X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

উড়ে যায় বকপাখি

মুর্শিদা জামান
০৪ মে ২০২১, ১৮:৩০আপডেট : ০৪ মে ২০২১, ১৮:৩০

অফিসের নতুন গঠন পরিচর্যায় দিন চারেক নিজেকে এতটাই নিবদ্ধ করে রেখেছিল কল্যাণ আজ যে ওর পলার সাথে সারা দিন কাটানোর কথা বেমালুম ভুলে বসে আছে। তড়িঘড়ি করে যেকোনোভাবে কাজ আগানো যায় না বারবার ভুল করেও মনে রাখতে পারে না। গাড়িতে ওঠার পর দেখল মানিব্যাগ না নিয়েই বের হচ্ছিল। ঘরে ফিরে দেখে দিব্যি পাখা চলছে। দক্ষিণের জানালা গলে রাজ্যের ধুলো ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে নদী দেশে সদ্য চর জেগে ওঠার মতো। দুদিন হলো সে কালো কুতকুতে পুতির চোখ আর একদলা ধূসর বিচুটি আঁশসমেত আটো সংকল্প নিয়ে রসুনের কচিপাতা রং তাতে কুনিকুনি তারাখচিত পর্দায় চেপে বসে আছে। জানালা খোলা তাতে তার ভ্রুক্ষেপটি নেই। অন্য সময় হলে ছবি তুলে পলাকে পাঠাতো হোয়াটসঅ্যাপে। কিন্তু কল্যাণ অতিমাত্রার ভূকম্পের ঝাঁকুনি খেয়ে জেনেছিল গত মাসের ছুটির দিনে, পলার জগৎজুড়ে বাবার ছোট ছোট ন্যাওটামির বদলে এখন পিয়ানো ক্লাসের বন্ধুদের গ্রুপ মেসেজবক্সের জমজমাট নতুন হিল্লোলের হুটোপুটি। চামচিকার ঘরে এসে পর্দা কামড়ে পড়ে থাকার ছবিতে আগের মতো লাফিয়ে উঠে ফোন করে বলবে না

—বাবা, ও বাবা ওকে খেতে দিয়ো। তাড়িও না।

না কল্যাণ কাউকেই তাড়ায় না। স্বভাবেই তো নেই। বরিশালের বাড়িতে পুকুরপাড়ে কটকটা রোদে তাপসীর ব্লাউজ পোড়ে। জন্মকালের রং হারিয়ে নতুনভাবে দোলে, যে স্তনবৃত্ত একদিন তালুতে খুন্তি স্যাঁকা খাওয়া ইস ইস সুখ দিয়েছিল সেই স্তনবৃত্তের ব্লাউজ এখন ওদের বাড়ির পুকুরে সাবান ঘষে ফেনা তুলে ধুয়ে পরিপাটি টানটান দড়িতে লটক খায়। তাপসী ছেড়ে গিয়েছিল বাকলখসা মৌসুমে। ত্বকের ভেতর থেকে নীল শিরা দপদপ করে জ্বলত কপালের কুচো চুলের নিচে। সেই নীলশিরা সেই কুচো কেশ, বগলের নরম ভাঁজ তার রেখায় রেখায় কল্যাণের রাক্ষুসে চুমু সমস্ত সাবানের ফেনায় ঘষা ব্লাউজ এখন। কিছুই ছেড়ে দেয়নি।

