X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

হিজড়া ।। কমলা দাস

অনুবাদ : ফজল হাসান
০৬ মে ২০২১, ১১:১০আপডেট : ০৬ মে ২০২১, ১১:১০

[সমকালীন ভারতীয় প্রথিতযশা নারী লেখকদের মধ্যে কমলা দাস অন্যতম। তিনি একাধারে একজন কথাসাহিত্যিক, কবি এবং কলাম লেখক। তাঁর ছদ্মনাম নাম ছিল মাধবীকুট্টি। তিনি রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারে ১৯৩৪ সালের ৩১ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মালয়ালাম ও ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনা করেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সামার ইন ক্যালকাটা’ ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত হয়। ইংরেজিতে অনূদিত তাঁর ছোটগল্প সংকলনগুলো হলো ‘এ ডল ফর দ্য চাইল্ড প্রস্টিটিউট’, ‘পদ্মাবতী : দ্য হার্লট অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’, ‘দ্য স্যান্ডাল ট্রিজ অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ এবং ‘দ্য কেপ্ট ও্যম্যান অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’। ‘মাই স্টোরি’ তাঁর আত্মজীবনীগ্রন্থ। তিনি অল্পসংখ্যক উপন্যাস রচনা করেন। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি একাধিক পুরস্কার লাভ করেছেন। তিনি পঁচাত্তর বছর বয়সে (৩১ মে ২০০৯) মহারাষ্ট্রের পুনে শহরে মৃত্যুবরণ করেন।]



বোম্বের সিয়ন কলিভাদা বস্তিতে একটা বিশেষ এলাকা আছে, যেখানে শুধু উভলিঙ্গ, অর্থাৎ হিজড়া, এবং মূর্খ লোকজন বসবাস করে। সেখানে রয়েছে ছোট্ট কুঁড়েঘর, নারকেলের ছোবড়া দিয়ে তৈরি খাটিয়া এবং স্তূপাকৃতি পচা শাক-সবজি ও মানুষের দুর্গন্ধময় ময়লার ভাগাড়। সেই এলাকার মানুষেরা মহিলাদের পোশাক পরিধান করে এবং তারা প্রতিদিন দাড়ি কামায়। যখন কোথাও কোনো শিশু জন্ম নেয়, তখন হিজড়ারা তড়িঘড়ি করে সেখানে ঢাকঢোল এবং ঝাঁঝ করতাল নিয়ে উপস্থিত হয়। তারা নবজাত শিশুর দীর্ঘজীবন এবং সুস্বাস্থ্য কামনা করে নৃত্য পরিবেশন করে। বিনিময়ে গৃহকর্তী তাদের হাতে গম, গুড় এবং নারকেল তুলে দেয়। বলা হয় যে, সেসব উপঢৌকন হিজড়াদের প্রাপ্য। যেসব গৃহকর্তী উপঢৌকন দিতে কৃপণতা করে, হিজড়ারা তাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। এছাড়া উত্তেজিত হিজড়া পরনের খাটো জামা তুলে তাদের ‘অভিসম্পাত’ প্রদর্শন করত, যা সচরাচর তারা ঢেকে রাখে। অনেকে মনে করে যে, হিজড়াদের ‘অভিসম্পাত’ দর্শন করা কঠোর শাস্তি। প্রতি শুক্রবার তারা ঢাকঢোল এবং ঝাঁঝ-করতাল নিয়ে শহরে প্রবেশ করে। তাদের পরনে হয় ফুটকি আঁকা খাটো জামা কিংবা শাড়ি এবং পায়ে রুমঝুম নূপুর। শহরের অনেক মহিলা ভয় পেয়ে তাদের দিকে চটজলদি খুচরো পয়সা ছুড়ে দেয়, যেন তারা তাড়াতাড়ি চলে যায়। মহিলাদের ভয় দেখে হিজড়াদের মধ্যে অট্টহাসির বন্যা বয়ে যায়। এছাড়া তারা অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করার সময় তাদের দেহের বিস্তারিত সৌন্দর্য প্রদর্শন করে। বোম্বেবাসী