X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

আদালতের বাইরে মীমাংসা, শাস্তি হয় না পাচারকারীদের

দুলাল আব্দুল্লাহ, রাজশাহী 
২৪ জুলাই ২০২১, ১১:০০আপডেট : ২৫ জুলাই ২০২১, ১৮:৫৬

ভালো কাজ দেওয়ার কথা বলে বহু বেকার তরুণ-তরুণীকে বিদেশে পাঠাচ্ছে মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যরা। তবে নিজের সর্বস্ব বিক্রি করে বিদেশে গিয়ে সুদিন ফেরানোর স্বপ্ন দেখা তরুণরা হচ্ছেন প্রতারণার শিকার। অনেকে বেঁচে দেশে ফিরতে পারলেও অনেকে হারিয়ে যায় চিরদিনের জন্য। ফেরত আসা ব্যক্তিরা পাচারের কাজে জড়িত দালালদের বিরুদ্ধে মামলা করলেও দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত হয় না। মামলার অনেক বাদী আদালতের বাইরে মীমাংসা করে ফেলায় গ্রেফতার হলেও শেষ পর্যন্ত ছুটে যায় পাচার চক্রের সদস্যরা। আর এতে করে লাভের লাভ কিছু হচ্ছে না। প্রতারক চক্রের নিয়মিত শিকার হচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তরুণরা।

জানা যায়, ২০১৫ থেকে ২০২১ সালের ১৭ জুলাই পর্যন্ত সাড়ে ছয় বছরে মানবপাচারে রাজশাহীসহ তিন জেলায় ৪৪টি মামলা হয়। এরমধ্যে ১৮টি মামলা আদালতের বাইরে মীমাংসা হয়েছে। আর গত পাঁচ বছরে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার ৬৭০ জন পাচার হওয়ার পরে বিদেশ থেকে ফেরত এসেছেন। এর মধ্যে পুরুষ ৫১২ জন ও ১৫৮ জন নারী।

মানবপাচার অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রাজশাহীর সাবেক পিপি (দায়িত্বপ্রাপ্ত) আঞ্জুমান আরা খাতুন লিপি বলেন, এই সমস্ত মামলাগুলো নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালে ছিল। এই ট্রাইব্যুনালে অনেক মামলা, তাই দেরি হতো। এখন পৃথক ট্রাইব্যুনাল হয়েছে। এতে কমেছে মামলার জট। রাজশাহী আদালতে আসা ৫০টি মামলার সবগুলো পর্যবেক্ষণে রয়েছে।

সম্প্রতি রাজশাহী নগরীর মতিহার থানার খড়খড়ি এলাকা থেকে র‌্যাব-৫ রাজশাহীর মোল্লাপাড়া ক্যাম্পের একটি দল তিন মানব পাচারকারীকে গ্রেফতার করে। তারা হলেন, বগুড়ার গাবতলী উপজেলার নিশুপাড়ার আবু তাহের ওরফে বাদশা বিন তাহের (৩০), সোন্ধাবাড়ির জিয়াউর রহমান (৩৫) এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার খাল্লা এলাকার বিল্লাল হোসেন পলাশ (৩৬)। এদের মধ্যে আবু তাহের নিজেকে বিডি ফিড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিল্লাল হোসেন পলাশ জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে পরিচয় দেন।

র‌্যাবের দাবি, তারা আন্তঃদেশীয় প্রতারক চক্রের সক্রিয় সদস্য। লোকজনকে ব্যবসা, চাকরি ও বিদেশে চাকরি দেওয়ার কথা বলে প্রতারণা করতো তারা। অভিযানে ল্যাপটপ-পেনড্রাইভ ছাড়াও জাল সিল, বিডি ফিড প্রোডাক্ট ক্যাটালগ এবং ফাঁকা চেক উদ্ধার করা হয়েছে। এই ঘটনায় প্রতারণার শিকার আল-আমিন বাদী হয়ে নগরীর মতিহার থানায় প্রতারণা ও মানব পাচার আইনে মামলা দায়ের করেছেন।