দাপুটে চোখ তুলে একবার চেয়ে কোনোমতে ঠোঁট আলগা করে ‘গোসলে আছে’ বলেই অদৃশ্য হলেন পলার নানি। চৌবাচ্চা আকৃতির দেয়াল টিভিতে বন্যার খবরাদি, ত্রাণ, ফসলের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে খবর পড়ছে ক্রিমমাখা নিখুঁত কামানো দাঁড়ি মুখের ছেলেটা, টাইয়ের রংটা নিশ্চই ওর পছন্দে কেনা না। কল্যাণ চেনে ছেলেটাকে। আগের অফিসের কাছেই বোধ হয় থাকত। ডিম কেনার সময়ও খবর পড়ার ভঙ্গিতে কথা বলে, মুখের মাছি তাড়ায়। রিমোট খুঁজতে গিয়ে দেখল পলার ফোনটা ক্রুসে বোনা সাদা টেবিল ম্যাটে। তাতে জাম্প দিচ্ছে ‘পাপ্পা’ কলিং শব্দ দুটি। ফোনের ওয়ালছবিতে সুরোমার গলায় দুবাহু চেপে ঝকঝকে হাসিতে ফেটে পড়ছে পলা, পাশেই নির্বিষ মুখটা। প্রখড় নাক, তাতে ভালোমানের রোদ চশমা চাপানো। চোয়াল শ্যামল দুধেলা গাইয়ের মতো উপযুক্ত রাগি। সুরোমার বুকে ঝুলছে মালদ্বীপ থেকে কেনা জ্বলন্ত কাঠরঙা সেই লকেটটা। ক্লিভেজে দুরন্ত তিলছানা। বহুবার পিষ্ট করেছে কল্যাণ ঐ তিলছানা ঠোঁট দিয়ে, জিভ দিয়ে। প্রতিবার মনে হতো পৃথিবী ধ্বংসের মুখে, এই শেষ তৃষ্ণাজল, সম্মুখে মৃত্যু অবধারিত। পানে ক্লান্তি রাখেনি যে জল। নিম্নবাহুতে জারকাটা পলকে দৃশ্যমান। আঙুলগুলো স্বয়ং সক্রিয়তায় ভরপুর, যেন এই মুহূর্তে ছুঁয়ে এসেছে সুরোমার খিলখিল হাসিমাখা ভরাট বৃত্তদল!

পুরোন স্বাদ মনে হতেই কল্যাণের ৪৬ বছরের শরীরটা আগল খোলা ঘোড়া হয়ে উঠল এক নিমিষে।

—বাবা, ও বাবা ভেতরে এসো।

মেয়ের মাথাভর্তি চুল। তারই ফাঁকে বছর পনেরোর বাচ্চা মুখটা কেমন দোল খায় আজও! কল্যাণের এখনো মনে হয় না পলা বড় হচ্ছে। পলা আলাদা থাকে। আলাদা ঘুমায়। মনে হয়, এই তো এইমাত্র কোলে দুলিয়ে দুলিয়ে ঘুম পাড়ালো। ওমনি কেমন প্রবঞ্চক সময় কেড়ে নিল সব। খাবার টেবিলে শিং মাছের গায়ের ভাসা ভাসা ঝোলে ছোট আলুর বল, কুমড়োর চাকা সোনালি করে ভাজা আর কি একটা শাকে জিভে পড়া কালোজিরের দঙ্গল। পলার গল্পের ঝাঁপি এখনো মুখবন্ধ। নানির আদেশমতো চুপটি করে ভাত মেখে, আস্তে আস্তে গিলে খাচ্ছে। মোটা মোটা রুটি দুখানা দিয়ে সবকটা পদ খেলো কল্যাণ। সুরোমার মা এখনো নিজে রান্না করেন। সেই আদি পাকঘরের স্বাদ। না বললেই নয় এমন ভঙ্গিতে জানালেন বাতে পা ফুলেছে তাই বেশি রান্না হয়নি আজ। কি নাকি ভুলে গেছেন রাঁধতে। আগামী রোববার রেঁধে রাখবেন।

মেয়েকে অঁলিয়সে নামাল। গেটে ঢুকে যাবার মুহূর্তে ঘাড় ঘুরিয়ে বাবাকে দেখে মিছে হাসি দিলো তাতেই কেমন নির্ভার হলো বুকটা। প্রাচীরের ওপাশ থেকেও মেয়ের সশব্দ হাসির ঝলক শুনতে পাচ্ছে কল্যাণ। ও জানে সহস্র ভিড়েও পলার কণ্ঠ, পলার একঝাঁক চুলের মাথা আলাদা করতে পারবে। হাসপাতালে যেমন পারত। অতগুলো বাচ্চার ভেতরে দুদিনের পলাকে সুরোমার চাইতে আগে চিনত ও। পিয়ানো ক্লাস শেষে উত্তরা চলে যাবে নির্বিষ মানুষটার সাথে। অল্প অল্প আঁধারে রাস্তার অপর প্রান্ত থেকে দেখে নেয় মেয়ের ব্যস্ত প্রহরটুকু। গাড়িটা চলে গেলে ধানমন্ডি রোগাক্রান্ত মোরগের মতো ঝিমুতে থাকে। সুরোমা চায় না বলেই ও উত্তরায় পৌঁছে দেওয়ার আনন্দ সময় হতে বঞ্চিত।

ওরা কি পারত না এদিকে থাকতে?

