X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

বাঁকা জলের খেলা

প্রশান্ত মৃধা
১০ মে ২০২১, ১৮:২২আপডেট : ১০ মে ২০২১, ১৮:২২

ফোঁপানোর দমকের ভিতরে বুঝতে পারছিলাম, এই আমার কান্নার শুরু। কান্নায় হালকা হয় মানুষ, আমি কাঁদতে কাঁদতে ভিতরে ভিতরে ভারী হয়ে যাচ্ছিলাম। কান্নার ওই কিছুক্ষণটা আজও মনে হয় যেন অন্তত কাল। ভারী হচ্ছিলাম অভিমানে, শোকে-দুঃখে, রাগে ও কষ্টে! আমার জীবনে এই ঘটল। আমার জীবনে, আমারই এইটুকু জীবনে এমন অভিশাপের ভার। আমাকে ভারী তো করবেই। এ থেকে আজ আর আমার ফেরার কোনো উপায় নেই। আমি জানি।

এতক্ষণ এ ঘরে কেউ আসেনি। চোখ তুলে বালিশে তাকালাম। অল্প একটু জায়গা ভিজে গেছে। ডান হাতে জায়গাটা মুছলাম। মুছলেই কি চোখের জল শুকায়? চোখের ওপরে হাত টান দিতে দিতে জীবনে এই প্রথমবার ছোটকার [ট-এর নিচে হসন্ত যুক্ত করে ‘ছোটকার’ পড়তে হবে–সম্পাদক] ওপর ভীষণ অভিমান হলো। চোখ ফেটে জল এল। বিড়বিড় করলাম, ছোটকার আইজে তুমি থাকলি আমার জীবনে কোনো ভাবে এই দশা হতো না। ভাবলাম সেই একই কথা, জিয়া তোমারে আর জেলে নেয়ার সময় পা’লো না, ছোটকার?

অজান্তে চোখে আমার জলের মোটা ধারা। ডান চোখ থেকে একফোঁটা পড়ল আজ সকালে পরা নতুন শাড়ির কোলের কাছে। সুতির শাড়ি। পড়ামাত্রই সে জল মিলিয়ে গেল। মুহূর্তে টের পেলাম, ওই চোখের জলের ফোঁটাটা শাড়িতে শুকিয়ে যেতেই বুঝতে পারলাম, আমি আর আমাকে নিয়ে ভাবতে পারছি না। আমার জীবনে যা ঘটেছে তা যদি সত্যি হয়, তাহলে সত্যি, আমার করার আর কিছু নেই। এখন ছোটকার জন্যে অন্তরের একেবারে ভিতরে ডাক দিয়ে উঠছে। খুলনা জেলখানার ঘটনা যেদিকে যাচ্ছে তাতে যদি ছোটকার একটা-কিছু হয়ে যায়। যদি গুলি চলে। যদি আর কোনো দিন না দেখতে পারি ছোটকার মুখ। এবার ‘ও ছোটকার’ বলে, না বিড়বিড় করে নয়, প্রায় হাহাকারের মতন শব্দে আমি আবারও বালিশে মুখ গুঁজলাম। টের পেলাম, ছোটকার জন্যে আশংকা আর নিজের জীবনে যা ঘটছে, সবই বাষ্প হয়ে কান্নার সঙ্গে একবার উগড়ে আসছে।

এ সময় মা ঘরে ঢুকে আমায় দেখে বলল, ‘তুই এইখেনে, রমা তোরে খুঁজদিচে।’

মা হয়তো আমার কান্নার অবস্থায় দেখেনি। কিন্তু ফোঁপালে তো শরীরে কাঁপুনি হয়, মা দেখলে বুঝে যেত। এখন মুখ তুললেও দেখবে চোখে জলের ধারা। দ্বিরাগমনে আসা মেয়ের চোখের জল সহ্য করতে পারে কোন মা। কিন্তু এখন তো চোখ মোছারও কোনো সুযোগ নেই। আমি বালিশ থেকে মাথা তুলে মার দিকে না তাকিয়ে সোজা তাকে জড়িয়ে ধরলাম, ‘আমার কিছুই ভালো ঠেকাতিছে না, মা। আইজ যে কী হয়!’

জানি না, মা ঘরে ঢুকে আমাকে বালিশে মুখ গোঁজা দেখে কী ভেবেছিল। কিন্তু তাকে জড়িয়ে ধরলে আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ‘আইজকে তোর জীবনের এইরম দিন, বিয়ের পর বাপের বাড়ি আইচিস, কিন্তু একটা মানুষও তোর সাতে ভালো কইরে কথা ক’তি পারতিচে না।’

আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম প্রায়। গলা ছেড়ে হাহাকার বেরিয়ে আসছে। আর্তনাদ সেখানে, ‘মা ছোটকার যদি কিছু হইয়ে যায়!’ অথচ, এই কথাটা বলতে বলতে মনে হলো, শুধু ছোটকার জন্যেই কাঁদছি না আমি। এই হাহাকার আর বিলাপের সঙ্গে মিশে আছে রমাদির ছায়াবউদিকে বলা কথা, তার দেওয়া সান্ত্বনা আর এর ফল হিসেবে নিজের জীবন এখন যে অনিশ্চয়তায় পড়েছে, তাই।

‘কী যে হবে?’ মা বিড়বিড় করল, ‘ঠাকুররে ডাক।’

বুঝলাম মা আমার মাথায় ডলতে থাকা তার ডান হাতের আঙুলগুলো থামিয়ে দিয়ে ঘরের পাটাতনের দিকে তাকিয়ে আছে। সেখানে তাকালে আমাদের ডাক যদি ঠাকুরের কানে পৌঁছায়।

আমার সরল মা, যে জেলখানায় তার প্রিয় দেওর সুধন্যর সঙ্গে দেখা করতে গেছে, সেখানে শুকিয়ে পাংশুটে হয়ে যাওয়া ছোটকারকে দেখেছে, সেই মানুষটা এতটা দিন ধরে অনশনে কাটাচ্ছে, তারপর শুনেছে তারা আলোচনায় বসেছে এই রণবিজয়পুরের মানুষ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাফিজ-সাবের সাথে—এটা শুনে তার চোখে-মুখে উদ্বেগ ছিল ঠিক, কিন্তু কোনো আতঙ্ক তো ছিল না। সরল মানুষের আতঙ্ক হয় দেরিতে। হলে সে প্রায় বোবা হয়। চোখে ভাষা থাকে না। গুলি হতে পারে শোনার পরে আতঙ্কে মা তো কিছুক্ষণের জন্যে প্রায় বোবাই হয়ে গিয়েছিল। এখন এই একটু গোপনে, যেখানে বুঝমান পুরুষমানুষ কেউ নেই, তাই যেন নিজের পুরোপুরি বুঝতে না পারা কথাটা জানানোর সুযোগ হলো। পাটাতনের দিকে তাকাতে তাকাতে মা জানতে চাইল, ‘এ খুকি, সত্যি গুলি চালাতি পারে?’

আমি মাকে ছেড়ে দিলাম। একটু সরে এসে চোখে আঁচল ডললাম। এরপর নাক ও মুখের ওপর দিয়ে আঁচল টেনে মুছে নিয়ে ধরা গলায় বললাম, ‘এই অবস্থা চললি চালাবে। রথীনদা ক’ল না?’

‘হয়। রথীন যহন কইচে তখন বুঝেই কইচে। তোর বাপ তো সব কথা কয়ও না। যা কয় ভাসুরমশাইর কাছে।’

‘বাবা কবে-বা কী, কদি [বলো তো]? সে তো এহোন প্রায় বোবা হইয়ে গেইচে!’

সাথে সাথে মা তার নিজের জগতে ফিরল। জানতে চাইল, ‘জামাই তোরে কবে নিতি আসপে?’

জানতাম মা একথা জানতে চাবে। যতই ছোটকার জন্যে সবাই কাতর হোক, পুরো বাড়ি কি গ্রামসুদ্ধ মানুষ আতঙ্কে থাকুক, ফিরানিতে আসা মেয়ের মার হিসেব তো অন্য। মুখে কাপড় চেপে ভিতরের কান্না লুকিয়ে তাকে সব সামাজিক কাজের কথা ঠিকই মনে রাখতে হয়।

এ সব নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। তবু বললাম, ‘আসপে দুই-চাইর দিনের মদ্যি।’

আমার বলায় একুট যেন অনিচ্ছা প্রকাশ পেল। মা বুঝল তা। বলল, ‘এইরাম অনিচ্ছার সাতে কতিচিস কী জন্যি?’

‘কোতায় অনিচ্ছার সাথে ক’লাম? সে যা কইচে তাই ক’লাম।’

‘জামাই নাকি ব্যবসার কাজে খুলনো গেইচে?’

‘সেইয়েই তো ক’ল [বলল]।’

‘ও ঠাকুর, খুলনো শহর নাকি প্রায় অচল!’

শুনলাম মার উদ্বেগের কথা। কিন্তু ভাবলাম অন্য। ব্যবসার কাছে গেছে না নন্দিতার সাথে দেখা করতি গেছে, তা তো আর আমারে কইয়ে যায়নি গো মা। কিন্তু সে কথা তো বলা যায় না। ভাবাও যাবে না। তাতে যদি নিজেকে সামলাতে না পারি। যদিও বললাম, ‘খুলনা অত বড়ো শহর। সেখেনের সারা শহর তো আর অচল না। তার যেখানে কাজ সে সব ঠিকই চলতিছে। না চললি যা’ত নাকি?’

মা আর কথা বাড়ল না। ফিরানির দশ দিনের ভিতরে কেউ এসে আমাকে নিয়ে গেলেই হলো। পুলকেশ যে আসবে না তার কথাতেই বুঝেছি। শুধু আমি কেন, পরীক্ষিৎও তা জানে। পরীক্ষিৎ বলেওছিল, ‘দাদা না গেলি আমিই আসপানে তোমারে নিতি।’

চৌকাঠের সামনে দাঁড়িয়ে মা বলল, ‘যা সেনান-টেনান কর। এট্টু সাজিস। ধন্য ওই অবস্থায়, কিন্তু মানষি নতুন বিয়ে হওয়া মাইয়ে দেকতি আইসে যেন না বোঝে আমরা একেবারে ভাইঙে পড়িচি।’

‘আচ্ছা।’ বলেই বুঝলাম আচ্ছা বলি আর যাই বলি, মাঝখানে মানুষটা তো ছোটকার। তার জীবনের এমন দিনে আমার পক্ষে ওপরের সাজটা হয়তো সম্ভব, কিন্তু মনের ভিতরের আমারে কে সাজাবে।

সেই দুপুরের কথা মনে পড়ল। ছোটকার লুকিয়ে এসেছে। আমার কাছ থেকে দশ টাকা নিয়ে গিয়েছিল। তখন রেডিয়োতে বাজছিল, ‘মনের রঙে রাঙাব, বনের ঘুম ভাঙাব, সাগর-পাহাড় সবাই যে কইবে কথা।’ আজ আমার মনে কোনো রং নেই। সাগর আর পাহাড়, কারওই সাথে আমার মনে মনে কথা বলার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। সে প্রশ্ন উঠবেও না আর কখনো।

বিছানায় প্রায় অনড় হয়ে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। দুই-একবার তাকালাম পাটাতনের দিকে। তারপর ঘর ছেড়ে সামনের উঠানে এলাম। ছায়াবউদি-রথীনদাসহ অন্য কয়েকজন আত্মীয় চলে যাওয়ায় সারাটা বাড়ি সুনসান। রাঙাদিদিমাও চলে যেত। কিন্তু তার বাতের ব্যথা বেড়েছে। ওদিকে তাকে দিয়ে আসার মতন কাউকে পাওয়া যায়নি। রবিনকে বলা হয়েছিল, কিন্তু তারও পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চির ফুটবল খেলা আছে আটটাকার মাঠে। নয়তো বাবা বিভাস আর রবিনকে সাথে দিয়ে রাঙাদিদিমাকে পাঠিয়ে দিত। বাড়ির লোকজন বাদে আছে ছন্দা, রাঙাদিদিমা আর রমাদি। তারা সবাই এখন পিছনে, রান্নাঘরের দিকে। জেঠামশাইও সম্ভবত বাড়িতে নেই। গ্রামের কোথাও কোনো শালিসি-বৈঠকে গেছেন। অথবা আমাদের বারোয়ারি কালীখোলায় মন্দির কমিটির মিটিঙে।

উঠানে এলাম। কার্তিকের আকাশ। এখনো আকাশজুড়ে শরৎকালের মেঘ। বাতাসে ঠান্ডা ভাব তেমন লাগেনি। রোদ সামান্য হেলে গেছে, কিন্তু তেজ তেমন কমেনি। তবে ভাদ্দরের তেজ নেই। আকাশও পরিষ্কার। উঠোনের দক্ষিণে খোলা। সেদিকে তাকালে একেবারে দিগন্তব্যাপী ধান খেতে চোখে পড়ে। যদিও পুব দিকের সীমানায় কেউ কেউ ঘের করেছে। চিংড়ি চাষ করে। এ নিয়ে দুই এক শরিক প্রতিবেশীতে কাজিয়া-বিবাদের কথাও আজকাল শোনা যায়। কয় বছর আগেও এমন ঘের করা ছিল না। ঝগড়াটা বাদে লবণ দেওয়া নিয়ে। এতে নাকি চিংড়ি ভালো বাড়ে, কিন্তু পাশের খেতের ধানের খুব ক্ষতি হয়। সেদিকে তাকিয়ে মনে পড়ল, বছরখানেক আগে হালদার আর পালবাড়ির এই নিয়ে যে ঝগড়া তা নিয়ে জেঠামশায় শালিসি করেছিলেন। ছোটকার বলেছিল, এই বাগদার চাষ একসময় এই অঞ্চলে নীল চাষে পরিণত হবে। চিংড়ি চাষ নীল চাষ। ছোটো ভাগচাষি আর ছোটো গেরস্তরা পথে বসবে। এই যে সাদা সোনার লোভ চারদিকে, এই লোভের ফল এই অঞ্চলরে একদিন কোথায় নিয়ে যাবে তা আজকে আমরা কেউ বুঝদি পারতিছি না।

ছোটকার কোনো কোনো কথা মনে হতো একেবারে যেন বক্তৃতা। ছোটকার ভালো বক্তৃতা করে। একবার আমাদের ইস্কুলে পার্টির পক্ষ থেকে বক্তৃতা দিতে এসেছিল। ঠিক ইস্কুলে না, ইস্কুলের বাইরের মাঠে। সেসময় তার বক্তৃতা একটু শুনেছিলাম। ইস্কুল ছুটি হয়েছে। বাড়ি ফিরতে হবে। ওদিকে ছোটকা বক্তৃতা দিচ্ছে। শুনতেও ইচ্ছে করছিল। কিন্তু উপায় নেই। সঙ্গীসাথিরা গেলে আমি ফিরব কার সাথে। ছোটকার তো মিটিং শেষ হলে সাইকেলে বাগেরহাট বা দেপাড়ার দিকে চলে যাবে। আমার কথা তার মনেও থাকবে না। সেদিন বুঁচি বলেছিল, ‘সুধন্যখুড়ো কী সুন্দর বক্তমো দেয়, খুকি দেইচিস [দেখেছিস]।’ আমি তো কোনো দিনও শুনিনি। বুঁচিকে ওর বাপ ভোলাকাকু নাকি আগে একদিন বলেছে এ কথা। কিন্তু আমাকে কেউ কোনো দিনও বলেনি।

ঘের নিয়ে ছোটকার অমন কথায় বরং বাড়ির সবার উলটো কথাটাই মনে পড়ল এখন। ওই কথা শুনলে জেঠামশাই বলতেন, ওই যে নেতাজি সুভাষচন্দর বক্তৃতা দিতিছেন। সবাইরে একেবারে যেন আজাদ হিন্দ ফৌজ মনে করেন নেতা। শুনে, ছোটকার চুপসে যেত। তার রাজনীতি করা নিয়ে কোনোভাবেই টুঁ শব্দও করত না। এই যে সকল ব্যবস্থা, এ সব এমনই চলুক, চলছে, বাড়িতে এ নিয়ে ছোটকার কোনো কথা নেই। শুধু যা বলা বলত আমাকেই। তাই দক্ষিণ দিগন্তে তাকিয়ে কার্তিকের আকাশ দেখতে দেখতে, পুব দিকের ছোটো ছোটো ঘেরের অস্তিত্ব ভেবে নিয়ে আবার ছোটকার কথা মনে পড়ল।

আমি ভুলে গিয়েছি আমাকে। এমনকি ভুলে গেছি, ছোটকার জেলে। জেলে আজ অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। যদি মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে কয়েদিদের আলোচনা ভেস্তে যায়, তাহলে কী হতে পারে আমার ছোটো মাথা তা কল্পনাও করতে পারছে না। গুলি! গুলির চেয়ে আর বেশি কী? পাকবাহিনীর গুলির সামনে থেকে বেঁচে ফিরেছে ছোটকার। ছোটোবেলায় আমাদের বলত, ‘বুঝলি খুকি, যদি সাইন্সে যে জুয়োলজি কয় ওইয়ে পড়তাম, তা’লি মানষির মগজের মদ্যি আঙুল দিয়ে ঘাটতি এট্টুও ভয় করত না। একাত্তরে সেইয়ে শিখিছি। মগজের মদ্যিদে গুলি খোঁচাইয়ে বাইর করিচি।’ শুনে গা শিহরে উঠত আমাদের। আমার, পারুল-আহ্লাদি আর বুঁচির। ছোটোপিসি ধারে থাকলে বলত, ‘ওইয়ে আর কইস না দিন [বলিস না তো]। শুনলি গার মদ্যি কীরাম জানি করে।’ সেই ছোটকা এখন গুলির সামনে!

আমার গলা শুকিয়ে আসে। গলা আমার অনেকক্ষণ ধরেই শুকনা। কান্নার পরে এমনিতেই গলা শুকোয়। জল খাইনি। উঠানে এসে মনে হয়েছিল, পাকঘরের দিকে যাই। রমাদির সঙ্গে দুটো কথা কই। শুনি দেখি, ওই অল্প কয়দিন কলেজের যাওয়া রমাদিকে তার এক ক্লাসমেটে যে কথা শুনিয়েছে পুলকেশ আর নন্দিতা সম্পর্কে, তা নিয়ে আরকিছু জানে কি না। আবার ভাবলাম, কী দরকার? কী লাভ? কী হবে তাতে? যা হওয়ার হয়ে গেছে। যা বলার তা তো পুলকেশই বলেছে বাসরঘরে! বাসরঘর! হাসি পেল আমার। বেহুলার বাসরও ছিল এর চেয়ে ভালো। সেখানে সাপ ঢুকেছিল। কিন্তু আমার বাসরঘরে ঢুকেছে অন্য একজন। তাকে দেখেছি আমি। সে ওই বাসরঘরে ছিল না, অথচ ছিল পুলকেশের সাথে আর ঘরজুড়ে ছায়া হয়ে। ফলে বেহুলা লখিন্দরকে উদ্ধার করতে পেরেছে, কিন্তু যে মানুষটাকে ঢুকিয়েছে পুলকেশ নিজেই, সেখান থেকে আমি নিজেকে কীভাবে উদ্ধার করি! অসম্ভব।

ওই ভাবনা আপাতত বাদ। পরীক্ষিৎ নিতে এলে তাকে জিজ্ঞাসা করব। যদি পরীক্ষিৎ ভালো মানুষ হয়, যদি ওর আমার প্রতি একটু সহানুভূতি থাকে, যদি ও আমাকে ওর দাদার অনুকম্পার পাত্রী না করে তোলে, যদি আমি ওই সংসারে একটা উপহাসের পাত্রীতে পরিণত না হই, তাহলে আমার ধারণা সে আমাকে যা জানে তা বলবে। যদিও আসার আগে ইঙ্গিতে হলেও পরীক্ষিৎ একটা কথা বলেছিল একদিন দেখো এই বাড়িতে তোমারে দেখার মতন আর কেউ থাকবে না।

গলা আরও শুকিয়েছে। যেন কানেও কিছু শুনছি না। দূর পশ্চিম আকাশের তুলো তুলো গোছা ধরা মেঘ আমার চোখে পড়ছে না। আমি ধীরপায়ে বড়োঘরের পাশ ধরে পিছনে রান্নাঘরের দিকে হাঁটতে থাকলাম। হঠাৎ গরম লাগল আমার। বুঝলাম, ছোটকার কথা ভাবতে ভাবতে এখন দেখি আমি আবার নিজেকে নিয়েই ভাবছি।

সন্ধ্যা থেকেই কেমন যেন গুমোট লাগছিল। কেন লাগছিল আজও জানি না। তবে মনে হচ্ছিল, আজ রাতে তো কিছু-একটা ঘটার কথা, তা ঘটতে পারে। মনে হয়, গুমোট লাগছিল নিজের জন্যে। কতক্ষণ যায় আর নিজের জীবনের কথা ভাবনায় ঢুকে পড়ে। এ খুব স্বাভাবিক। কয়েক দিন বিয়ে হয়েছে আমার। এখনো বলতে গেলে সপ্তাহই পার হয়নি, অথচ সবসময় যদি মুখখানা ঢাকনা দেওয়া মলিন দেখে সবাই, বিশেষ করে মা, তাহলে আমার অন্তরটা তার কাছেও পরিষ্কার হয়ে যায়। যদিও অন্যরা মনে করে, ভাবে, খুলনা জেলের পরিস্থিতির কারণে এই অবস্থা। শুধু রমাদি জানে, রমাদি বোঝে, সে যে সংবাদটা দিয়েছে তাও আমার এই গুমোট ভাবের একটা কারণ। হয়তো সেই জন্যে রমাদি আজ সকালে কিছু সময় আমাকে এড়িয়ে চলেছে। ভেবেছে কী হতো আমার এমন সুখের দিনে অমন সংবাদটা আমাকে না বললে। অমন সংবাদ আমার জীবন ওলটপালট করে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার চেয়েও কঠিন সংবাদের ভিতরে আছি আমরা সবাই। স্কুল ছুটি, তাই বলে খেলতেও যাবে না বিভাস? গেছে ঠিকই, কিন্তু ঠেলে পাঠানো লাগল বলতে গেলে। আসলে বিভাস বুঝতে পারছিল বাড়ির কারও মন ভালো নেই, এ সময় তার খেলতে যাওয়া হয়তো ঠিক না। যদি বাড়িতে এখন কোনো কিছুর প্রয়োজন হয়। বাবা বাড়ি নেই, বাগেরহাট শহরে গেছে। জেঠামশাই বয়স্ক মানুষ।

এক ফাঁকে রমাদিকে জিজ্ঞাসাও করেছিলাম, ‘ও রমাদি, আর কিছু জানো নাকি?’