র‌্যাব জানায়, সংঘবদ্ধ চক্রটি বিভিন্ন কোম্পানির নামে ভুয়া অফিস ও জাল কাগজপত্র তৈরি করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বেকার যুবকদের দেশে-বিদেশে চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা করে আসছিল। চক্রটি ভুয়া অফিস ও ফ্যাক্টরি দেখিয়ে চাকরি দেওয়ার নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিল। গ্রেফতাররা নিজেদের বিডি ডিজিটাল ফুড, বিডি ফিড কোম্পানির মালিক ও পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেন। কিন্তু এই সংক্রান্ত বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। পরে তাদের বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
 
ভুক্তভোগীদের বরাত দিয়ে একটি সূত্র জানায়, বিদেশে চাকরি দেওয়ার নামে স্থানীয় পর্যায়ে মানবপাচার চক্র কাজ করছে। একজনকে পাচার করতে পারলে পাচারকারীরা ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পায়। তবে ঢাকায় যারা এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তারা বেশি টাকা পেয়ে থাকে। পাচারকারীচক্র মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে রাজমিস্ত্রি, ওয়েলডিং মিস্ত্রি, গাড়িচালক, পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও নারীদের গৃহকর্মী হিসেবে বিদেশে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবে সাড়া মিললে তখন সৌদি আরব, ইরাক, কাতার, মালয়েশিয়া, ওমান ও দুবাইয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু চক্রটি ভিসা দেয়, ট্যুরিস্ট, হজ্ব ও ফ্রি ভিসা। যে ভিসার মেয়াদ মাত্র তিন মাস। কেউ কোনোভাবে পাঁচারচক্রের বাইরে পালিয়ে গিয়ে সর্বোচ্চ তিন মাস কোথাও কাজ করতে পারে। এরপরে ভিসার মেয়াদ শেষ হলে পুলিশ তাকে আটক করে।

রাজশাহীর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সচেতনের প্রকল্প সমন্বয়কারী মাহমুদ-উন-নবী বলছেন, রাজশাহীতে গত পাঁচ বছরে নারীর থেকে পুরুষরা বেশি পাচারের শিকার হয়েছেন। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৫-২০২০ সালের (পাঁচ বছর) জানুয়ারি পর্যন্ত ৪২টি মামলা হয়েছে রাজশাহী মহানগর ও জেলার বিভিন্ন থানায়। পাচারের শিকার হয়ে দেশে ফিরে ৩৭টি মামলা করেছেন পুরুষরা ও পাঁচটি মামলা করেছেন নারীরা। এর মধ্যে ১৮টি মামলা আদালতের বাইরে দুই পক্ষ বসে আপস মীমাংসা করেছে। এই ১৮ মামলায় ১৪ জন মানবপাচারকারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তবে জেল হাজতে থাকা অবস্থায় আসামিদের পরিবার ভিক্টিমের সঙ্গে দেন-দরবার করে মীমাংসা করে নেয়। এছাড়া বাকি মামলাগুলো চলমান রয়েছে। কোনোটি তদন্ত পর্যায়ে, কোনোটি আবার চার্জশিট পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা গেছে।

জানা যায়, প্রতারক চক্র এলাকাভিত্তিক পাঁচ থেকে সাত জনকে টার্গেট করে। এরপরে বিদেশে পাঠানোর নামে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়। কোনও স্বজন বিদেশে আছেন কিংবা বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছেন, তাদেরকে সামনে রেখে পাচার কাজ চালিয়ে যায় পাচারকারীরা। সাধারণ মানুষ যাতে করে তাদের বিশ্বাস করে তাদের প্রতি আস্থাভাজন হয় এ জন্য এই ব্যবস্থা নেয় প্রতারকরা। চক্রটি বিদেশ থাকা স্বজনের মাধ্যমে ভালো বেতনে কাজ পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেয়। তারপর প্রতারক চক্র সুবিধামতো দিনে চাকরি-প্রত্যাশীদের ঢাকায় ডেকে নেয়। আগ্রহীদের ট্যুরিস্ট, হজ্ব ও ফ্রি ভিসায় বিদেশে নিয়ে যাওয়া হয়। পাচারের বিষয়টি ভুক্তভোগীর এলাকায় জানাজানি হলে চক্রের সদস্যরা দ্রুত এলাকা পরিবর্তন করে বলে এনজিও কর্মীদের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

