X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

চিঠি

মুহাম্মদ মহিউদ্দিন
০৫ মে ২০২১, ১০:৫৮আপডেট : ০৫ মে ২০২১, ১০:৫৮

অফিসঘরে এসে চেয়ার টেনে বসতে না বসতেই কেয়াটেকার শহীদুল ডান হাতে একটি খাম এগিয়ে দিয়ে বলল—
স্যার, আপনার চিঠি।
অবাক হয়ে শহীদুলের হাতের দিকে তাকালেন দেওয়ান আবু আতিক সাহেব।
ইতোমধ্যে আতিক সাহেবের ডান হাতে ধরে থাকা লাঠিটি ছাড়িয়ে নিয়ে অফিসঘরে ঢোকার মুখে দরজার কোনায় খাড়া হেলান দিয়ে রাখল শহীদুল। চিঠির খামটি দেওয়ান আতিক সাহেবের সামনে টেবিলের ওপর। পাশে আজকের দুটি দৈনিক পত্রিকা সাজানো। প্রায় প্রতিদিন সন্ধের নাশতা সেরে লাঠিতে ভর করে লিফটে নিচ নামেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা দেওয়ান আবু আতিক। বয়স উনআশি পেরিয়েছে। সামনের নভেম্বরে আশি ছোঁবে। ধানমন্ডি এগারো নম্বর সড়কের আরবান প্লামবাগো অ্যাপার্টমেন্টের চারতলায় ছেলের পরিবারের সাথে থাকেন। একসময় নিজের পরিবার ছিল। স্ত্রী গত হয়েছেন প্রায় কুড়ি বছর হতে চলল। তিন ছেলের মেজো ছেলে তাদের মা গত হওয়ার তিনমাস সাতাশ দিনের মাথায় হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে চলে গেল। ছোট ছেলে সস্ত্রীক আমেরিকায়। আর এখানে ছেলের পরিবার বলতে ছেলে ও বউমা। তাদের দুই সন্তানও পড়াশোনার উচ্চডিগ্রি নিতে আমেরিকায়। ছেলে ব্যবসা নিয়ে মহাব্যস্ত। আজ দেশে তো কাল অন্য দেশে। বউমা ৯টা-৫টার চাকরি আর ঘর-সংসার, আত্মীয়-অনাত্মীয় ঝুট-ঝামেলার মধ্যে সময়কে কোনোভাবেই হাতের নাগালে রাখতে পারছে না। সকালে ছেলে-বউমা একসাথে অফিসে বেরিয়ে যায়। বউমা সন্ধ্যায় আর ছেলে কখনো রাত আর কখনো গভীর রাতে ফেরে। দেওয়ান আতিক সাহেবের দেখভাল ও ঘর গেরস্থালির কাজের জন্য একজন সার্বক্ষণিক মহিলা বাসায় থাকছে। তারও বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। সময়মতো ওষুধ, চা, খাবার সবই টেবিলে এসে যায়। শহীদুল চিঠির খামটি টেবিলে রেখে বাড়ির গেটের কাছে ফিরে গেছে। ঠিক আধঘণ্টা পর এসে ফ্লাক্সে পানি গরম করে এক মগ জলে একটি গ্রিনটির প্যাকেট চুবিয়ে দেওয়ান আতিক সাহেবের সামনে রেখে যাবে। দৈনিক পত্রিকা দুটির আদ্যপান্ত চোখ বুলানোয় মজে থেকে বেশ সময় নিয়ে ঠান্ডা করে মগের চা অর্ধেকের বেশি শেষ করবেন দেওয়ান আতিক সাহেব। গভীর মনোযোগ দিয়ে সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয়, ফিচার পড়বেন। অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দাদের কেউ দরজায় উঁকি-ঝুঁকি দিলেই তাকে ডেকে বসিয়ে পত্রিকার কারেন্ট ইস্যু নিয় দুদণ্ড আলাপ জমাবেন।
শহীদুলের রেখে যাওয়া খামটি হাতে নিয়ে দেখছেন দেওয়ান আতিক সাহেব। প্রাপকের নাম-ঠিকানা সবই ঠিক আছে। কিন্তু প্রেরকের স্থানে লিখা—আসিফ আহমেদ, আদমদিঘি, বগুড়া। সাথে মুঠোফোন নম্বর।
চিঠির খামটি হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে বেশ মনে করতে চাইলেন কে আসিফ আহমেদ। বন্ধু, কর্মস্থল, আত্মীয় প্রতিবেশী কোথাও এ নামের কারো সাথে কখনো পরিচয় হয়েছিল তেমন কাউকে পেলেন না। কে হতে পারে? আসিফ আহমেদ। কেন আমাকে লিখলেন?
