাদিনের বস্তির মতো অবস্থা হয়ে গিয়েছিল জামজাম আলীর। তার সাথে করোনা আতংক। কাজকর্মও নাই।

এসব ছাপিয়ে জামজাম যে জায়গায় বিজয়সরনীর সিগন্যালের মতো আটকে গিয়েছিল, তা হলো জয়নবের পেট। ফুলতে ফুলতে তার পেটের অবস্থা জামজামের মায়ের সেই পোষাগাইটার মতো হয়ে গিয়েছিল। ভয় পেটফোলা নিয়ে নয়, গাভিন গাইটা যেভাবে মরে গিয়েছিল, জয়নাবও যদি?

ক'দিন আগে মা মরেছে জয়নাবের। করোনায়। মা মরার কথা এই অবস্থায় জয়নাবকে বলতে চায়নি জামজাম। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর খবর সবার আগেই চলে আসে মেয়ের কাছে, মা মরলে সবার আগে আশ্রয়হারা হয় মেয়ে।

জয়নাবের কাছেই আসার কথা ছিল তার মায়ের, যদিও জামজাম আর জয়নবের নেবার পর বস্তির এই ছাপড়ায় শ্বাস নেওয়ার মতো এতটুকু বাতাস অবশিষ্ট থাকে না, জামজাম তার শ্বাসের বাতাস ছেড়ে দিয়ে বাইরে থাকতে চেয়েছিল, আর মা না আসলে! অবশ্য মা না আসলে কী হতো তা দেখার আগেই মাকে দেখে নিয়েছে করোনা।

তবুও ঘেমোগায়ে রিকশাটানার মতো করে সবকিছুই টেনে নিয়ে যাচ্ছিল জামজাম। কিন্তু করোনার কারণে থমকে গেছে রাস্তা, শত প্যাডেল মারলেও রিকশা এগোয় না। কয়েকদিন রাস্তার এ মোড়ে ও মোড়ে ভাড়া মেরেছে জামজাম। ভাড়া না মারতে পারলেও অন্যকিছু একটা করতে পারত জামজাম।

এই দুঃসময়ে কেউ কারো দিকে এগিয়ে আসে না। তেমনি জয়নাবের দিকেও আসেনি। কিন্তু যার আসার সে ঠিকই বেরিয়ে এসেছে। জয়নাবের কোলজুড়ে এসেছে একটা ছেলেসন্তান। কিন্তু জামজামের আসার কথা নাই।

জামজাম রিকশার পাশে শুয়েছিল। প্রথমে মানুষ ভেবেছিল, হয়তো ক্লান্ত চালক ঘুমাচ্ছে। আশপাশ দিয়ে মানুষ যাচ্ছিল, আসছিল। সবকিছুই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু এর মধ্যেই কেউ একজন বলে বসল, এত মনে হয় মরে গেছে। এ কথা শোনার সাথে সাথে মানুষ দূরে সরে গেল কিন্তু একেবারেই চলে গেল না। কেউ হাঁটতে হাঁটতে ফিরে এসে বলল, একে তো কিছুক্ষণ আগেই এখানে বসে কাশতে দেখেছিলাম। কাশির কথা শুনে মানুষ আরেকটু দূরে সরে গেল। একজন বলল, আরে আমি তো দেখলাম মাথায় পানি ঢালছিল, এর তো জ্বর ছিল। মানুষ আরেকটু দূরে সরে গেল। একজন বলল, কিছুক্ষণ আগেই এখানে বসে হাঁপাতে দেখেছিলাম। মানুষ আরও একটু দূরে সরে গেল৷ ভিড় ঠেলে মুখ বের করে একজন বলে বসল, এ তো করোনায় মারা গেছে৷ মানুষ আরও দূরে সরে গেল, কিন্তু কেউ কেউ একেবারেই চলে গেলেও সকলেই গেল না।

এরই মধ্যে একজন পকেট থেকে স্যামসং নোট বের করে জামজামের মৃতদেহের দশ সেকেন্ডের এজটা ভিডিও করল, কয়েকটি সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ামাত্র তা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল। লাইক-শেয়ার-কমেন্টে ভরে উঠল জামজাম। সাংবাদিক, পুলিশ এবং আঞ্জুমানে মফিদুল আসতে জামজাম পৌঁছে গেছে সকলের ওয়ালে ওয়ালে। তারপর আরেক সংবাদ পেয়ে মানুষ দ্রুত জামজামকে ভুলে মানুষ নতুন খবরে মেতে ওঠে।

ঘরে তেমন কিছু নেইও। থাকার কথাও না, কিন্তু আছে শিশুটি। তার গলার আওয়াজে কেঁপে ওঠে ছাপড়ার চালা। তার ঠোঁটে অনেক জোর। একবার জয়নবের বুকে মুখ দিলে আর ছাড়তেই চায় না৷ দুধ পায় না ঠিকমতো। পাবেই-বা কীভাবে৷ সদ্য পোয়াতি জয়নবের মুখে দেওয়ার মতো কিছু নেই। জয়নব একবার ভাবে, জামজাম তাকে ফেলে এভাবে চলে যেতে পারল? আবার ভাবে, না কিছুতেই তাকে ফেলে যেতে পারে না, ফিরে সে আসবেই।

এদিকে ছেলে দুধ পাচ্ছে না, দুধের বোঁটা মুখে নিয়ে চোষার জোর ক্রমশ কমে আসছে। দাদির কথা মনে পড়ে জয়নবের, দাদি বলত ষোলো ফোঁটা রক্তের বিনিময়ে একফোঁটা দুধ তৈরি হয়। সুপারিকাটা জাঁতি দিয়ে তার বাম হাতের কুড়ে আঙুলের মাথা কেটে ফেলে আঙুলটা ছেলের মুখে আঙুলটা পুরে দেয় জয়নব...