কথাটা এমন ভাবে বলেছিলেন যেন কোনো গল্প। অথবা অন্য কোনো বিষয়। রমাদি বিভাদির পাঠানো একটা জলসা পত্রিকার পাতায় চোখ রেখে বলল, ‘তুই একটা খবর জানিস, খুকি?’ আমি বুঝলাম আমার কথাটার উত্তর দেবার জন্যে এই ঘরটা যথেষ্ট নিরাপদ নয়, তাই রমাদি কথাটা ঘুরিয়ে দিলো। আমি চোখ বড়ো করে রমাদির দিকে তাকাতেই সে বলল, ‘মিঠুন চক্রবর্তী যারে বিয়ে করিচে সে কিশোরকুমারের বউ ছেলো।’

জানতে চাইলাম, ‘এইখেনে আছে নাকি তা লেখা? নেই তো।’

‘আরে এ তো আগের পত্রিকা। বিয়ে করিচে কয় মাস আগে। কী জানি নাম। বাঙালি না।’

‘তুমি জানলা কোয়ানদে?’

‘ছায়াবউদির ছোটদা কইচে। কিশোরকুমারের তিন নম্বর বউ ছেল ওই বিটি।’

মা মনে হয় সামনের বারান্দা থেকে আমাদের কথা শুনছিল। বলল, ‘শেখর ওইসব খবর রাখায় ওস্তাদ। পড়াশোনায় মন না থাকলি হবে কী, খালি শোনবা সিনেমার গপ্পো।’

মার কথায় বুঝতে পারলাম রমাদি কেন জলসায় চোখ রেখে আমাদের কথাটা কিশোরকুমার মিঠুন চক্রবর্তীতে নিয়ে গেছে। পত্রিকাটা খাটের ওপর ছুড়ে দিয়ে রমাদি বলল, ‘চল, পুকুরপারে যাই। দক্ষিণ দিক দে এহোন কী ফাইন বাতাস আসতিচে। সেই বাতাসে এট্টু এট্টু কাঁচা ধানের গন্ধ!’

রমাদি লেখাপড়া সেই এসএসসির পরে আর এগোল না, কিন্তু কথা যখন বলে তখন কত বিষয়ে যে কাব্যি করতে জানে। আর সবকিছুতেই সচেতন। হয়তো মানুষের রূপে ও গুণে খানিক খুঁত থাকলেই সে সচেতন হয়। যেন এমন কোনো ভুল না করে যাতে মানুষ তাকে খারাপ বলতে পারে। রমাদির এমন বুদ্ধি আগেও দেখেছি, আজও দেখলাম। যদি আমার জানতে চাওয়ামাত্র সে বলতে শুরু করত আর মা শুনে ফেলত, তাহলে কেলেংকারির হতো একশেষ। কিছুই আর বাকি থাকত না। যে আগুনে আমি একলা পুড়ছি তাতে পুড়ত পুরো গুষ্টি। শুধু গুষ্টি না জ্ঞাতিগুষ্টি আত্মীয়স্বজন। আর ছোটকার কানে দুদিন বাদে খবরটা পৌঁছলে কী দাঁড়াত, তা অনুমান করে আমার গা কাঁপে।

পুকুরের দক্ষিণপারে বাঁশ দিয়ে বানানো বেঞ্চি পাতা। একটু দূরে সরকারবাড়ির সীমানায় খালপাড়ের গোলগাছের পাতাগুলো বাতাসে কাঁপছে, দেখা যায় এখান থেকে। সেখানে একঝাঁক ফিঙে নাকি শালিক তা অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না। বেঞ্চিতে বসার পরই রমাদি আমার ডান হাতটা টেনে নিয়ে বলল, ‘আর কিছুই জানি নারে, খুকি। আর কী জানব?’

‘তোমার ওই ক্লাসফ্রেন্ড আর কিছু কইনি তোমারে?’

‘কী কবে? আমি কয়দিন বা কলেজে গেইচি। ওই যারে কয় মুখ চেনা। সেই ফাঁকে তোর বউ ভাতে আমারে দেইখে কয়, তুমি রমা না? আমি ওরে চেনলাম। নাম কামরুল। ওগে গোলপাতা গরান বাইন কাঠের ব্যবসা। পুলকেশের বাপের সাথে ওর বাপের ব্যবসায়ী সম্পর্ক। বাপ আসিনি, ছওয়ালরে পাঠাইচে।’

আমার মন কিছু মানছিল না। ওদিকে রমাদি শুধু যেন ভূমিকাই দিয়ে যাচ্ছে। তাই আমি আবারও বললাম, ‘তা ওই কামরুল না কি নাম ক’লা ওই দাদা সেদিন আরকিছু কইনি?’

‘না। আর কী কবে। খালি আমি কেন এই জায়গায় জানতি চা’ল। যখন ক’লাম আমার মামাতো বোনের বউভাত, তহোন দেখি ওর মুখটা একটু যেন শুকইয়ে গেল। আমার দিক তো তাকায়নি, তবু যেটুকু তাকাইল, সেহানদে মুখ সরাইয়ে নেল অন্যদিক। মনে হলো জানি যদি পারে তো আমার সামনে দে চইলে যায়।’

আমার মনে হলো রমাদি ঘটনার ভিতরে ঢুকছে। আর নিজেও তাতে যে জড়িয়ে পড়ছে। তার ওই একই কথা দ্বিতীয়বার বলতে ভালোও লাগছে না। কিন্তু সে আমার দিকে চেয়ে এড়াতেও পারছে না। অথচ, এখন তার কথায় আর কামরুল নামের সেই লোকটির আচরণে যেন এক নিষিদ্ধ বিষয়ের দিকে এগোনোরই প্রস্তুতি। তাই রমাদি বাড়তি আর কিছু বলার আগে কামরুলের সেই এড়ানো ভঙ্গির ভিতরে প্রায় অস্ফুটভাবে বলা কথাটা প্রথম বলল, ‘সে ক’ল রমা, বউ তোমার মামাতো বুন? এয়া জানলি আইজের এই বউ ভাতে আমি কোনোভাবে আসতাম। আব্বা পাঠাইচে, তাও আসতাম না।’ এই বলে রমাদি বেঞ্চিটা ছেড়ে একটু দক্ষিণ দিকে হেঁটে গেল যেন এখন আমাকে আর মুখ দেখাতে চায় না সে। তারপর একই স্বরে বলতে লাগল, ‘যেই আমি ক’লাম, কেন হইচে কী? তখন চারদিক তাকাইয়ে দেখল পাশে কেউ নেই। তারপর গলা নামায়ে ক’ল, জানানো কিছু, না? আগে তোমার কোনো খোঁজও নেওনি, বুঝদি পারিচি।... আমি তো কামরুলের দিকে তাকাইয়ে রইচি ভাবিছি এগে বংশ নিয়ে কি গুষ্টির কারও কাণ্ডকীর্তি নিয়ে আর নয় ব্যবসা নিয়ে কিছু কবে। তা না। তখন ওই কথা ক’ল।’

বুঝলাম, কথাটা রমাদি আর বলতে চাইছে না। আমাকে শোনানো যেমন তার জন্যে কষ্টের, একইসঙ্গে ওই কথা দ্বিতীয়বার বলতেও চাইছে না। শত হলে আমি তার ছোটোবোন। কদিন হলো বিয়ে হয়েছে। আমার জীবনে এমন? কিন্তু আমি তো যা বোঝার বুঝেছি, যা বলার পুলকেশই আমাকে বলেছে, সেকথা তো আর কেউ জানে না।

ছোটকার জেলে গেল, তারপর মাকসুদকাকু যখন খুন হলো, সেই থেকে ধীরে ধীরে আমার পরানটাও আগের চেয়ে শক্ত। এখন মনে হয়, ভাবি, কাল-পরশু যদি ছোটকার বড়ো কোনো দুঃসংবাদ আসে তা জন্য এখনই শক্ত হওয়া দরকার। পরান পাষাণে বাঁধলে যা হয়, সেই অবস্থা। তাই রমাদি যতই এড়িয়ে যাক, তবু জানতে চাইলাম, ‘কও, তারপর কী ক’ল তোমার বন্ধু?’

বন্ধু কথাটা শুনে রমাদি হাসল। যেমন তার যাওয়া কলেজ, সেখানে আবার বন্ধু। সেই হালকা তুচ্ছ হাসিটা নিজের মুখে ধরে রেখে বলল, ‘তোরে কইনি বউদি সকালে? যা কইচে সেইয়ে।’

‘তুমি কও। কী কইচে?’

‘কী আর কবে। কামরুল তখোন গলা নামাইয়ে ক’ল পুলকেশদার সাথে ওই পানিঘাটের নন্দিতা আছে না, ওর সাথ লাইন। এইয়ে নাকি অনেকেই জানে।’

‘তুমি জিগোশুনি সে কোয়ানদে শুনিচে?’

‘অত কথা জিগোনোর সময় তহোন? ও নিজেই তো ক’ল—পুলকেশদা ব্যবসার কাজে খুলনো গেলি প্রায়ই বিএল কলেজে যায়। সেই সময় দেহিচে।’

আরও কথা থাকতে পারে। হয়তো আছে। আমার জন্যে আরকিছু শোনা জরুরিও নয়। বরং রমাদি তখন আমার বেশ কাছে এসে বলল, ‘সেয়া নাকি মেলা দিন ধইরে চলতিচে।’

আমার চোখ জলে ভরে গেছে। আমি দূরে তাকিয়ে থাকলাম। সরকারবাড়ির সীমানার গোল গাছগুলোর নিচে পাখিদের ঝাঁক আর নেই। হয়তো সেখান থেকে ওরা অন্য জায়গায় চলে গেছে। একেবারে সামনে একটা মরা কাপিলার কচার ডাল থেকে একটা ফিঙে কাককে তাড়া করল। ডালটা নাচছে। দুলছে। আমার জলে ভরা টলমল চোখে সে নাচ ঠিক যেন ধরাও পড়ছে না। ধীরে ধীরে বেলা একেবারে নুয়ে পড়ায় প্রান্তরে একটু যেন আবছা ভাব। নাকি জলভরা চোখে সবই এমন আবছা লাগে।

ভাবলাম, রমাদির কাছে বলে দিই সব। বলতে তো হবেই একদিন। তবু ভেবেছিলাম, আজকাল কাউকে কিছু বলব না। ছোটকার তো রমাদিরও ছোটোমামা। সবারই তার জন্যে মন খারাপ। তবু নিজের ভিতরের এই কষ্ট আর বয়ে বেড়াতে পারছি না। যদি বলি তাতে একটু হালকাই হব। তখন এত কষ্টের ভিতরেও ছোটকারক অবস্থা নিয়ে সবার সঙ্গে কথা কইতে পারব। মাথার ভিতরে আর পুলকেশ-নন্দিতা, নন্দিতা-পুলকেশ—এই দুইজন বারবার খোঁচাতে থাকবে না।

আমার ঘাড়ের উপরে রাখা রমাদির হাতটা ধরলাম। তাকিয়ে থাকলাম মাটির দিকে। পায়ে এখনো আলতা আমার। রং যা একটু ফিকে হয়েছে এই কদিনে। রমাদির হাতে একটু চাপ দিলাম। সে আমার দিকে তাকাল। কাতর চোখ। সে চোখের দিকে তাকিয়ে আমার চোখ আবারও জলে ভিজল। চট করে বাম হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বললাম, ‘রমাদি, তুমি যা ক’লা [বললে] এ সমস্ত না জানালিও বাকি সব আমি জানি। জাইনে গেইছি।’

রমাদি বিস্ফারিত চোখে আমার দেখল। হাতটা সরাল আমার ঘাড় থেকে। একটু উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চাইল, ‘কইস কী তুই? কোয়ানদে শুনলি?’

আবারও চোখ মুছলাম, ‘কোয়ানদে আবার? যে কওয়ার সে কইচে!’

‘মানে?’ রমাদির গলায় ঝাঁজ।

‘পুলকেশবাবু। বাসরঘরেই আমারে কইছে, বিয়ে করিচে বাপ-মার জন্যি। এখন তে [থেকে] সে তার মতো আমি আমার মতো। তয় আরও কইচে, এখনই কেউরে কিছু কওয়ার দরকার নেই। বুজদি দেয়ারও না।’

‘তুই কিছু কইসনি?’

‘কী কব? খালি শুইনে গেইচি। যে লোক বাসররাত্রে এই কথা ক’তি পারে, তারে কিছু কওয়ার প্রবৃত্তি থাহে। কও, রমাদি?’

‘কিছুই কইসনি?’

‘ক’লাম তো না। কী কওয়ার আছে?’ আমার চোখ আবার জলে ভরে উঠছে। আবারও দিগন্তে তাকালাম। সেদিকে উদাস তাকিয়ে থাকলাম। যেন নদীর কূলে দাঁড়িয়ে দেখছি আমার ভরা নাওখানা ধীরে ধীরে জলে তলিয়ে যাচ্ছে। আমার করার কিছু নেই।

‘এই জন্যি রাঙাদিদিমা পরদিন বউদিরে কইল, বেণুরে দেইখে মনে হলো নাতিজামাই ওরে ছোঁয়ও নেই। আমি ভাবলাম, কী কয় বুড়ি। বুড়ো মানষির চোখ—দেখলিই সব বোঝে।’

রাঙাদিদিমার মাড়ি দাঁতহীন পান খাওয়া মুখটা মনে পড়ল। ঠিকই তো বুঝেছে বুড়ি। সেখানে কোনো ভুল নেই। কিন্তু কথাটা রমাদি একশ্বাসে এমনভাবে বলল যে, গলার ভিতরে কান্নার বাষ্প নিয়েও আমি হাসলাম। হাসল রমাদিও।

তখনই ঘরের পোতা থেকে মার উঁচু গলা। ডাকছে আমাদের। রথীনদা এসেছে। আমি সেদিকে যেতে যেতে ভাবলাম, নিশ্চয়ই রমাদিকে নিতে এসেছে। কিন্তু আজ সকালে গেল রথীনদা, আবার এখনই ফিরল? নাকি কোনো সংবাদ। পুকুরের পার ধরে হাঁটতে হাঁটতে পিছন থেকে রমাদির হাত টেনে ধরে বললাম, ‘ও রমাদি, তুমি কিন্তু কেউরে কিছু কইয়ে না। কোনো দিনও না?

রমাদি বলল, ‘খুকি, এইয়ে কেউরে কওয়া যায়?’ তারপর ঘরের কাছে এসে উলটো ফিরে ভুরুতে গিঁট পাকিয়ে আমাকে বলল, ‘এহোন হঠাৎ দাদা কেন আইচে!’

সন্ধ্যা হতে আর বাকি নেই। উঠোনজুড়ে ছায়া ধীরে কালো হচ্ছে। বড়োঘরের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে রথীনদা। শক্তসবল মানুষটার কালো মুখটা আরও কালো। সাইকেল চালিয়ে এসেছে। কোঁকড়া চুল উড়ানো। ফুটবল খেলোয়াড়ের এমন হয়। কানের পাশে নামানো চুল তার স্টাইল। সে চুল ঘামে ভেজা। কিন্তু রথীনদার দমের তো অভাব নেই। এক গেলাস জল চেয়ে মাঝউঠানে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে মা জেঠিমা বিভাস আর বীথি। বিভাসকে মনে হয় ইস্কুলের মাঠ থেকে ধরে নিয়ে এসেছে। জেঠামশাই বাড়িতে নেই। বিকালে ঘুরতে বেরিয়েছেন। ইস্কুলের কাছে অথবা কুন্ডুবাড়ির খালপাড়ে আড্ডা দিচ্ছেন তার সমবয়সীদের সাথে।

আমি আর রমাদি এখানে পৌঁছানোর আগেই রথীনদা যা বলার বলেছে। তাতে সবাই যে চুপ তা বুঝতে পারলাম। বারান্দায় ছন্দা আর রাঙাদিদিমা বসা। দুজনার চোখে তখন ঘুমজড়ানো। মনে হলো একটু আগে উঠে চোখে মুখে জলও দেয়নি। দিলে পুকুরঘাটে দেখতাম।

‘এদা, তুই! এহোন?’ বিস্মিত রমাদি জানতে চাইল।

‘এমনি আসলাম। বাড়ির দে বাগেরহাট আইলাম খেলার কথা শুনতি। বায়েজিদভাই ক’ল খুলনায় এহোন খেলার কিছু নেই, সব স্বাভাবিক না হওয়ার আগে খেলা নিয়ে কিছু কওয়া যাতিচে না। উনি কাইলকে আইচে খুলনাদে। তাই ভাবলাম কী কয় শুইনে আসি।’

রথীনদার কথাতে বুঝলাম, যা বলার তা হয়তো মা জেঠিমাকে বলেছে। এখন আমাদের বলছে অন্য কথা। নাকি বলতে চাইচে না। কিন্তু রথীনদার থতমত মুখ অন্য কথা বলছে। রমাদি একভাবে রথীনদার মুখের দিকে তাকানো। আমি একবার মার মুখে একবার জেঠির মুখের দিকে দেখি। বিভাস ও বীথি বোবা মুখে তাকিয়ে আছে। রমাদি থমথমানি কাটাতে গলা একটু উঁচু করে বলল, ‘এদা, হইচে কী?’

এতক্ষণে রথীনদা সবাইকে কী বলেছে তা আমরা জানি না। কিন্তু বলেছে তো একটা কিছু। সে কথা হয়তো আর বলতে চাইছিল না। রমাদির এমন জানতে চাওয়ায় একটু আগে শোনানো, এখানে সবার জানা সেই কথাটা আবার বলল, ‘খুলনা জেলের অবস্থা আসলেই খুব খারাপ!’

আমি সঙ্গে সঙ্গে বলি, ‘সে তো দুইদিন ধইরেই শুনতিচি।’ এহোন আবার নতুন কী হলো?’ বললাম, কিন্তু কদিন ধরেই এমন থমথমে অবস্থায় সেই নতুন কথাটার আশঙ্কায় বুকের একদম ভিতরে দুরদুর করে কাঁপুনি টের পেলাম।

আমি প্রায় খেঁকিয়ে ওঠায় রথীনদা চোখ বড়ো করে তাকাল আমার দিকে। কী যেন ভাবল। ভাবতে ভাবতে তাকাল মার মুখে। জেঠির দিকেও একবার। তারপর নিচুগলায় আবার বলল কথাটা, ‘অবস্থা আসলেই খুব খারাপ, খুকি।’

সঙ্গে সঙ্গে রমাদি জানত চাইল, ‘নতুন কিছু জানলি নাকি তাই ক’।’

‘দুপুরের পর শহরে আইসে বায়জিদভাইর সাথে দেখা করতি সে গো সুপুরির আড়তে গেইচি।’

মা মাঝখানে জানতি চাইল, ‘সেও তো ধন্যর সাথে যুদ্ধ করিচে, সেইয়ে না ও রথি?’

রমাদি জানাল, ‘হয় মুক্তিযোদ্ধা। ভালো ফুটবল খেলে। খুলনো জেলা দলে খেলে। ঢাকায়ও।’

রথীনদার কথায় বাঁধা পড়েছে, সে আবারও সবাইকে দেখল। তারপর বিভাস-বীথিকে বলল, ‘তোরা যা ভোলামামা আছে নিকি দেইখে আয়। দুইজোনই যা।’

এবার মনে হলো, সত্যি গুরুতর কিছু। রথীনদা এসেই সে কথা বলতে পারেনি। কালো মুখে ধীরপায়ে বিভাস ও বীথির ভোলাকাকুর ঘরের দিকে যাওয়া আমাদের উৎকণ্ঠা বাড়াল।

রথীনদা বলতে শুরু করল, ‘বায়জিদভাইর ওই জায়গায় আরও কয়জন ছিল। সবাইরে তোমরা চেনবাও না। কেউ কেউ রাজনীতি করে। তারা তো ভিতরের অনেক কথা জানে। মোস্তাফিজ-সাব যে আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় দিচে মিট করার জন্যি, সেইয়ে আইজে রাত্তির বারোটায় শেষ হবে।’

‘তা’লি? মীমাংসা তো কিছু হইনি।’ আমি বললাম, ‘নাকি হইচে?’

রথীনদা প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখের একপাশ মুছল। সেই ফাঁকে আমার কথায় একটু ধমকও দিলো, ‘কথার মদ্যি কথা কইসে নে, খুকি।’

জেঠিমা এক গেলাস জল হাতে এসে দাঁড়িয়েছে। রথীনদা সেদিকে দেখল না। কারও দিকেই না তাকিয়ে বলে চলল, ‘ওদিকে দাঙ্গা পুলিশের বিরাট বাহিনী আইচে খুলনায়। তারা নাকি জেলখানার উঁচা দেয়াল পার হইয়ে ভিতরে ঢুকতি পারে। আইজকে রাত্তিরে তাগে ঢুকোইয়ে দেবে।’

মা আঁতকে উঠে বুকে হাত দিলো, ‘ও ঠাকুর, কী কতিচিস রথি তুই!’

‘হয়, মাইজে মামিমা। তাই। তারপর যে কী হবে!’

‘আলোচনায় কোনো ফল হবে না কতিচো?’ আমি জানতে চাইলাম।

‘আর কী ফল। ঘটনা তো কোন দিকে যাতিচে বুজদি পারতিচিস।’

‘এরাম হল কেন? ভিতরের খবর ওই নেতারা কেউ কিছু কইচে?’

‘তারা তো কবে সেই আগের কথা। তাগে দল ক্ষমতায়, তারা তো দলের পক্ষেই কবে। শোনলাম, ওই যাগে যাগে যাবজ্জীবন দিছে আর এই ছোটো মামাগে মতন যারা কমনিস্ট করে, তারা মিলে বন্দিগো খেপাইয়ে তুলিছে, এর মদ্যি কয়জনে নাকি একজন মহিলা কয়েদির সাথে খারাপ ব্যবহার করিচে। জেলে তো দাগিদুগি কতপদের মানুষ থাহে। এহোন সব দোষ পড়িছে এইসব নেতাগে উপর। আর বন্দি করিছে ডেপুটি জেলারসুদ্ধ প্রায় জনা তিনিশরে।’

‘সে তো শুনিচি।’ রমাদি বলল, ‘কিন্তু এক বিটি কয়েদির সাথে খারাপ ব্যবহার করিচে, এ তুই আইজকে শুনলি? এডা ওই দলের নেতা বানানো খবর না তো?’

‘বানানো হ’লি বানানো। সেহানে আমাগে শুইনে যাওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ আছে?’ বলে, রথীনদা জেঠিমার হাত থেকে জলের গেলাসটা নিল। প্রায় এক চুমুকে বড়ো কাঁসার গেলাসভর্তি জলটা খেয়ে বলল, ‘এইয়ে শুইনে ভাবলাম যাই মেজমারে খবরডা জানাইয়ে আসি।’

‘আইসে ভালো করিচাস।’ মা বলল, ‘যে সংবাদ নিয়ে আসলি বাবা। পরানে আর জল নেই। যা হাতমুখ ধো। প্যান্টজামা ছাড়। তোরে ধন্যর একখান লুঙ্গি দিই।’

‘না মামিমা। চাইলে যাই। এখনই রওনা দিলি অন্ধকার বাড়ার আগেই বাড়ি যা’তি পারব।’

‘সেইয়ে হয়?’ জেঠিমা বলল, ‘এহোন তুই যাবি কোয়ানে? শহরদে আসার সময় কেউরে কইয়ে আসিসনি মামাবাড়ি আসতিচিস্, তোগে বাড়ি যেন খবরডা দিয়ে দে।’

‘আইচি। তবু ছায়া ভাববে হঠাৎ আবার কেন মামাবাড়ি আসলাম।’

রমাদি বলল, ‘বোঝবেনে। সবাই বুঝদিচে কী হ’তি পারে।’

রথীনদার কথা আর রমাদির এই যে সবাই বুঝছে কী হতে পারে, এই সবই যা হবার হয় এদিন খুব ভোরে। কিন্তু সেই সংবাদও তো সেই ভোরে বা সকাল সাতটার রেডিয়ো বাংলাদেশের খবরে কি বিবিসির খবরে জানা যায়নি। জানতে জানতে তাও বিকেল। সে খবরও রথীনদাই নিয়ে আসল।

মা জেঠিমার অনুরোধে রথীনদা আর যায়নি সেদিন। কিন্তু সন্ধ্যার পরপর বাবা ফিরলে আর তার আগে জেঠামশাই বাড়ি এলে, রথীনদাকে তাদেরও একই কথা বলতে হয়। বাবা বাগেরহাট থেকেও প্রায় একই খবর নিয়ে এসেছিল। আমরা জানতাম, বাবা বাগেরহাট গেছে ছোটকার খবর জানতে। শহরের বিএনপির নেতা দুই-একজনকে সে চেনে। কারও কারও সঙ্গে কলেজে পড়ার সময় আলাপ পরিচয়। তাদের কেউ আলাদা করে তেমন কিছু জানতে পারেনি। তবে বাবা গোপনে রেজাউলকাকুর সঙ্গে দেখা করেছে। সেটা কীভাবে সম্ভব হয়েছে সেকথা খুব নিচুগলায় বলল। রেজাউলকাকুর ভাবি জানিয়েছে, নদীর এপারে কোন বাড়িতে সে আছে। বাবা বাড়ি ফেরার আগে খেয়া পার হয়ে রেজাউলকাকুর সঙ্গে দেখা করে এসেছে। তার কাছেই শুনেছে যে রাজবন্দিরাই আসল টার্গেট। কারণ সরকারের ধারণা, তারাই সাধারণ কয়েদিদের উসকে দিয়েছে। এর পরেরটুকুই আমার বোঝার বাইরে। রথীনদা বুঝল। সেটা হলো, ছোটকার দলের অনেকেই তো জিয়ার দলে যোগ দিয়েছে, যারা দেয়নি তাদের যদি এখন সাইজ করা যায়। এদের প্রায় সবাই মুক্তিযোদ্ধা।

বাবাকে প্রায় বাড়ি পর্যন্ত দিয়ে গেছে মাহমুদ। সেকথা বলার সময়ে বাবা জানাল, ‘ছেলেটা একেবারে শুকোইয়ে গেইচে। মনে হয়, কত রাত্তির ভালো মতন ঘুমোয় না। ওইটুক মানুষ। বড়োভাইডা ওইভাবে মরল। ওর সামনের বার আইএসসি পরীক্ষা।’

একটু পরে উঠোনে রেডিয়ো বাজে। একটা চেয়ারের উপর রাখা। আশপাশের দুই এক বাড়ির সবাই জড়ো হয়েছে। ভাবানীকাকু, ভোলাকাকু আর সরকারবাড়ির অনাদিদা ও মণ্ডলবাড়ির সুজিত আছে। অনাদিদা আর সুজিত এসেছে রথীনদার কাছে। সব ফুটবল খেলার দল। রেডিয়ো বাংলাদেশ ঢাকা কেন্দ্র থেকে রিলে করা খবরের আগে অনাদিদা যথারীতি তার ছাড়া গলায় বলল, ‘এইবার শুরু হবে বানানো খবর। যা ঘটিনি তা কবে। যা ঘটবে তাও কবে। কিন্তু ঘটাবে নিজেরা।’ এরপর নিচুগলায় ‘বালের’ বলে এরপর ‘খবর’ শব্দটা উঁচু গলাতেই বলল। এরপর একটু তফাতের অন্ধকার থেকে এল চেয়ারটার কাছে।

অনাদিদা কেন, সবাইই তো জানতাম কী বলতে পারে। তাই বলল। পরিস্থিতি অস্থিতিশীল। সরকার চেষ্টা করছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলোচনায় এখনো প্রস্তুত। ইত্যাদি। রথীনদা তো এর বাইরের খবর এনেছে। বাবাও বলেছে তলে তলে ভিতরে কী হতে যাচ্ছে।

কিন্তু, ভাবানীকাকুর রেডিয়োয় চলানো বিবিসির খবর কিছু নতুন কথা বলল। তাতে পুলিশপ্রধানের ভাষ্যে জানা গেল, রথীনদা যা শুনেছে ঠিকই। কিন্তু সে খবরে তো আর সরাসরি ওভাবে বলেনি। বলেছে যদি আলোচনা ফলপ্রসূ না হয় তাহলে পুলিশ যেকোনো উপায়ে জেলখানার নিয়ন্ত্রণ নেবে। সাংবাদিক জানতে চেয়েছিলেন, তাতে বল প্রয়োগের ঘটনা ঘটবে কি না। পুলিশপ্রধান প্রশ্ন এড়িয়ে বলেছেন, এ বিষয়ে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা সিদ্ধান্ত দেবেন তাই করা হবে। বিবিসির সংবাদপাঠক বললেন, এতক্ষণ ঢাকা থেকে তাদের প্রতিনিধির জানানো সবশেষ খবর এই। রাতের অনুষ্ঠানে যদি এরপরের কিছু খবর জানা যায় তাই জানিয়ে দেবেন। তবে এখন গোটা খুলনা শহর প্রায় অবরুদ্ধ এক নগরী। অফিস আদালত ও পাটকল কোথাও স্বাভাবিক কাজকর্ম সেভাবে হয়নি। হলেও সর্বত্র চাপা উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।

এ সবে জেঠামশাইর যথারীতি কোনো হেলদোল নেই। একইভাবে নির্বিকার তিনি। যেমন থাকেন। সব সময় সরকারি দল। তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানের উপর আস্থার কোনো শেষ নেই তার। ফলে রথীনদা আর বাবার সব কথা শুনে জেঠামশাই জানালেন, ‘ও মোস্তাফিজ-সাব যহোন আলোচনা কইরে যাতিচেন, তাই সব ঠিক কইরে ফেলাতি কতক্ষণ। ওইসব না-খাওয়া পার্টির ছ’ল-প’লরা [ছেলেপেলে] পারে নিকি সরকারের সাতে।’

কিন্তু এর ভিতরেই রথীনদা বলল, ‘না বড়োমামা, আমি যাগে ধারদে শুনিচি তারা খুলনোর খবর ঠিকই জানে। দাঙ্গা পুলিশ জেলখানার দেয়াল বাইয়ে উইঠে ভিতরে ঢোপবে।’

‘সে তো ঢোকপেই।’ জেঠামশাইর নির্বিকার সিদ্ধান্ত।

রমাদি পাশ থেকে বলল, ‘তারপর গুলি চালালি?’

তখন জেঠামশাই আরকিছু বলেননি। শুধু জেঠিমাকে বললেন, ‘বড়ো বউ, খা’তি দাও।’ সঙ্গে রথীনদাকে খেতে ডাকলেন।

বাবাও খেতে বসল তাদের সঙ্গে। কিন্তু থালে বাবার হাত নড়ে না। গেরাস মুখে তোলে আর চোখ সামনে নিয়ে কোথায় চেয়ে থাকে। অন্য সময়ে হলে রথীনদার পাতে আরও ভাত ঝোল তরকারি মাছ দিতে বলত। ভাগনে তো।

আমার মনে হলো, এর ভিতরে পুলকেশ লোকটা খুলনা শহরে করে কী? ব্যবসার কাজে দিন দুই বাদে গেল চলত না। ইস্কুল-কলেজে ইদের ছুটি। নন্দিতা নিশ্চয়ই খুলনায় যায়নি। তাহলেও? কিন্তু খবর শোনার সময় বারবার মার চাপাকান্নায় নাকটানার ফোৎ শব্দে সেকথা আর ভাবতে পারিনি। বরং একটু পরে ঠাকুমাকে মা খাওয়াতে গেলে, সে আবারও আজ কয়েকবার বিড়বিড় করে জানতে চেয়েছে, ‘ও বউ, ধন্য কেন আসে না? খবর জানো কিছু?’

হারিকেনের আলোয় রমাদির চোখে জল দেখি। টের পেলাম আমারও চোখ বেয়ে নামছে।

রাতে রমাদি আমার কাছে শোয়। পুলকেশকে নিয়ে কোনো কথা বলল না। শুধু বলল, ‘খুকি, যদি ছোটোমামার কিছু হয়ে যায়, এই মামাবাড়ির সংসারডা কিছু ভাইঙে যাবে। দেহিস্।’

অমি অন্ধকার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, ‘সব বুঝি রমাদি। এর মদ্যি আমারে বিদেয় কইরে বাপ-জেঠা ভাবিল রক্ষা পা’ল। সেহানে আমি বাধাইয়ে ফেলাইচি আর এক সমস্যা। দেইখো, আমারে নিয়েও ফ্যাসাদ শুরু হল।’ বলতে বলতে আমার গলা আটকে আসছিল।

রমাদি বলল, ‘এভাবে ভাবিস না, বুন্ডি। সব ঠিক হইয়ে যাবে। দেহিস কাইল সকালে ভালো খবর আসপে।’

চিরদিন এমন আশার খবর বলে রমাদি। সেদিনও বলেছিল। যদিও এই সকালটা ছিল আমাদের জন্যে সন্ধ্যার চেয়েও অন্ধকার। কারণ ভোর ছিল একই। একটু একটু শিশির পড়তে শুরু করেছে। দক্ষিণের পোতার কোনায় শিউলি গাছটায় ফুল আর ফুল। সূর্য উঠবে। উঠছে। বাড়িতে ভাগনে আছে, তাই খুব সকালেই উনোনে ভাতের হাঁড়ি। সেদ্ধ ভাত হবে।

সকালে হতে হতে বাবা সাতটার খবর চালিয়ে দিতেই এই সকাল সত্যি গতকালের সন্ধ্যার মতো অন্ধকার হয়ে গেল।

খবরে বলল, ভোররাতে পুলিশ জেলের নিয়ন্ত্রণ নিতে ভিতরে ঢুকেছে। এখন সেখানে পুলিশি তৎপরতা চলছে। ইতিমধ্যে কয়েকজনের হতাহতের খবর জানা গেছে। এখনো কয়েদিদের কাছ থেকে সকল জিম্মিকে উদ্ধার করা যায়নি। জেলখানা ও এর আশপাশের এলাকায় একশ চুয়াল্লিশ ধারা জারি করা হয়েছে।

হতাহতের খবর শুনে বাড়িতে মা-জেঠিমা শব্দ করে কাঁদে। রথীনদা তৈরি হয়, এখনই সাইকেল চালিয়ে বাগেরহাট শহরে যাবে। যদি আরও কোনো খবর জানা যায়। কিন্তু জেঠিমা তাকে একমুঠ ভাত না খাইয়ে যেতে দেবে না।

ওদিকে ঠাকুমা তার বিলাপের ভিতরে বলে চলল, ‘ধন্য আসে না কেন? আর কোনো দিন আসপে না?’

রেডিয়োর খবর শুনতে আর গত রাতের খবরের উৎকণ্ঠায় আমাদের উঠোনে আশপাশের বাড়ির কতজন! তাতে ঠাকুমার কথা যেন সত্যি মনে হয়। পরিষ্কার আকাশে তাকিয়ে ভাবলাম, মানুষের অধিকার আদায়ে যে ছোটকার সারাটা জীবন কাটল, তাকে এভাবে মরতে হবে! তা কী করে হয়?

জানি না। কতকিছুই তো হয়। আমার জীবনেই তো হয়েছে।

দুপুরের পরপর পরীক্ষিৎ আর বুড়োকা এল। সকালে খবর শুনেই পুলকেশের বাবা তাদের পাঠিয়েছেন।

পরীক্ষিতের মুখ স্বাভাবিকভাবেই ভার। আমার সামনে আসলে তা আরও ভারী হয়। তালই বাড়ি এসেছে, কিন্তু এখন বেয়াই-বেয়ানদের সঙ্গে ঠাট্টা ইয়ার্কির প্রশ্ন ওঠে না। বার কয়েক পরীক্ষিতের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল, ওর মুখ এমন ভার হয়ে থাকার কারণ পুলকেশের আচরণ। এই বাড়ির এমন একটা দুর্যোগের দিনে এখন এখানে তো পুলকেশেরই থাকার কথা ছিল, উচিতও ছিল, পরীক্ষিৎ হয়তো তার সঙ্গে আসত, সেখানে পুলকেশ নেই, পরীক্ষিৎ এসেছে। পুলকেশ সেই খুলনাতেই। যে শহর এখন প্রায় অচল। সেখানে যারা কাজে গেছে, চলে এসেছে। অথচ সে লোকের খোঁজ নেই। এতে আমার মনে হয়েছিল, লোকটা আমার কাছ থেকে পলাচ্ছে না তো। পুলকেশের খুলনা থাকায়, তাদের বাড়ি আর আমাদের বাড়ি― দুজায়গাতেই তাকে নিয়েও খানিক উৎকণ্ঠা আছে। যদিও সকালের খবরের পরে খুলনা জেলের ঘটনা, ছোটকার, ছোটকার সঙ্গে জেলে বন্দি অন্যদের ছাড়া আর কোনো চিন্তা কেউ করেনি। মোটামুটি জনা আষ্টেক লোক খুলনা জেলে আছে যাদের ছোটকার কারণে যাদের মা-বাবাসহ পাড়া-প্রতিবেশী অনেকে চেনে।

পুলকেশ আসার আগে লাউফলা বাজার হয়ে এসেছে। সেখান থেকে এটা-ওটা কিনে এনেছে। এমন আনা লাগে তাই এনেছে। তবে একটা বিশেষ সংবাদও নিয়ে এসেছে। পুলিশ জেলখানার বাইরে থেকে ভিতরে বন্দি কয়েদিদের উপর গরম জল মেরেছে। গুলির খবর জানতাম, কিন্তু ফুটন্ত গরম জল মারার কথা আমাদের জানা ছিল না। বুড়োকা এ খবর পাননি, বন্দিদের মুক্ত করা গেছে কি না? জানেন না, সবমিলে কতজন মারা গেছে। রাজবন্দি নেতাদের কেউ মারা গেছে কি না। মারা যাওয়ার সংখ্যা শুনেছেন অন্তত তিরিশ জন। আরও বেশি হতে পারে। জেলখানার গায়েই ভৈরব। যদি মারা মানুষ সেখানে ডুবিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে তা রূপসা হয়ে আরও দক্ষিণে পশুরে গিয়ে ভেসে উঠবে। তখন ষাট জনকে তিরিশ বলুক কি একশকে পঞ্চাশ বলুক, কার তাতে কী? কে গুনতে আসছে।

পরীক্ষিৎ ও বুড়োকা এসব জানিয়ে, একটু জিরানোর আগেই যা আশঙ্কা করেছিলাম তাই হলো। মা বা জেঠিমা নয়, রাঙাদিদিমা এসে জানতে চাইলে, ‘এইয়ের মদ্যি নাতিজামাই খুলনোয় কী অরতিচে?’

বুড়োকা একটু বিব্রত। চুপ করে রইলেন। এ প্রশ্নের উত্তর তো পরীক্ষিতেরও জানা নেই। সে আমাদের যা বলেছে সে কথাই বলল, ‘ব্যবসার কাজে গেইচে তো। আছে ভালো। দাদা যেহানে আছে সেহানে কোনো সমস্যা নেই।’

‘নেই বোঝলাম। কিন্তুক আমার নাতনিডার মুহের দিকে এহোন চাওয়া যায়? এক ওর ছোটোখুড়োর এই অবস্থা, তার মদ্যি বর রইচে দূরে। এ সময় মাইয়েডার ধারে থাহাও তো ভালো মানষির কাজের মদ্যি পড়ে। না কী কও, ও ভাই?’

সকালের পরে আর পান খায়নি রাঙাদিদিমা। মাড়ির দাঁতছাড়া ওই মুখের খেড়খেড়ে গলায় কথাগুলো বললে পরীক্ষিৎ একটু বিব্রতই হলো। কিন্তু আমি তো জানি, ও কী করতে পারে। তবু এসেছে।

রাঙাদিদিমা এবার বুড়োকাকে বলল, ‘কী ও তালইবাবা, কথা কন না কেন?’

বুড়কা কী বলবেন। তিনি এসেছেন খুলনা জেলের খবর শুনে। তার ভাইপোর কাণ্ড সম্পর্কে এখানে তার কী বলার আছে? তবু নিচুগলায় বললেন, ‘কথা তো ঠিকই কইছেন মাওইমা। মনে হয়, এই পরিস্থিতিতে যে হবে বুঝদি পারিনি। আটকাইয়ে পড়িচে।’

রাঙাদিদিমা এবার পরীক্ষিৎকে বলল, ‘আসতি চা’লি আসা যায় রে ভাই। রথি ক’ল ওগে সাথে ফুলবল খেলে একজন তো ঠিকই কাইলকেই চইলে আইচে।’

মা বলল, ‘ছোটোমাসি চুপ করো। ও কী করবে? তবু দেখো খবর শুইনেই চইলে আইচে।’

বুড়োকাও চুপ করে রইলেন। বাবা তাকে নিয়ে পিছনের দিকে গেলে। ওসব কথায় পড়তে দিয়ে চাইছে না। এই ফাঁকে একটু চা-জলখাবার তৈরি হোক।

পরীক্ষিৎ মাথা নিচু করে বসেছিল। কাছে ডাকল বিভাসকে। ফুটবল নিয়ে তাদের কথা শুরু হলো। একটু পরে বিভাস তাকে নিয়ে গেল ভিতরের ঘরে।

আমরা রথীনদার ফেরার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। জেঠামশাই ঘুমোচ্ছেন। বাবা খাওয়ার পরে সেই যে পুকুরের দক্ষিণ দিকে যেয়ে বসেছে বলতে গেলে আর ওঠেনি। পরীক্ষিৎরা আসার পরে একবার এসেছিল। বুড়োকাকে নিয়ে আবার সেখানে গেছে। পুকুরে পারের ওই জায়গা থেকে অনেকটা দূরে বড়ো রাস্তা দেখা যায়। যদি সাইকেল চালিয়ে ফিরছে কেউকে দেখে অনুমানে তার মনে হয় রথীনদা ফিরছে, তাহলে বাড়ির ভিতরে আসবে। তাই হলো। কিছুক্ষণ পরে বাবাকে দেখলাম মাঝউঠানে। বাঁশের একটা দুটো কঞ্চি আর গরুর পায়ে পায়ে আসা যশুরে লতা পরিষ্কার করছে। বুঝলাম, কিছুক্ষণের ভিতরেই রথীনদা চলে আসবে। যদি না আসে তাহলে বাবা আবার নিঃশব্দে পুকুরের দিকে চলে যাবে। কাউকে কিছু বলবে না। আমি আর রমাদি বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাবাকে দেখলাম। মানুষটা যেন হাঁটতে পারছে না। হাঁটছে ঠোকর খেয়ে। একটু যেন খুঁড়িয়ে। কাল রাতে বিছানাপড়তা বোধবুদ্ধিহীন ঠাকুমার বিলাপ যদি সত্যি হয়! যদি আর কোনো দিন ছোটকার ফিরে না আসে! এ মালিকে জাহান গান গাওয়া ছোটকার গরম জলে ভেসে গেছে, তখন একফোঁটা জলের জন্য তার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। সেসময় কি একবারও তার খুকির মুখখানা মনে পড়েনি। খুকি গেলাসে জল নিয়ে দাঁড়িয়ে। রোদের ভিতরে দাঁড়ানো বাবার দিকে তাকিয়ে আমি চোখে বুদ্বুদ্ দেখি। ওঠে নামে, নামে ওঠে। বাবার মুখ দেখি না। চোখ ভিজে উঠছে আমার। বাবার মুখটার জায়গায় ছোটকার মুখ। শুধু রমাদি যেই বলল, ‘মেজমামা, তোমারে আর তালইমশাইরে এট্টু চা কইরে দেব?’ তখন আমাদের দিকে ফিরতেই মনে হলো, এ তো বাবা, ছোটকার কোথায়?

বাবা বলল, ‘নারে মা, কিছু মুখি দিতি ইচ্ছে করতিচে না।’

বুঝলাম, বাবা তার কষ্ট ভাগ করতে চাইচে না। বুঝতে দিতেও চাইছে না সেভাবে। তবু গলায় স্বরে তো বোঝা গেল। জড়ানো পায়ে বাবা পুকুরের দিকে যাওয়ার আগে পরীক্ষিতের খোঁজ নিয়ে চলে গেল দক্ষিণ দিকে। বার দুই পিছনে আমাদের দিতে ফিরে, তাকাল সামনের দিকে। যদি রথীনদা আসে। আমি অসহায় তাকালাম রমাদির দিকে। রমাদি আমার দিকে।

এ সময় রথীনদা সাইকেল নিয়ে উঠোনের মাঝখানে থামল। যাওয়ার সময় মুখে যে থমথমানি ছিল এখনো তাই। কোঁকড়া চুল একটু আউলে গেছে। রমাদি গলা ছোড়ে বাবাকে ডাকল, ‘মেজমামা, দাদা আইচে।’ আমি বারান্দা থেকে নিচে নামলাম। রথীনদার দিকে এগোতে এগোতে জানতে চাইলাম, ‘ওদা, কিছু জানতি পারলে!’

‘মাইরে প্রায় সাফ কইরে দিচে!’ একটু উঁচু গলায় একথা বলে সাইকেলটা উঠোনের একপাশে স্ট্যান্ডে রেখে বারান্দার কাছে এসে বলল, ‘রমা, জল দে।’

আমি জানতে চাইলাম, ‘মানে। সাফ কইয়ে দিচে মানে?’

‘মানে আবার কী? কথা বুজিস না, আবার জিগোস?’

আমি চিৎকার করে জানতে চাইলাম, ‘ছোটকার?’

রথীনদা ‘কিছু জানতি পারিনি’ বলার আগে বাবা প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে দাঁড়িয়েছে। পিছনে বুড়োকা। বারান্দায় মা-জেঠিমা। পরীক্ষিৎ আর বিভাস উঠোনে নেমেছে। বীথি রমাদির কাছে। রমাদির হাতে জলের গেলাস। রথীনদা গেলাসটা হাতে নিয়ে ঠোঁটে ছোয়ানোর সময় বাবা জানতে চাইল, ‘ও মামা, নতুন কোনো খবর পা’লি কিচু?’

অর্ধেক গেলাস জল খেয়ে আমার হাতে গেলাসটা দিল রথীনদা। পরীক্ষিতের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসল। তারপর বলল, ‘মামা, এখন পর্যন্ত যা শুনিচি মরিচে জনা পঞ্চাশেক। জেলখানা রক্তে ভাইসে যায়। গরম জল দিয়েও মারিচে।’

‘ওগে কেউর কোনো খবর জানলি?’

‘এহোন পর্যন্ত যা শুনিচি নেতারা কেউ মরিনি। এত বড়ো ঘটনা। সেয়া হওয়ার কথা না। মনে হয়, পাবলিকরে ঠান্ডা রাখতি কিছু জানতি দিতিচে না। তয় খবর তো ধীরে ধীরে বাইরোবে।’

‘বাগেরহাটের কেউর কোনো খবর?’

‘না মামা, আলাদা কইরে কিছু জানার উপায় আছে। খুলনার সেই কাস্টম ঘাটদে কার্ফ্যুর মতন। শহরে মানুষজন তো কেউ বাইরে নেই। সকাল নয়টার ট্রেনে যারা আইচে, তারা যা খবর নিয়ে আইচে। সে ট্রেনও নাকি ছাড়িচে দেরি কইরে। আমি স্টেশনে দাঁড়াইয়ে থাকলাম। যদি পরিচিত কেউরে পাই।’

বাবা বিড়বিড় করল, ‘শেষমেষ মোস্তাফিজ-সাব এইয়ে করল? তাও নিজের জেলায়?’

রথীনদা বারান্দায় উঠতে উঠতে বুড়োকাকে নমস্কার জানাল, ‘তালইমশাই কেমন আছেন?’ আবার আগের মতো উঁচু গলায় বলতে থাকল, ‘আসার আগে শোনলাম, এই ঘটনার প্রতিবাদে কাইলকে খুলনায় হরতালের ডাক দিছে সব দল। মানে দশ দল।’ এরপর মলিন হাসিতে পরীক্ষিতের কাছে জানতে চাইল, ‘বেয়াই, আসলেন কহোন? খুকিরে নিতি আইচেন?’

পরীক্ষিৎ আমাকে নিতেই এসেছিল। ঠিক তাও না, এসেছিল ছোটকার খবর শুনে। একই সাথে যদি আমাকে নিয়ে ফেরা যায়, বাড়ির লোকজন অনুমতি দেয়, তাহলে ফিরবে। একথা ও আমাকে পরে জানিয়েছে। কিন্তু রথীনদা ফেরার পরে সারাবাড়ির যে অবস্থা, তাতে তো ও কথা তোলার সুযোগই নেই। তবু পরীক্ষিৎ আমায় বলেছে, যদি বাড়ির লোকজন রাজি হয়, তাহলে কাল সকালের পরে রওনা দেবো। তখন আমিও ঠিক করেছি, বড়ো রাস্তায় পৌঁছে ভ্যানে ওঠার পরে ওকে বলল, ওর সঙ্গে আমার কথা আছে। আর তা তাদের বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই। কারণ বাড়িতে আমরা দুজন পুলকেশ আর নন্দিতাকে নিয়ে কথা বললে কে না কে শোনে। এটা আমাকে বলেছে রমাদি। আমি জানি, তোমার সাথে আমার কথা আছে পরীক্ষিৎ। একথা বললেই ও যা বোঝার বুঝে যাবে।

কিন্তু, আমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা পরীক্ষিৎ আর তুললই না। সম্ভব ছিল না। বরং কোনোভাবে আর কোনো খবর পাওয়া যায় কি না, সেজন্য অপেক্ষা করা। দুপুরের পরে বুড়োকা ছন্দাকে নিয়ে চলে গেল। রথীনদাও যায় বাগেরহাটে। তারপর থেকে আমরা গোটাবাড়ির মানুষজন এক নিঃসীম ফাঁকা অবস্থায় পড়লাম। যেন আমাদের বাড়ির ওপর দিয়ে এখন বাতাসও বইছে না। একটা পাতা নড়ে না। দম আটকানো অবস্থা। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলে না। কেউ কারও মুখের দিকে তাকায় না। এর ভিতরে পরীক্ষিৎ যাওয়ার তোলার সুযোগ পেল না।

রথীনদা চলে যাওয়ার সময়েই বুঝেছি, আজ আর সে ফিরবে না কোনো বিশেষ সংবাদ না পেলে। এককাপড়ে বাড়ি থেকে এসেছে। যদিও রাখালগাছির সবাই জানে মামাবাড়িতে গেছে। সে বাড়িতেও ছোটকার সংবাদ শোনা নিয়ে উৎকণ্ঠায় সবাই। বড়োপিসি এতক্ষণে তার কোলেপিঠে করে মানুষ করা ছোটোভাইটার এই বিপদে না জানি কতবার কেঁদে বুক ভাসিয়েছে। শক্ত মানুষ পিসিমশাইও নিশ্চয়ই রথীনদা কী সংবাদ নিয়ে আসে তার অপেক্ষায়। আর আমরা অপেক্ষায়, রথীনদা রাখালগাছি যাওয়ার পথে বাগেরহাট শহর হয়ে যাবে, সেখানে যদি বিশেষ কোনো সংবাদ পায়, যদি সেই সংবাদ দিতে ফেরে। আর না হয় সন্ধ্যায় বিবিসি আর আকাশবাণীর খবরই ভরসা। ভয়েজ অব আমেরিকার খবর প্রায় রেডিয়ো বাংলাদেশেরই খবর, যেন তা ঢাকা কেন্দ্র থেকে রিলে করে আমেরিকা থেকে প্রচার করা হয়।

বিশেষ সংবাদটার কথা ভাবতেই আমি আকাশের দিকে তাকাতাম। সেখানে যদি ভগবান থাকে, তাহলে সে আমার চোখের জল দেখতে পারে। তবু তা ঘটে গেছে, যদি ঘটে যেয়েই থাকে, তাহলে বিশেষ সংবাদ হলো ওই যে ষাট কি সত্তর জন মানুষ মরেছে, তাদের সঙ্গে আছে আমার ছোটকার। আর অন্য বিশেষ সংবাদ―না, ছোটকার কিছু হয়নি। ভালো আছে। সেই খবরটাই শুনতে চায় মন। বাড়ির সবাই, প্রতিবেশী, গ্রামের মানুষ। তাদের ধন্য বেঁচে আছে। যতই নকশাল বলুক, কারও বিপদে ধন্যর মতন ঝাঁপিয়ে পড়া মানুষ এই গ্রামে দ্বিতীয়জন নেই। সেই ধন্য জেলে থাকুক, এত বড়ো ঘটনা পরে বেঁচে আছে জানলে সবাই এই চাপা অবস্থা থেকে স্বস্তি পাবে। তাই আমি কতবার যে তাকিয়েছি ওই আকাশে। ভগবান, আমার ছোট্কার যেন কিছু না হয়।

আঁচলে চোখ মুছে আকাশ থেকে নজর ফেরতেই ভাবলাম, ছোটকার একথা শুনলে আমায় কী বলত? ভেবে, এই অবস্থায়ও হাসি পেল। বলত, ‘ওই সব ঢঙের কথা কইসে নে, খুকি। যে সবার মুখ দিতে পারেনি কয়ডা ভাত সেই নাকি মানুষের ভাগ্যবিধাতা!’ বলে হেসে যোগ করত, ‘বাড়ির নারায়ণ ঠাকুর আবার শুনিনি তো। গৃহদেবতা। গেরস্তের অকল্যাণ হবে!’

গৃহদেবতা হয়তো অতটা অকল্যাণ চায়নি। সন্ধ্যার আগে আগে মাহমুদ আসে। তাকে পাঠিয়েছে রেজাউলকাকু। মাহমুদ জানাল, ছোটকার বেঁচে আছে। এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে, বাগেরহাটের যারা বন্দি তারা কেউ মরিনি। আজকে খুলনায় এমন হরতাল হয়েছে যে রাস্তায় এট্টা কাকপক্ষীও দেখা যায়নি।

আপাতত স্বস্তি। বেঁচে আছে ছোটকার। রফিককাকু, মৃণালকাকু, শওকতকাকু সবাই জীবিত। তবে এরা এত বড়ো ঘটনায় ইন্ধন দেয়ায় নিশ্চয়ই বিচার হবে। মোড়লগঞ্জের মধুর কথা জানতে চাইল বাবা। মাহমুদ অত কিছু জানে না। শুধু বলল, ‘এখন খবর বাইরোচ্ছে এইসব কমিউনিস্ট জাসদ ন্যাপ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতারা কয়েদিগো ইন্ধন দিছে।’ এইসব দলের কোনটা যে কী, আমি বুঝি না। বরং মাহমুদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এত ভালো ছাত্র, তাও দেখো রাজনীতির কতকিছু জানে। মাহমুদ একদিন মনে হয় বড়ো নেতা হবে। ডাকসু-রাকসুর ভিপিও হতে পারে।

সেদিনের বিবিসির খবরেও প্রায় মাহমুদের কথাগুলোই জানা গেল। অবশ্য সঙ্গে সরকারের ভাষ্যও। যার অনেককিছু দুদিন পরে খবরে কাগজেও জানা যায়। ঈদের ছুটি থাকায় লাউফলা বাজারে আগামী কালকে বের হওয়া খবরের কাগজে আসবে তা আরও দুই দিন বাদে। কিন্তু রেডিয়ো বাংলাদেশ তো দেশবাসীকে যথাযথ সরকারি খবর জানিয়েই যাচ্ছে। খুলনা রেডিয়ো মাঝে মাঝে বিশেষ খবরও তো প্রচার করেছে। সে খবর জেঠামশাই কিছুটা হলেও বিশ্বাস করতে পারে, বাকি কারও বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। তবু আপাতত ঘটনা কিছুটা স্থিতিশীল অথবা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসার পরে যা-যা জানা গেল, তা হল : খুলনা জেলে কয়েকজন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া আসামি, যাদের ভিতরে কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা, তারা এই ব্যাপারটা ঘটিয়েছে। তারা সাধারণ কয়েদিদের সংঘবদ্ধ করে যাদের কাছে জেলখানার চাবি থাকে সেইসব কারারক্ষীকে বন্দি করে। মোট চব্বিশজন। এদের ভিতরে ডেপুটি জেলারও ছিল। এরপর তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অলোচনায় আহ্বান জানান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, জেলের কর্মচারীদের ছাড়লেই তিনি আলোচনায় বসবেন।

এইসব কথা আমাদের আগেই জানা ছিল। যেটা জানা ছিল না, এসব কয়েদিরা বন্দি একটি মেয়েকেও নিজেদের জিম্মায় নিয়ে নিয়েছিল। আর তাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে। এই ঘটনায় তো আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতপা গুটিয়ে বসে থাকা চলে না। ওই নারীকে উদ্ধার করার জন্যেই মূলত তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। নইলে পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিত। আর তারপরও সরকার বন্দিদের আটচল্লিশ ঘণ্টা সময়ও বেঁধে দিয়েছিল। যাতে বিষয়টির সুরাহা হয়।

নারীর প্রতি এমন অবমাননাকর ঘটনায় সাধারণ কয়েদিরাও আন্দোলনকারী কয়েদিদের উপর আক্রমণ করে। জেলে একেবারে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পুলিশ বাধ্য হয় শক্তি প্রয়োগ করতে। তাতে পঁয়তাল্লিশ বন্দি নিহত হয়।

এমন পরিস্থিতির জন্যে সরকার গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছে। নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে কি না, তা জানা যায়নি। অথবা বলেনি কোনো প্রচার মাধ্যম।

তবে বিবিসির প্রতিবেদন জানিয়েছে একটু ভিন্ন কথা। রংপুর ও এরপরে খুলনা জেলে বন্দিরা অনশন করেছে, প্রায় একমাস ধরে। তা খাবারের জন্যে। পানীয় জল ও কয়েদিদের একটু উন্নত জীবনযাপনের জন্যে। কেননা কয়েদিদের সঙ্গে জেল কর্তৃপক্ষ খুবই অমানবিক আচরণ করে। ওই অনশন শুরু হওয়ার পর থেকে দেশের কয়েকটি কারাগারে বন্দির অনশন করেছে। সে বিষয়টি রেডিয়ো বাংলাদেশের সংবাদে পুরোপুরি এড়িয়ে গেছে।

অনাদিদা খবর শুনতে শুনতে একথা বলল। বাবারও সমর্থন আছে তাতে। কেননা আজ নয় এই ঘটনা, কিন্তু রংপুর ও খুলনার পরে যশোর ময়মনসিংহ বরিশাল ঢাকা―বেশ কয়েকটি কারাগারেই বন্দিদের আন্দোলনের কথা শোনো গেছে।

যাক, ছোটকার জীবিত। মরেনি। এর চেয়ে ভালো খবর আর কী? কিন্তু এই ঘটনায় উসকানিদাতা হিসেবে পরে কী হবে তা সেদিন জানা যায়নি, আর জানা যায়নি যারা মারা গেছে তাদের পরিচয়। সেটি অবশ্য দিন দুয়েক বাদেই জানা যাবে। তবে খুলনায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হওয়ায় সরকার অন্তত বুঝেছে, তারা যাই প্রচার করুক, সাধারণ মানুষ ঘটনাটা স্বাভাবিকভাবে নেয়নি।

আপাতত আর তো কোনো টেনশন নেই। অন্তত যা হচ্ছিল, সে থেকে সবাই খানিকটা চাপমুক্ত হয়েছে।

পরদিন সকালে পরীক্ষিৎ আমাকে নিয়ে তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

ছোটকার উৎকণ্ঠায় আমাদের বাড়ির কেউ পুলকেশের কথা তেমন কিছু জানতে চায়নি। আমিও না। কাল খুলনা শহরে হরতাল ছিল, লোকটা তো আগের দিন বাড়ি আসতে পারত, হরতালের দিন সকালে আসতে পারত আমাদের বাড়ি। আসেনি। যেন ওই বাসররাতে আমাকে সব বলেই খালাস। আর কোনো দায়িত্ব নেই। কিন্তু আমি তো একটা মানুষ। আমার ছোটকার এই অবস্থা। এ বাড়ির নতুন বিয়ে হওয়া মেয়ে, তাদের বাড়ির বউ। আমার এই অবস্থায় তো একটু পাশে এসে দাঁড়ানো লাগে। নাকি তার সে বোধও নেই। অথবা আছে বলেই হয়তো খুলনা যাওয়ার অগে পরীক্ষিৎককে বলে গেছে আমাকে নিয়ে যেতে। এর ভিতরে জেলের এই ঘটনা।

পরীক্ষিতের সঙ্গে রওনা দেওয়ার আগে, মা আমাকে ডেকে এটা-ওটা বলেছে। শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে তা বুঝিয়েছে। পড়াশোনা করতে বলেছে বাবা। বলেছে দুই-একখানা বই নিতে। বাকি বইপত্র পরে বিভাস গিয়ে দিয়ে আসবে। পরীক্ষিৎ তা শুনে বলেছে, একদিন সেও সাইকেলে এসে নিয়ে যেতে পারবে। ওদিকে রমাদি আমাকে বুঝিয়ে বলেছে, আজই পরীক্ষিৎকে পুলকেশের বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করার দরকার নেই। আমার অবশ্য তার কথায় সায় ছিল না। আমি বললাম, ‘কেন, যাওয়ার পথে জানতি চা’লি সমস্যা কোতায়?

রমাদির বিয়ে হয়নি ঠিকই, কিন্তু সাংসারিক বুদ্ধি তো আমার চেয়ে বেশি। মানুষের কখন কোনো সময়ে কী বলা উচিত সে বোধও টনটনে। বলল, ‘তুই এহোনো নতুন বউ। আজই প্রথম ফিরানির পর যাচ্ছিস। আইজই যদি দেওররে এইসমস্ত জিগোইস, সেইয়ে কোনো কাজের কথা?’