বিশ্বাস করে যে, হিজড়ারা শিশুদের অপহরণ করে এবং ছুরি দিয়ে ওদের যৌনাঙ্গ কেটে হিজড়ায় রূপান্তরিত করে। কিন্তু সেই ধরনের অপহরণের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অথবা যদিও কোনো ভাবে প্রমাণ পাওয়া যায়, কিন্তু ভয়ে আর আতঙ্কে কোনো সাক্ষী এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতে সাহস পায় না। হয়তো হিজড়ারা শিশু চুরি করে। যদি তাই না হয়, তবে কেমন করে কুখ্যাত হিজড়াদের পাড়ায় নতুনদের আগমন ঘটে? নির্দিষ্ট এলাকাটিতে প্রচুর সংখ্যক হিজড়া বসবাস করে। সেখানে তারা অবসর সময় কাটায়, ঘোরাঘুরি করে, অলস ভঙ্গিতে ঢাকঢোলে চাটি মারে, ঝাঁঝ-করতালে ঝনঝন আওয়াজ করে অথবা পায়ের ঘুঙুর বাজায় এবং কাকের মতো কর্কশ গলায় গান গায়। সারা দিন তারা এদিকে-ওদিকে যায়। তাদের এলাকা যেন আলাদা রাজ্য। সেখানে স্থানীয় সরকার আছে এবং একজন শাসনকর্ত্রীও আছে। তার নাম রাম কিঙ্করী। দৈত্যের মতো তার বিশাল দেহ এবং সবাই তাকে সাধারণত রামুবাঈ সম্বোধন করে। তার উচ্চতা প্রায় ছয় ফুট এবং সবসময় সে সাদা শাড়ি পরিধান করে। সারাক্ষণ পান-খাওয়া লাল ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে তার সমাধি-পাথরের মতো দাঁত যে কারোর নজরে পড়বে। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করার জন্য সত্যি সে একজন জ্বলজ্যান্ত পণ্ডিত।
রাম কিঙ্করীর প্রতিদিনের অভ্যাস ছিল সন্ধ্যেবেলা তেল মেখে স্নান করা। চার আউন্স ব্রাহ্মী তেল এবং তার স্নেহময় বন্ধু শাক্কুবাই ছিল স্নানের জন্য অপরিহার্য। রামুবাঈ নারকেলের ছোবড়া দিয়ে তৈরি খাটিয়ায় উল্টো হয়ে শুতো এবং তেল মালিশের সময় শাক্কুবাঈয়ের নরম হাতের যত্নশীল স্পর্শ অনুভব করত। তেল মালিশ করার পরে হিজড়া নেত্রী জোছনায় আশপাশে আধঘণ্টা পায়চারি করত। সেই সময় সেপাড়ার সবার খোঁজখবর নিত।
এক সন্ধ্যায় রামুবাঈ নারকেলের ছোবড়া দিয়ে তৈরি খাটিয়ায় শুয়েছিল। তখন তার কাছে এক বৃদ্ধা মহিলা আসে। গুজরাটি মহিলাদের শাড়ি পরার মতো সেই বৃদ্ধা একইভাবে শাড়ি পরেছিল। তার কানে বা গলায় কোনো অলঙ্কার ছিল না। তবে তার চোখের তারায় ছিল অসাধারণ দ্যুতি। রাম কিঙ্করী সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে নিয়েছিল যে, মহিলাটি পাগল।
‘একজন মহিলা এসেছে,’ শাক্কু বলল। ‘গুজরাটি মহিলা।’
বিছানা থেকে উঠে বসার তোয়াক্কা না করে রাম কিঙ্করী তীব্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে :
‘বুড়ি, কী চাও? তুমি কী জানো না, এটা হিজড়াপাড়া? এই পাড়ায় প্রবেশ করার জন্য তোমাদের মতো লোকজনের কোনো অনুমতি নেই।’
বুড়ি মহিলা মাটিতে বসেছিল এবং সে তার পা চুলকাচ্ছিল। ‘আমি বিকেল থেকে হাঁটছি,’ সে বলল। ‘আমি প্রতিজ্ঞা করেছি যে, আমার মনোরমা শিশুকে না দেখে বাড়ি ফিরে যাব না।’
‘তোমার মনোরমা শিশু?’ রাম কিঙ্করীর চোখেমুখে আশ্চর্যের চিহ্ন ফুটে উঠে। সে জিজ্ঞেস করে, ‘তাকে এখানে খোঁজার কী কারণ? এখানে শুধু হিজড়ারাই থাকে। তুমি কী জানো না?’
‘সে হিজড়া হয়েই জন্মেছিল,’ বুড়ি মহিলা বলল। ‘আমার বিয়ের সতেরো বছর অনেক প্রার্থনা, আচার-অনুষ্ঠান এবং অর্ঘ্য দেওয়ার পরে আমি ওকে পেয়েছিলাম। ওর মুখটা ছিল উদীয়মান চাঁদের মতো। ঠোঁটের উপরে ছিল একটা আঁচিল। অবশ্যই আপনার লোকজন দোলনা থেকে ওকে অপহরণ করেছে। আমি ওকে ছাড়া যাব না।’
‘আমরা শিশুদের চুরি করি না,’ রাম কিঙ্করী বলল। ‘কিছু সংখ্যক পরিবার আমাদের কাছে শিশু-সন্তান বিক্রি করে। আমরা চড়া দামে সেই সব শিশু-সন্তানদের ক্রয় করি। আমরা চুরি করি না। তোমাদের চেয়ে হিজড়ারা অনেক বেশি সৎ এবং সরল প্রকৃতির মানুষ। আমরা হলাম মর্ত্য দেবীর সন্তান।’
‘কখন তুমি তোমার সন্তান হারিয়েছ?’ শাক্কু জিজ্ঞেস করে।
‘আগামী দিওয়ালির সময় ওর বয়স উনিশ বছর হবে। দিওয়ালির দিনেই সে নিঁখোজ হয়েছে। আমি যখন স্নান করতে গিয়েছিলাম, তখন কোনো চোর এসে চুরি করে নিয়ে যায়। সেই সময় আমি চাকরদের কক্ষে ঘুমাতাম। হিজড়া সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য আমার স্বামী এবং শাশুড়ি আমার প্রতি বেজায় নাখোশ ছিল। এছাড়া তারা শিশুটিকে গলা চেপে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। আমার আর্তচিৎকারে তারা ক্ষান্ত হয়। কিন্তু তারা আমাকে বলেছে যে, আমি যেন শিশু-সন্তানকে গোপনে চাকরদের ঘরে লালনপালন করি। তারা আমার আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবদের বলেছে, জন্মের পরে অনুসূয়া চিকিৎসার জন্য তার ডাক্তার দাদার বাড়ি গিয়েছে।’
রাম কিঙ্করী খাটের ওপর উঠে বসে। বুড়ি মহিলার দৃষ্টি অন্ধকারে হারিয়ে যায়।
‘তাহলে তোমার সন্তানের বয়স এখন আঠারো বছর,’ রাম কিঙ্করী বলল। ‘চাঁদের মতো মুখশ্রী। আমাদের এখানে সেই ধরনের চেহারার কোনো মেয়ে নেই।’
‘আমার সন্তানকে না নিয়ে আমি বাড়ি ফিরে যাব না।’
একদল হিজড়া ঢোল নিয়ে হাজির হয়। তাদের কয়েকজন বুড়ি মহিলার দিকে তাকায়। তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মানুষ ছিল। অনেকের মুখের আদল ছিল পুরুষালি এবং খোঁচা খোঁচা চিবুক, অনেকের ছিল সুন্দর চেহারা এবং মেয়েলিসুলভ অঙ্গভঙ্গি ও চালচলন, অনেকে শাড়ি পরেছিল, অনেকের পরনে ছিল খাটো জামা, অনেকের কপালে ট্যাটু ছিল, অনেকের চেহারা ছিল কুৎসিৎ…
‘কে সে?’ হিজড়াদের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করে।
রাম কিঙ্করী হাসল। ‘বুড়ি মহিলা বলছে তার সুন্দর চেহারার সন্তান এখানে আছে। সন্তানটি নাকি উনিশ বছর আগে নিখোঁজ হয়েছে। ভরা চাঁদের মতো সুন্দর চেহারা এবং ঠোঁটের ওপরে একটা আঁচিল ছিল।
‘আমাদের রুগমা হতে পারে।’ হিজড়াদের মধ্যে একজন বলল। ‘সে দেখতে সুন্দরী এবং তার ঠোঁটের ওপর আঁচিল আছে।’
‘বাজে কথা বলিস না!’ রামু চিৎকার করে বলল। ‘সেই ধরনের কোনো মেয়ে এখানে নেই। রুগমার কোনো আঁচিল নেই।’
হিজড়ারা রাগে-ক্ষোভে গজগজ করতে থাকে।
‘দাদারে গান গেয়ে কত পেয়েছিস? নবজাত শিশুর মা কী গুড় এবং গম দেয়নি?’
রাম কিঙ্করী হিজড়াদের বোঁচকা খোলে এবং ভেতরের জিনিসপাতি পরীক্ষা করে।
‘ঘাটকোপারে রবিবার একটা শিশু ছেলের জন্ম হয়েছে,’ হিজড়াদের মাঝ থেকে কেউ একজন বলল। ‘চলো, আগামি সোমবার সেখানে গিয়ে নাচ-গান করি। তারা টাকাওয়ালা ব্যবসায়ী।’
‘এই বুড়ি ওঠো, বাড়ি ফিরে যাও,’ শাক্কুবাঈ বলল। ‘দেখছো, অন্ধকার হয়ে গেছে। আমরা চাই না তোমাকে খুঁজতে তোমার লোকজন এবং পুলিশ এখানে আসুক। এই এলাকা শুধু আমাদের জন্য, অন্য কারোর জন্য নয়।
‘আমার সন্তান ছাড়া আমি বাড়ি ফিরে যাবো না,’ বুড়ি মহিলা বলল। সে মাটিতে কাত হয়ে শোয় এবং চোখের পাতা বন্ধ করে।
‘এখানে ঘুমাবে?’ রামু বলল। ‘আমরা তোমাকে তুলে নিয়ে যাব এবং রেলওয়েস্টেশনে নামাব। তোমার এখানে থাকার কোনো অধিকার নেই।’
‘আমার মেয়ে যদি এখানে থাকতে পারে, তাহলে আমিও থাকতে পারব,’ বুড়ি মহিলা বলল। ‘আমি আপনার জন্য রান্না করব। আমি খুব ভালো ঢোকলা১ এবং কান্তউই২ তৈরি করতে পারি। আমাকে ফেরত পাঠাবেন না।’
‘তুমি সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষ,’ শাক্কু বলল। ‘আমরা গরিব প্রাণী। যদি তোমার লোকজন জানতে পারে যে, তুমি আমাদের জন্য খাবার তৈরি করেছ, তাহলে তারা ক্ষুব্ধ হবে।’
‘তারা কেউ আমাকে চায় না,’ বুড়ি মহিলা বলল। ‘সবাই আমাকে পাগলীনি ডাকে এবং ধূমকেতুও বলে। সকালে প্রথমেই যদি আমার শাশুড়ি আমাকে দেখে, তবে তৎক্ষণাৎ সে স্নান করবে।’
‘রামুবাঈ, সে কে?’ বুড়ি মহিলার দিকে ইঙ্গিত করে লাল রঙের খাটো জামা পরা এক সুন্দরী নারী জিজ্ঞেস করে। ‘আমি অন্দরে ছিলাম এবং এইমাত্র সুলু আমাকে বলেছে যে, এখানে একজন গুজরাটি মহিলা এসেছে।’
‘রুগমা, ভেতরে যাও,’ রামু চিৎকার করে বলল। ‘এই মুহূর্তে ভেতরে যাও।’
চাঁদের আলোয় রুগমার নাকফুল ঝলমল করে। সবাই স্পষ্ট ভাবে দেখতে পারে, তার ঠোঁটের ওপরে প্রিয় আঁচিল রয়েছে। বুড়ি মহিলা একদৃষ্টিতে রুগমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘চাঁদের আলোয় আমাকে পাঁচ মিনিট জিরিয়ে নিতে দাও,’ রুগমা বলল। ‘আমার পা সত্যিই ব্যথা করছে। আমি উত্তপ্ত পাকা মেঝেতে কত ঘণ্টা নেচেছি! আমি যদি এইভাবে বিশ্রাম না নিয়ে নাচতে থাকি, তাহলে আগামী দিওয়ালির আগেই মারা যাব।’
‘ডার্লিং, এ ধরনের অপ্রীতিকর কথা বলিস না,’ রামু বলল। ‘তুই মরে গেলে আমি বাঁচব কেমন করে? তুই কী আমার প্রিয় ছোট্ট ঘাসফড়িং নস?’
বুড়ি মহিলা উঠে নারকেলের ছোবড়া দিয়ে তৈরি বিছানার কাছে দাঁড়ায়। সে রুগমার মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে এবং একসময় জিজ্ঞেস করে, ‘এই মেয়ে, তোমার বয়স কত?’
‘ওর বয়স চব্বিশ,’ বলল শাক্কু। ‘চার বছর আগে সে মহিশূর থেকে এখানে এসেছে। সে তোমার সুন্দরী মেয়ে নয়।’
‘অই যে আঁচিল…,’ বুড়ি মহিলা বিড়বিড় করে।
‘হ্যাঁ, ওটা আঁচিল নয়। ওর কপাল থেকে এক ফোঁটা চাঁদ ঝরে পড়েছে,’ বলল রামু। ‘রুগমার কোনো আঁচিল নেই।’
‘শুধু আমার শরীরের গোপনঅঙ্গে একটা আঁচিল আছে,’ বলল রুগমা এবং বলেই সে হাসতে থাকে। ‘ঠিক বলেছি না, রামুবাঈ?’
‘সত্য বলেছিস।’ পেট ধরে রামুবাঈ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। ‘হো হো হো… তোমার দেখার জন্য সেই সুন্দর আঁচিল নয়, বুঝেছ বুড়ি মহিলা।’
রুগমা বিছানার একপাশে রানির মতো বসে আছে। সে ডান পা নাড়াতে থাকে এবং তার গোড়ালির সৌন্দর্য প্রদর্শন করে। বুড়ি মহিলা দুহাতের মুঠোয় মুখ ঢেকে জিজ্ঞেস করে :
‘এই মেয়ে, আমাকে বলো। তুমি কী আমার আদরের সন্তান নও? তুমি কী সেই শিশু নও, যে আমার বুকের দুধ পান করেছে এবং আমার দেহের সঙ্গে লেপ্টে ঘুমিয়ে থাকত? আমি কী তোমার মা নই, যে তোমাকে জন্ম দিয়েছে?’
‘না,’ রুগমা চুল বাঁধতে বাঁধতে তিক্ত এবং রাগী গলায় বলল। ‘না, মর্ত্য দেবী আমার মা।’
রুগমা তাড়াহুড়া করে উঠে দাঁড়ায় এবং নাচতে শুরু করে। সে পরনের খাটো জামার কুচির ভাঁজ দোলাতে থাকে। বুড়ি মহিলার মনে হয় রুগমার খাটো জামার কিনারের রুপালি বুটিদার কারুকাজ যেন তরঙ্গের মতো, যা জোছনায় উজ্জ্বল হয়ে নেচে বেড়াচ্ছে। রুগমা চোখেমুখে হাসি ফুটিয়ে রাখে, যেন সে কিছু আনন্দময় মুহূর্ত স্মরণ করছে। সাদা কবুতরের ঝাপটানো ডানার মতো তার হাত। তার পায়ের মল ঝনঝন করে বাজতে থাকে।
রামু তার কোলের ওপর ঢোল তুলে নেয়। বুড়ি মহিলার কাছে ঢোলের শব্দ হালকা মাথা ব্যথার মতো অসহ্য লাগতে শুরু করে। ইতোমধ্যে চাঁদের আলো আরও ঘনীভূত হয়েছে। রুপা যেন সোনায় পরিণত হয়েছে। বুড়ি মহিলা অনুভব করে যে, সেখানে পান্নার তৈরি গলার মালা ঝুলছে।
‘হে ভগবতী, ইয়েলাম্মা৩, আমাকে রক্ষা করো…’ রুগমা গান ধরে। ‘আমার শরীর জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। কে আমার পায়ের ফাঁকে কিছু পাথর রেখে আগুন জ্বালিয়েছে? কে আমার স্রোতস্বিনী রক্তনদীতে বাঁধ নির্মাণ করেছে? হে দেবী, ইয়েলাম্মা, আমাকে রক্ষা করো…’
