X
বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
১১ আষাঢ় ১৪৩২

দেশে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার প্রায় সমান

জাকিয়া আহমেদ
১০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৯:০০আপডেট : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২৩:৩১

গত ২৫ মে রাজধানীর সবুজবাগ থানার বাসাবোর মায়াকানন এলাকায় সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী চাঁদনি আক্তার আত্মহত্যা করে। ১৩ বছর বয়সী এই শিশুটির কোনও এক আবদার না রাখায় মায়ের সঙ্গে অভিমান করে আত্মহত্যা করেছে বলে স্বজনদের দাবি।

মোবাইল ফোন কিনে দেওয়াকে কেন্দ্র করে বাবার সঙ্গে অভিমান করে গত ৭ জুন গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে রাজধানীর কামরাঙ্গীর চরে নাসিরউল্লাহ মোহাম্মদ সানি (১৭) নামের এক কিশোর। গত ১৫ জুন রাজধানীর ডেমরা এলাকায় মায়ের সঙ্গে অভিমান করে আত্মহত্যা করে ১৫ বছরের জাকিয়া নাজনীন।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় টিকটক ও লাইকি ভিডিও তৈরিতে আসক্ত হয়ে পড়ে বগুড়ার ধুনট উপজেলার পশ্চিম ভরনশাহী গ্রামের সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী। জনপ্রিয়তা বাড়াতে ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে। লেখাপড়া বাদ দিয়ে সবসময় টিকটক নিয়ে থাকতো। আর এ নিয়ে পরিবারের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় গত ২ সেপ্টেম্বর ওই শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে।

কিশোর-কিশোরীদের সঙ্গে বাবা-মায়ের সর্ম্পক কীভাবে এবং কতটা আত্মহত্যা প্রবণতার সঙ্গে জড়িত তা নিয়ে বিশ্বে বড় পরিসরে কোনও গবেষণা হয়নি। তবে বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান লাইফস্প্রিং লিমিটেড সম্প্রতি এটি বোঝার জন্য ৫২ দেশের ১২-১৫ বছর বয়সী ১ লাখ ২০ হাজার ৮৫৮ জন কিশোর-কিশোরী নিয়ে একটি জরিপ করে।

বাংলাদেশের দুই হাজার ৫৪৫ কিশোর কিশোরী এতে অংশ নেয়। এই গবেষণার ফলাফল দ্যা ল্যানসেট এ প্রকাশিত ‘ই ক্লিনিক্যাল মেডিসিন নামক ওপেন-এক্সেস পিয়ার রিভিউড জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এই গবেষণায় এসেছে সামগ্রিকভাবে কিশোর বয়সের মেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা সমবয়সী ছেলেদের চাইতে বেশি। তবে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এই প্রবণতা কম এবং সবচাইতে বেশি আফ্রিকান অঞ্চলে। ছেলে আর মেয়েদের তুলনা করলে দেখা যায়, ধনী দেশগুলোর ছেলেদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতার হার সবচেয়ে বেশি এবং দরিদ্র দেশগুলোর মেয়েদের মধ্যে এই হার সবচেয়ে কম।

তবে বাংলাদেশে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার প্রায় সমান। যথাক্রমে ১১ দশমিক ছয় শতাংশ আর ১১ দশমিক সাত শতাংশ। আর এর সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন দেশের মানসিক স্বাস্থ্য রোগ বিশেষজ্ঞরাও। তারা বলছেন, আমাদের দেশে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে তেমন কোনও ভেদাভেদ নেই।

বাংলাদেশে প্রতি বছর কমপক্ষে ১৩ থেকে ৬৪ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। গত এক যুগে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে আত্মহত্যায় মৃত্যুহার প্রতি লাখ মানুষে কমপক্ষে সাত দশমিক আট থেকে ৩৯ দশমিক ছয় জন। বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্টে বোঝা যায় যে দেশে আত্মহত্যার হার বাড়ছে। এখন পর্যন্ত দেশে আত্মহত্যার সঠিক হার নির্ণয় না করা গেলেও গবেষণায় দেখা যায়, কিশোর-কিশোরী এবং কমবয়সী তরুণদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত বাংলাদেশি গবেষকদের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে অন্তত প্রতি দশ জনে একজন কিশোর-কিশোরীর মধ্যে আত্মহত্যা  প্রবণতা রয়েছে।

এদিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আত্মহত্যাকে ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যার পূর্বাভাস কৈশোরেই পাওয়া যায়। সেটা সম্ভব হয় কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যা  প্রবণতা আছে কি না তা বুঝার মাধ্যমে। তারা বলছেন, আত্মহত্যার চিন্তা, পরিকল্পনা এবং চেষ্টা- এ তিনটি বিষয়ের কোনও একটি যদি কারও মধ্যে বিদ্যমান থাকে, তাহলে তার আত্মহত্যা প্রবণতা আছে বলে ধরে নেওয়া যায়।

গবেষণা জানাচ্ছে, বিশ্বে ১২ থেকে ১৫ বছর বয়সীদের প্রতি ছয়জনে অন্তত একজনের মাঝে এই তিনটি বিষয়ের যে কোনও একটি আছে। কৈশোরে আত্মহত্যা প্রবণতা থাকা যেমন ভবিষ্যতে আত্মহত্যা করাকে ইঙ্গিত করতে পারে, তেমনি এটি কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে বিভিন্ন মানসিক সমস্যাও সৃষ্টি করতে পারে। আবার বিভিন্ন মানসিক, সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যাও একজনের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি করতে পারে।

উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে ছেলেদের আত্মহত্যার হার বেশি। কিন্তু মধ্যম আয় আর নিম্ন আয়ের দেশে এই হার সমান-সমান বলেন। এই গবেষণা দলের নেতৃত্বদানকারী মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সায়েদুল আশরাফ। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, আমাদের দেশে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে সমান সংখ্যায় বিষণ্নতায় ভোগে।

এক্ষেত্রে ছেলেদের ‘আর্টিফিসিয়াল শক্ত’ না হওয়ার পরামর্শ দেন এই চিকিৎসক। তিনি বলেন, তাদের (ছেলেদের) যদি কোনও সমস্যা হয় তাহলে যেন তারা ‘এক্সপ্রেস’ (প্রকাশ) করে। একইসঙ্গে নারীদের ক্ষেত্রে নানারকম ‘ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স’ থাকে বাংলাদেশে, মেয়েরা অনেক বেশি ভোগে ছেলেদের চাইতে। নারীদের যদি এক্ষেত্রে সহযোগিতা করা যায় পারিবারিক এবং সামজিকভাবে তাহলে মেয়েদের ক্ষেত্রে এই হার কমিয়ে আনা সম্ভব।

বাচ্চারা এখন অনেক বেশি সোশ্যাল মিডিয়াতে ‘ইনভলভ’ হয়ে পড়ছে। অনেক সময়েই তারা সঠিক গাইডেন্স থাকে না। এমন কিছু কনটেন্ট দেখে ফেলে যা তাদের ‘কনফিউজড’ করে তোলে জীবনের ক্ষেত্রে। ফিলোসফিক্যালি তারা অনেক দিকভ্রান্ত থাকে জানিয়ে ডা. সায়েদুল আশরাফ বলেন, সেই সঙ্গে বাবা-মায়েরা মেন্টাল হেলথ ইস্যুতে খুবই কম সাপোর্টিভ আমাদের দেশে।

যার কারণে সন্তানকে পাগল মনে করে, বুলি করে-যেটা সন্তানকে আরও দুর্দশার ভেতরে ফেলে দেয়। যার কারনে এসব সমস্যা হচ্ছে, বলেন তিনি। আর এজন্য শরীরের অসুখ হলে চিকিৎসকের কাছে সন্তানকে নিয়ে যান বাবা-মা, ঠিক তেমনি এরকম মানসিক সমস্যা হলে চিকিৎসক দেখানো প্রয়োজন মনে করতে হবে।