ছেলে আনন্দে প্রবল বেগে জয়নবের কাটা আঙুল চুষতে থাকে, সে শুধু জানে ক্ষুধার স্বাদ নোনতা।

৪.

—আপনার ধারণা কী? আপনার ছেলেকে কেউ কিডন্যাপ করেছে? মানে আপনার কোনো শত্রু?

—না, আমার কোনো এনিমি নেই। ডলার, খোন্দকার হাকিরুল হাসান চৌধুরী আমার একমাত্র সন্তান। আর যদি শত্রুতা থাকেও তার প্রতিশোধ আমার সন্তানের ওপর দিয়ে তুলতে হবে?

কথাগুলো বলেই খোন্দকার হাজিনূর হাসান চৌধুরী তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা কারো দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতে কিছু বললেন, এর অর্থ তিনি এবং তাঁর ম্যানেজার ব্যতীত অন্য কেউ জানবে না, এটাই স্বাভাবিক, তবু ধারণা করে নেওয়া যায়, হয়তো সম্ভাব্য শত্রু, যারা তাঁর সন্তানকে কিডন্যাপ করতে পারে তাদের তালিকার দিকে নজর বোলাতে বললেন তিনি।

—কবে থেকে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না! আর এমনও কী হতে পারে তিনি নিজেই কোথাও চলে গেছেন? রাগ বা ঝগড়াঝাঁটি করে!

—এসব উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করবেন না। অহেতুক। চেহারায় উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট চৌধুরী সাহেবের।

—আমরা জানি, আপনার ব্যাবসায়ীশত্রু অনেক... রাজনৈতিক শত্রুরও অভাব নেই।

—করেই দেখুক কেউ এমন, গলা ছিঁড়ে ফেলব না। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সেক্রিটারি জানালো এটা রেকর্ড হচ্ছে।

খোন্দকার হাজিনূর হাসান চৌধুরী শহরের অনেক বড় ব্যবসায়ী, রাজনীতির সঙ্গেও আছে নিবিড় যোগাযোগ। একমাত্র সন্তানকে গত তিনদিন থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গত সপ্তাহেই বিদেশ থেকে ফিরেছে। বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। সেই বন্ধুদের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, সবার একই কথা, ডলার তো তাদের সাথে দেখা করে নিজেই ড্রাইভ করে বাসায় গেছে। নিজে ড্রাইভ করে এসেছে তাও তো ঠিক। গাড়িটাও উদ্ধার করা হয়েছে। মোবাইলটা গাড়ির সিটেই পড়ে ছিল। তাই ছেলেটার অবস্থান জানা যাচ্ছে না কিছুতেই।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব ধরনের চেষ্টা বৃথা গেছে। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। থানায় থানায় খবর দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালগুলোর মর্গে খোঁজ করা হয়েছে।

সংবাদসম্মেলন করে তিনি ছেলের নিখোঁজ হবার খবর দেশবাসীকে জানালেন, এও জানালেন ছেলের খবর কেউ দিতে পারলে তাকে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।

একমাত্র ছেলের সন্ধান না পেয়ে হাসান চৌধুরীর স্ত্রীও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাঁকে দেখতে পারিবারিক চিকিৎসক এসেছেন। দেখা শেষ করে ড্রইংরুমে এলেন তিনি।

—আমার মনে হয় মেন্টাল আপসেটের কারণে উনার বিপি ফ্লাকচুয়েট করছে।

—যা যা লাগে করুন। প্রয়োজনে হসপিটালাইজড।

—না, মনে হয় তার দরকার পড়বে না৷ কিছু ঔষধ দিলাম। ঠিক হয়ে যাবে।

—কিন্তু! আচ্ছা। আমার ছেলেটা! শুনেছেন তো?

—হ্যাঁ। শুনলাম। ও কোনো নেশাটেশা করে না তো!

—না, সম্ভবত না।

—গার্লফ্রেন্ড?

—সেটা জানি না!