টিনের তৈরি কুঠির থেকে কালো ছায়ার মতো বিশাল সংখ্যক হিজড়া বেরিয়ে আসে। তাদের মুখে শুষ্কতার ভাব। তাদের চোখে কাজল কালো অন্ধকার এবং তারা শুকনো ধরণীর দিকে তাকিয়ে আছে। লাল রঙের ধুলাবালি যেন নৃত্যরত পায়ের চতুর্দিকে লুটিয়ে পড়েছে। অকস্মাৎ বৃষ্টি নেমে আসে। হালকা বৃষ্টিমাত্র এক বা দুমিনিটের জন্য ছিল। বুড়ি মহিলার কাছে মনে হয়েছে, ধাঁড়ি ইঁদুরের প্রস্রাবের মতো বৃষ্টির গন্ধ। সে মাথা দোলায়।
‘সত্যি, তুমি আমার মেয়ে নও। আমার সন্তান দেখতে অনেক সুশ্রী,’ বলল বুড়ি মহিলা। ‘তোমার গায়ের রঙ লাল মাটির মতো। সত্যি, তুমি অবশ্যই মর্ত দেবীর কন্যা।’
যেই ঢাকঢোলের শব্দ গাঢ় এবং দ্রুত হয়, বুড়ি মহিলা হিজড়াদের এলাকা থেকে বেরিয়ে যায় এবং রেলওয়ে স্টেশনের দিকে হাঁটতে থাকে। অন্ধকারের মধ্যেও সে স্টেশনের লালবাতি দেখতে পায়। হিজড়াদের ঢাকঢোলের শব্দ তাকে অনুসরণ করে।


[পাদটীকা : যদিও মূল গল্পে নেই, তবে পাঠকদের সুবিধার্থে দেওয়া হলো–অনুবাদক।]
১ এক ধরনের নিরামিষ খাবার, যা ভাত এবং খেসারির ডাল দিয়ে তৈরি করা হয়। এই খাবার প্রধানত গুজরাট এবং পার্শ্ববর্তী রাজ্যের কিছু অংশে পাওয়া যায়। সকালের নাশতা, দুপুরের বা রাতের খাবারের প্রধান খাদ্য হিসেবে, বা পার্শ্ব খাবার হিসেবে, এমনকি জলখাবার হিসেবেও খাওয়া হয়।
২ ভারতের গুজরাট ও মহারাষ্ট্রের একটি সুস্বাদু খাবার, যা সাধারণত বুটের ময়দা এবং দই দিয়ে তৈরি করা হয়।
৩ মহারাষ্ট্র এবং দক্ষিণ ভারতের তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক এবং তামিলনাড়ু রাজ্যের পৃষ্ঠপোষক দেবী। তার ভক্তরা তাকে ‘মহাবিশ্বের জননী’ হিসেবে শ্রদ্ধা করে।

গল্পসূত্র :
‘হিজড়া’ গল্পটি কমলা দাসের ইংরেজিতে ‘দ্য হিজড়াস’ গল্পের অনুবাদ। মালয়ালাম ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ভি সি হ্যারিছ এবং সি কে মোহামেদ উমর। গল্পটি লেখিকার ইংরেজিতে অনূদিত ‘দ্য স্যান্ডাল ট্রিজ অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ ছোটগল্প সংকলনে অন্তর্ভুক্ত এবং সেখান থেকে নেওয়া হয়েছে।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া