অথচ এই ফ্লাটটা কেনার দিন কোমর জড়িয়ে ধরে সুরোমা দিশাহারা চুমু খেয়েছিল লিফটে। মা তখন বেঁচে। খুব যে ওর কাছে থাকত, তা নয়। সুচিবায়ু ব্যামো নিয়ে কারো কাছেই থাকতে পারত না। মায়ের একাদশি রান্নার আয়োজন, পুজোর জোগাড় সবকিছুতেই ছোঁয়াছুয়ির বাতিকে বরিশালের বাড়িতে শাপ শাপান্ত করতে করতে কাটিয়ে গেছে জীবন। সুরোমার কথা জানাজানি হলে আর সবার মুখ থেকে রক্ত সরে গেলেও মা সোজা গিয়ে দরজা বন্ধ করে মরণ চিৎকার জুড়ে দিয়েছিল। কত তুফানের মুখ থেকে ভালোবাসা, সংসার, গুজব, চাহিদা, ব্যথা, বিয়োগ সমস্তর তরি ঘুরিয়ে কিনারের দিকে ছুটে গিয়েছিল। সেই তো ডুবল। বড়দি এক উকিল মেয়ের খোঁজ দিচ্ছিল কথায় কথায়। গোত্র টোত্র মেলাতে যায়নি অত এই বয়সে বিয়ে কপালে জুটছে যা তাই সই। বড়দি চায় আবার দুজনা হোক ওর সংসার। মেয়েটির ফেসবুকের কর্মকাণ্ড দেখেই কল্যাণের সেই ছোটবেলার মায়ের বাড়িঘর লেপা, সকালের ভেজা গামছা জড়ানো শরীরে জবাফুল তোলার দৃশ্য মনে হানা দিয়েছিল। ধর্মের শক্ত দড়িতে বাঁধা কাউকেই সহ্য হয় না। বাবার জীবনটা মা কেমন বিষময় করে দিয়েছিল সে তো জানে, তাই বুঝি সুরোমার স্বাধীনচেতা স্বভাবের প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছিল ফোর্থ ইয়ারে।

বাড়ি ফিরে থেমেই পর্দায় চোখ বুলালো। যাক চলে যেতে পেরেছে তাহলে। ল্যাপটপে মেইল খুলতেই দেখল অর্ডারটা পাশ হয়েছে শেষপর্যন্ত। খুশিতে বড় পেগ বানিয়ে হাত পা ছড়িয়ে নিল খানিকটা। গত মাসে অনুপ জবর একটা পার্টি দিয়েছিল বসুন্ধরায়। সেখানেই দেখা মেয়েটির সাথে। বেশ করে কাটা খোলা পিঠের ব্লাউজে কোয়েল পাখির ডিমের মতো ছাপা মসৃণ শাড়িতে লহড়ি তোলা শরীর জড়িয়ে রেখে হালকা সিপ দিতে দিতে আলাপ করছিল। চোখের ভেতর জ্বলজ্বলে শেষরাতের বড় তারা। একটা ধ্রুপদী ভাঙন তুলেছিল ওরা অনুপের লাইব্রেরি ঘরের লম্বালম্বি পেতে রাখা শিরিষ কাঠের টেবিলে। সুরোমা কিছুতেই রাজি হতো না এই ভঙ্গিতে। ওর শয়নশয্যা ছাড়া হতো না। কিন্তু সেদিন রাশি রাশি আইনি বইয়ের ভিড়ে একটা সুষম বণ্টন করছিল ওরা। আদরের ছানাছানি ছিল না বটে কিন্তু শাড়ি না খুলে পরিচ্ছদ বেষ্টিত হয়ে কেমন আশ্লেষে ডুবে ডুবে মন প্রাণ ভড়িয়ে তোলা যায় সেটা টের পাচ্ছিল।

লিপস্টিক ঘষতে ঘষতেই জানালো!