ভেবে কোনো কূল-কিনারা না পেয়ে খামটি খোলার মনস্থির করে তাৎক্ষণিক মত পরিবর্তন করলেন। না, এখন খুলবেন না। বাসায় ফিরে দেখবেন।
আসিফ আহমেদ নামের ব্যক্তির চিঠি নিয়ে মনের ভেতর কৌতূহল প্রভাব বিস্তার করতে চাইলেও কিছু সময়ের জন্য চাপা দিলেন দেওয়ান আতিক সাহেব। পাশে রাখা পত্রিকার পাতা উল্টাচ্ছেন। সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, ফিচার ছাড়াও কত নজরকাড়া হেডলাইন চোখে পড়ল। দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, ধর্ষণ, নির্যাতনসহ কত সংবাদ। কিন্তু কোনো সংবাদেই আজ দেওয়ান আতিক সাহেবের মনোনিবেশ ঘটাতে পারল না। পত্রিকার কালো ছাপার অক্ষর পড়ার ফাঁকে আসিফ আহমেদ—নামটি যেন ঢুকে পড়ছে। পড়ছেন—দেশের স্বাস্থ্যখাতে পুকুরচুরি। কিন্তু হঠাৎ চোখ ঝাপসা হয়ে তিনি দেখতে পাচ্ছেন আসিফ আহমেদ, আদমদিঘি, বগুড়া।
শহীদুল এলো।
স্যার, চা দিচ্ছি।
না।
থমকে দাঁড়াল শহীদুল। স্যারের কি শরীর খারাপ।
না রে। শহীদুল। আজ চা খেতে ইচ্ছে করছে না। বয়স তো কম হলো না। কখন যে কি ইচ্ছে করে না করে। তুমি আমার লাঠিটা এনে দাও। দরজার কোনায় হেলানো লাঠিটি এনে দিল শহীদুল। বাঁ হাতে চিঠির খাম আর ডান হাতে লাঠি ধরে কাঁপতে কাঁপতে বাসায় ফিরলেন দেওয়ান আতিক সাহেব। ফেরার পথে স্মৃতির ক্যানভাস ঘুরে আশি বছর জীবনের অলিগলি পথ মাড়িয়ে খুঁজতে চাইলেন আসিফ আহমেদকে। কিন্তু কোথাও আসিফ আহমেদের কোনো পদচিহ্ন পাওয়া গেল না।
সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলেও বোশেখের তীব্র তাপদাহের দাপট কমেনি। ঘরে এসে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্রটি কিছু সময়ের জন্য চালু করে দিলেন দেওয়ান আতিক সাহেব। বিছানায় দুটো মাথার বালিশের সাথে দুটো কোলবালিশ। ঘুমানোর সময় আতিক সাহেবের দুটো কোলবালিশ দুপাশে থাকে।
বিছানার সিঁথানে বালিশগুলো পরপর সাজিয়ে ওতে হেলান দিয়ে বসলেন। মুঠোফোনটি হাতে তুলে নিলেন। স্ক্রিনটাচ মুঠোফোন। হাতের কাঁপুনিতে উল্টোপাল্টা স্পর্শ হয়ে গেলেও অভ্যস্থ হয়ে পড়েছেন দেওয়ান আতিক সাহেব। খামের ওপর আসিফ আহমেদের নামের সাথে দেওয়া ফোন নাম্বারটি স্ক্রিনে তুললেন। কল বাটনে স্পর্শ করলেই সংযোগের জন্য কল চলে যাবে। ভাবলেন। থামলেন। রেড বাটন স্পর্শ করলেন। কল গেল না।
ঘরে থাকা নাজুর মা—সার্বক্ষণিক ঘরে থাকা কাজের মহিলা—দরজায় এসে দাঁড়ালো। এ বাসায় কাজ নিয়েছে প্রায় মাসখানেক আগে। এখনো বাড়ির হালচাল পুরো ধাত হয়ে ওঠেনি।
খালু চা দিমু।
পরে দাও।
আইচ্ছা।
শোন। বউমা ফিরেছে?
জে, না।
আচ্ছা যাও।
নাজুর মা চলে গেল। দেওয়ান আতিক সাহেব চিঠির খামটি একপাশ থেকে ছিঁড়লেন। ভেতর থেকে স্ট্যাপল পিন দিয়ে আটকানো কয়েকটি ডায়েরির পাতা বেরিয়ে এলো। টাকা গোনার মতো চিঠির পাতাগুলো গুনে দেখলেন। সাতটি পাতা। মানে চৌদ্দ পৃষ্ঠা। দুই পার্শ্বে লেখা। চিঠির শেষ পৃষ্ঠায় নিশ্চয় প্রেরক অথবা যিনি লিখেছেন তার নাম থাকবে। তা মনে করে দেওয়ান আতিক সাহেব শেষ পৃষ্ঠাটা আগে দেখতে চাইলেন। কিন্তু পৃষ্ঠা উল্টাতে গিয়ে নিজে থেকেই বিরত থাকলেন। দেওয়ান আতিক সাহেব বিশ্বাস করেন প্রতিটি মানুষের মধ্যে দ্বৈতসত্তা থাকে। আর এ দুটি সত্তাই সবসময় একজন মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। চিঠির শেষপৃষ্ঠা দেখা থেকে দেওয়ান আতিক সাহেবকে বিরত রাখল তার দ্বিতীয় সত্তা।
বিছানায় পা টেনে বসে চিঠি পড়া শুরু করলেন। তার আগে রিমোটে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্রটি বন্ধ করলেন। চিঠির হাতের লেখা কেমন পরিচিত মনে হলো দেওয়ান আতিক সাহেবের।
তিনি পড়ছেন—‘কেমন আছ?’
চিঠিটা পেয়েই একটি ধাক্কা খেলে তাই না। এ বয়সে তোমাকে চিঠি লেখার মতো কেউ নেই। থাকলেও থাকতে পারে। তবে এখন তো চিঠি লেখার সেই প্রচলনটি একেবারে উঠে গেছে বললেই চলে।
মানুষ কত সহজে হাজার হাজার মাইল দূরের মানুষের সাথে মোবাইল স্ক্রিনে দেখে দেখে কথা বলে। ইচ্ছে করলে আমরাও বলতে পারি। এ বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। তবে চিঠির শুরুতে তোমার কাছে একটি অনুরোধ রাখছি। শোন। তুমি চৌদ্দ পৃষ্ঠার এ চিঠি ধীরে ধীরে শেষ করবে। শেষটা আগে দেখবে না। তুমি কি শেষটা দেখে নিয়েছ? যদি নিয়ে থাক তাহলে আপাতত ভুলে যাও। কারণ চিঠির ভেতর তোমার জন্য অনেক চমক রয়েছে।
তুমি প্রথমত চিঠিটা পেয়ে অবাক হয়েছ। আর এই যে ‘তুমি তুমি’ করে বলছি—এতেও তুমি ভড়কে গেছ, তাই না? নাকি খুব বিরক্ত হচ্ছ? আমি জানি চিঠি পড়তে তোমার মোটেই বিরক্তি নেই। বরং চিঠি পেতে এবং পড়তে তুমি খুব ভালোবাস। তাই এত লম্বা একটি চিঠি তোমাকে লিখছি। আচ্ছা তুমি কি এতক্ষণে বুঝতে পেরেছ, আমি কে? আমার বিশ্বাস তুমি বুঝতে পেরেছ। কারণ তুমি খুব মেধাবী ছিলে। হয়তো এখনো আছ। বয়স হয়েছে সেটা জেনেও বলছি।’
দেড় পৃষ্ঠা পড়ে থামলেন দেওয়ান আতিক সাহেব। চিঠি হাতে কর্তব্যবিমূঢ় হয়ে থাকলেন। বজ্রপাতে মানুষ যেমন পাথর হয়ে যায় অনেকটা তেমনি। এ কার চিঠি? হেমার? আজ এত বছর পর! আঙুলের ডগায় না গুনেও বলতে পারলেন—কমপক্ষে ষাট বছর। কী করে সম্ভব? হেমা এখনো বেঁচে আছে?
প্রশ্নটি করে নিজেই ফিরিয়ে নিলেন। দেওয়ান আতিক সাহেবের দ্বিতীয় সত্তা বলল—কেন বেঁচে থাকবে না। আপনি যেভাবে বেঁচে আছেন হ্যামেলিয়াও তাই। হেমার পুরো নাম হ্যামেলিয়া। দেওয়ান আতিক সাহেব ডাকতেন হেমা। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ইংরেজি বিভাগে পড়তেন দুজনে। হেমা ছিল তিন বছরের জুনিয়র। হেমার বাবা ছিলেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। সেসূত্র ধরে—তাদের কুমিল্লায় থাকা। আর দেওয়ান আতিক সাহেবের পৈতৃক নিবাস কুমিল্লার মুরাদনগরে।
অবাক চোখে দেয়ালে আটকে থাকা বন্ধ টেলিভিশনের কালো পর্দার দিকে তাকিয়ে আছেন দেওয়ান আতিক সাহেব। বন্ধ টেলিভিশনের পর্দায় তিনি দেখতে পাচ্ছেন ষাটের দশকের কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের স্বচ্ছ জল, পাড়ে সারি বাঁধা নারিকেল গাছ, গেটের কাছে হরেকরকম ফুলের সমারোহ। চারদিকে শিক্ষার্থীদের আড্ডা। ঘোরাফেরা। কথার খই ফুটিয়ে মেয়েদের দল বেঁধে চলা। কলেজ ফাঁকি দিয়ে প্রেম।
ট্রে হাতে লেবু চা আর ডায়বেটিক বিস্কিট নিয়ে এলো নাজুর মা। বিছানার পাশে থাকা ছোট্ট টেবিলে রাখল। দেওয়ান আতিক সাহেবের কল্পনার ক্যানভাস থেকে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ সরে গেল।
নাজুর মা দাঁড়িয়ে আছে।
খালুজান কিছু কইবেন? মানে কিছু লাগব?
না। তুমি যাও।
দেওয়ান আতিক সাহেব চায়ের কাপটি তুলে নিয়ে চুমুক দিলেন। বালিশের পাশে রাখা চিঠির বাকি অংশ পড়া শুরু করলেন—
‘শোন আমাদের সেই কলেজ জীবনটি আরো একবার ফিরে দেখতে চাই। আমি জানি তোমার কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। আমাদের জীবনের স্বর্ণালি সময়টি ছিল—কলেজের কটি বছর। আচ্ছা তোমার কি মনে আছে আমি তোমাকে কিভাবে কাছে টেনে নিয়েছিলাম। কিভাবে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলাম?
এখন হয়তো মনে নাও পড়তে পারে। শোন, লক্ষ্মীছেলের মতো শোন। আমি তোমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি। আচ্ছা আশি বছরের একজন বুড়োকে কেউ যখন লক্ষ্মীছেলে বলে ডাকে তখন তার কী মনে হওয়া উচিত। আমি বুঝতে পারছি তুমি হাসছ। আমি এখনো তোমার অনুভূতি অনুভব করতে পারি।
কলেজে পড়ার সময় আমরা সিনিয়রদের সাথে গ্রুপ স্টাডি করতাম। তুমি তিন বছরের সিনিয়র ছিলে। আমাদের ব্যাচের কয়েকজন তোমার সাথে গ্রুপ স্টাডি করতে পছন্দ করতাম। আচ্ছা তোমার কি লুবনার কথা মনে আছে? ও তোমাকে খুব পছন্দ করত। তোমার ব্যাপারে লুবনার আগ্রহ ছিল প্রবল।
লুবনার কথায় পরে আসছি।
একবার তোমার খুব অসুখ হলো। তুমি তিন-চার দিন কলেজে আসোনি। পরে খবর পেলাম তুমি অসুস্থ। তোমার অসুস্থতা আমাকে সুযোগ করে দিলো। আমরা সদলবলে তোমার বাড়িতে গিয়ে হাজির। সাথে লুবনাও ছিল। তুমি হঠাৎ আমাদের দেখে খুব অবাক হয়েছিলে। খুশিও হয়েছিলে বেশ। লুবনা তো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তোমার সারা ঘর দেখছিল। তোমার মা আর ছোটবোন আমাদের বেশ আপ্যায়ন করেছিল। তোমার মায়ের চালের গুঁড়ার নাড়ু আর নারকেলের পিঠার কথা ভুলিনি। বাদ দাও ওসব। তোমার প্রেমে কিভাবে পড়েছিলাম সে গল্পটি বলি।
আমাদের গ্রুপে শ্রেয়া নামে একজন মেয়ে ছিল। তোমাদের ব্যাচের অনিমেষের সাথে ওর প্রেম চলছিল। সেই শ্রেয়াই একদিন তোমাকে দেখিয়ে বলল—ঐ ভাইয়াটা খুব সুন্দর। শ্রেয়া বলার আগে তোমাকে অনেকবার দেখেছি। কিন্তু তোমার চেহারার সুন্দরটা আমার চোখে পড়েনি। অথবা সুন্দর দেখার চোখে আমি তাকাইনি। শ্রেয়া বলার পর তোমাকে দেখলাম। প্রেমে পড়ে গেলাম। প্রস্তাব দিলাম।
প্রস্তাব কিভাবে দিয়েছিলাম মনে আছে? চিঠির মাধ্যমে। তোমাকে দেখতে গিয়ে বাসার ঠিকানা জেনে এসেছিলাম। তারপর ডাকে একটি চিঠি পাঠালাম। বেনামি চিঠি। এক সপ্তাহে পরপর তিনটি চিঠি লিখলাম। ইতোমধ্যে তোমার সাথে কলেজে দেখা হচ্ছে। কথা হচ্ছে। গ্রুপ স্টাডি হচ্ছে। চা-সিঙ্গাড়া খাওয়া হচ্ছে। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না তুমি চিঠিগুলো পেয়েছ কি না। টেনশন হচ্ছিল। টেনশন আরও বেড়ে গিয়েছিল যখন দেখলাম লুবনা তোমাকে একটি ফাউন্টেন পেন গিফ্ট করছে। রাগ হচ্ছিল খুব। তুমি কেন নিলে। রাগটা পুষে রাখলাম। তোমার কি মনে পড়ছে সব? ভুলে যাওয়ার কথা নয়। এ কথাগুলো আমাদের সাড়ে চার বছরের প্রেমের জীবনে তোমাকে অনেকবার বলেছি। আজ দীর্ঘ জীবনের শেষ সময়ে এসে সুযোগ পেয়ে আবারও বলছি।
আচ্ছা তোমাকে নতুন করে এই চিঠি লেখার সুযোগ আমি পেলাম কি করে? তুমি চিঠি পড়তে পড়তে তাই ভাবছ, তাই না? ভাব। তোমার হদিস কিভাবে পেলাম সেকথা বলছি। পরে। একটু রয়ে-সয়ে পড়।
তারপর একদিন আমার তৈরি করা নোট দেখে দেওয়ার জন্য তোমাকে দিলাম। আর ঐ নোটখাতার ভেতর আমার চতুর্থ চিঠিটি ছিল।
তিনদিন বন্ধের পর কলেজ খুলল। এই হাতেগোনা মাত্র তিনটি দিন আমার কাছে তিন হাজার বছর মনে হয়েছিল। জানো সে তিন রাত আমি ঘুমাইনি। রাত জেগে একা তোমার সাথে কথা বলেছি। আমার বিছানায়, পড়ার টেবিলে, বারান্দায়, ছাদে এমনকি বাথরুমেও আমি একা তোমার সাথে কথা বলতাম। এখনো বলি। আমার অবচেতন মন বলে।
বন্ধের পর সেদিন আমাদের গ্রুপ স্টাডি হওয়ার কথা ছিল না। তুমি কলেজের পুকুরপাড়ে জোড়া নারকেলগাছতলায় আমার নোটখাতাটি ফেরত দিয়েছিলে। সেদিন তোমার একচিলতে সুন্দর চেহারাটা আরো অনেক বেশি সুন্দর, কোমল হয়ে উঠেছিল। আমি দেখেছিলাম তোমার সলজ্জ চাহনি, জিহ্বায় জড়ানো এলোমেলো কথা আর অস্বাভাবিক পদযাত্রা। তুমি কিছু বলতে চেয়েছিলে। লুবনা এসে পড়ায় বলতে পারোনি। তোমার সে মুহূর্তের কথাটুকু আমার এখনো খুব শুনতে ইচ্ছে করে। জানি না মৃত্যুর আগে শুনে যেতে পারব কি না। তারপর দিনদিন আমাদের হৃদ্যতা বাড়তে থাকল। কলেজ, পড়াশোনা, পরীক্ষা, গ্রুপ স্টাডি সবই নিয়মমাফিক চলছে। আমরা নিয়ম করে চিঠি লিখছি। সপ্তাহে কখনো দুটি আর কখনো তিনটি। তুমি খুব দীর্ঘচিঠি পেতে পছন্দ করতে। আর উত্তর দিতে ছোট করে। তারপরও চিঠি দেওয়া-নেওয়ার মোহটা আমাদের পেয়ে বসেছিল। প্রতিদিন কলেজ ক্যাম্পাসে, ক্যান্টিনে, লাইব্রেরিতে আমাদের দেখা হতো। কথা হতো। তারপরও চিঠির উত্তর পেতে দেরি হলে দুজনেরই খুব মন খারাপ হতো।
একবার গ্রুপ স্টাডির প্রস্তাব দিলাম। আমাদের বাসায়। তুমি সবার সামনে অনিচ্ছা দেখালে। লুবনাও ভ্যাটো দিয়েছিল কারো বাসায় কেন গ্রুপ স্টাডি হবে? তারপরও আমার জন্মদিনের কথা বলায় সবাই রাজি হলো। সেবার তুমি প্রথম আমাদের বাসায় এলে। আচ্ছা তোমার কি কলেজের কাছে চারতলা বিল্ডিংয়ের আমাদের নিচতলার বাসাটির কথা মনে আছে? সামনে বড় বারান্দা। বড় বসার ঘর।
তোমার ভুলে যাওয়ার কথা নয়। তুমি কত এসেছ আমাদের সেই বাসায়। মা আর জিনিয়া তোমাকে খুব পছন্দ করত। জিনিয়ার কথা মনে আছে? আমার ছোটবোন। ও তোমার সাথে খুব দুষ্টুমি করত। মা তোমার আর আমার সম্পর্কটি সানন্দে গ্রহণ করেছিল। পৃথিবীতে বেশিরভাগ প্রেমের সম্পর্ক পিতা-মাতা মেনে নিতে চায় না। ছেলেমেয়েরা পালিয়ে বিয়ে করে। আরো কত কি!
আমাদের সম্পর্কের পাকাপাকি অবস্থান জেনে জিনিয়া তোমাকে কি ডাকত মনে আছে? থাক আমিই মনে করিয়ে দিচ্ছি। জিনিয়া তোমাকে ডাকত— বাবুর আব্বু। আমি খুব হাসতাম। আর তুমি খুব লজ্জা পেতে।
আমাদের চিঠি দেওয়া-নেওয়া। বাইরে ঘোরাফেরা আর মাখামাখি এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে গ্রুপের অন্যদের চোখ এড়াল না। লুবনা কথায় কথায় খোটা দেওয়া ছাড়া থাকতেই পারত না। তারপরও তুমি কিছু বলতে না, বরং আমাকে বলতে—চুপ থাকো। একবার কলেজ ফাঁকি দিয়ে তুমি আর আমি শালবন বিহারে বেড়াতে গেলাম। দুপুর গড়িয়ে বিকেল পর্যন্ত প্রত্নতাত্ত্বিক পুরোনো ইটের দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘাসে বসেছিলাম। হাতে হাত ধরে। দর্শনার্থীরা চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আমাদের কাছাকাছি আসার অনেক মুহূর্তের স্মৃতি শালবন বিহারের সবুজ ঘাসভর্তি মাঠ, পলেস্তরাহীন পুরোনো ইটের দেয়াল, নানান জাতের ফুলের গাছ আর বিস্তীর্ণ আকাশ এখনো মনে রেখেছে। এটি আমার বিশ্বাস। কারণ প্রকৃতি কখনো কিছুই ভুলে যায় না।
শালবন বিহারে প্রেমের আলপনা আঁকতে গিয়ে আমরা ধরা পড়েছিলাম। মনে আছে? শ্রেয়া ও অনিমেষ সেদিন কলেজ ফাঁকি দিয়ে ঘুরতে গিয়েছিল। দুজন হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়েছিল। যে শ্রেয়া আমাকে তোমায় দেখিয়ে দিয়েছিল সে এতটা জল গড়ানো দেখে খুব চমকে গিয়েছিল।
শ্রেয়া আর অনিমেষকে বারণ করেও কোনো কাজ হয়নি। আমাদের দুজনের সম্পর্কটি অল্প সময়ে কলেজে রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর আমরা দুজনে লুবনার রোষানলে পড়লাম। লুবনা গ্রুপ ছেড়ে দিল। ঈর্ষায় জলে-পুড়ে বলেছিল—‘দেখিস তোরা সফল হবি না’। কথাটা আমি তোমাকে বলেছিলাম। তুমি প্রতিবারের মতো বললে—চুপ থাক। আর আমি চুপ থাকলাম। কিন্তু শেষমেষ লুবনার কথাই ঠিক হলো।
নানাদিক থেকে আমার বিয়ের প্রস্তাব আসছিল। তুমি সদ্য এমএ পাস করলে। চাকরির ইন্টারভিউ দিচ্ছ। যুতসই জায়গায় হচ্ছে না। মা খুব করে চেয়েছিলেন তোমার সাথে আমার বিয়ে হোক। জিনিয়াও তাই চেয়েছিল। কারণ ও তোমাকে নিয়ে বেশ মজা করত। কিন্তু বাবা আমাদের বিষয়টি জানতেন না। মা তোমাকে এটাও বলেছিল—তুমি পারিবারিকভাবে একটি বিয়ের প্রস্তাব আনার ব্যবস্থা করো। তুমি বেকার হলেও বাকিটা তিনি সামলে নেবেন। কিন্তু সেটা তুমি পারনি। তোমার সাহসে কুলোয়নি। আজ এত বছর পর এসে যদি তুমি মনে করো—আমি তোমাকে দোষারপ করছি; তবে তাই। কেন তোমাকে দুষছি তাও তুমি জানতে পারবে। অবশ্য জেনেও এখন তোমার করার কিছু নেই। আবার আছেও।
যদি তুমি করতে চাও। এই বয়সে তোমার সাহসে যদি কুলোয়...।
চিঠি পড়তে পড়তে মানসিক উত্তেজনা বাড়ে দেওয়ান আতিক সাহেবের। তিনি ভাবছেন—কী বলতে চাইছে হেমা!
বাবা! ঘরে আছেন? সামনের ঘর থেকে ডেকে ভেতরে আসে বউমা ফারজানা। দেওয়ান আতিক সাহেবের চিন্তা এবং চিঠি পড়ায় ছেদ পড়ে। ডান হাতের চিঠিটা বালিলের কাছে রেখে ইতঃস্তত ভাবনায় ফারজানার দিকে তাকায়।
বাবা কী করছিলেন? জানতে চায় ফারজানা।
কিছুই না, মা। কী আর আমার করার আছে। বসেই আছি।
এই সময় তো টেলিভিশন দেখেন। আজ দেখছি তাও বন্ধ। শরীর খারাপ করেনি তো।
না।
দেওয়ান আতিক সাহেব চিঠির কথা বলতে পারলেন না। কী করে বলেন। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে প্রেমিকার চিঠি পড়ছেন। কলেজজীবনের প্রেমের স্মৃতিতে সাঁতরে বেড়াচ্ছেন। এ কথা কি ছেলের বউকে বলা যায়?
আজ তোমার ফিরতে দেরি হলো।
জি, বাবা। অফিসে একটা মিটিং ছিল। শেষ করতেই দেরি হয়ে গেল। আচ্ছা বাবা রাতের খাবারের জন্য কী রান্না করব?
করো একটা কিছু—আচ্ছা আলুভর্তা করো। সাথে ডাল। অনেকদিন আলুভর্তা খাওয়া হয় না।
আচ্ছা, বাবা।
বউমা ফারজানা বেরিয়ে গেল। আলুভর্তার কথায় দেওয়ান আতিক সাহেবের হেমার মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। হেমার মায়ের হাতের আলুভর্তা অসাধারণ। প্রায় ষাট বছর পরেও সেই স্বাদ মনে করে জিভে জল এল। গোল চাকতির মতো আলুভর্তার দুই পিঠ কালো করে তেলে ভাজা। মচমচে প্রলেপ। শুকনো লঙ্কার টুকরো মেশানো।
বউমা ফারজানা ফিরে যাওয়ার পর পুনরায় চিঠি হাতে নিলেন দেওয়ান আতিক সাহেব। পড়ছেন—
‘তোমার সাহসে কুলোয়নি। তোমাদের পক্ষ থেকে পারিবারিক কোনো প্রস্তাব না পাওয়ায় আমার মাও হতাশ হলেন। তোমার বিষয়ে আর আগাতে পারেননি। বাবার পছন্দের ব্যাংকার ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করলেন। বিয়ে পাকাপাকি হওয়ার পরও তুমি একবার আমাদের বাসায় এসেছিলে। সেদিন মা ও জিনিয়া খালার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল। বাবার অফিস থেকে ফেরার পথে মা ও জিনিয়াকে নিয়ে আসার কথা। সবকিছু জেনেই আমি তোমাকে আসতে বলেছিলাম। আমার বিয়ে পাকা হওয়ার কথা তোমাকে জানাইনি। তবে ইঙ্গিত দিয়েছিলাম।
তুমি এলে।
সেদিন তোমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিলাম। তোমার বুকে মাথা রেখে অনেক করে বলেছিলাম—এই জীবনে আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি এবং হৃদয়ে তোমাকে ধারণ করেই বাকি জীবন কাটাতে চাই।
কিন্তু তোমার অসহায়-নিরূপায় চেহারা দেখে আমি জোর করতে পারিনি। তবে আমার যে স্বপ্ন ছিল সে স্বপ্ন একেবারে মিছে হয়ে যায়নি।
কি স্বপ্ন! ভাবছ!
ভেবেও কোনো কুল-কিনারা পাবে না।
বলছি, শোনো।
সেদিন আমি খুব ইমোশনাল হয়ে তোমার কাছে একটি প্রস্তাব রাখলাম। তুমি রাজি হচ্ছিলে না। মনে আছে তোমার? আমি বলেছিলাম—একটিবার তোমার সাথে বিছানায় যেতে চাই।
তুমি কর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলে। কারণ তুমি আমাকে ত্যাগ করতে চাওনি। আবার গ্রহণও করতে পারছিলে না। তোমার নীরবতায় আমার স্বপ্ন থমকে দাঁড়িয়েছিল। তারপর আমি তোমাকে নানানভাবে প্রলুব্ধ করলাম। আমি আমার স্বপ্নকে হারাতে চাইনি। জীবনের প্রথম ভালোবাসাকে আমি পরাজিত হতে দিতে চাইনি। তোমাকে আশ্বস্ত করলাম আমি ওষুধ নেব। তোমাকে বিপদে পড়তে হবে না। আমার জীবদ্দশায় তোমার যেকোনো বিপদে আমি ঢাল হিসেবে থাকতে চাই। এতসব কথা বলার সাথে আমি খুব কান্না করছিলাম। তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে চোখের জল মুছে দিচ্ছিলে।
তারপর!
হ্যাঁ, তারপর একটা সময় তুমি আমার সাথে বিছানায় গেলে। প্রথম স্বাদ পেলাম। জীবনের সে স্বাদ এখনো আমি কোনো দিন পাইনি। তারপর এক সপ্তাহ আমি কলেজে যাইনি। তোমার কোনো খোঁজ নেইনি। তুমিও আমার খোঁজ নাওনি। পরের সপ্তাহে আমার বিয়ে হয়ে গেল। আমি স্বামীর সংসারে বগুড়া চলে এলাম। তারপর থেকে তোমার সাথে আমার কোনো দিন দেখা হয়নি। কথা হয়নি। এমনকি খোঁজও নেওয়া হয়নি। তবে আজকের এই চিঠি দেওয়ার উপায়টি কিভাবে পেলাম তা পরে বলছি।
আমার এতসব কথা শুনে তোমার বুকে অনেক বিশাল একটি দম আটকে আছে। তাই না?
দম ছাড়ো। নতুন করে দম নাও। এরপর যে কথা বলব তা শুনে নিজেকে সংযত রাখার জন্য তোমার অনেক দমের প্রয়োজন হবে।
শোনো। সেদিন তোমাকে দেওয়া কথা আমি রাখতে পারিনি। তোমার সাথে বিছানায় যাওয়ার পর ওষুধ নিইনি। ওষুধ নিলে তো আমার স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে যেত। আমি হেরে যেতাম আমার ভালোবাসার কাছে।
তুমি খুব অবাক হচ্ছ? নাকি ভেঙে পড়ছ? কোনোটাই হবার দরকার নেই। কারণ তোমাকে দেওয়া একটি কথা আমি রেখেছি। এখনো রাখছি। সেটা হলো আমি কখনো তোমাকে বিপদে ফেলব না।
চিঠির খামের ওপর যে নামটি দেখলে আসিফ আহমেদ, তার পুরো নাম দেওয়ান আসিফ আহমেদ। বগুড়া শহরে একজন নামকরা ডাক্তার। আসিফ আহমেদ নামটি আমার স্বামী রেখেছেন। আর ‘দেওয়ান’ আমি যোগ করেছি।
ডা. দেওয়ান আসিফ আহমেদ তোমার সন্তান। আমার সেই স্বপ্ন পূরণের চিহ্ন। আমার বিজয়ী ভালোবাসা।’
চিঠির এই অংশটুকু পড়ে দেওয়ান আতিক সাহেবের দেহে কাঁপুনি দিলো। বালিশে হেলান দেওয়া বিছানাটি তাকে নিয়ে ঘুরছে। শরীর ঘেমে গেছে। হাতের পাশেই রিমোট। দেওয়ান আতিক সাহেব শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র চালু করতে ভুলে গেলেন। বালিশের পাশেই একটি কড়লেস কলিংবেল। সেটি টিপলেন। নাজুর মা দৌড়ে এল।
দেখল দেওয়ান আতিক সাহেব কাঁপছে।
খালুজান! আপনার শরীর খারাপ লাগছে? আপা ও আপা! ফারজানাকে ডাকতে থাকে নাজুর মা।
অ্যাই তোর আপাকে ডাকতে হবে না। একগ্লাস জল দে।
নাজুর মা তড়িঘড়ি জল দিলো। কাঁপুনি হাতে জল নিয়ে সাবাড় করল দেওয়ান আতিক সাহেব। নাজুর মা ফিরে গেল।
দেওয়ান আতিক সাহেব শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র চালু করলেন। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছেন। জীবনসায়াহ্নে এসে একি জানলেন তিনি! বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু সত্তরের ঘরে। আশি বছর পেরিয়ে যায় খুব কম মানুষ। জীবনের এই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করানোর জন্যই কি স্রষ্টা তাকে এ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছেন।
দেওয়ান আতিক সাহেব আর ভাবতে পারছেন না। শেষ করার জন্যই চিঠির বাকি অংশ পড়া শুরু করলেন।
‘এই প্রথম আমার সন্তানের পিতৃপরিচয় তার পিতাকে জানালাম। আমার আত্মাটা শান্তি পেল। প্রতিদিন কত সময় আমি মনে মনে তোমার সাথে কথা বলতাম। এখনো বলি। তোমার একটু খোঁজ পাওয়ার জন্য আল্লাহকে কত বলেছি। যেন মৃত্যুর আগে হলেও অন্তত একবার তোমার খোঁজ পাই। একটিবার তোমাকে জানিয়ে যেতে পারি আসিফ আহমেদ তোমার ঔরসের সন্তান। আমার সে আশা পূর্ণ হয়েছে। এখন আমি মরেও শান্তি পাব। তোমার হয়তো জানতে ইচ্ছে হতে পারে আমার আর কোনো সন্তান আছে কি না? নেই। প্রাকৃতিকভাবেই আমার স্বামী অক্ষম। বিয়ের আগেই তিনি অক্ষমতার কথা জানতে পেরে চিকিৎসা করাচ্ছিলেন। ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছিলেন; বিয়ে হলেই তাঁর সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তাই পারিবারিক সম্মতিতে বিয়ে করা।
বিয়ের পর যখন জানতে পারলেন আমি মা হতে চলেছি তখন পরিবারের সবার বিশ্বাস জন্মাল আমার স্বামী সক্ষম। কিন্তু একজন সন্তানের পিতা কে তা একমাত্র মাই বলতে পারেন।
আসিফ আহমেদ জন্মানোর পর পরিবারে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। আর নেপথ্যে আমার দুচোখে জল ঝরছিল কিভাবে এ সংবাদটি তোমাকে দেবো। আজ এত বছর পর সংবাদটি তোমাকে দিতে পেরে আমি মুক্ত হলাম। আমার এ জীবনে আর কিছুই চাওয়া-পাওয়ার নেই।
এবার বলি তোমার ঠিকানা পেলাম কি করে।
তোমার ধানমন্ডির বাসায় একজন মহিলা প্রায় এগারো বছর কাজ করেছে। শেফালীর মা। গত জানুয়ারি মাসে কাজ ছেড়ে দিয়ে বগুড়া চলে আসে। মেয়ে-নাতি-নাতনিদের নিয়ে বাড়িতে থাকবে বলে। তোমার সব দেখভাল সেই করত। তোমার পরিবারে সবকিছু শেফালীর মায়ের কাছ থেকে শোনা।
আমার বাড়ির কাছেই শেফালীর মায়ের বাড়ি। মাঝে মাঝে এসে খুচরো কাজগুলো করে দেয়।
বড় অবাক করা বিষয় কি জানো? প্রকৃতির কেমন মিরাকল তোমাকে খুঁজে পেতে শেফালীর মাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিলো। আমার জীবনের শেষ চাওয়াটুকুও পূরণ হয়ে গেল।
চিঠিতে তোমার সন্তান ডা. আসিফ আহমেদের নাম দিয়েছি। ইচ্ছে করে। আর ফোন নম্বরটি কারো নয়। এটি খেয়াল খুশিমতো লিখে দেওয়া। শেফালীর মার ফোন নম্বর পরিবর্তন হয়েছে। তার আগের নম্বরে ফোন করে পাবে না। আমার ফোন নম্বর দিলাম না। ইচ্ছে হলে যেকোনো একদিন ফোন করে আমি তোমার সাথে কথা বলে নেব। অথবা কথা নাও বলতে পারি। বলব কি বলব না—সেটা সময় বলে দেবে। তুমি ভালো থেকো। সাবধানে থেকো। তোমার সন্তানের জন্য দোয়া করো।
পুনশ্চ : তোমার মেঝোসন্তানের অকাল প্রয়াণে গভীর দুঃখ প্রকাশ করছি।
তোমার
হেমা।’
হাতের মুঠিতে চিঠি আটকে আছে। দেওয়ান আতিক সাহেব পাথরের মতো গেড়ে বসে আছেন। হেমার চিঠি শেষ করে মনে হলো তিনি বিস্ময়কর এক বাস্তব সিনেমা দেখা শেষে সিনেমার গল্পের মধ্যেই মজে আছেন। কি হলো! এখন কি হবে? এমন হাজারো প্রশ্ন দেওয়ান আতিক সাহেবের মাথায় কিলবিল করছে।
বউমা ফারজানা এসে রাতের খাবারের জন্য ডাকলেন।
বউমা।
জি, বাবা। বললেন ফারজানা।
বাবু ফিরলে বলো কাল সকালে আমি বগুড়া যাব।
হঠাৎ! কেন, বাবা? চমকে ওঠে বললেন ফারজানা।
এমন শরীর নিয়ে এতদূর জার্নি করতে পারবেন না, বাবা। ফারজানা তাঁর কথায় যোগ করলেন।
পৃথিবীতে অনেক অসম্ভবই সময়ের প্রয়োজনে সম্ভব হয়ে যায়। যেতে আমাকে হবেই।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
রাজধানী স্থানান্তর করছে ইন্দোনেশিয়া, বিশেষ মর্যাদা পাচ্ছে জাকার্তা
রাজধানী স্থানান্তর করছে ইন্দোনেশিয়া, বিশেষ মর্যাদা পাচ্ছে জাকার্তা
সড়ক আইনে শাস্তি ও জরিমানা কমানোয় টিআইবির উদ্বেগ
সড়ক আইনে শাস্তি ও জরিমানা কমানোয় টিআইবির উদ্বেগ
পিসিবি প্রধানের আস্থা হারালেও শ্বশুরকে পাশে পাচ্ছেন শাহীন
পিসিবি প্রধানের আস্থা হারালেও শ্বশুরকে পাশে পাচ্ছেন শাহীন
ইভ্যালির রাসেল-শামীমার বিচার শুরু
ইভ্যালির রাসেল-শামীমার বিচার শুরু
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
রাজধানীর ৫ জায়গায় তরমুজ বিক্রি হবে কৃষকের দামে
রাজধানীর ৫ জায়গায় তরমুজ বিক্রি হবে কৃষকের দামে