X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

একটা ‘রোডম্যাপ’ খুব জরুরি

জাকিয়া আহমেদ
২৮ জুলাই ২০২১, ১১:০০আপডেট : ২৮ জুলাই ২০২১, ১১:২২

দেশে করোনাভাইরাসের মৃত্যু ও সংক্রমণে প্রতিদিনই ভাঙছে আগেরদিনের রেকর্ড। গেল ২৪ ঘণ্টার (২৭ জুলাই সকাল ৮টা পর্যন্ত) পাওয়া তথ্যেও তার আগের ২৪ ঘণ্টার হিসাবকে ছাড়িয়ে গেছে। এসময় ভাইরাসটিতে সংক্রমিত হয়ে মারা গেছেন ২৫৮ জন। করোনা মহামারিকালে একদিনে এত মৃত্যু আর দেখেনি বাংলাদেশ। তার আগেরদিন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৪৭ জনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। বিশ্বে যেসব দেশে করোনায় দৈনিক মৃত্যু সবচেয়ে বেশি হচ্ছে, সেই তালিকায় বর্তমানে বাংলাদেশ দ্বাদশ অবস্থানে। আর গতকাল মৃত্যুর এই রেকর্ডের সঙ্গে দেশে শনাক্ত হওয়া রোগী সংখ্যাতেও রেকর্ড সংখ্যক রোগী শনাক্ত হয়, ২৪ ঘণ্টায় ১৫ হাজার ১৯২ জনের শরীরে ভাইরাসটি শনাক্ত হওয়ার কথা জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর।

ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সামাজিক সংক্রমণে জর্জরিত এখন পুরো দেশ। গত আট দিনে মারা গেছেন ১ হাজার ২৮৯ জন এবং শনাক্ত হয়েছেন ৭৫ হাজার ৯৬১ জন। ইতোমধ্যে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, বর্তমান সংক্রমণে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টই বেশি। দেশের আট বিভাগের মধ্যে সাত বিভাগেই করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তির নমুনা থেকে জিনোম সিকোয়েন্সে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটা (জিআইএসএআইডি) অনুযায়ী, দেশের সাতটি বিভাগে এখন পর্যন্ত ১৫০টি নমুনায় ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বি-১৬১৭ পাওয়া গেছে। 

সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতির জন্য মানুষের স্বাস্থ্যবিধি না মানার সঙ্গে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা। কেবল বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বগতির জন্য ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টকে প্রধানতম কারণ বলছেন বিশ্বজুড়ে জনস্বাস্থ্যবিদেরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলেছে, গত বছরের শেষ দিকে যুক্তরাজ্যে প্রথম শনাক্ত হয় করোনার আলফা ধরন। এই ধরনকে অতি সংক্রামক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু আলফার চেয়ে ডেলটা ৫৫ শতাংশ দ্রুত ছড়ায়।

দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি যে এত ভয়ংকর হয়ে উঠবে সে আশঙ্কার কথা আগেই জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। এখন থেকে দুই সপ্তাহ আগেই (১৫ জুলাই) স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন জুলাই মাসকে ‘অত্যন্ত কঠিন’ মন্তব্য করে বলেছিলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি মানতে উদাসীন হলে দেশে করোনা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।’

আর ঈদের আগে লকডাউন শিথিল করে দেওয়ার ঘোষণায় ‘হতভম্ব’ হয়ে যায় খোদ কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি কমিটি। আর গতকাল ( ২৬ জুলাই) একইদিনে শনাক্ত রোগী এবং মৃত্যুর সংবাদের পর কমিটির একাধিক সদস্য বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, তারা হতাশ।

সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতিকে ‘মাল্টি-ফেকটোরিয়াল’ বলে জানিয়েছেন কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা। তিনি মনে করছেন, লকডাউন শিথিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টও সংক্রমণশীলতার ঊর্ধ্বমুখিতার কারণ। তিনি বলেন, এখন যত সংক্রমণ হচ্ছে তার মধ্যে ৮০ শতাংশই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট, এই ভ্যারিয়েন্ট আগের যে কোনও ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে প্রায় দেড়গুণের বেশি ছড়াচ্ছে। সব মিলিয়েই এ অবস্থা।

ঈদ শেষে হেঁটেই ঢাকায় প্রবেশ করছে মানুষ। ছবি: বাংলা ট্রিবিউন

পরিস্থিতি দেখে হতাশ হলেও এখনও আশাবাদী ডা. সহিদুল্লা। তিনি বলেন, ‘এত মৃত্যু-এত সংক্রমণ দেখে হতাশ লাগছে। কিন্তু এরচেয়েও বেশি মৃত্যু-বেশি সংক্রমণ অন্য দেশ দেখেছে, কিন্তু তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তাই আমি মনে করি, যেটা হয়েছে…হয়েছে। কিন্তু এখন দরকার সবাই মিলে সঠিক কাজটি করা। আর তার মধ্যে অন্যতম স্বাস্থ্যবিধি মানা, চলমান লকডাউনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে সঠিক বাস্তবায়ন করা দরকার। সঙ্গে রোগী শনাক্তকরণে টেস্ট বাড়ানো। সেইসঙ্গে শনাক্ত রোগীর আইসোলেশন, তার সংর্স্পশে আসাদের কোয়ারেন্টিনে রাখা এবং তাদের টেস্ট করানো এবং চলমান টিকাদান কর্মসূচিতে আরও গতি এনে আরও মানুষকে টিকা দেওয়া।

‘এবং ফাইনালি সবকিছু নিয়ে একটি রোডম্যাপ তৈরি করা খুব দরকার’, বলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা।

এই রোডম্যাপ কিসের ভিত্তিতে হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হাসপাতাল কয়টা হবে, অক্সিজেনের কী হবে, টিকার কী হবে, সবাইকে মাস্ক পরানো যাচ্ছে না-তার কী হবে। ওভারঅল একটা রোডম্যাপ থাকা দরকার।’

সংক্রমণ থেকে উত্তরণের রোডম্যাপ কী হওয়া উচিৎ জানতে চাইলে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দরকার পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট এবং জনগণকে সম্পৃক্ত করা। আর যেসব ক্ষেত্রে সরকারি কাজে ঘাটতি রয়েছে সেসব পূরণ করতে পারে জনগণের অংশগ্রহণ।

তিনি বলেন, প্রতিটি শনাক্ত মানুষকে ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হবে, তার মধ্যে রয়েছে মেডিক্যাল ব্যবস্থাপনা এবং পাবলিক হেলথ ব্যবস্থাপনা। প্রতিটি শনাক্ত রোগীকে যদি স্বাস্থ্যবিভাগের নেতৃত্বে এবং প্রশাসনে সহায়তায় মেডিক্যাল এবং পাবলিক হেলথ ব্যাবস্থাপনায় আনতে পারলে গুরুতর রোগীর সংখ্যা যেমন কমে যাবে তেমনি রোগের সংক্রমণ কমে যাবে। কারন, তাদের আইসোলেশন নিশ্চিত করা হবে।

আইসোলেশন নিশ্চিত করার জন্য যাদের বাসায় ব্যবস্থা নেই অথবা প্রান্তিক মানুষ যাদের জীবিকার জন্য বাইরে বের হতেই হবে তাদের জন্য কমিউনিটি আইসোলেশন সেন্টার দরকার জানিয়ে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, উপজেলা হেলথ কম্পেলক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র, স্কুল ঘর বা কমিউনিটি সেন্টারে করা যায়। অর্থ্যাৎ শনাক্ত রোগীদের ব্যবস্থাপনার উপরে এখন যে জোর দেওয়া খুবই কম, সেটা সর্বাত্মক জোর দিতে হবে। আর এখানে সাধারণ মানুষের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব না।

এখনও প্রান্তিক পর্যায়ে অনেকেই সামাজিকভাবে নিগৃহীত হওয়ার আশংকায় করোনার সংক্রমণ জানাতে ভয় পান। এর ফলে টেস্টও করাতে চান না। এটা দূর করা উচিৎ উল্লেখ করে মহামারি বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন, শুরুর দিকে লাল পতাকা উড়িয়ে যে ভীতি সৃষ্টি করা হয়েছিল সেখান থেকে সরে আসতে হবে, সহযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আর এতে করে মানুষ টেস্ট করতে আসবেন, শনাক্ত হবেন- এই ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানাতেও জনগণের সহযোগিতা থাকতে হবে। কেন স্বাস্থ্যবিধি মানা দরকার, কেন দিনকে দিন এটা বাড়তে থাকবে- সেসব বুঝিয়ে ‘সবাই কষ্ট ভাগ করে নেবো’ এই মানসিকতা তৈরি করতে গেলে কমিউনিটিকে অ্যাজ অ্যা হোল মবিলাইজ করা দরকার।

সেইসঙ্গে টিকা দিতে হবে আর এখানেও জনগণ সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে হবে জানিয়ে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, বিশেষ করে রেজিস্ট্রেশন যারা করতে পারছে না, যাদের ডিভাইস নাই-টেকনিক্যালি পারদর্শী নয়-তাদের এ ক্ষেত্রে সাহায্য করতে হবে। 

‘সেইসঙ্গে হাসপাতালগুলোকে অচল করা যাবে না। রোগী যদি একের পর এক যেতে থাকে তাহলে চিকিৎসকসহ অন্যরা না পারবে কিছু করতে, …তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হযে যাবে। আর  এতে কারে স্বাভাবিক কাজেও সমস্যা হবে, এদিকেও মনোযোগী হতে হবে‘ -বলেন তিনি।

করোনার ভয় উপেক্ষা করেই লকডাউনের আগে রাস্তায় মানুষের ঢল

আর সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রোডম্যাপের জন্য প্রথমেই একটা ‘রেড অ্যালার্ট’ জারি করা দরকার বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য অধ্যাপক আবু জামিল ফয়সাল। তিনি বলেন, প্রতিরোধের দিকে মনোযোগ দিতে হবে, প্রতিষেধক টিকা পরে। মাত্র ১ কোটি টিকা হাতে রয়েছে, এতে করে কিছুই হবে না।

‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নেতৃত্বে মিটিং হলো, কিন্তু সেখানে কেবল টিকা নিয়ে বলা হলো, টিকা নিয়ে কথা হলো, অন্য কোনও কথাই হলো না, কেন হলো না- প্রশ্ন করে ক্ষোভ জানান অধ্যাপক আবু জামিল ফয়সাল। তিনি বলেন, মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন- কিছুই নেই এখন। অথচ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এগুলোই প্রধান নিয়ামক।

‘রেড অ্যালার্টের’ উপর পুনরায় জোর দিয়ে তিনি বলেন, ২৬ কোটি ডোজ দিতে দেড় বছর সময় লাগবে, সেজন্য যে পরিকল্পনা রয়েছে সেটা ঠিক আছে। কিন্তু প্রতিরোধের ব্যবস্থা কী-সে নিয়ে রেড অ্যালার্ট হওয়া খুব জরুরি। মাস্ক বিতরণ করতে হবে, মাস্ক নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রোডম্যাপের অন্যতম নিয়ন্ত্রক। একটা আন্দোলন করা এখন দরকারি, আর কিছু না।

/ইউএস/
সম্পর্কিত
প্রথমবার লকডাউন চীনের বাণিজ্যিক শহর সাংহাই
প্রথমবারের মতো লকডাউনে কিরিবাতি
একজনের ওমিক্রন শনাক্তের পর পুরো বিল্ডিং লকডাউন
সর্বশেষ খবর
শিশু হাসপাতালে আগুন: পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন
শিশু হাসপাতালে আগুন: পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন
অটোরিকশায় বাসের ধাক্কা, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা নিহত
অটোরিকশায় বাসের ধাক্কা, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা নিহত
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে: জাতিসংঘ
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে: জাতিসংঘ
ফ্যাটি লিভার প্রতিরোধে কোন কোন খাবার এড়িয়ে চলবেন?
বিশ্ব যকৃৎ দিবসফ্যাটি লিভার প্রতিরোধে কোন কোন খাবার এড়িয়ে চলবেন?
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!