—আমি মাহি।
—ওহ! কল্যাণ মৈত্র।
—পারফিউমটা জবর।

কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না ও। সত্যি কথাই জানায়।

—খুব সুন্দর চোখ আপনার।

লিপস্টিকের খাপ আটকাতে আটকাতে জানালো একদিন পুরোটা দেখতে চায়। কল্যাণ বুঝে পেল না সেই মুহূর্তে কি বলবে। পার্টিতে ফিরে গিয়ে ওরা মেতে উঠেছিল পরে হাসি গল্পে। মাহি লিখে ফেসবুকে যাকে পেল বুঝতে পারছে না সেই কি না। কোয়েলপাখির ডিমের মতো শাড়ি পরা ছবি খুঁজল কতক্ষণ। না নেই। মনে হচ্ছে অনুপকে ফোন করলে পাওয়া যাবে। কিন্তু অনেক রাত। ভঙ্গুর বরফে নেচে নেচ মদ পড়ল গ্লাসে। কল্যাণের ল্যাপটপে এখন নির্দিষ্ট সাইট। হরেক ভঙ্গির মিলনকেতু। মাহি সব দেখতে চেয়ে কোথায় গেল? আর দেখা হবে না? এত অল্প দিয়ে সবাই ওকে ছেড়ে চলে যায় কেন?

তাপসীকে মনে পড়ে আবার। গোবরমাখা হাতে বাচ্চাকে দুধ খাওয়ায় তাও কী সুন্দর লাগে! ওর কি মনে আছে সেই ভোরের কথা। হলুদের ফুল তুলতে গিয়ে ঘোষবাড়ির বাগানে ভাঙ্গা মন্দিরের ভেতর সেই প্রথম কল্যাণের সজাগ অঙ্গটি নেড়েচেড়ে বলেছিল, জ্যান্ত শিব, তুই আমার জ্যান্ত শিব! কল্যাণও হাতের ভেতর একতাল মাখন পেয়ে বলেছিল—তুই আমার সকাল, সূর্য!

দুজনে কি করবে আর কি করবে না সেসব নিয়ে বিন্দুমাত্র না ভেবে আকুল আদরে সকাল করে দিয়েছিল। আজও ভালো লাগে তাপসীকে। মনে হয় ওর ঐ তিন বাচ্চা হওয়া শরীর আবার আদরে আদরে ভোর সকাল হোক।

আমুল গেঁথে থাকা কেউ নেই আজ ওর পাশে। ছোট ছোট, খণ্ড খণ্ড স্রোত কেবল। কল্যাণের সে এক ব্যস্ত জীবন ছিল। তবু সন্ধ্যে হলে মেয়ের গায়ের গন্ধে ঘর ভরে থাকত। অফিস থেকে ফিরে শ্বাস নিত বিরাট করে। সুরোমা ব্যাংকে ভালো পোস্টে। গাড়িটা নিজেই চালিয়ে নিতো। মানুষটা তখনো ওদের জীবনে আলটপকে প্রবেশ করেনি। কোথাও গেলে ওরা কী এক দৈব আকর্ষণে টেনে নিত আসর। পলার কান ফোটানোর দিন সব থেকে বুক কেঁপেছে কল্যাণের। মাধুর্য ঢেলে পলা সারা বাড়িঘর ঘুরঘুর করে ছড়া বলত। মা বরিশালের বাড়ি থেকে নারকেল, পুকুরের মাছ, গুড় লোক দিয়ে পাঠাত। আস্তে আস্তে সুরোমার পর থেকে বিদ্বেষ তুলে নিচ্ছিল মা যখন বেশিদিন পায়নি আর এ-ধরায় আয়ুপাতে। ওরা দুজনে মিলে ঠিক করেছিল মেয়ের নাম। অপলা। কোনো সারনেম রাখবে না। কিন্তু মায়ের অসহনীয় জেদের কাছে নত হয়ে গিয়েছিল ওদের ইচ্ছে। অপলা মৈত্র, সবার নয়নের মণি। চোখ দুখানা অবিকল মায়ের চোখ তুলে এনে বসানো। অল্পবিস্তর সুরোমা আর বাকিটা কল্যাণের জিন অস্থি-মজ্জাসমেত। মেয়ে দুপুরবেলার পুকুরঘাটের মতো শান্ত, স্থির। পলার বয়স বারোতে যখন সুরোমার মনে নাগালিংগম ফুলের গোলাপি তরঙ্গ। একতাল ফুলের ভেতর থেকে হাতড়ে ওকে খুঁজে বের করতে গিয়ে ক্লান্তিতে নুয়ে যেত কল্যাণ। দুতরফা বিবাদে মেয়েটা শরবিদ্ধ হরিণের মতো কাঁপত সোফার কোণে। কল্যাণ আর সুরোমার তাতানো কথার বিষে ঘরটা তখন নীলকণ্ঠ। আর সে বিষ ছড়াতে দেয়নি কোথাও। তরি ডুবল পলার আহ্লাদ, অভিমানমাখা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুতির মালা ছিঁড়ে ছিটিয়ে কেমন শূন্য বেতাল হয়ে।