বলে খোন্দকার সাহেব আশপাশে তাকালেন। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে জনাদশেক মানুষ। বাড়ির কেয়ারটেকার, কাজেরলোক, ড্রাইভার, আত্মীয়স্বজনেরা খুবই উদ্বিগ্ন, হতবিহ্বল। এদের অনেকেই পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু কোনো কিছুই হচ্ছে না। ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েছেন হাসান খোন্দকার, সেটা কিছুইতে প্রকাশ করতে চাইছেন না। তবে অস্থিরতা ঢেকে রাখতে পারছেন না।

বেশকিছুক্ষণ থেকেই খোন্দকার হাজিখ হাসান চৌধুরীর আশপাশে এসে একটা মাছি ভনভন করে উড়ছে, উড়তে উড়তে মুখের কাছে চলে আসছে। কথার ফাঁকে ফাঁকে মাছিটা তাড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি। কিন্তু আবার উড়ে আসছে, বিরক্ত করছে।

—আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না, ছেলেটা গ্যালো কোথায়? এত প্রচেষ্টা, চারদিকে খোঁজ নেওয়া শেষ! খারাপ কিছু... এই এই মাছি কোথা থেকে এলো... আবার হাত দিয়ে তাড়িয়ে দিয়ে কথা বলা আরম্ভ করলেন তিনি।

—কেউ যদি শত্রুতাবশত, তাহলে, যত টাকা লাগে দেবো। কিন্তু আমার ছেলেটা...

—আচ্ছা আপনার ব্যবসায়িক পার্টনাররা...

—আমি জানি না। কিছুতেই মাথাঠান্ডা রাখতে পারছি না।

আবার হাত দিয়ে মাছিটাকে তাড়িয়ে দিলেন তিনি। মনে হচ্ছে সন্তান লাপাত্তা হবার পর থেকে সবাই তার সাথে এই মাছিটার মতো ব্যবহার করছে।

—কিন্তু যাবে কোথায়? অবশ্য দেশের আইনশৃঙ্খলার যা অবস্থা! আপনি একটু ভালো করে খোঁজ লাগান।

—ডাক্তার সাহেব সব জায়গায় খবর! কেউ মেরে! না না। এমন কিছুই হবে না। মাছিটা ভনভন করে আবার উড়ে আসে তার মুখের কাছে। এবার ভীষণ বিরক্ত হলেন তিনি, এই মাছি কোথা থেকে ঢুকল। হ্যাঁ। একে মারার ব্যবস্থা করো। মাছি মারার তোড়জোড় আরম্ভ হলো।

মশা মারা ব্যাট, ইনসেকটিসাইড স্প্রে, কোনো কিছুতেই মারা যাচ্ছে না মাছিটাকে। ঘুরে ফিরে চৌধুরী সাহেবের মুখের আশপাশে ঘোরাঘুরি করছে।

চৌধুরী সাহেবের বাম গালে বসেছে মাছিটা। সবাইকে ইশারা করলেন, সবাই স্থির। ঠাশ করে নিজের গালে চড় মারলেন। টার্গেট মিস করা মানুষ তিনি নন। কিন্তু মাছিটা মরল না। চড়টা অনেক জোরেই ছিল। মরেনি দেখে ভীষণ অপমানিতবোধ করলেন।

মাছিটাকে মারতেই হবে, যেন ছেলে হারানোর জন্য ঘোষণা করা পঞ্চাশ লাখ টাকা যে মাছি মারিবে তাকেই দিয়ে দেবেন চৌধুরী হাসান। 

অবশেষে মাছিটা মারা পড়ল চৌধুরীর হাতেই। পরেরবার নিশানা মিস করেননি তিনি।

চকচকে টাইলসের ওপর পড়ে থাকা মাছিটাকে তুলে বাইরে ফেলে ফিরে আসছিল কাজেরমেয়েটা।

ভীষণ চিৎকারে সবার মনোযোগ বাইরের দিকে চলে যায়। প্রায় দৌড়ে সবাই সদর দরজা পেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়।

—কী কী হয়েছে? চৌধুরী হাসান বলেন।

—এই যে ছোট সাহেব!

—কিন্তু এখানে এই অবস্থায় কে ফেলে গেল, আমার ছেলেটাকে শেষ পর্যন্ত মেরেই ফেলল। যেই একাজ করেছে তাকে ছাড়ব না, ছাড়ব না। একথা বলে ছেলের মৃতদেহ নিজের কোলে তুলে নিলেন, কিন্তু...

—সাহেব, কেউ ফালাইয়া যায় নাই তো, আমি ঘোর থিকা মরা মাছিটারে যেই না এইহানে ফেলছি, মাছিটা ছোট সাহেব হইয়া গ্যাছে...

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
কেমন চলছে ভারতের লোকসভার দ্বিতীয় দফার ভোট?
কেমন চলছে ভারতের লোকসভার দ্বিতীয় দফার ভোট?
সাফের আগে চাইনিজ তাইপের বিপক্ষে সাবিনাদের ম্যাচ
সাফের আগে চাইনিজ তাইপের বিপক্ষে সাবিনাদের ম্যাচ
কানের ধ্রুপদি বিভাগে শ্যাম বেনেগালের ‘মন্থন’
কানের ধ্রুপদি বিভাগে শ্যাম বেনেগালের ‘মন্থন’
থাইল্যান্ডের রাজা-রানির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য সাক্ষাৎ
থাইল্যান্ডের রাজা-রানির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য সাক্ষাৎ
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