X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইলিয়াসের নিরুদ্দেশ যাত্রা

লীনা দিলরুবা
০৫ মে ২০২১, ১৮:০০আপডেট : ০৫ মে ২০২১, ১৮:০০

‘এই মনোরম মনোটোনাস শহরে অনেকদিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হলো। রাত এগারোটা পার হয় হয়, এখনো রাস্তায় রিকশা চলছে ছলছল করে যেন গোটিয়ার বিলে কেউ নৌকা বাইছে, ‘তাড়াতাড়ি করো বাহে, ঢাকার গাড়ি বুঝি ছাড়ি যায়।’ আমার জানালায় রোদন-রূপসী বৃষ্টির মাতাল মিউজিক, ভেজা পাতাবাহারের ভিজে গন্ধভরা সারি, বিষাদবর্ণ দেয়াল; অনেকদিন পর আজ আমার ভারি ভালো লাগছে। ছমছম করা এই রাত্রি, আমারি জন্যে তৈরি এরকম লোনলি-লগ্ন আমি কতদিন পাইনি, কতকাল, কোনো দিন নয়। বৃষ্টি-বুনোট এইসব রাতে আমার ঘুম আসে না, বৃষ্টিকে ভারি অন্যরকম মনে হয়, বৃষ্টি একজন অচিন দীর্ঘশ্বাস।’

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ এভাবেই শুরু হয়েছিল। এটি যেন এক আশ্চর্য গল্প, আগাগোড়া হৃদয়তন্ত্রীতে স্পর্শ করার মতো এক ভাষায় কখনো নাম পুরুষে, কখনো উত্তম পুরুষে বর্ণনা করা ইলিয়াসীয় ঘরানার গল্প। গাইবান্ধার সাঘাটা থানার গোটিয়া গ্রামে মাতামহের বাড়িতে জন্ম হয়েছিল বাংলা কথাসাহিত্যের এক শক্তিমান লেখকের, যিনি নির্মোহভাবে জীবনকে দেখতে শিখেছিলেন, সেই দেখাশোনাকে অসাধারণ সংহতভাবে নিখুঁত নৈপুণ্যে তুলে ধরেছিলেন তাঁর ২৮টি গল্প আর দুটি উপন্যাসে। ইলিয়াসের ডাকনাম ছিল মঞ্জু, এখানে গল্পের প্রধান চরিত্র রঞ্জু যেন এক জাতিস্মর, আগের জন্মে যে ছিল দুর্গার সহোদর; ‘পথের পাঁচালী’র বিস্ময় দৃশ্য হয়ে হাজির হয়েছে নিরুদ্দেশ যাত্রায়। রঞ্জু বৃষ্টিরাতে ঢাকার রাস্তায় রিকশা চলার দৃশ্য দেখে অনুভব করে রিকশা নয় এ-যেন গোটিয়া বিলের নৌকা, সওয়ারিরা নৌকায় চড়ে ঢাকার গাড়ি ধরার তাড়ায় আছে। গল্পে গোটিয়া নামটি অলৌকিক মনে হয়। একইসঙ্গে গ্রামটির প্রতি লেখকের নিমগ্ন ভালোবাসা আর্দ্র করে আমাদের। তীব্র আর স্নেহের মাখামাখিতে উষ্ণ নামটিকে যেন ইলিয়াস বাংলা সাহিত্যে চিরস্থায়ী করে রাখলেন।
বৃষ্টিরাতে গল্পের রঞ্জুর ঘুম আসে না। সামনে বই পড়ে থাকে। সে পড়তে পারে না। রঞ্জুর মনে পড়ে যায় অনেক আগের এক রাতের কথা। এক বন্ধুর সঙ্গে এমনই ভরাবাদলের একরাতে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে বাড়ি ফিরছিল সে, যেন স্বপ্নের মতো এক স্মৃতি।