সুরোমার অনামিকায় এখন চাবুকের মার খাওয়া ফোঁস ফোঁস করা জন্তুর জ্বলুনি চোখের মতন হিরের রিং। ত্বকেও অপরিসীম সময় নিয়ে মাখনলেপা পরোটার ভূভাগ। ও জানে আবার কখনো সুযোগ পেলে গভীর আলিঙ্গনে ঘাড়ে কুমিড়ের বালুতটে পরে পড়ে রোদ খাওয়ার মতো পড়ে থাকবে কতটা, জানে শরীরের গুহা হতে ডাক আসে সে শুধুই বিবাহের বাঁধন টুটে যাওয়া রমণী বলে নয় ভালোবাসার সর গাঢ় হয়ে জমে ছিল তাই। আবার কাউকে বাসতে ইচ্ছে হয়। অফিস ফেলে, গাজিপুরের চিকন রাস্তা ধরে গাড়িতে জ্যাজ চালিয়ে রেশম চুলের কাউকে নিয়ে আবার লংড্রাইভে যেতে চায়। কিন্তু কই? সেই মানুষ কই?

কল্যাণ, অনুপ-রাজিব-পল্লব ওদের মতো শেকড় বিস্মৃত একেবারেই না। বিশ্রী জান্তব অভ্যেসের দিকে পা বাড়ায়নি কোনোকালেই। লতাগুল্মের মতো নরম ও। শেকড় দাপানো বৃক্ষের মতো প্রেম চেয়েছে শুধু। খবরে যে কারো মৃত্যু সংবাদে চোখ আদ্র হয়। ভিখেরির মেকি কান্নাতেও কাঁদে এমন। বড় কোনো গাছের শাখা হতে শিশু পাখি পড়ে গেলে যতটা অসহায় ঠিক তাই কল্যাণ। বাথরুমের দরজার নব কাজ করে না প্রায় বছরখানেক। কত যে স্যুট দিনের পর দিন ঝুলছে, পরাই হয় না। অর্ধেক জীবন তার মাটির উঠোনের মতো গোবরের সোহাগে ধুলো ঢেকে দিত সেই জীবন আজ সড়কের তালকানা ধুলো। ভাবতে ভাবতে ভোরের দিকে চোখের পাতা লেগে এসেছিল প্রায়। অমনি অমৃতধ্বনি। অপলার নম্বর হতে কল এসেছে। সটান স্নায়ু কল্যাণের মুহূর্তে।

—বাবা, ও বাবা জলদি এসো এখানে। পাপার বুকে ব্যথা।

মেয়ের গলায় প্রেতপুরির আতঙ্ক। সাথে সেই চেনা কান্না।

—এক্ষুনি আসছি পরাণ! একদম কেঁদো না। কিচ্ছু হবে না পাপার। মাকে বলো মাথা ঠান্ডা রেখে বড় পিসিকে ফোন করতে। আমার আগেই পৌঁছে যাবে পিসি কেমন সোনা!

—বাবা, ও বাবা তুমি এসো আগে।

কল্যাণের গাড়ি ছুটতে থাকে তিরবেগে। মেয়ের ছোট প্রাণটা ঠিক ওর মতো। সবাইকে সহজে আপন করে নেয় দ্রুত। যাকে ছবিতে বা পলার সাথে দূরে কোথাও দেখলেই বুকটা জ্বালা করত, রাগে তেড়ে ছুটে গিয়ে ঝগড়া করতে ইচ্ছে হতো সেই কত প্রিয় পলার। ‘পাপা’ বলে এখন সে ঘন স্বরে ডাকে। কল্যাণের নিজেরও ভালো লাগতে থাকে মানুষটাকে। ঘুমের ভেতর পলা নখের আঁচড় খায়। সুরোমার অভ্যেসটা পেয়েছে। নিশ্চই মানুষটা ওর মতো ভ্রু কুঁচকে লাল আঁচড়ে ভেসলিন মেখে দেয়। পলার জন্য সিগারেট ছেড়ে দিয়েছে পর্যন্ত। মাঝে মাঝে আইসক্রিম পার্লারে গিয়ে মেয়ের গল্পের মাঝে বুঝত কতটা জীবন্ত হয়ে থাকে সুরোমা পলার মাঝে মানুষটা। সন্ধ্যের সময় কি সুন্দর নিয়ে গেল মেয়েকে। কখন যে কী ঘটে যায়? মেয়ের নম্বর থেকে কল আসতেই ধরল।

—হ্যাঁ মানিক, চলে এসেছি প্রায়।
—আমি বলছি, আমরা ক্লিনিকে। বড়দিও এসেছে। এড্রেস সেন্ড করছি।

বলেই টুক করে কেটে দিলো লাইন। সকালের ঢাকা এত সুন্দর! আহা ঘুমে ঘুমেই কেটে গেল কত সকাল!

উত্তরায় এত কম এসেছে কল্যাণ যে রীতিমত চমকে যাচ্ছে। এ এক অন্য ঢাকা, অন্য শহর! ওর হাড়ে মজ্জায় তো ধানমন্ডি গেঁড়ে বসে আছে। ঢাকার এত বিস্তৃতি এত সূক্ষ্ম বদল তলায় তলায় সেটা মাহি কে দিয়ে বুঝেছিল সেদিন আর আজ উত্তরায় এসে। গাড়ি পার্ক করতে করতেই দেখতে পেল বড়দির ড্রাইভার ওকে দেখে এগিয়ে আসছে। ছেলেটা এত সুদর্শন, মাঝে মাঝে চমকাতে হয়। একটা বড় প্যাকেট এগিয়ে দিলো ওর দিকে। বড়দির সব অবস্থাতেই তাল ঠিক থাকে। কল্যাণের বেশকিছু জিনিসপত্র বড়দি অঙ্ক করার মতো সামলায়। তাই এত তোলপাড়েও শান্তমাথায় নির্দেশনার ছড়ি ঘোড়াতে ভোলেনি। প্যাকেটটা কোনোমতে গাড়ির ভেতর ছুড়ে ক্লিনিকের ঝাঁ চকচকে লিফটের পেটে ছেড়ে দিলো নিজেকে। প্রথমেই সুরোমার সাথে দেখা হয়ে গেল ওর। এত স্বচ্ছ সেই অবয়ব, ভীষণ সাবলিল হাঁটাচলা।

—পলাকে বাইরে নিয়ে কিছু খাওয়াও আগে। ইশ! দাঁত মাজোনি? মদ খেলে কিছু খেয়াল থাকে না তোমার?
—ওনার কি অবস্থা?
—মাইল্ড অ্যাটাক, আপাতত সব দেখছেন ডক্টররা।