কী জানি কাজের কথা কি না। তবে খারাপ বলেনি রমাদি। বলতে গিয়েও বললাম না, আমাকে যা বলার সবই তো পুলকেশ বলেছে, সেকথা রমাদিকে আগে বলেছি আর এখন পরীক্ষিৎকে তা বললে দোষ কোথায়? মেনে নিলাম রমাদির কথা। আপাতত বলব না কিছু। কিন্তু? সেকথা রমাদিই বলল, ‘যদি পরীক্ষিৎ নিজে কিছু কয়, তা’লি শুনবি। জানতে চা’বি। কিন্তু নিজের কথা এখনই কিছু বলিস না।’

জানি না কেন রমাদি এভাবে জোর দিয়ে বলেছিল। কিন্তু ঠিকই বলেছিল। আমি আগবাড়িয়ে বলার আগে যদি পরীক্ষিৎই বলে বা কিছু জানায়, তাহলে আমি ভিতরে আরও যদি কোনো গোমর থাকে তা জানতে পারব। তাছাড়া আমার চোখমুখ দেখে, আমাদের বাড়ির এই পরিস্থিতি জেনে পরীক্ষিতেরও তো আমারে কিছু বলার থাকতে পারে। কিন্তু ওর সঙ্গে ওই বাড়িতে যেতে যেতে একটা জিনিস ঠিক করে নিয়েছিলাম, ও বাড়ির একমাত্র পরীক্ষিৎ ছাড়া আর কারও সাথে এ নিয়ে কথা বলব না। আর, পরীক্ষিতের সাথেও এ নিয়ে নিচুগলায় কথা বলব না, যাতে শ্বশুর-শাশুড়ি কিছু বোঝে।

পরীক্ষিৎ আমার চেয়ে বয়সে বছর চারেকের বড়ো আর যথেষ্ট বুঝমান মানুষ। ওর সঙ্গে হেঁটে কিছুদূর যাওয়ার পরে নৌকায় উঠেছি, খেয়াল করলাম ও আমার দিকে তাকাচ্ছে, কিন্তু সহজ হতে পারছে না। চোখে মুখে এক ধরনের বিব্রতকর অবস্থা। আমাদের বাড়িতে থাকতে তা ছিল না। বুঝলাম, এই যে আমাকে নিয়ে ফিরছে সে, এটা তার ভালো লাগছে না। যেখানে তার দাদার আসার কথা। যদিও আমি ও বাড়ি থেকে আসার আগে সে মজা করে বলেছিল, রাম না গেলে লক্ষ্মণ যাবে। কিন্তু সেই বলাটা যে সত্যি সত্যি ঘটবে, তা হয়তো পরীক্ষিৎ ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি।

নৌকা থেকে উঠে ভ্যান। এটা আমিই বলেছি। এতক্ষণ নৌকায় বসে যাওয়ার মানে হয় না। তার চেয়ে ভ্যানে গেলেই হল। যদিও পরীক্ষিৎ বলেছে, নতুন বউ ভ্যানে যাওয়া যায় নাকি? আমি বলেছি, ‘হইচে, বড় কইরে ঘোমটা টাইনে দিয়ে বসব। ভ্যান তো রিজার্ভ। আমরা দুইজন। তবু পরীক্ষিতের মনে হচ্ছিল, বাড়ি ফিরলে শ্বশুরমশাই ওকে গালমন্দ করতে পারেন। এভাবে নতুন বউকে নিয়ে ভ্যানে কেন এসেছি।

লাউফলা বাজার থেকে ভ্যানে ওঠার পরে পরীক্ষিৎ বলল, ‘বউদি, তোমার খুব মন খারাপ?’

আমি বললাম, ‘বোঝই তো। ছোটকার আমার জীবনে কী, সেয়া কেউরে বুজইয়ে ক’তি পারব না।’

‘আমি জানি। না, জানতাম না। বুড়োকা ক’ল। বুড়োকা দেহি ছোটতালইরে খুব ভালো চেনে।’ বলে পরীক্ষিৎ যোগ করল, ‘অবশ্য বুড়োকা তো বিবিসি। চলো বাড়ি। দেইখেনে তোমরা যা শুনিচো, ওই মাহমুদ আইসে যা ক’ল তার চেয়ে বেশি খবর সে এতক্ষণে পাইয়ে গেইচে।’

‘সে আমার প্রথমদিনই ওনারে দেখে মনে হইচে।’

‘দাদা যে এইয়ে করবে!’ পরীক্ষিৎ এই পর্যন্ত বলতেই, আমি ভ্যানের পিছন থেকে উলটো ফিরে ওর পিঠে খোঁচা দিয়ে ভ্যানঅলাকে দেখালাম। পরীক্ষিৎ আর কথা বাড়াল না। আমার কেন যেন মনে হয়েছিল ভ্যানঅলা পরীক্ষিৎকে চেনে। জানে আমি তার বড়োভাইর বউ। আমার দিকেও তাকিয়েছে সেভাবে।

পরীক্ষিতের ওই কথায় আমি একটু পরে ওকে জিজ্ঞাসা করার সুযোগ পেলাম। ও বাড়ির কাছে আসতেই পরীক্ষিৎ একজনকে ডেকে বলল, সে ভ্যানে বসে যেন ব্যাগ দুটো ধরে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যায়। আমি আর ও হেঁটে আসছি।

এদিকে ভৈরবের চরে ধান ফলে প্রচুর। হেমন্তকালে বতি হাওয়া ধানের গন্ধ আমার সব সময় ভালো লাগে। এই কয়দিন শরীর আর মনের উপর যে চাপ পড়েছে, দুই পাশের ধানখেতের ভিতর দিয়ে একটুক্ষণ হাঁটতেই সেটা খানিকটা কেটে গেল। পরীক্ষিৎ তখন ভ্যান বাড়ির দিকে পাঠাচ্ছে। আমি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ধানখেতের দিকে তাকিয়েই থাকলাম। একটু পরে পরীক্ষিৎ আমার কাছে এসে বলল, ‘কী দেখো?’

আমি বললাম, ‘এই ধানখেত। তোমাগে এই দিকের চরের ধানের বাড়ন্ত ভাবই আলাদা।’

‘কাকা বিপ্লবী ভাইঝি কবি। ঘটনা কওদি [বলো তো] কী তোমাগে?’

আমি চট করে পরীক্ষিতের চোখে তাকালাম। ও শ্লেষ করছে না তো। না, তা নয়। বললাম, ‘এই কথাও ছোটকার কাছেই শুনিচি। নদীর জলের কারণে কাছাকাছি এলাকা হ’লিও ধানের ফলনে কত তফাৎ হয়।’

‘উনি অনেককিছু জানে, না বউদি? নকশালরা কত পড়াশুনো করে।’

‘নকশাল না, আরও কত কী? ওসব গুজব।’ বলেই সেই ভ্যানের কথাটায় ফিরলাম, ‘কী জানি কচ্ছিলে তোমার দাদারে নিয়ে?’

‘না। কচ্ছিলাম, তোমাগে উপর দে এই ঝড় গেল আর দাদা যাইয়ে খুলনায় বইসে র’ল। দাদা যে এই যে করবে। মা কচ্ছিল, আমাগে কী মনে করিচে তোমাগে বাড়ির মানুষজন।’

আমি একবার পরীক্ষিতের দিকে তাকালাম। ওই একবারই। তারপরে নিচের দিকে চোখ দিয়ে হাঁটতে থাকলাম। শত হলেও পতিনিন্দা! মা-ঠাকুমা-জেঠিমাকে বলতে শুনেছি, সতী কখনো পতিনিন্দা সহ্য করে না। তা সে তার ছোটোভাইর মুখ থেকে হলেও না। কিন্তু দুর্গা দেবীর তো শিবের মতন বর ছিল, আমার? হতে পারে খুলনায় গিয়ে আটকা পড়েছে, কিন্তু রমাদি তার সেই বন্ধুর কাছে যা শুনেছে তা কি মিথ্যা। আর পুলকেশ নিজেই যা বলেছে আমাকে? মাটির দিকে তাকিয়ে চোখ দুটো না তুললেও, পরীক্ষিতের কথার উত্তর তো দিতে হয় কিছু একটা। বললাম, ‘মনে হয় কাজে আটকাইছে, সেই জন্যি আসতি পারিনি।’

বুঝতে পারলাম, পরীক্ষিৎ আমার চোখ দেখতে চাইছে। আমি কথাটা কি বুঝে বলছি, নাকি তার দাদাকে পুরো বিষয় থেকে এই অবহেলার জন্যে মাফ করে দিতে চাইছি? কিন্তু কথাটা বলে পরীক্ষিতের উত্তর শোনার জন্যে আমি আর ওর দিকে তাকালাম না। তাতে যদি আমার চোখের অসহায়ত্ব ওর কাছে ধরা পড়ে যায়।

‘তোমার তাই মনে হল?’ পরীক্ষিৎ একটু ঝাঁজের সাথে বলল, ‘কাজের জন্যি আসিনি, না অন্যকিছু? একটা মানুষ এক বাড়ির জামাই, তার কোনো দায়িত্ব নেই? এমন যদি হতো যে সে খুলনা আছে, সেখানে যা ঘটিছে, সেই খবর নিয়ে চলে আসত। কাইলকে হরতাল ছিল। পরশু সন্ধ্যায় সে বাড়ি আইসে, কাইলকে তোমাগে বাড়ি আসতি পারত। নাকি পারত না?’

এ প্রশ্ন তো আমারও। সেকথা আমি কাহারে শুধাই। কারে কই। পরীক্ষিৎ বলছে বলুক, কিন্তু ওকে আমি একই প্রশ্ন কীভাবে করি। বললাম, ‘তোমার তো দাদা, তুমি জিগোইয়ে দেইখো বাড়ি আসলি?’

‘তোমারও তো বর, তুমি জিগোতি পারব না?’

‘না। আমার দরকার নেই।’ বলে, সরাসরি তাকালাম পরীক্ষিতের চোখের দিকে। চোখে রাগ ফুটে বেরুচ্ছিল নাকি? জানি না। বুঝিনি। কিন্তু ওর আমার দিকে তাকানো দেখে মনে হল, ও বুঝতে পেরেছে আমি ভিতরে ভিতরে কতটা রেগে আছি দুঃখে আর কষ্টে। ফোঁস করিনি। সম্ভবও নয়। কিন্তু চোখে কি কোনো ছাপও পড়তে নেই?

পরীক্ষিৎ নিচুগলায় বলল, ‘বউদি, তোমার খুব দুঃখ, না?’

মনে হলো, পরীক্ষিৎ আমার চেয়েও বয়েসে ছোটো। অনেকটাই নাবালক আর আমি এই কয়দিনে অনেকখানিক বড়ো হয়ে গেছি। এখন দুঃখকষ্টে যেন ছোটোভাইকে নিয়ে স্বামীর বাড়ির দিকে চলেছি। ওর কথায় একটু হাসলাম। বললাম, ‘থাক, বাদ দেওদি। বাড়ি আইচি। মা যেন কিছু বোঝে না।’

সেদিন বিকালে পুলকেশ ফিরল। আমি তাকে কিছুই জিজ্ঞাসা করিনি। যা বলার শাশুড়িই বলেছেন। সে অবশ্য বলেছে শহরের পরিস্থিতি আর সবমিলে ভেবেছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর যখন আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে, তাহলে সব ভালোয় ভালোয় মিটে যাবে। কিন্তু ঘটনা যে এখানে গিয়ে দাঁড়াবে তা সে বুঝতে পারেনি। কাল হরতাল ছিল বলে আসতে পারেনি। এছাড়া, জেলের পরিস্থিতি নিয়ে যা বলল, সে সবই আমাদের বাড়িতে থাকতে যা শুনেছি, তাই। পুলকেশের কথায় বুঝেছি, সে বড়ো বাজারে এর ওর কাছ থেকে শোনা, ওর ব্যবসায় পরিচিতদের কাছ থেকে শোনা কথাই আমাদের জানাচ্ছে। বাকি কিছুই জানে না। এমনকি তার কাকাশ্বশুর যে এই ঘটনায় কেমন কী আছে, সে নিয়েও তার জানা নেই কিছু। শুধু আলাদা করে একটা খবর শুনলাম পুলকেশের কাছে। কয়েকজন নেতার শরীরের অবস্থা খুব খারাপ। আহতদের নিয়ে হাসপাতালে ঠাঁই হচ্ছে না। কয়েকজনকে শিগগির ঢাকায় চালান দেবে। সেখানে এই ঘটনায় তাদের বিচার হবে।

যাক, বাবু তাহলে হোটেলে পায়ের উপর পা তুলে ঘুমায়নি। তবু এভাবে সেভাবে কিছু একটা সংবাদ এনেছে। সেই সংবাদের শেষটুকু শুনে মনে হলো, ছোটকারকে চালান দেবে না তো। যদিও এই সময়ে আমি ভেবেছি, এইসব আপাতত ক’দিন মাথায় নেব না।

কিন্তু তারও কি উপায় আছে। বিকালে আমার সঙ্গে দেখাত করতে এল নন্দিতা। আসলে এসেছে পুলকেশের সাথে দেখা করতে। আমি যে রমাদির কাছে তাদের সম্পর্কে সবই জেনেছি তা কোনোভাবেই চেহারায় আনলাম না। বরং এ সময়ে পরীক্ষিৎকে দেখে মনে হলো, সে ভীষণ বিরক্ত। ফলে আমার জন্যে একটা সুযোগ হলো, ভাবলাম, একসময়ে পরীক্ষিৎকেই সব জিজ্ঞাসা করব। তখন মনে হলো, পুলকেশ যে ফিরে এসেছে তার কারণ, নন্দিতা দুই চারদিনে খুলনা যেতে পারছে না তাই। নয়তো, আজ যেত অথবা কাল। পরশু থেকে তো কলেজ। বিএল কলেজ নিয়েই নন্দিতার সঙ্গে কথা হলো। এমনিতে নন্দিতাও তো আচরণে কোথাও কিছু বুঝতে দেবে না। তবু যত চেষ্টা করি ভিতরের অস্বস্তি তো কোনো ভাবেই যায় না।

শাঁখা-পলা হাতে, কপালে ও সিঁথিতে সিঁদুর পরা আমাকে দেখে লুৎফা-মর্জিনা ও সুলতার খুশি ছিল চোখে পড়ার মতো। বিয়ের আগে কদিনই-বা ক্লাস হয়েছে। শহরের দিকের মেয়েদের কারও সঙ্গেই তেমন ভাব হয়নি। তবু আমাকে দেখতে একটু নতুনই লাগছে। কেউ কেউ তাই জেচে এসে কথা বলল। শুধু একজন এসে বলল, ‘তুমি সুধন্য রায়ের ভাইঝি না?’ আমি তার দিকে তাকালাম। একেবারে এভাবে জানতে চাইল? তারপর আমার নামও বলল। আমি তার দিকে অবাক তাকিয়ে থাকায় সে তার নাম বলল, পাপড়ি। শওকতকাকু তার মামা। পাপড়ি তার মার কাছে শুনেছে আমার কথা। যাক, তবু ক্লাসে একজন পাওয়া গেল যে ছোটকারকে চেনে। আমার কাকার মতো তার মামাও দেশরক্ষা আইনে বন্দি। কিন্তু জয়ন্তীদির কাছে শোনা সেই যে রোজি নামটা। যার সঙ্গে পার্টির নির্দেশে শওকতকাকুর বিয়ে হয়েছে, সেকথা তখন জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না। শুধু ভাবলাম পরে কখনো। তখন জানতে চাইলাম, খুলনার নতুন খবর ও কিছু জানে কি না? পাপড়ি বলল, না। তবে চালান কনফার্ম! মনে হল, জয়ন্তীদি যদি একবার আসত কলেজে। তবু সেই মুখখানা দেখলে ছোট্কাকে নিয়ে দুকথা বলা যেত।

পাপড়ি বলেছে, সে আমার ছোটকারকে অনেক আগে থেকেই চেনে। শওকতকাকুর সঙ্গে কোনো কোনো রাতে তাদের খারদ্বারের বাড়িতে এসেছে। এসেই চা চাইত। চা বানাত পাপড়ি। তারপর দুজনে পিছনের দিকের ঘরে কী সব আলোচনা করত। কোনো রাতেই সকাল হওয়ার আগে তারা ঘুমাত না। শুনতে শুনতে আমি ছোটকারকেই ভাবছিলাম। এ দেখি অন্য ছোটকার। শহরে ভোর হওয়ার আগে কেন ঘুমাত না বুঝতে একটু সময় লাগল। পরে বুঝলাম, রাতে পুলিশ আসতে পারে, তাই। ভোর হলে বাড়ির লোকজন জাগলে, তখন তাদের সঙ্গে পুলিশের কথা হবে। সেই ফাঁকে পিছন দিকের বাগান হয়ে সাহাপাড়ার ভিতর দিয়ে একদিক না একদিকে চলে যেতে পারবে।

এক ফাঁকে, অন্য বান্ধবীদের মাঝখানে পাপড়ি শুধু বলল, তোমার সাথে কথা আছে। ফোর্থ পিরিয়ডের পর সে পিসি রায়ের মূর্তির সামনের গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমি যেন কমন রুম থেকে একলা তার কাছে যাই। আমি ফোর্থ পিরিয়ডের পরে লেডিস কমনরুম থেকে তাকিয়ে থাকি।

না, পাপড়ি নেই। একবার ওইদিকে পোস্ট অফিসের কাছে যাই। না, তখনও আসে না। সেদিন পাপড়ি আসেনি।

শ্বশুরবাড়ি ফিরতে ফিরতে আমার একটু খটকা লাগল। কেন পাপড়ি এসে এভাবে নিজের পরিচয় দিলো? ওভাবে ছোট্কার ও শওকতকাকুর কথা বলল? আর কথা আছে বলে পিসির রায়ের মূর্তির সামনের গেটে দাঁড়াতেই-বা বলল? একবার ভাবি, সুলতাকে একথা বলি। একবার ভাবি, না বলব না।

যাত্রাপুর স্টেশনে নেমে দেখি পরীক্ষিৎ আমার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে। দেওর এসেছে আমাকে নিতে তাই দেখে মর্জিনা হেসে কুটিকুটি। বলল, ‘ওতো কইচেই ওরে আনতি রাম যায় না কোথাও, সবখানে পাহারাদার লক্ষ্মণ!’ আমরা হাসলাম।

ভ্যানে উঠে পাপড়ির কথাটা পরীক্ষিৎকে বললাম। পরীক্ষিৎ বলল, ‘মনে হয় ছোটতালইর কোনো বিষয় বলবে, সেই জন্যি একলা দাঁড়াতি কইচে।’ শুনে, আমার মুখটা মলিন হয়ে গেল। ছোটকার আবার কী হলো। যা হওয়ার তো হইচেই। আর কী? পরীক্ষিৎকে তাও বললাম। ও বলল, ওরা খারদ্বারের বনেদিবাড়ির মেয়ে। শওকতসাবের মতন নেতার ভাগনি। খালি খালি তোমারে দাঁড়ায়াইয়ে থাকতি কওয়ার মানুষ না।’

কলেজ মিছিল হয়েছে দশ দলের। খুলনা জেলের ঘটনা নিয়ে কোনো কোনো ছাত্রনেতা বক্তৃতাও দিয়েছে। কেউকেই চিনি না। মাহমুদকে দেখেছি। দূর থেকে। আমি এখন তো আর ছোটকার ভাইঝি শুধু নেই, ওই মিছিলে যাওয়ার যত ইচ্ছেই থাক আমার, একবাড়ির বউ হিসেবে সেখানে চাইলেই তো যেতে পারি না। তাছাড়া সারা গায়ে নতুন বউর ছাপ। হিন্দুর মেয়ে আমি। বাবার সরকারি প্রাইমারিতে চাকরি আর ছোটকার জেলে। আমার হাতপা কত দিক দিয়েই আটকানো। যদিও সেই মিছিলেও পাপড়িকে দেখিনি। ইচ্ছে হচ্ছিল মাহমুদের সাথে কথা কই। সায়েন্স বিল্ডিঙের দিকে যাব যাব করেও যাইনি। কে কী ভাববে। আমাকে কিছু বলার থাকলে মাহমুদ নিশ্চয়ই খুঁজে বের করত।

আর, আর্টস বিল্ডিঙের সামনে মাঠের দেয়ালে বড়ো করে লেখা : খুলনা জেলের হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।

পরীক্ষিৎ হয়তো ঠিকই বলেছে। পাপড়ি হয়তো ভুলে গেছিল। আর নয়, পরে বলবে। হয়তো কাল বা পরশু। অথবা কোনো দিনও বলবে না আর। পরীক্ষিৎ বলল, ‘এ নিয়ে আর কেউর সাথে কথা বলার দরকার নেই।’

আমি ওর সঙ্গে রসিকতা করলাম, ‘আমার যেন কতজন কথা বলার মানুষ আছে?’

পরদিন পাপড়িকে ক্লাসে দেখলাম। ও আমাকে প্রায় না চেনার ভাব করছে। পরে একসময় কাছে এল। তখন আমি একলাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে। বলল, আজ লজিক ক্লাসে একটু পরে ঢুকতে। আমি তাই করলাম। ক্লাসের আগে কমনরুমে বসে মর্জিনাকে বললাম, একটু পরে ক্লাসে যাব। ওরা যেন যায়। স্যার আসলেনও একটু দেরি করে। আমি ওদের সঙ্গে বসে থাকলাম। পাপড়িও তাই। স্যার এলে পাপড়ি ওদের সঙ্গে বেরিয়ে যাওয়ার সময় হাতটা পিছনে নিয়ে আমাকে আসতে ইশারা করল। খেয়াল করলাম, স্যারের পিছন পিছন সবাই ক্লাসে ঢুকতেই পাপড়ি এই লম্বা একতলা কলাভবনের বারান্দা ধরে এগিয়ে গেল। অর্ধেক যাওয়ার পরে ডানে ঘুরে গিয়ে দাঁড়াল পোস্ট অফিসের রুমটার সামনে। সেখানে উলটো দিক থেকে বেশ লম্বা ফরসা একজন লোক এসে দাঁড়াল। আমি গুটিগুটি পায়ে ভীষণ শংকা আর সংকোচ নিয়ে এগোচ্ছিলাম। পাপড়ি লোকটার সামনে দাঁড়াতেই একটু হলেও অনুমান করতে পারলাম কেন পাপড়ির এমন গোপনীয়তা। এই লোকটা নিশ্চয়ই ছোটকার দলের কেউ। কাছে যেতে পাপড়ি বলল, ‘ইনি বাচ্চুভাই। ফোর্থ ইয়ারের ছাত্র। অনার্স পড়তেন। বাদ দিয়েছেন।’

লোকটা, অর্থাৎ বাচ্চুভাই বললেন, ‘তুমি সুধন্যদার ভাইঝি, পাপড়ি বলেছে।’ ভীষণ সুন্দর গলা। মুখে অনেক দিনের না-কামানো দাড়ি। চোখ কোঠরে বসে গেছে। কতদিন যে ঘুমায় না।

আমি আদাব দিতে হাত তুললাম। ভাবছি ভাই ডাকব না কাকা। পাপড়ি তাকে ভাই-ই ডাকছে। তার কথা শেষ হতেই পাপড়ি বলল, ‘এখন আমাদের কাছে উনি হোসেনভাই। বাচ্চুভাই না। ও নাম মুখে আনব না।’

শুনে, বাচ্চুভাই মলিন অথচ রহস্যজনক হাসলেন। হোসেনভাই বললেন, ‘বাকি সব পাপড়ির কাছ থেকে জেনে নিও। এখন তোমরা ক্লাসে যাও।’ বলেই পোস্টঅফিসে ঢুকলেন।

পাপড়ির সঙ্গে ক্লাসের দিকে এগোলাম। ও বলল, ‘সুধন্যমামার সব খবর হোসেনভাইর কাছ থেকে পাবি।’ এই প্রথম পাপড়ি আমাকে তুই করে বলল, ‘আর নয় উনি মাহমুদকে দিয়ে জানাবেন।’

জানতে চাইলাম, ‘ওনার বাড়ি কোথায়?’

পাপড়ি বলল, ‘কী দরকার তোর?’ বলে হাসল, ‘রণবিজয়পুর।’ মনে হলো পাপড়ি ঠিক বলেনি।

এদিন কলেজ থেকে ফিরে পাপড়ি আর হোসেনভাইর বিষয়টা পরীক্ষিৎকে বললাম। আমার তো আর কাউকে কিছু বলার নেই। পুলকেশ তো আমার কোনোকিছুই জানতে চায় না। তার এ নিয়ে কোনো আগ্রহও নেই। এই যে কলেজে যাই আমি এতে তার কিছু বলার নেই, না গেলেও যেন তার কিছু যায় আসে না। বাজারের দোকানে যাওয়ার আগে অথবা আগের দিন রাতে আমাকে হাত ও পথ খরচের টাকা সাধে। আমি বলি, এখনো টাকা কিছু আছে আমার কাছে। লাগলে চাব। তবু সে তার দায়িত্ব পালন করে। এতেই আমি খুশি। অন্তত এইটুকু যে ভেবেছে। বেশিরভাগই দিনই তো পরীক্ষিৎ আমাকে স্টেশন থেকে আনতে যায়, অথবা বাড়ি থেকে বেরনো পরে, ভ্যান ঠিক করে দেয় বড়ো রাস্তার মুখে যেয়ে। অথবা এগিয়ে দিয়ে আসে সুলতার বাড়ি পর্যন্ত।

হোসেনভাইর কথা বলতেই পরীক্ষিৎ বলল, ‘এইসব পার্টির কত গোপনীয়তা। ওদিকে এখন আছে আরও চাপে। যাক ছোটতালইর খবর তা’লি কিছু পাবা।’

আমার একটু আশা হয়। কতদিন ছোটকার খবর পাই না। মাঝখানে রবিবার আমার বইপত্র নিয়ে বিভাস এসেছিল। ও তখন কিছু বলতে পারেনি। ঢাকায় চালান হয়েছে কি হয়নি, জানে না। ও জানে না মানে বাবাও জানে না। রথীনদা খবরটা দিয়ে গিয়েছিল। তবে এখনো কাউকে দেখা করতে দিচ্ছে না।

এদিন সারাটা সন্ধ্যা আমার ছোটকার মুখ মনে পড়ে বারবার।

জেলের ওই ঘটনার পর এখন না জানি কেমন আছে। হয়তো আর শুকিয়েছে। চোয়াল বসে গেছে। মুখময় দাড়িভর্তি ছোটকার সেই মুখখানা কল্পনায় দেখতে দেখতে আমার চোখে জল আসে। শাশুড়ি তা দেখে ফেলে বললেন, ‘আর চোখের জল ফেলাইও না, বউমা! কী করবা কও?’ তারপর বিড়বিড় করেলেন, ‘শুনিচি উনি তোমার কাছে বাপের চাইতেও বেশি। কত কষ্টে আছে তোমার খুড়োমশাই। ভাবলি আমারও কীরাম জানি লাগে।’

শাশুড়ি মানুষটা রাশভারি। শ্বশুরমশাইর উপরও ছড়ি ঘোরান। কিন্তু আগেও দেখেছি, এবারও বুঝলাম অন্তরে তার মায়াদয়া খুব। সেই মার ছেলে পুলকেশ, কিন্তু তাকে কোনো কোনো সময় মনে হয়, একেবারে ঠান্ডামাথার খুনি। যেন ওই চোখের ভিতরেও আমার জন্যে কোনো দয়া নেই। যা করে তা লোকদেখানো। কর্তব্যের খাতিরে।

সিদ্ধান্ত নিলাম, যা জানি সব বলব পুলকেশকে। কথাটা পেটে গুমরালেও মুখে আনতে পারছিলাম না। তবু ঠিক যখন করেছি বলবই।

দুদিন বাদে পাপড়ি জানাল, ‘বারোটার দিকে যেন ওর সঙ্গে কলেজ স্টেশনে যাই।’ আমি ভেবেছি ও মনে হয় কলেজ স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠে বাগেরহাট স্টেশনে যাবে। তারপর সেই ট্রেন আবার রূপসার দিকে ছাড়লে আমি নামব যাত্রাপুর। তাহলে সুলতা আর মর্জিনাকে বলে যাব। ওরা যেন কলেজ স্টেশনে ফিরতি ট্রেন আসলে ওঠে লেডিস কম্পার্টমেন্টে। আমি সিট রাখব। সেকথা পাপড়িকে জানালে বলল, না। অন্য কাজ। আমরা আবার কলেজে আসব। কিন্তু সুলতা আর মর্জিনাকে না-জানিয়ে কীভাবে স্টেশনে যাব তা বুঝে পেলাম না। হাতঘড়ির দিকে দেখি। বারোটায় পৌরনীতি ক্লাস।

সে ব্যবস্থা অবশ্য পাপড়ি করল। হঠাৎ আমাকে এমনভাবে ডাকল যেন খুব দরকার। মর্জিনাকে বলল, ‘তোরা ক্লাসে যা। আমি ওরে নিয়ে একটু দেবপ্রসাদ স্যারের সঙ্গে দেখা করে আসি। আব্বা কইচেন।’

প্রিন্সিপাল স্যারের অফিসের সামনে দিয়ে পাপড়ি আমাকে বিজ্ঞানভবনের দিকে নিয়ে গেল। সেখান থেকে সুখ সরোবরের পাশ ধরে স্টেশনের দিকে। স্টেশনে ঢোকার আগে ক্যান্টিন থেকে সিঙ্গারা কিনল। কিন্তু ভিতরে ঢুকল না। ভিতরে পাপড়ির পরিচিত অনেকেই আছে। নিচুগলায় আমাকে তা বলল। তারপর একদিকের দরজার কাছে টেবিলের উপর থেকে দুই গেলাস জল এনে, একটা গেলাস আমায় দিল। জলে ঠোঁট দিয়েই উঠিয়ে বলল, ছাত্রদলের সবগুলো এই জায়গায়। সামনে ডাকসু তো সব জায়গায় তৎপরতা বাড়িচে ওগে।’

পাপড়ি ভীষণ চটপটে। বুদ্ধিমান। কতকিছু জানে। ওর সাথে থাকলে আমার নিজেরে বোকা বোকা লাগে। এই যে কীভাবে আমাকে ট্রেনস্টেশনে নিয়ে আসল। প্লাটফর্মে হাঁটছে ষাটগম্বুজ স্টেশনের দিকে মুখ করে। যেন সেদিক থেকে ট্রেন আসলে একেবারে পিছনের দিকে উঠবে। যাতে বাগেরহাট স্টেশনে নেমে দ্রুত বেরিয়ে আসতে পারি। বার কয়েক এ মাথা ও মাথা আর ছাউনির কাছে দাঁড়াতেই ওদিকে থেকে ট্রেন এল। তখন পাপড়ি আমাকে নিয়ে প্লাটফর্মের সেই শেষ দিকেই গিয়ে দাঁড়াল। ট্রেনের গা থেকে একটু দূরে। সবাই নামলে তারপর উঠবে এমন ভাব। নামলও সবাই। ট্রেনের শেষ মাথায় লোক কম। সবাই নেমে সামনের দিকে হাঁটছে। হঠাৎ নামলেন হোসেনভাই। পাপড়িকে দেখেই বললেন, ‘বাসায় ফিরছ? দাঁড়াও। তোমার পৌরনীতি বইটা কাল আনতে বলেছিলে। আমার আর বাগেরহাট শহরে যাওয়া হয়নি। কাল খুলনা গেছিলাম। ওখান আমার এক বড়ো ভাই প্রফেসর, ওর স্পেশিমেন্ট কপিটাই নিয়ে এলাম।’ বুঝলাম এত বৃত্তান্ত বলার কারণ, কাছের লোকদের সরে যাওয়ার সময় নেওয়া। পাপড়ি, ‘আচ্ছা, আচ্ছা’ বলে বইটা হাতে নিতে হোসেনভাই এগিয়ে গেলেন। আমরা যেন ট্রেনে উঠব, পাপড়ি বইটা ঠিক আছে কি না দেখছে। না, ঠিক আছে। হোসেনভাই প্লাটফর্মের ওই মাথায়। ট্রেনের হুইসেল দিল। বললাম, ‘উঠবি, পাপড়ি?’

ট্রেন ধীরে ধীরে গতি নিচ্ছে। পাপড়ি সেই তালে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘তুই ওঠ্। বদল নাকি তুই? গাধি জানি কোয়ানকোর?’

কিছুই বুঝলাম না। কী হলো। ট্রেন চলে যাচ্ছে। আমি আর পাপড়ি স্টেশনের মাঝখানের পথ দিয়ে আবার কলেজ ক্যান্টিনের সামনে এলাম। হোসেনভাই ক্যান্টিনে। আমাদের দেখছেন না। অথবা, দেখলেও দেখছেন না। তার দলের কর্মীদের সঙ্গে বসেছেন হয়তো। আমরা সুখ সরোবরের পার ধরে হাঁটতে হাঁটতে সায়েন্স বিল্ডিংয়ের দিকে এগোলাম। প্রিন্সিপালস্যারের বাংলোর আড়ালে এখন কলাভবন। পাপড়ি তখন বুকের কাছে ধরা বই ও নোট খাতা থেকে হোসেনভাইর দেওয়া বইটা বের করল। হাতের অন্য একটা বই ও নোট খাতাটা আমাকে দিয়ে খুলল পৌরনীতি বইটা। দুটো হলদে খাম। আঠা দিয়ে মুখ লাগানো। পাপড়ি খামের ওপরে নাম দুটো পড়ল। প্রথমটায় লেখা : সৈয়দা শামায়লা নাসরীন। দ্বিতীয়টায় : মোছাম্মৎ নুবেয়রা খাতুন। দ্বিতীয়টা খামটা পাপড়ি আমার হাতে দিলো। একপলক দেখলাম শুধু। পাপড়ি বলল, ‘বুকে বই চাপা অবস্থায় ব্লাউজের মদ্যি ঢুকো।’ তাই করলাম। বিস্ময় তখনও কাটেনি।

সায়েন্স বিল্ডিং বাঁয়ে রেখে আবার কলাভবনের দিকে আসতে আসতে পাপড়িকে জিজ্ঞাসা কলরাম, ‘ঘটনা কী? কার খাম আমারে দিলি?’

‘অত বোঝার দরকার নেই। বাড়ি যাইয়ে খুইলে পড়িস।’

তবু আমি নাছোড়। জানতে চাইলাম, ‘ক’লি কী হইচে [বললে কী হয়]?’

‘আমার ভালো নাম জানিস? মীর শায়লা নাসির। ওখানে লেখা সৈয়দা শামায়লা নাসরীন। তোর নাম এট্টু বাড়াইচে। কিন্ত মূলটা ঠিক আছে।’

আমি তখনও বুঝি না। বিস্ময়ে তাকাই পাপড়ির দিকে। বলল, ‘কী নুবেয়রা খাতুন আছে না? নুবেয়রা মানে বেণু রায়। ছাগলের ছাগল। নামটা উলটো কইরে দেখ।’

আমি হেসে উঠলাম। অনেক দিন পরে হাসলাম।

সত্যি ছোটকার চিঠি! আগে একটা এসেছিল কলেজের ঠিকানায়। কিন্তু এভাবে তো আসেনি। তখন সময়ও এত খারাপ ছিল না। আমি চিঠিটা খুলে খাতার পাতা ছেঁড়া অর্ধেক কাগজটা সামনে মেলে ধরে হাসি, চোখের একদম সামনে এনে চোখে চেপে ধরি খুশিতে। ভাবি পরীক্ষিৎকে বলব, কীভাবে চিঠিটা আমার হাতে এসেছে। কিন্তু তখনও পড়তে শুরু করিনি।

চিঠির উপরে আমার নাম লেখা নেই। তারিখও নেই। কিন্তু প্রথম লাইনেই লেখা, এই প্রায় দিন দশেক কিসের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি বুঝতেই পারছিস। যে কোনো দিন চালান হয়ে যাব। এরপর বিচার। জানি না কী হবে।

এরপর, আমি নিশ্চয়ই ভালো আছি। আমার লেখাপড়ার কথা। এই বাড়িতে কেমন আছি। আর আমাদের বাড়িতে যদি পারি যেন জানাই। পড়া হলে চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলার কথা। নিচে আর কিছু লেখা নেই। কিন্তু হাতের লেখা তো বলে এ চিঠি আমাকে লিখেছে ছোটকার।

ওই জায়গাটা পড়তেই গিয়ে চোখ সরছিল না। আমি আবার কেমন আছি। ভাবলাম, যদি কোনো দিন দেখা হয় তখন দেইখো ছোটকার তোমার খুকি কেমন আছে। যদি কোনো দিন সুযোগ হয়, তোমারেই জানাব ছোটকার। আর, পড়ালেখা? ভাইব না। আমি করব। করব, শুধু তোমার মুখের দিকে চেয়ে।

কতবার যে পড়লাম। কতবার যে একথা ভাবলাম তার ইয়ত্তা নেই। মনে মনে পরীক্ষিৎকে খুঁজলাম। ওকে অন্তত বলব কীভাবে পাপড়ি চিঠিখানা আমার হাতে দিয়েছে। এইসব আমার কাছে বিস্ময়ের। অথচ পাপড়ি কত স্বাভাবিকভাবে কাজটা করল। এভাবে পারতাম না আমি। লেজেগোবরে হয়ে যেত। ওরা শহরের মেয়ে। রাজনীতি করা বাড়ির মেয়ে। মামাবাড়ির দিকের সবাই রাজনীতি সচেতন।

না, চিঠিটা ছিঁড়ব না। চুলোয়ও দিয়ে দেবো না। কোথায় যে রাখব তাও জানি না। তবে ছোটকার লেখাটা নিজে এক জায়গায় টুকে রাখব। যেন বিলাসী গল্পের উত্তরের ভিতরে এই কয়টা কথা। তারপর, চিঠিটাখানা হারালেও কথা কয়টা তো থেকে যাবে। কিন্তু তার আগে, পরীক্ষিৎকে দেখাব। না, পরীক্ষিৎকে খাতার লেখাটা দেখাব।

তাই করলাম। বিলাসী গল্প নিয়ে স্যারের লেকচারের যা লিখেছিলাম, তাই খাতার অন্য জায়গায় অনেকখানিক লিখলাম। তারপর ছোটকার চিঠিটা দেখে টুকলাম। সাত আট লাইনই তো। তারপর আবার স্যারের লেকচার। লেখা হলে বুঝে পেলাম না, আমার মাথায় এত বুদ্ধি এল কোথা থেকে। চিঠিটা একটা চৌকাঠের খুঁটির উপরের আড়াবাতার ফাঁকে গুঁজে রেখে দিলাম!

সন্ধ্যার পরপর লাউফলা বাজার থেকে পরীক্ষিৎ ফিরলে ওকে বললাম সবটা। আমার চোখের দিকে পরীক্ষিৎ এমনভাবে তাকাল যেন বিস্মিত।

খাতা খুলে পড়ে শোনালাম। চিঠিটা কোথায় ও জানতে চাইল। বললাম, ‘এখনো আছে। ছিঁড়িনি।’

পরীক্ষিৎ বলল, ‘এইবার তুমি আসলেই সুধন্য রায়ের ভাইঝি।’ কিন্তু এরপর ও যা বলল, তা শুনে আমি আর ওই কথার আহ্লাদে থাকলাম কই? সে জানাল, ‘দাদা এট্টু আগে খুলনা গোইচে। কাইল পরশু থাকপে। এই জন্যি বাবার বাজারদে আসতি দেরি হবে।’

আমি শুধু বললাম, ‘ও-ও। আচ্ছা।’

‘তোমার দেহি কোনো প্রতিক্রিয়া নেই?’

‘কী কব, কও? আইজ সকালে কিন্তু আমারে কিছু কইনি যে খুলনা যাবে। তাও এই সন্ধ্যার ট্রেনে। কেন হঠাৎ?’

‘মনে হয়, কোনো কাজে। আগের বার যাইয়ে তো সব কাজ সারতি পারিনি।’

মনে হলো, পরীক্ষিৎ তার কথায় কোনো ইঙ্গিত দিচ্ছে। আমি বুঝেও না বোঝার ভান করলাম। শুধু বললাম, ‘কাইলকে কলেজ দিয়ে আমারে আনতি যা’তি পারবা?’

‘পারব। কলেজে যা’তি পারব না। আমি যাত্রাপুর স্টেশনে থাকপ।’

‘তা’লিই হবে।’

এদিন কলেজে গেলে পাপড়ি আমাকে চেনে না। কিন্তু পৌরনীতি ক্লাসে সামনের বেঞ্চি থেকে আমাকে একটা চিরকুট দিল। ছড়া লেখা :

নগর রাষ্ট্র নগর রাষ্ট্র

মহাদুর্ভোগ অতি কষ্ট,

ঝালমুড়িতে ভীষণ ঝাল

উত্তর দিস পরশু বা কাল।

পড়লাম। মর্জিনাকে দেখালাম। ও বলল, ‘পাপড়ি যে কী ফাজিল!’

বললাম, ‘হুঁ।’ আমি কিন্তু বুঝলাম পাপড়ি কী লিখেছে। খাতার কোনা ছিঁড়ে লিখলাম : চিঠি লিখিব নিশিরাতে লন্ঠন জ্বালাইয়া! মর্জিনাকে দিলাম। ও পড়ে হাসল। পাঠাল সামনে। পাপড়ি হাতে পেয়ে একবার ফিরল আমার দিকে। চোখে অনুমোদন। লেকচার শোনায় মন দিলো।

ক্লাস থেকে বেরিয়ে লেডিস কমনরুমের দিকে যেতে যেতে পাপড়ি আমাকে পাশ থেকে জানাল, ‘নাম ধাম লিখিস না। দরকারে বাম হাতে লিখিস। আমার কাছে প্রেমপত্র লিখবি তো। বর দেখলি খবর আছে।’

আমি যেন শুনছি না। তবু ওর বলা শেষ হলে মাথা কাৎ করলাম। খুঁজলাম মাহমুদকে। যদি এদিকে আসে। না হলে একবার সায়েন্স বিল্ডিঙের দিকে যাব। গেলামও। মাহমুদকে পেলাম না। কলেজ মাঠে ক্রিকেট খেলা শুরু হয়েছে। সেখানে একপাশে অনেকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে মাহমুদ। সুখ সরোবরের পাশে। সুলতাকে বললাম, ‘চল্ ক্যান্টিনের দিকে যাই। সিংগারা খাব।’

সুলতা অবাক। বলল, ‘খাওয়াবি?’

বললাম, ‘হুঁ’। পতিদেব হাতখরচ দিচে। তা খরচ করা লাগবে না?’

আসল উদ্দেশ্য মাহমুদকে বলা যে ছোটকার খবর পেয়েছি। ও যেন আমার মাকে গিয়ে বলে ছোটকার ভালো আছে।

আমরা প্রিন্সিপাল স্যারের বাংলোর সামনে দিয়ে যেতে যেতে দেখি মাহমুদ অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। সুলতাকে বললাম, ‘তুই আর মর্জিনা ক্যান্টিনের দিকে যা। আমি মাহমুদভাইকে একটা কথা বলে আসছি।’

সুখ সরোবরের পুব পার ধরে এগোতে এগোতে টিনের ছোট্ট প্যাভিলিয়নে দেখলাম হোসেনভাইকে। চিনল না আমাকে। একটু এগিয়ে মাহমুদকে পেলাম। অনেকের সঙ্গে। আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম যেন চোখে পড়ি। এতগুলোর ছেলের কাছাকাছি একটি মেয়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, হোসেনভাই আমাকে দেখছে। দেখল মাহমুদও। সে এগিয়ে আসতেই বললাম, ‘ছোটকার একটু খবর পাইছি। আছে ভালো। চালান দেবে। এট্টু মারে কইয়ে আইসেন। গেলাম।’

মাহমুদ জানতে চাইল, ‘কে দিলো?’

‘তা পরে কোনো দিন কব।’

মাহমুদ হাসল। হাসিতে বোঝা গেল, আমার যে এই বুদ্ধি হয়েছে সেই অনুমোদন।

সিংগারা খেতে খেতে সুলতাকে বললাম, ‘আইজকে আর ক্লাস করব না।’

‘তা’লি কী করবি?’

‘জানি না।’

মর্জিনা বলল, ‘বাড়ি যাবি? দেওর দাঁড়াইয়ে রইচে স্টেশনে?’

লুৎফা জোরে হোসে উঠল, ‘দেখতি কিন্তু দারুণ!’

সুলতা বলল, ‘দাদাবাবুও দেকতি দারুণ!’

মর্জিনা বলল, ‘দুই ভাই-ই সুন্দর।’

আমি কিছুই বললাম না। ওদের কথায় তাল মিলিয়ে হাসলাম শুধু। আর ভাবছিলাম, হুঁ, স্টেশনে আমাকে নিতে অসবে পরীক্ষিৎ। ওকে সব জিজ্ঞাসা করব।

কিন্তু যাত্রাপুর স্টেশনে নেমে দেখি পরীক্ষিৎ নেই। সুলতার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকি। ওর দেরি হয়ে যাচ্ছে। ওর বাড়ি থেকে ট্রেনের হুইসেলের শব্দ স্পষ্ট শোনা যায়। এই ট্রেনেই প্রতিদিন ও ফেরে, এখন যদি দেরি করে যায় তাহলে বাড়ি গিয়ে কী বলবে। ওর উশখুশ অবস্থা দেখে তা বুঝতে পারলাম। তাই ওকে বললাম চলে যেতে। কিন্তু সুলতা এমন ফাঁকা স্টেশনে আমাকে একলা রেখে যেতেও চাইছে না। সেদিন রূপসার দিকে ট্রেনটা চলে যাওয়ার পরে স্টেশনটা খুব ফাঁকা লেগেছিল। অমন হঠাৎ ফাঁকা হয়ে যাওয়া স্টেশন আগে দেখিনি। সুযোগও ছিল না। ট্রেন থেকে নেমে বাইরে এসেছি সব সময়। এমন তো দাঁড়িয়ে থাকিনি। যেন পরের ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করছি। সেটা আসবে অন্তত ঘণ্টা দেড়েক বাদে। ততক্ষণে বিকাল প্রায় সন্ধ্যার দিকে গড়িয়ে যাবে। সুলতাকে চলে যেতে বললাম। ও বলল, ওর সঙ্গে যেতে। একটু গেলে পথে কোনো পরিচিত ভ্যান পেলে আমাকে তুলে দেবে। আর নয় ওর ছোটভাইকে দিয়ে ভ্যান আনাবে বটতলা বাজার থেকে। এখানে এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব আমরা।

যুক্তি মন্দ নয়। সুলতার বাড়ির দিকে একটু এগোতেই হঠাৎ পরীক্ষিৎ সাইকেলে এসে হাজির। পরীক্ষিৎ স্টেশন আসার কথা ভুলে গেছিল। আড়তে ছিল একাই। ট্রেনের হুইসেল শুনে মনে পড়েছে। এক খদ্দেরের সাইকেল নিয়ে এসেছে। ওর সাইকেল বাড়িতে। ইচ্ছে করেই আনেনি। ভেবেছে আমাকে নিয়ে তো ভ্যানেই ফিরতে হবে। এখন তো সেই সাইকেলেই ফিরতে হচ্ছে। কিন্তু আমাকে তো আর সাইকেলের সামনে বসিয়ে নিতে পারবে না।

সুলতা পরীক্ষিৎকে আসতে দেখে বলল, ‘ওই যে তোর বডি গার্ড আইচে। একজন গেইচে খুলনা তো কী আর একজন সব সময় হাজির।’

ভাবলাম, সেই একজন একবারও খোঁজও নেয়নি। নেবেও না। বুঝে গেছি। আমিও ভাবি না। ভাবব না।

পরীক্ষিতের সাইকেলের সামনে ওঠা ঠিক হবে। কেউ দেখলে কী ভাববে। ও চিন্তা না থাকলে পরীক্ষিৎকে বলতাম, তোমার সাইকেলের সামনে বসি। সুলতাকে বাড়ির সামনে দিয়ে আমরা হাঁটতে থাকলাম। আমি রাস্তার বাম দিকে। পরীক্ষিৎ আমার ডানে। দুই হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে হাঁটছে। আমি হঠাৎ, না হঠাৎ না, সেই সকাল থেকে বা কাল থেকে প্রস্তুতি নেওয়ায় সব সাহস এক জায়গায় জড়ো করলাম। টের পেলাম আমি যেন একটু শক্ত হয়ে যাচ্ছি। তবু আমাকে বলতে হবে। সামনে দেখলাম। কেউ নেই। ডান হাতটা বাড়িয়ে সাইকেলের হ্যান্ডেলের ধরা পরীক্ষিতের বাম হাতের উপরে রাখলাম। পরীক্ষিৎ গাঢ় চোখে তাকাল আমার দিকে। বুঝতে পারছে আমার ভিতরে কোনো তোলপাড়া হচ্ছে। আমি হাতটা সরলাম না। বললাম, ‘এট্টা কথা কবা? সত্যি কবা? কও?’

পরীক্ষিৎ সামনে তাকিয়েছিল। আমি ওর হাত থেকে হাতটা সরালাম। এইমাত্র আবার ও আমার চোখে তাকাল। একটু যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছে। কী বলব, হয়তো বুঝতে পারছে। অথবা বুঝলেও আমি এইভাবে জানতে চাব তা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। ভাববার কথাও নয়। যেন খাবি খাওয়া গলায় বলল, ‘কও। কী কবা?’ বলে, বিষয়টা একটু সহজ করল, ‘আমারে এত আঁটগাঁট বাইন্দে কওয়া লাগে?’

কথাটা তো আমার ঠোঁটেই ছিল, ওর বলা শেষ হওয়ামাত্র বললাম, ‘ওই নন্দিতার সাথে তোমার দাদার সম্পর্ক, না?’ আমি সম্পর্কের জায়গায় রমাদির মুখে যেমন শুনেছি সেভাবে লাইন কথাটা বলতে চাইছিলাম। মুখে আটকাল। শত হলেও স্বামী, বলছি দেওরকে। ইয়ার্কি তো মারছি না।

পরীক্ষিতের আমার দিকে তাকানো সেই চোখ আমি জীবনেও ভুলব না। ও যেন ভূত দেখছে। ও যেন হঠাৎ অন্ধকার থেকে আলোয় এসেছে। চোখ দুটো ফুটে বেরুচ্ছে। কী সুন্দর চোখজোড়া পরীক্ষিতের! অমন চোখে এই বিস্ময়! মুখে কোনো কথা বেরুচ্ছে না। একপলক তাকাল আমার মুখে। আমি যেন ষষ্ঠীর দিনে অল্পবয়সি মেয়ের প্রথম দেখা দুর্গাপ্রতিমা। কী দেখে পরীক্ষিৎ আমার মুখে। ওই থমমত খাওয়ার চোখে অস্ফুট স্বরে বলল, ‘হুঁ। তুমি জানলা কোয়নদে?’

‘হুঁ’ শুনেই, যতই আটকাতে চেষ্টা করি তবু আমার চোখে জল এসে গেল। কিন্তু ভিতরের জেদে তা সামলালাম। সালাতেই হবে। উপায় নেই। ছোটকার ভাইঝি আমি। না, আমি ছোটকার মেয়ে। না, আমি ছোটকার মা। ছোটকা পাভেল, জয়ন্তীদি নাতাশা, আমি ওদের মা। আমার এইটকু সাহস নেই? কতবারই তো কাল রাতে একলা বিছানায় শুয়ে ভেবেছি। ভগবান আছে কি না জানি না, ছোটকার আমার সাথে আছে। যতই জেলে থাকুক আর কাল বাদে পরশু কি যেকোনো দিন চালান হয়ে যাক।

পরীক্ষিৎকে এবার নিচুগলায় বললাম, ‘আর থাক। সে যেহানদে শুনি, আমি নিশ্চিত হলাম।’

পরীক্ষিতের দশায় পড়া অবস্থা কাটেনি। তবু আমি এ বিষয়ে কথা থামিয়ে দিয়েছি বলে মিনমিনে গলায় জানতে চাইল, ‘বললা না তুমি জানলা কোয়ানদে?’

‘সে জাইনে তোমার কাজ কী?’

‘কও না?’

‘না। তয় কাজটা তোমরা না তোমার দাদা আমার সাথে ভালো করিনি।’

পরীক্ষিৎ চুপ করে গেল। শুধু যেন বিড়বিড় করল, ‘সে তো ঠিকই।’

সেই থেকে আমার চোখভেজা। শাশুড়িকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। শ্বশুর ফিরবে রাতে। পরীক্ষিৎ আমায় বাড়িতে দিয়েই বাজারে চলে গেছে। আমি শাশুড়ির সামনে একটু যেন লুকিয়েই থাকি। যা জানার ছিল সব স্পষ্টতই জেনে গেছি। আর কী? বুঝেছি পুলকেশ কেন এক ঘনঘন খুলনায় যায়। কল্পনাও করেছি এখন সে খুলনায় কোথায় আছে। যদিও সে কল্পনা কি কোনো কূল পায়। খুলনা কত বড়ো শহর। কোথায় সেই দৌলতপুর বিএল কলেজ। কিছুই বলতে গেলে চিনি না আমি।

সন্ধ্যার পরে বই খাতা খুলে নিয়ে বসে প্রথমেই ছোটকার জন্য চিঠি লিখলাম। যে ইঙ্গিত দিয়েছে পাপড়ি সেভাবে। কোথাও কোনো সম্বোধন নেই। আমার কথাও ইঙ্গিতে। অথচ শুরুতে লিখতে ইচ্ছে হচ্ছিল : পরম পূজনীয় ছোট্কা, আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম নিও। কিন্তু সম্বোধনহীন চিঠিতে তা লেখার সুযোগ নেই। শেষে যে লিখব ইতি তোমার খুকি। তাও সম্ভব নয়। কিন্তু এটা জানলাম, মন দিয়ে পড়াশোনা করা চেষ্টা করছি। জানি এই একটা কথা থাকলেই ছোটকার খুশি। ঠাকুমার শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ শুনেছি। মর্জিনা বলেছে কাল। সেকথা লিখলাম। ছোট্কাকে লিখতে লিখতে ভাবলাম, দুয়েক দিনের ভিতরই একবার বাড়ি যাব ঠাকুমাকে দেখতে। কিন্তু পুলকেশ খুলনা থেকে না ফিরলে তা সম্ভবও নয়। কবে যে ফেরেন ভদ্রলোক। কেষ্ট ঠাকুর গেছেন বৃন্দাবন, দ্বারকার কথা তখন তার মনে না পড়াই স্বাভাবিক। ভেবে, একলা ঘরে হেসেছিলাম।

যদিও এসব ভেবে আমি নিজের ভিতরে একটু কূল পাচ্ছিলাম। এই যে একটা তীরহারা মানুষ আমি, ছোটকার ভাবনা, লেখাপড়ার কথা ভাবা, পাপড়ির কৌশল, হোসেনভাইর কায়দা আর কলেজে পিসি রায়ের মূর্তি। কলাভবনের সামনে খোলা চত্বরের সামনে ঢোকার আগে তাঁর ওই খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবি পরে দাঁড়ানো ভাস্কর্যের দাড়িভর্তি ছোট্ট মুখখানার দিকে তাকিয়ে আমার সাহস বাড়ে। যেমন বাড়ে ছোটকারকে ভেবে। খুলনা জেলের ঘটনায়ও যখন ছোটকার মরেনি, তাহলে ছোটকার জীবনে আর ফাঁড়া নেই। সব কেটে গেছে। চালান হোক, বিচার হোক, ছাড়া তো একদিন না একদিন পাবেই। আমি জানি, সেদিন কেউ আমার কাছে না থাকলেও ছোটকার আছে। ছোটকার আমায় পথ দেখাবে। ছেড়ে যাবে না। ছেলে যায় কখনো মাকে ছেড়ে। এ সব ভেবেও হাসলাম।

কী সব আকাশ পাতাল ভাবছি আমি। কী সব লিখছি এই খাতায়? নিজের পিছনে ফেলে আসা দিনের এসব কথার কি কারও কাছে কোনো গুরুত্ব আছে? তা ভেবে-বা কী লাভ।

বরং পরদিন ক্লাস শুরু হওয়ার আগে পাপড়িকে খুঁজে বের করলাম। ও তো সাধারণ লেডিস কমন রুমে ঢোকেই না। বলে, এটা নাকি মুরগির খোয়াড়। কিন্তু আমি কী করতে পারি। মানুষের কাছে দাগি নকশালবাড়ির মেয়ে আর একবাড়ির বউ। আমার পক্ষে তো পাপড়ির সঙ্গে তাল দিয়ে ড্যাংড্যাং করে ঘোরা সম্ভব নয়। বরং, সুলতা, মর্জিনা-লুৎফাই আমার আশ্রয়। এক স্কুলে পড়েছি আমরা। এখনো একসাথে।

পাপড়িকে পেয়েই বললাম, ‘এই যে কালকের পৌরনীতির নোট।’ এ খাতাটা নতুন। এক দিস্তা কাগজ দিয়ে বানিয়েছি। ভিতরের একটা পৃষ্ঠায় পলার সাথের সেপটিপিনটা খুলে তা দিয়ে ছোটকার কাছে লেখা চিঠিটা আটকে দিয়েছি। এখন যা করার পাপড়িই করবে। তবু ভাবলাম, এতে পাপড়ির কোনো বিপদ হবে না তো। শুনেছি কলেজে কত পদের টিকটিকি। আমাদের ক্লাসেও তো থাকতে পারে। আমার বা পাপড়ির দিকে ক্লাসেই কেউ হয়তো আলাদা করে নজর রাখে। শত হলেও সৈয়দ শওকত খান পাপড়ির মামা। যা হয় হবে। কী আর? পাপড়ির কাছ থেকে কেউ ওই খাতাটা নিয়ে চেক করবে। হাতের লেখা আমার ঠিকই। কিন্তু ছোটকারকে লিখছি তার কোনো প্রমাণ কোথাও ধরা পড়বে না। পাপড়ি সেভাবেই তো লিখতে বলেছে।

ফোর্থ পিরিয়ডের পরে আজও কলেজে বড়ো মিছিল হল। প্রথমে দশ দলের। আমার ক্লাস নেই। কমনরুমের সামনে দাঁড়িয়ে সেই বড়ো মিছিলটা দেখলাম। ঢাকায় ডাকসু নির্বাচন এগিয়ে আসছে। সর্বত্রই তৎপরতা। জাসদ ছাত্রলীগের মিছিল হয়েছে একটু আগে। তারপর ছাত্র ইউনিয়নের। তখন ক্লাসে ছিলাম। এরপর বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলের প্রথম দিকে কয়েক সারির পরেই দেখি মাহমুদকে। মিছিলটা আসছে বিজ্ঞানভবনের দিক থেকে। মাঠ ও কলাভাবনের মাঝখানের রাস্তা ধরে এগোচ্ছে। বাণিজ্যের ওদিকে যেয়ে ফিরে এই কলাভবনের করিডোর দিয়ে ধরে আসবে। এই মিছিলের শেষদিকে জয়ন্তীদি! আমি অবাক। কখন এল সে। একটু অভিমানও হলো, আমাকে একবার খোঁজও করল না? সঙ্গে সঙ্গে পড়েও গেল সে অভিমান। ওই তো জয়ন্তীদি। খোঁজ তো নাও নিতে পারে। আমার সাথে দেখা করার বিপদ তার ভালোই জানা আছে। হয়তো সেও আছে পুলিশের সন্দেহের চোখে। তবু মিছিলে এসেছে। কেমন আছে? মনে হলো, আমি ছুটে যাই ওই মিছিলের পিছনে। তা সম্ভব নয়। মিছিলটা কমার্স বিল্ডিং ঘুরে সরোজিনী লাইব্রেরির সামনে দিয়ে এদিকেই আসবে। ততক্ষণ জয়ন্তীদি মিছিলের সাথে হাঁটলে হয়।

একটু পরে মিছিলটা এদিকে আসতে আসতে, হঠাৎ বাঁয়ে ঘুরে গেল। এখন পোস্ট অফিসের সামনে কিছুক্ষণের সমাবেশ হবে। আমি এগিয়ে গেলাম করিডোর ধরে। সমাবেশের দিকে নিচের ছোটো মাঠটায় নামার আগে জয়ন্তীদি করিডোরেই দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখলেন, কিন্তু চোখে উচ্ছ্বাস নেই। কাছে যেতে বললেন, ‘ক্লাস না থাকলি ধীরে ধীরে ক্যান্টিনের দিকে যাও।’

সুলতার কাছে জানতে চাইলাম, ও যাবে কি না? যাবে না। মর্জিনা-লুৎফা ক্লাসে। একাই ধীরে হাটতে শুরু করলাম। সমাবেশে এখন মাহমুদের কাছেই পাপড়ি দাঁড়ানো। পাপড়ি যদি আসত। ধীরে প্রিন্সিপালের বাংলোর সামনে দিয়ে হাঁটতে থাকলাম। মাঠে ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। সুখ সরোবরের পাশে উঠতেই, পিছন ফিরে দেখলাম, আরও দুজন লোকের সাথে জয়ন্তীদি দ্রুত হেঁটে আসছে। আমি গতি কমালাম।

জয়ন্তীদি আমার কাছে আসতেই সেই দুজন তাকে বলল, ‘দিদি, আমরা ক্যান্টিনে আছি।’ জয়ন্তীদি কোনো উত্তর দিলেন না। আমার কাছে সরাসরি জানতে চাইলেন, ‘সুধন্যদার খবর তো শুনেছ?’

আমি তার দিকে তাকালাম। বলতে চাইছিলাম, কেমন আছেন। বলা হলো না। বরং জানালাম, ‘হুঁ।’

জয়ন্তীদি বললেন, ‘তোমাকে শেষমেশ বিয়েই দিয়ে দিলো, বেণু?’

কী বলব। বললাম, ‘দিলো তো।’

‘সুধন্যদা বাইরে থাকলে এটা হতো না। যাক, শ্বশুরবাড়িতে কেমন কাটছে?’ জানতে চেয়েই জয়ন্তীদি যেন কথাটা ঘুরিয়ে নিতে চাইল, ‘কেমন কাটছে আমি কিছুটা জানি।’

অবাক হবার পালা আমার। সেই চোখে তার চোখে তাকালাম। সেখানে হতাশা না রাগ, বুঝলাম না। তাহলে জয়ন্তীদিও জানে। সবই? আমাকে যে কেটে ভৈরবে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা দেখি কারও জানতে বাকি নেই। এত রাজ্যির লোক জানত, জানত না খালি আমার বাপ-মা জেঠা-জেঠি আর রথীনদা? রথীনদার জানার কথাও না।

জয়ন্তীদির কাছে আর জানতে চাইলাম না সে কী জানে। সে বলল, ‘আজকাল যে কোনো দিন চালান হবে।’

‘পাপড়িও তাই বলল।’ জানতে চাইলাম, ‘আপনি সরকারি প্রাইমারির জন্যে পরীক্ষা দিলেন তার কিছু হলো?’

‘ভাইভা হইচে ভালো। হয়ে যাবে। তারপর তো আর মিছিল করতে পারব না। তাই ভাবলাম কলেজে যখন আইচি, এট্টু মিছিল করি।’

‘আপনার ডিগ্রি পড়া?’

‘ও চালাব এক ভাবে।’

আমি শুকনো হাসলাম। ভাবলাম, আমার কথা তো সবই জানে দেখি। কিন্তু কীভাবে? যদিও সে হিসাব আমার বোধের বাইরে।

‘তোমার কাকার চিঠির উত্তর দিচো? নামটাম কিছু লেখনি তো?’