রঞ্জুর এখনকার বাস্তবের এই জীবন নিরেট। কঠিন। আগের দিনগুলোতে রঞ্জুর মা সিনেমা দেখতে যেত, রঞ্জুও সঙ্গী হতো কখনো-কখনো; বাবার সঙ্গে দেখতে যেত ছোটোদের সিনেমা। জীবন ছিল আলোকময়। তখন সে ঘুমাতে পারত।
এখানে আজ এই বৃষ্টিমুখর রাতে সেদিন যথারীতি রঞ্জুর ঘুম আসছিল না। বাবা-মায়ের ঘরের দিকে যেতে চায় অস্থিরচিত্ত রঞ্জু, মনে হয়, সে কি-যেন ফেলে এসেছে। এতরাতে সেখানে পৌঁছুতেও রঞ্জুর বেশ ঝামেলা লাগে। দরজায় করাঘাত করে রঞ্জু।
রঞ্জু কী একজন অসুস্থ মানুষ? লেখক এক ফাঁকে তথ্যটি জুড়ে দেন। জানা যায়, ডাক্তার বলেছেন, ওয়েদার পাল্টালে তার অবস্থা ইম্প্রুভ করতে পারে।
দরজা খুলে মা জানতে চান, সে কী মায়ের ঘরে আসলেই কিছু ফেলে এসেছে! মায়ের প্রশ্নে রঞ্জু কেন যেন অপরাধী বনে যায়। বিনয়ী আর বিব্রতও হয় সে। কেবল জিনিসটা যে কী সেটি কিছুতেই তার মনে আসে না।
রাতে ঘুম আসে না, এই বিষয়টিও সে একা সামলাতে পারে না, মা-বাবার সাহায্য দরকার হয়। বাবা বলেন, দূরের মাঠের ভেড়া গুনলে একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমাবে সে। রঞ্জু তো এক জন্ম-ক্লান্ত মানুষ, ভেড়া না গুনেই তো তার অনেক ক্লান্তি, তবু কেন সেই ক্লান্তিতে ঘুম আসে না তার? রঞ্জুর প্রশ্নের মুখে বাবা নতুন কিছু বলেন না, বরং সেই যুক্তিহীন কথাটি উচ্চারণ করে ছেলের মন ফেরাতে চান। কে জানে, হয়তো পৃথিবীর সব প্রশ্নের উত্তর যুক্তি দিয়ে করা যায় না।
রাত হয়েছে। বাবা-মা ছেলের গায়ে চাদর টেনে দিয়ে, ‘আমরা যাই, তুমি ঘুমোও, কেমন?’ বলে বিদায় নেন। তার আগে বাবা ছেলেকে সতর্ক করে যান : ‘রাস্তায় বেরিয়ো না, আকাশ আজ ভারি বিশ্রী’। এমন রাতে বাইরে বেরুনো উচিত হবে না—বাবার এ-কথাটি যেন রঞ্জুর মাথায় যায়নি, উচিত-অনুচিতের বেড়া ডিঙিয়ে সে ঝড়-বাদলের রাতে বাইরে বেরিয়ে পড়ে।
অনেক রাত। প্রহরী এক পুলিশ সদস্য কোথা থেকে যেন মাটি ফুঁড়ে সামনে আসে। তার সঙ্গে আলাপে রঞ্জু জানতে পারে, তিনি রঞ্জুর পরিবারের চেনা মানুষ, তার দাদার সঙ্গে চাকরি করেছিল। রঞ্জুর বাবাকেও খুব চেনে। আলাপের ফাঁকে পুলিশ সদস্যের এক প্রশ্নের জবাবে রঞ্জু জানায়, সে কলেজে যায় না, চাকরি করে না, আর তাছাড়া কোনো কিছুই রঞ্জুর ভালো লাগে না।
আমরা বুঝতে পারি, সুস্থিতি বলতে সচরাচর আমরা যা বুঝি সেটি অজ্ঞাত কারণে তার মধ্যে অনুপস্থিত বলে রঞ্জুর মধ্যে শক্তিশালী হয়েছে গাঢ়তম আবেগ। রঞ্জুর চিন্তাগুলো হয়তো এ-কারণে বিক্ষুব্ধ ঝঞ্ঝার। রঞ্জুর অনুভবে প্রকৃতি মূক নয়, সে যেন কথা বলে উঠতে চায়।