কারণ যত বেশি দেরি হবে, তত বেশি খারাপ হবে। তাই এই স্টিগমা ভেঙে ফেলতে হবে, বলেন সায়েদুল আশরাফ।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বাংলাদেশে ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি এবং এখানে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে তেমন খুব একটা পার্থক্য নেই।

তাই কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে বেশি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন জানিয়ে তিনি বলেন, ইকো-লজিক্যাল সিস্টেমের কারণে পারিবারিক পরিবেশ, নিজেদের বেড়ে ওঠা, শিক্ষা, চারপাশ এবং সর্বোপরি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অনেক বিষয়ও এই শ্রেণিকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে।

তিনি আরও বলেন, পরীক্ষা পদ্ধতি-স্কুলিং-রেজাল্ট, এসবও প্রভাব ফেলে।

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, পরিবার, বাবা-মা, বাবা-মায়ের এক্সপেক্টেশন-এসবও মানসিক স্বাস্থ্যকে কোনও না কোনওভাবে প্রভাবিত করে।

যখন এ বিষয়গুলো ইতিবাচক থাকে তখন তাদের সক্ষমতা বাড়ে আর যখন সেটা নেতিবাচক হয় তখন তাদের মানসিক স্বাস্থ্য বিপন্ন হয়। আর মানসিক স্বাস্থ্য বিপন্ন হলেই আত্মহত্যা, নিজের ক্ষতির দিকে ধাবিত হয়।

/এফএএন/
সম্পর্কিত
সেগুনবাগিচায় ক্যানসার আক্রান্ত বৃদ্ধার আত্মহত্যার অভিযোগ
ঋণের চাপে ডিম বিক্রেতার ‘আত্মহত্যা’
বটগাছের ডালে ঝুলে ছিল ট্রাকচালকের মরদেহ
সর্বশেষ খবর
সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে: জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট
সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে: জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট
৫ আগস্ট জুলাই অভ্যুত্থান, ৮ আগস্ট নতুন বাংলাদেশ ও ১৬ জুলাই শহীদ আবু সাঈদ দিবস
৫ আগস্ট জুলাই অভ্যুত্থান, ৮ আগস্ট নতুন বাংলাদেশ ও ১৬ জুলাই শহীদ আবু সাঈদ দিবস
কনা দিলেন বিচ্ছেদের খবর, স্বামী বললেন ‘না’!
কনা দিলেন বিচ্ছেদের খবর, স্বামী বললেন ‘না’!
আন্তর্জাতিক নির্যাতনবিরোধী দিবসে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা কাঠামো সংস্কারের জোর দাবি
আন্তর্জাতিক নির্যাতনবিরোধী দিবসে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা কাঠামো সংস্কারের জোর দাবি
সর্বাধিক পঠিত
রাইস কুকারে রান্না করতে গিয়ে মা-মেয়ের মৃত্যু
রাইস কুকারে রান্না করতে গিয়ে মা-মেয়ের মৃত্যু
যে কারণে শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী টিটুকে সরিয়ে দিলেন ট্রাইব্যুনাল
যে কারণে শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী টিটুকে সরিয়ে দিলেন ট্রাইব্যুনাল
বছরে ৯৬০ কোটি টাকা সুদ দিতে হয়, চলছে না আইসিবি: অধ্যাপক আবু আহমেদ
বছরে ৯৬০ কোটি টাকা সুদ দিতে হয়, চলছে না আইসিবি: অধ্যাপক আবু আহমেদ
আটকের পর অধ্যক্ষ বললেন ‘আ.লীগ করায় দোষ হলে যেকোনও শাস্তি মেনে নেবো’
আটকের পর অধ্যক্ষ বললেন ‘আ.লীগ করায় দোষ হলে যেকোনও শাস্তি মেনে নেবো’
ইশরাক বললেন ক্ষমা চাইতে, আসিফ দিলেন ‘কড়া বার্তা’
ইশরাক বললেন ক্ষমা চাইতে, আসিফ দিলেন ‘কড়া বার্তা’