এনজিও সূত্রে জানা গেছে, পাচার চক্রের হাতে থাকা বাংলাদেশিদের বিমান থেকে নামার পরে একটি ঘরে আটকে রাখা হয়। সেখানে তাদের ওপর চলে মারপিট ও নির্যাতন। এসময় প্রবাসী ওই বাংলাদেশিকে বাড়িতে ফোন দিয়ে মুক্তিপণ হিসেবে টাকা চায় চক্রটি। টাকা না পাওয়া পর্যন্ত দিনের পর দিন না খেতে দিয়ে রাখা হয়। যোগাযোগ করতে দেওয়া হয় না কারও সাথে।

ইরাক থেকে ফেরত আসা বাঘা উপজেলার আবদুর রহিম (ছদ্মনাম) জানান, ২০১৫ সালের ৮ আগস্ট তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ইরাকে। একই বছরের ১৯ ডিসেম্বর দেশে ফিরে আসেন। মাঝখানে ২ মাস ২০ দিন কেটেছে নির্যাতন ও অনাহারে। ইরাকে মসজিদ ও মাদ্রাসায় ৪০ হাজার টাকা বেতনে চাকরির কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয়। তার আগে নন্দনগাছীর ভূগোল নামের এক দালাল তার কাছ থেকে নিয়েছিল চার লাখ টাকা।

আবদুর রহিম আরও বলেন, বিমানে আমাদের সঙ্গ দেয় কয়েকজন দালাল। বিমান থেকে দুবাই নামি। আমাকে যে মানুষটি নিতে আসার কথা ছিল সে আসেনি। তখন যেতে না চাইলে আমাকে মারধর করা হয়। এয়ারপোর্ট থেকে বের করে একটি পাঁচ তলা বাড়িতে আমাদের চার-পাঁচ জনকে আটকে রাখে তারা। 

তিনি বলেন, ইরাকে নিয়ে গিয়ে আমাকে ক্লিনারের কাজে দেওয়া হয়। ঠিকমতো খেতে দিতো না। কাজ ঠিকঠাক না হলে মারধর করতো। অত্যাচর থেকে বাঁচতে একদিন গোপনে পালিয়ে যাই। এয়ারপোর্টে আসলে সেখানে অ্যাম্বাসির স্বাক্ষর না থাকায় আমাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। বিষয়টি বাড়িতে জানালে সুদের উপরে এক লাখ টাকা আমাকে পাঠায়। আমি দেশে ফিরে ওই দালালের বিরুদ্ধে মামলা করি। তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। তবে অভাব-অনটনের কারণে দুই লাখ ৫০ হাজার টাকায় মীমাংসা করতে হয়েছে। এছাড়া বেশিরভাগ মানুষকে দেশে ফিরতে মুক্তিপণের টাকা দিতে হয়েছে বলে জানান তিনি।

সার্বিক বিষয়ে রাজশাহী জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইফতেখায়ের আলম বলেন, গত ৫ বছরে রাজশাহী জেলায় হওয়া মামলাগুলোর ১৮টির চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। বাকি মামলাগুলো তদন্তাধীন রয়েছে। আমরা মানবপাচার রোধে কাজ করছি। প্রয়োজনে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সঙ্গে এ বিষয়ে প্রচারণামূলক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে বলেও জানান তিনি। 

/টিটি/
সম্পর্কিত
ইউরোপে মানবপাচারের নতুন রুট নেপাল
দুই মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে ‘বালি প্রসেসের’ প্রতিনিধি দলের সাক্ষাৎ
শতাধিক বাংলাদেশি উদ্ধারমানবপাচারের দায়ে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে মালয়েশিয়া
সর্বশেষ খবর
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী