বাংলাদেশি বাবা ও জাপানি মায়ের দুই শিশুকে খাস কামরায় নিয়ে তাদের বক্তব্য শুনেছেন হাইকোর্ট। উভয়পক্ষের শুনানি নিয়ে মঙ্গলবার (৩১ আগস্ট) বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রায় আঁধা ঘণ্টা তাদের বক্তব্য শোনেন।
আদালতে মায়ের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট ফাওজিয়া করিম ফিরোজ। অন্যদিকে রিটকারী জাপানি নারীর পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার।
শুনানিকালে হাইকোর্ট বলেন, আপনারাতো দুইপক্ষ নিজেদের দাবীতে অনঢ়। আমরা আপনাদের আবেদন শুনে দুই শিশুকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পাঠিয়েছিলাম। আপনাদের বলেছিলাম, নিজেরা বিষয়টি সুরাহা করেন। কিন্তু সেটি করতে পারেননি।
তখন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির আদালতকে বলেন, আমরা চাই শিশুদের মধ্যে যে ট্রমা দেখা দিয়েছে সেটি দূর হোক। রাতে তাদের সঙ্গে যেন মা থাকতে পারেন। তারা একটা বাসা নিয়েছেন। আপনারা উপযুক্ত মনে করলে আরেকটা নেবেন প্রয়োজনে।
অ্যাডভোকেট ফাওজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, মায়ের মত বাবাও যেন রাতে বাচ্চাদের সঙ্গে থাকতে পারেন সে ব্যবস্থাও চাই। বাচ্চাদের মা যে বাসা নিয়েছেন সে বাসা নিয়ে আমাদের আপত্তি আছে।
আদালত বলেন, বাবা থাকুক বা মা থাকুক আমরা চাই পারিবারিক পরিবেশে তারা বাবা-মায়ের কাছে থাকুক।
অ্যাডভোকেট ফাওজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, আমরা যৌথভাবে বাসা খুঁজতে চাই। শিশুদের মা যে বাসা নিয়েছেন সে বাসার লোকেশন নিয়ে আমাদের আপত্তি আছে।
এরপর আদালত দুইপক্ষকে বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখার অনুরোধ জানিয়ে খাস কামরায় দুই শিশুর বক্তব্য শোনেন।
প্রায় আঁধা ঘণ্টা দুই শিশুর বক্তব্য শুনে আদালত দুইপক্ষকে বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে মধ্যস্থতা করতে দুপুর ৩টা পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন।
এর আগে ২৩ আগস্ট শরীফ ইমরানের জিম্মা থেকে দুই শিশু সন্তানকে সিআইডি কর্তৃক উদ্ধারের পর আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তেজগাঁওয়ের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে উন্নত পরিবেশে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত তাদের মা এবং বেলা ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বাবা শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারবেন বলেও আদালত সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। এছাড়াও আগামী ৩১ আগস্ট শিশুদের হাইকোর্টে হাজির করতে এবং এ সময়ের মধ্যে উভয়পক্ষের আইনজীবীদের বিষয়টি সমাধান করতে ভূমিকা রাখার প্রচেষ্টা চালাতে পরামর্শ দিয়েছিলেন আদালত।
গত ১৯ আগস্ট শরীফ ইমরানের জিম্মায় থাকা দুই শিশু সন্তানকে আগামী ৩১ আগস্ট হাজির করার নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে তাদের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন আদালত। শিশুদের মা জাপানি নাগরিক নাকানো এরিকোর করা রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট এসব আদেশ দেন।
পরে দুই শিশুকে নির্যাতনের অভিযোগে তাদের মা পৃথক মামলা দায়ের করলে গত ২২ আগস্ট শিশুদের উদ্ধার করে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ- সিআইডি। এরপর তাদের তেজগাঁওয়ের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখা হয়েছিল।
প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালের ১১ জুলাই জাপানি নাগরিক নাকানো এরিকো (৪৬) ও বাংলাদেশি আমেরিকান নাগরিক শরীফ ইমরান (৫৮) জাপানি আইন অনুসারে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তারা টোকিওতে বাসবাস শুরু করেন। ১২ বছরের সংসারে তিনটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। তারা হলো-জেসমিন মালিকা (১১), লাইলা লিনা (১০) ও সানিয়া হেনা (৭)। এরিকো পেশায় একজন চিকিৎসক। মালিকা, লিনা ও হেনা টোকিওর চফো সিটিতে অবস্থিত আমেরিকান স্কুল ইন জাপান (এএসআইজে) এর শিক্ষার্থী ছিল।
চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি শরীফ ইমরান এরিকোর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের (ডিভোর্স) আবেদন করেন। একই মাসের ২১ জানুয়ারি ইমরান এএসআইজে স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে তার মেয়ে জেসমিন মালিকাকে নিয়ে যাওয়ার আবেদন করেন। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ এরিকোর সম্মতি না থাকায় তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। পরে ইমরান তার মেয়ে জেসমিন ও লিনাকে স্কুলবাসে বাড়ি ফেরার পথে বাসষ্টপ থেকে অন্য একটি ভাড়া বাসায় নিয়ে যান। পরে গত ২১ ফেব্রুয়ারি ইমরান তার দুই মেয়ে জেসমিন ও লাইলাকে নিয়ে দুবাই হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। পরে দুই মেয়েকে জিম্মায় চেয়ে বাংলাদেশের হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন দুই শিশুর মা জাপানি নাগরিক এরিকো।