পুলিশ সদস্যের কাছ থেকে আগের দিনের গল্প শোনে রঞ্জু; তার দাদার গল্প, বাবার গল্প। যেন গতজীবনের স্মৃতিগুলো রঞ্জুর করোটির মধ্যে সেঁধিয়ে ছিল। হাওয়ায় ভেসে দিনগুলো তার চারদিকে ছবির মতো ভাসতে থাকে। কিন্তু পুলিশের তো শুধু গল্প করে উপায় নেই, তাদের অনেক দায়িত্ব। একসময় রঞ্জুকে আঁধারের মধ্যে রেখে সে বিদায় নেয়। রঞ্জুও অনিকেত রাত্রির পাহাড় ডিঙিয়ে হাজির হয় শহরের শেষ মাথায়, নদীর পাড়ে।
ঝড় তখন তেড়েফুঁড়ে নেমেছে। রঞ্জুর মনে পড়ে তার বন্ধুদের কথা। এখানে তারা ক্রিকেট খেলত, একবার এক বন্ধু তাদের সঙ্গে খেলবার জন্য রঞ্জুকে ডেকে সার, রঞ্জু সাড়া দেয়নি। আরেকদিনের কথা মনে পড়ে, সেদিন বন্ধুরা তাদের ক্রিকেট বলটি হারিয়ে ফেলেছিল, খুঁজে পায়নি শেষমেষ। এসব কিছু মনে পড়ে রঞ্জুর। তার জীবনটাই যেন হারিয়ে ফেলার গল্পে ভরপুর। এখনো, কি যেন হারিয়ে ফেলেছে সেই চেনা অনুভূতিটা টের পায় রঞ্জু। অন্ধকারে অসহ বিষাদের সঙ্গে ফিরে আসে বিহ্বলতা। উৎকণ্ঠা। আধিভৌতিক অনুভূতি।
প্রবল ঝড়বৃষ্টির রাত। একসময় নদীর জলের দিকে কান পেতে শিমুল গাছের নিচে শুয়ে পড়ে রঞ্জু। তার ঠোঁটটা সিক্ত হতে চায় জলের আভাসে। পাশেই নদীর ঠিকানাহীন ঢেউগুলো দুর্বার হারিয়ে যাচ্ছে, জলের আধিদৈবিক ফোঁটার নাগাল পায় না সে।
রঞ্জু খুঁজে মরে তার পিতা-মাতার চিহ্ন, হারিয়ে যাওয়া মাঠ। কিন্তু এসব কোনো কিছুই আর তার নাগালে নেই।
রঞ্জু শুয়ে আছে শিমুলগাছের নিচে, হঠাৎ গাছের মস্ত এক ডাল রঞ্জুর মুখের ওপর শব্দ করে ভেঙে পড়ে। রঞ্জু চোখ মেলে দৃশ্যটা দেখার চেষ্টা করে, ডালটা স্পর্শ করার জন্য হাতটা উঠাতে চায়, শিমুলফুলের গন্ধ শুঁকতে নিশ্বাস নিতে চেষ্টা করে রঞ্জু। কিন্তু নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো কোনোটিই আর তার নিয়ন্ত্রণে নেই। আনত শিমুলের ডাল ততক্ষণে মিটিয়ে দিয়েছে রঞ্জুর জীবনের সব হিসাব। অবশেষে সেই বৃষ্টিমুখর রাতে, যে রাতটিকে রঞ্জুর অনেকদিন পর ভারি ভালো লেগেছিল; সেরাতেই, কিছুতেই ঘুম না আসা রঞ্জু চিরঘুমের দেশে চলে যায়। রঞ্জুর এ-প্রস্থান যেন আর কিছু নয়; উদাসীন, ম্লান, রিক্ত, বিষণ্ন, প্রকৃতিলগ্ন এক জীবন কাটিয়ে অনন্তকালের দিকে তার ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!