মাথা নাড়ালাম।

‘যাই, বেণু’, বলে জয়ন্তী এগোলেন, ‘পড়াশোনা করো ঠিকঠাক। তোমার ক্যান্টিনে নেব না। কী দরকার তোমার গায়ে ছাপ দিয়ে।’

মনে মনে জয়ন্তীদির উদ্দেশ্যে বললাম, ঠিক আছে। আমি পড়াশোনা করব। আপনি বইলেন ছোটকাররে যদি কোনো দিন দেখা হয়। এইটুকু ভাবতেই জয়ন্তীদি আবার ফিরে এলেন, ‘আচ্ছা, তোমাদের বাড়ির সবাই ভালো আছে?’

‘তা আছে। তবে ঠাকুমা খুবই অসুস্থ। খালি ছোটকাররে খোঁজে।’

‘তুমি যাননি দেখতি?’

‘যাব। এই রবিবার।’

‘আচ্ছা, আসি।’

এখন আমার যেন আর করার কিছু নেই। সারাটা কলেজ ফাঁকা লাগছে। শীত আসছে। সুখ সরোবরের জলে টান পড়েছে। সে জলের ওপর দিয়ে বাতাস বয়ে গেলে, থির জল কেঁপে কেঁপে কূলের দিকে যায়। উলটো দিকের সীমানার পরে নারকেলগাছের দিকে তাকাতে মনে হলো, বড়ো ফাঁকা। জয়ন্তীদির চলে যাওয়া সোজা তাকালে কলেজস্টেশন। সেটাও ফাঁকা পড়ে আছে। সরোবরের চারপাশের বেঞ্চিগুলোয় কেউ নেই। মনে হলো, তাও ফাঁকা। যেন একেবারে খাঁ-খাঁ করছে। মাঠে খেলা হচ্ছে। তারপরে ঠিক মাঝখানে উঁচু বেদিতে লাঠি হাতে দাঁড়ানো আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, তার মুখে রোদ। কিন্তু চারদিক ফাঁকা লাগা ভাবটা আমার এত দূর থেকে তার দিকে তাকিয়েও গেল না। নিচের সমাবেশটা এই ভাঙল। সবাই এখন হয়তো ক্যান্টিনের দিকে আসবে। আমি উলটো ফিরব। লেডিস কমন রুমে সুলতা আমার জন্যে অপেক্ষা করছে।

মাঠের উত্তর পাশ ধরে হেঁটে আমি প্রিন্সিপাল স্যারের অফিসের সামনের রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছতে পারিনি, তার আগে পাপড়ি ওই সমাবেশ-ভাঙা সবার ভিতর থেকে দ্রুত হেঁটে আমার কাছে এল। নিচুগলায় বলল, ‘থাকিস্। কথা আছে।’

‘আমি লেডিস কমন রুমে আছি।’

‘কয়টায় যাবি।’

‘আড়াইটার ট্রেনে।’

‘তোর খাতাটা দেবো।’

আমি বুঝলাম, নিশ্চয়ই কোনো বিষয় আছে। যদিও পাপড়ি সব সময়ই সিরিয়াস। কিন্তু এখন একেবারে ট্রেনের টাইমও জানতে চাইল? আমার তেষ্টা পেয়েছে। লেডিস কমনরুমে তো যাই আগে।

সোয়া দুটো পর্যন্ত পাপড়ি এল না। নিশ্চয়ই কেন্টিনেই আছে। আমরা স্টেশনে গেলে ক্যান্টিনের সামনে দিয়ে ওকে দেখা যাবে। কিন্তু না। ছিল না। জয়ন্তীদিসহ বাকি কেউ নেই। হয়তো তারা সবাই কোথাও গেছে। প্ল্যাটফর্মে উঠেও দেখা নেই পাপড়ির। ট্রেন আসতে মিনিট দশেক। এই ট্রেনে যাব না? না, তাহলে পরীক্ষিৎ চিন্তা করবে। শাশুড়িকে বলতে হবে কেন দেরি হলো। সে জবাব আমার কাছে নেই। আগের দিন হোসেনভাই যেখানে নেমেছিলেন, স্টেশনের পশ্চিম দিকে শেষ মাথায় দাঁড়ালাম। সুলতা মর্জিনা আছে। লুৎফা শহরে খালার বাড়ি গেছে। কিন্তু পাপড়ি কোথায়? ভাবলাম, কথাটা সুলতাকে বলি। না, চলে যাই। কাল তো দেখা হবে। পরশু রবিবার। ও দিন ঠাকুমাকে দেখতে যাব।

ট্রেন এল। এখানে তেমন কেউ নামে না। লেডিস কম্পার্টমেন্টের দিকে এগোতে দেখলাম, দরজায় পাপড়ি। বলল, ‘ওঠ্ ওঠ্।’ ও এখানে কেন? জানতে চাইলে বলল, ও যাবে বাহিরদিয়া। জয়ন্তীদির সাথে। মনে হলো, ভুল বলছে। আশপাশের সবাইকে এড়ানো। হয়তো একটু পরে একলা পেলে বলবে, কোথায় যাচ্ছে। কী দরকার? জয়ন্তীদিকে এখন একটু ক্লান্ত লাগছে। তবু কী সুন্দর করে গুছিয়ে বসেছে। আঁচলটা টেনে দেওয়া। সে তুলনায় পাপড়ি জামা কাপড়ে একটু উদাসীন। আর আমি। এখন জয়ন্তীদিকে দেখে, তার মতো গুছিয়ে বসতে চেষ্টা করলাম। আমাকে কি আর অমন দেখায়? আমি পারি অত কিছু?

কিন্তু পারতে হবে। ছোট্কাকে কথা দিয়েছি।

মর্জিনা ষাটগম্বুজ স্টেশন নামল। ট্রেন ছাড়ার পরে পাপড়ি ওর কাঁধের ঝোলা ব্যাগ থেকে একটা খাতা বের করল। মনে হলো যেন আমার খাতাটাই। না, অন্য একটা? বুঝতে পারছি না। জয়ন্তীদিকে কিছু একটা বলতে কাছে গিয়ে দাঁড়াল। দুই দিকের শুকনো পুঁটিমারির বিলের দিকে তাকাতে তাকাতে আমার আমাদের বাড়িতে জয়ন্তীকে প্রথম দেখার কথা মনে পড়েছিল। সেই মানুষটা নেই। সেখানে একটু মলিনতা। কলেজে দেখার সময়ে কেন তা মনে হয়নি। এখন কেন মনে হচ্ছে। ছোটকারকে মনে পড়ছে বলে। বুঝলাম, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। ট্রেনেরও গতি কমছে। জয়ন্তীদিও কি কিছু ভাবছিল। জানি না। শুধু আমাকে উঠতে দেখে বলল, ‘ভালো থেকো। যা করবা নিজের বুদ্ধি দিয়ে। এই কয়দিনে অনেক বড়ো হয়ে গেছ। সময় মানুষকে কত কিছু বুঝতে শেখায়।’

জয়ন্তীদির কথায় আমি আর তার মুখের দিকে তাকাতে পারলাম না। ইচ্ছে হচ্ছিল তাকে প্রণাম করি। তা সম্ভবও নয়। হাত দুটো এক জায়গায় নমস্কারের ভঙ্গি করলাম। জয়ন্তীদি দেখেও দেখলেন না। বললাম, ‘আপনিও ভালো থাইকেন।’ আমার গলা ধরে আসছিল।

দরজায় আমি আগে। আমার পিছনে সুলতা। পাপড়ি আগে থেকে সেখানে দাঁড়ানো। হাতে ধরা খাতাটা আমাকে দিয়ে বলল, ‘সেপটিপিন সমেত ফেরত দিচি। আমি মূলঘর নামব। ক্রসিঙের ট্রেনে ফিরে আসব। কাল কলেজে কথা হবে। মন খারাপ করিস না। আমারে দেকতিচিস না?’

‘না, পাপড়ি। মন অর খারাপ নেইরে। আচ্ছা, জয়ন্তী দিয়ো মূলঘর নামবে।’

উত্তর দেওয়ার আগে পাপড়ি আমার পিছনে দেখল। না, সুলতা ছাড়া কেউ নেই। নিচুগলায় বলল, ‘না। উনি যাবে খুলনা। আমার ছোটোমামাও সকালে গেছে। তোগে বাড়ি দে কেউ যায়নি?’

‘জানি না তো। বাবা নয় রথীনদা যা’তি পারে।’

‘আচ্ছা। যা। কাইলকে দেখা করিস।’

পাপড়ির কথায় এত রহস্য থাকে যে ওর সব কথা সব সময় বুঝেও উঠতে পারি না। ট্রেন থেকে নামামাত্র সুলতা পাপড়ির দেয়া খাতাটার দিকে তাকাল। আমি তখন ওই খাতাটা বুকে চেপে ধরা খাতা ও একখানা বইয়ের সঙ্গে গুছিয়ে নিচ্ছি। সুলতা কিছু বলল না। বুঝলাম ও বুঝতে পারছে। পাপড়ি রাজনীতি করে, মিছিলে যায়। আমার ছোটকার জেলে। পাপড়ি হয়তো পার্টির কোনো বিষয় আমার সাথে লেনদেন করে। একবার ভাবলাম, সুলতাকে বিষয়টা বলি। বলব কি বলব না যখন ভাবছি, এ সময় স্টেশনের বাইরে আসতে আসতে পরীক্ষিৎ হাত নাড়ছে। ততক্ষণে আমি ভেবেছি, না, সুলতাকে কিছু বলব না।

পরীক্ষিৎ সাইকেল নিয়ে এসেছে। এটা ওর সাইকেল। মনে হলো, তাড়া আছে। সুলতার বাড়ি পর্যন্ত গিয়েই বলল, ‘চল তোমারে ভ্যানে তুলে দিই।’

হঠাৎ কী কারণ? ওর চোখের দিকে তাকাতে বলল, ‘আমারে দোকানে যা’তি হবে। কাইলকে হাটবার। আড়তে মাল তুলতি হবে।’

আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল পরীক্ষিৎকে আজকে পাপড়ি কীভাবে আমাকে খাতা দিয়েছে তা বলতে। যদিও এখনো জানি না খাতার ভিতরে কী আছে। কিন্তু ওর খাতা দেবার কায়দায় মনে হয়েছে, ওখানে ছোটকার চিঠি আছে। আর সে চিঠি এনেছে জয়ন্তীদি। হয়তো জয়ন্তীদি আমাকে দেখতেও এসেছিল। আজ খুলনায় ফিরে যাচ্ছে। কাল কোনো সুযোগ হলে ছোটকার সঙ্গে দেখা করে আমার কথা বলবে। নয়তো কোনো কায়দায় চিঠি পাঠাব। জয়ন্তী বলেছে, কাল-পরশুর মধ্যে চালান দিয়ে দেবে। কোথায়? জানি না তো। ঢাকায় নাকি যশোরে? রাজশাহী না রংপুরে?

পরীক্ষিৎ জানতে চাইল, ‘কোনো দরকার আছে?’

‘না। ভ্যান ডাইকে দাও।’

‘বোঝে তো। বাবা একলা সামলাতি পারিবে না। বুড়ো মানুষ। দুপুর খাইয়ে এট্টু ঘুমবে। পারল না। দাদার কাইলকে আসার কথা ছেল আসল না।’

এই শেষটুকু পরীক্ষিৎ একটু নিচুগলায় বলল। মনে হলো, একথা বলতে ওর ভালো লাগছে না। আমিও কিছু বললাম না। কী বলব। কী বলার আছে। বরং বাড়ি যেয়ে ছোটকার চিঠিটা পড়ি। তখন মনে হলো, খাতায় ছোটকার চিঠি নাও থাকতে পারে।

না, ছোটকার চিঠি। এই খাতাটার মাঝখানের পৃষ্ঠায়। একটা মোটা ধরনের নিউজপ্রিন্ট কাগজে লেখা। কোনো সম্বোধন নেই। নিচে কিছু লেখাও না। কাগজখানা খাতায় সেপটিপিন থেকে খুলতে উপরে একটা ফুটো হয়েছে। এ কাগজটার পাশটাও টেনে ছেড়ে। ত্যাড়াব্যাঁকা। কোথায় পেয়েছে এই কাগজ?

সব শুনলাম। খারাপ। কেন এমন হলো? কি বলব জানি না। শক্ত থাকতে হবে। পড়াশোনা যেন ঠিক থাকে। এখন ওইটুকু সম্বল। কাল বা পরশু পাঠাবে। ভালো আছি। পুনঃ পড়াশুনো!

ছোটকার হাতের লেখা। একটু জড়ানো। মনে হলো, ইচ্ছে করে। আমাকেই লিখেছে। খারাপ শব্দটার আগে একটু জায়গা ফাঁকা। ওখানে লোকটা বা ছেলেটা বসবে। কার সম্পর্কে লিখেছে বুঝতে বাকি রইল না। আমাকে দুইবার পড়াশোনা করতে নির্দেশ দিয়েছে। আর পাঠানো মানে চালান দেওয়া। তাও বুঝলাম। গত চিঠিটার উত্তর আজই দিয়েছে। সেটা পাওয়ার আগে এই চিঠি। তার মানে ছোটকার জানে না কবে আবার লিখতে পারবে। তাই আজ পাঠিয়েছে। না, এটা হয়তো কাল লিখেছে। ছোটকারকে কে বলেছে ছেলেটা খারাপ। হোসেনভাই না জয়ন্তীদি? আমাদের বাড়ির লোকজন কিছু জানেনি তো। জানলেই-বা কী? ছায়াবউদিকে বলেছে রথীনদাকে? সেখান থেকে ছোটকার জেনেছে? জানি না। জানতে চাই না। আমাকে কী করতে হবে লিখেছে ছোটকার। পড়াশোনা। চিঠিটা বুকে চেপে ধরলাম। চোখভর্তি হয়ে গেছে জলে। যদি শাশুড়ি দেখে ফেলে। দেখলে দেখুক। বলব ছোটকার চিঠি। না, খারাপ কথাটা লেখা আছে। ওনাকে দেখানো যাবে না। পরীক্ষিৎকে? না, তাকেও না। তবে পরীক্ষিৎকে বলব।

এ চিঠি তো আমার কাছে থাকতে পারে, পাপড়ি তো কিছু বলেনি। শুধু বলেছে কাল কথা আছে। কাল কী কথা বলবে পাপড়ি। চিঠিটা ভাঁজ করতে করতে আগের চিঠিটা যেখানে রেখেছিলাম সেই জায়গাটা দেখলাম। ওখানেই রাখব? না। ভাঁজ খুলে আবারও খাতাটার ভিতরেই রাখলাম। উপরে দুইখানা বই।

১০

পরীক্ষিৎ এত রাতে ফিরল যে ওকে আর কিছু বলা হলো না সেভাবে। ওর খাওয়ার সময়ে পাশে বসে থাকলাম। তারপর আমি খেলাম। ও তখন বসে থাকল। ওর খাওয়ার সময়ে বারবার বলেছে, আমি যেন একইসঙ্গে খেতে বসি। বলেছি, তাই হয় নাকি? পরীক্ষিৎ হেসেছে, হ’লিই হয়। সারা জীবন মাকে দেখছে বাবার জন্য বসে থাকতে। তারপর বাবার খাওয়া হলে মা খেয়েছে। এখনো তাই। তারপরে নিচুগলায় বলল, ‘কিন্তু তুমি যার জন্যে বসে থাকপা, সে তো তোমার কথা ভাবলই না।’ শুনে, চোখে জল আসছিল। কিন্তু সামলাম।

আমার খাওয়ার সময় পরীক্ষিৎ জানত চাইল, কী জানি ওকে বলব?

বললাম, ‘ওই পাপড়ির কথা। কাইলকে ক’বানে।’

‘ছোটতালইর কোনো খবর জানলা?

‘কাল বা পরশু চালান হয়ে যাবে।’

পরীক্ষিতের মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। হারিকেনের আলোয় এমনিতেই দুজনার মুখে ছায়া পড়েছিল। মুখেও আমাদের মনের ছায়া। এখন আমার কথায় তা আরও গাঢ় হতে আমার আর খেতে ইচ্ছে করল না। ভাতে জলে ঢেলে দিলাম। পরীক্ষিৎ অবাক হলো না। আমার মুখের দিকে তাকিয়েই থাকল।

শুকনো হেসে কোনো মতে জানতে চাইলাম, ‘কী দেখো?’

পরীক্ষিৎ কিছু বলল না। চোখ সরাল। মেঝের দিকে চেয়ে থাকল। শান এখন ধীরে ধীরে ঠান্ডা হচ্ছে। শীত আসছে। ভাবলাম, ছোটকার চিঠির কথা ওকে বলব না। বলা হলো না। তাছাড়া রাতও হয়েছে।

শুয়ে ঘুম আসছিল না। এই প্রথম এমন হলো। কেন এমন হচ্ছে আমি জানি। এ বাড়িতে এক পরীক্ষিৎ ছাড়া কেউ আমাকে বুঝল না। হয়তো শ্বশুর-শাশুড়ি এখনো জানেই না। অথবা জেনেই এ কাজ করেছে তারা। আমার কী? এখন আর এসব ভাবতে চাই না। কাল যদি পাপড়ি উত্তর দিতে বলে, ছোটকারকে লিখব, তুমি ভেবো না। পড়াশোনা করব আমি। কাল তো বাড়ি যাব। সকালে গিয়েই মর্জিনাকে বলব, ওর সঙ্গে ষাটগম্বুজ স্টেশনে নামব। মর্জিনা খুশি হবে।

আমার সব ভাবনা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। জানি কেন এমন হচ্ছে। ছোটকার কী হবে? পুলকেশ পারল এই কাজ করতে? কাল যে মানুষের আসার কথা সে আজও এল না। কাল আসবে। নন্দিতাকে নিয়ে এক সাথে আসবে। নন্দিতা নামবে খানজাহানপুর। পুলকেশ নামবে যাত্রাপুরে। বাড়ির লোকজন ভাববে ব্যবসার কাজ করে ফিরেছে।

সকালে স্নান সেরে গরম ভাত খাওয়ার সময়ে পরীক্ষিৎকে বললাম, আমার সঙ্গে স্টেশনে যেতে। ও একটু অবাকই হলো। ক’দিন ধরে বলি সুলতাদের বাড়ি পর্যন্ত ভ্যান ঠিক করে দিতে। আজ আবার আমার কী হলো? কিন্তু জানতে চাইল না।

ভ্যানে দুইজনই সামনের দিকে বসেছি। আমি একবার পরীক্ষিতের দিকে তাকালাম। মনে হচ্ছিল, এই মানুষটা আমারে কত শ্রদ্ধা করে। ভালোবাসে। আমার দুঃখে দুঃখ পায়। এই যে কিছু না জানতে চেয়ে আমার সঙ্গে এল। জানতে চাইল না কী বলব আমি।

ট্রেন আসল। সুলতা উঠল। আমি শেষে উঠব। লেডিস কম্পার্টমেন্টের কাছে, পরীক্ষিতের থেকে দরজার দিকে এগোতে এগোতে চোখ ভিজে উঠল আমার। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে এই প্রথম বললাম, ‘ও ভাই, আমি যাই। আর কিন্তু আসপ না।’ পরীক্ষিতের চোখ বিস্ফারিত। ও যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তাকিয়ে আছে।

আমি বলে চলেছি, ‘কলেজ দে বাড়ি যাব। ঠাকুমারে দেখতি। ভালো থাইকো। আর ফেরব না।’

পরীক্ষিৎ তাকিয়ে আছে। আমি উঠেছি। ট্রেনের দরজায়। ও কিছুই বলছে না। জানতাম বলবে না। ও আমাকে বুঝেছে।

ট্রেন ছাড়ল। বুকের কাছে খাতায় ছোটকার চিঠি। আমাকে পড়াশোনা করতে হবে। অন্য চিঠিখানা পরীক্ষিতদের বাড়িতে সেই ঘরের একটা চৌকাঠের খুঁটি আর আড়াবাতার মাঝখানে থেকে গেল!


[কথাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিতব্য উপন্যাসের শেষাংশ]

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে সামাজিক কুসংস্কার’
‘যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে সামাজিক কুসংস্কার’
নারী উদ্যোক্তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ব্যবহার বিষয়ক প্রকল্পের সমাপনী অনুষ্ঠিত
নারী উদ্যোক্তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ব্যবহার বিষয়ক প্রকল্পের সমাপনী অনুষ্ঠিত
ইউক্রেনকে ৬২ কোটি ডলারের অস্ত্র সহায়তা দেবে যুক্তরাজ্য
ইউক্রেনকে ৬২ কোটি ডলারের অস্ত্র সহায়তা দেবে যুক্তরাজ্য
ছেলেকে প্রার্থী করায় এমপি একরামুলকে দল থেকে বহিষ্কারের দাবি
ছেলেকে প্রার্থী করায় এমপি একরামুলকে দল থেকে বহিষ্কারের দাবি
সর্বাধিক পঠিত
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা
উৎপাদন খরচ হিসাব করেই ধানের দাম নির্ধারণ হয়েছে: কৃষিমন্ত্রী 
উৎপাদন খরচ হিসাব করেই ধানের দাম নির্ধারণ হয়েছে: কৃষিমন্ত্রী