সত্যি তো কোনো রকমে জামা প্যান্ট দেহের ভেতর গলিয়ে চলে এসেছে। সুরোমা এমনভাবে কথা বলছে যেন এইমাত্র রান্নাঘর থেকে চা করে এল। যেন বাথরুমে ফেলে রাখা ভেজা তোয়ালে নিয়ে মৃদু কড়া ধমকে ওর মোজা খুঁজে এনে দিচ্ছে। চাবি দেওয়া পুতুলের মতো ক্লিনিকের বাথরুমে আঙুল দিয়ে ভালো করে দাঁত মেজে নিল। আয়নায় নিজেকে দেখে হাসল একটু। কতদিন পর, দেখা হলো! সুরোমার চোখের তলায় প্রেম নেই ওর জন্য, নাকি আছে?
সামান্যতেই এত ভাবে কেন ও। বাকিদের মতো অসুর-দেবতা-বধে, তর্কে, তামাশায় কেন এলিয়ে দিতে পারে না নিজেকে। কোনোভাবেই কার্নিসে আপনা আপনি গজানো বুনো ঝোপের জীবন থেকে লাফিয়ে সরে এসে কেন মাটিতে বীজ, পত্র, শাখা, পল্লবে অতিকায় ছায়া বিস্তার করা বৃক্ষ হতে পারে না কল্যাণ? বড়দির কোলের ভেতর লুটিয়ে আছে মেয়ে। পিঠের ওঠা নামাতেই বুঝতে পারছে কেঁদে কেঁদে ফুলে ফুলে ক্লান্ত। বড়দির ডাকে মুখ তুলে তাকাতেই ভারি বর্ষণসিক্ত চোখে অনুনয় নিয়ে বলতে লাগল,

—বাবা, ও বাবা পাপার কিচ্ছু হবে না তাই না? বলো তাই না?
—হ্যাঁ তো সোনা, কিচ্ছু হবে না।
—বড়দি ওর চুলগুলো বেঁধে দেনা।

কোলের ভেতর সহস্র শ্বাসের স্ফুরণ নিয়ে পলা ফোঁপাতে ফোঁপাতে ঘুমিয়ে গেল। বড়দি বিনুনি পাকাতে পাকাতে অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছে একটু পরপর। কল্যাণ এই দৃষ্টি বিনিময়ের মানে জানে। কতদিন ঠাকুর দেবতাকে ডাকে না ও। দুর্গাপুজোতেও সামিল হয় না। বড়দিকেই দেখছে কাগজপত্র নিয়ে উপুড় হয়ে পুজোর দশদিক গোছাতে। পলার পুজো, ঈদ দুটো উৎসবেই শপিংয়ের হাঙ্গামা সামাল দিয়েছে কলেজে পড়াতে পড়াতে। সংসার করতে করতে। আজ কিছুতেই মনে করতে পারছে না দুর্গার আরেকটি নামের নামে ওদের মায়ের নাম।

—এই বড়দি মা’র নাম দুর্গার আরেকটা নামে না?

চোখ পাকিয়ে এমন একটা মুখ করল।

—তুই সত্যি মৈত্রী বাড়ির ছেলে তো? মায়ের নাম পর্যন্ত গিলে খেয়েছিস। ঠাকুর, ও ঠাকুর!

একদম মায়ের মতো হা-হুতাশ করছে। সুরোমা কফি এনে দিলো ওদের। বড়দি এত আত্মমগ্ন হয়ে কথা বলছে সুরোমার সাথে দেখে কে বলবে এরা এখন আর একবাড়ির মানুষ না। একান্ত দেয়ালতোলা। কোনো সুদূর বনপাহাড় থেকে যেন সুরোমা কথা বলছে তার টান, লয়, পতন সমস্ত বিঁধছে বুকে এসে। বড়দি কোথায় যেন গেল, হয়তো ফোন টোন করবে। পরিষ্কার গলায় তখন জানতে চাইল,

—মা’র নামটা মনে করতে পারছি না, বলবে একটু?
—সুরোমা বিদ্যুৎ চমকে বলে দিলো।

শিবানী মৈত্র।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ট্রাম্পের বিচার চলাকালে আদালতের বাইরে গায়ে আগুন দিলেন এক ব্যক্তি
ট্রাম্পের বিচার চলাকালে আদালতের বাইরে গায়ে আগুন দিলেন এক ব্যক্তি
দুই জনপ্রতিনিধির নাম বলে সাভারে সাংবাদিকের ওপর কেমিক্যাল নিক্ষেপ
দুই জনপ্রতিনিধির নাম বলে সাভারে সাংবাদিকের ওপর কেমিক্যাল নিক্ষেপ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
গরমে পুড়ছে খুলনা বিভাগ
গরমে পুড়ছে খুলনা বিভাগ
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি