X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কবিতা, সাহিত্য, সংগ্রাম

দীপংকর গৌতম
১০ অক্টোবর ২০২১, ১১:৪৩আপডেট : ১০ অক্টোবর ২০২১, ১৪:৪৩

কবিতার কথা আর কি লিখব? ভেতরে কবিত্ব না থাকলে কবিতা হয়? যদিও কার হয় কার হয় না সেটাই দেখি সবচেয়ে আলোচ্য বিষয়। হওয়াটা যে এন্টিবায়োটিক ট্যাবলেট না সেটা আমার বুঝ—একান্ত আমার। তারশংকরের ‘কবি’ উপন্যাসে নেতাইর যদি কবিতা না হয় তাহলেও তার করার কিছু নেই। কারণ সে তো আর কিছু করতে পারে না। এভাবে কবিতা লিখতে সমর্পণ লাগে। এক সময় কলকাতায় দেখেছি, নেপালে, শ্রীলংকাতেও কবিরা শুধুই কবি। সর্বোচ্চ কোনো পত্রিকা অফিস বা প্রকাশনীতে কাজ করেন। তবু সমাজে তিনি সম্মানিত। আমাদের দেশে তার উল্টো (অবশ্য উল্টো হলে যে কবিতা হবে না এই হওয়া না হওয়ার সঙ্গে আমার কোনো যোগ নেই। আমি একটা সময়ের কথা বলছি। আমাদের সময়ের কথাই যদি বলি—আমরা কতজন একসঙ্গে চলতাম। শুধু ঢাকায় না ঢাকার বাইরেও।আমি পত্রিকার কাজে সারা দেশ ঘুরতাম একই সঙ্গে কবিদের আড্ডা—কবিতার আড্ডা হতো। আমার সেইসব বন্ধুরা অনেকেই আমলা পদস্থ ইত্যাদি। আমি লোলেখি ছাড়া আর কিছু করি না (পত্রিকার কাজ লেখালেখি এই সূত্রে)। তাতে বন্ধুত্ব তো আর যায় না। তবে ওই শ্রেণিবিভক্তি তা কিন্তু হয়েছে। যারা শ্রেণিগতভাবে এক জায়গার তারা যেসব অনুষ্ঠান করে তা আমি দেখি সামাজিক গণমাধ্যমে। আমিও যেখানে যাই তারা আমার শ্রেণির। পুঁজির যে অসম বিকাশ এবং শ্রেণিবিভক্ত হওয়ার যে ঘটনাগুলো দ্রুত ঘটছে তাতে আমরা সমাজে নতুন একটি শ্রেণিকে দেখছি যারা আমলা, কাঁচা টাকার মালিক তাদের সাহিত্যের একটা গ্রুপ আছে। যাদের টাকা আছে, চাকা আছে। তাদের উৎসব আছে, প্রকাশনা আছে। কিন্তু সেখানে আমি নেই। এই না থাকাটা কষ্টের এজন্য বিত্ত-বৈভবের প্রত্যাশা আমার কোনোকালে ছিলো না, এখনও নেই। কিন্তু বন্ধুহীন হওয়ার কষ্ট অনেক। আত্মীয় স্বজন যারা রাতারাতি বড়লোক হয়ে গেছে তারাও অনুষ্ঠানে না ডেকে পারলে ডাকে না। এ চর্চাটা মানে অনেক টাকা না থাকলে গুরুত্ব দেওয়া যাবে না এটা আর কোথাও দেখিনি। এটা আমার আক্ষেপ না—এটা সংগ্রামের একটা অধ্যায়। আমার লেখার ভেতরে রাজনীতি, অবক্ষয় যেমন আছে আছে প্রেম, প্রকৃতি, নিসর্গও। আমার মনে হয়েছে লেখকের হতাশার কিছু নেই। বরং, এটাই সাহিত্যের উপাদান। এভাবেই সাহিত্য হয় তারপর কাল বিচারে তা মানোত্তীর্ণ হয়। কিন্তু সময় যেন খেমটা তালে নাচছে। জ্ঞানের চর্চার জায়গাটা এত ছোট হয়ে আসছে। কোথাও নতুন একটা বইয়ের দোকান হচ্ছে না—খাবারের দোকান আর ক্লিনিক। সাহিত্যে দল, দোকান, গ্রুপ এসবে কাজ দেয় না। আসল হলো চর্চা। এই করোনায় ধস নেমে গেল, শহর থেকে চলে গেল কত মানুষ, কত মানুষ ক্ষুধার্ত। রাস্তার পাশে গভীর রাতে শুয়ে থাকা মানুষগুলোকে সজাগ পাথর মনে হয়। এক সময় গণমানুষকে নিয়ে লেখার একটা ট্রেন্ড ছিলো এখন সেটা অনেক কমে গেছে। সাহিত্যে রাজনীতির উপস্থিতি কম, দেশেও নেই। মানুষ সব ছেড়ে যেন সর্বগ্রাসী ক্ষুধায় প্রমত্ত। আামি ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়ন, পরে উদীচী, ছায়ানট সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি করি। আমার ভেতরের বিপ্লব আমি করছি। কিন্তু চারদিকের পরিবেশ-বিশ্বের পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে সমাজে টাকাওয়ালা বাড়ছে যে হারে লেখক-কবিদের সংখ্যা কমছে সেই হারেই। তারপরে ডিজিটাল আইন আছে। প্রয়োগ আছে। এর বিরুদ্ধে কথা বলার মানুষ নেই। তবে এই অচলায়তন কবিতা-সাহিত্য তৈরির উপযুক্ত সময়। এ সময় আমার অনেকগুলো কাজ আসছে—আসবে। আমি প্রগতি লেখক সংঘের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে সভা-সমাবেশে যাই। আর লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত থাকি। যে সময় আমরা পার করছি এ সময় যত কঠিন হবে, বিত্তের প্রভাব যত বাড়বে—মৌলিক সাহিত্য ততই হালে পানি পাবে—এ বিশ্বাস নিয়ে লেখি। এভাবেই রাত যায় দিন যায়—চুলে চিল্কায় বয়স। আমি জ্ঞানচর্চা-সাহিত্যচর্চার সুদিনের স্বপ্ন দেখি। আমি যা কিছু বলছি—এটা আমার বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের মধ্যে থেকে সাহিত্য করি। আর কিছু করব না, করতে পারি না। আমার একথায় কারো সায় আছে কি না জানি না। তবে যা বলেছি এটাই সমকালীন সাহিত্য বা তার চলমান অবস্থার চিত্র।

 

উপেক্ষা

তোমার উপেক্ষাগুলো পথের দুপাশে দেবদারু বৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। 
তবু আমি পাতাদের সংসারে কবিতার চাষে ব্যস্ত সময় কাটাই।
কতকাল যেন আকাশ দেখি না, পাখির কুজন কিংবা 
ঢাকের প্রাণহরা বাদ্য শুনি না। 
আমাদের তল্লাট থেকে রয়ানির গান, পদকীর্তন 
ডাহুক কিংবা তিলাপরা ঘুঘুর মতো বিরল হয়ে গেছে
শৈশবে আমার বন্ধু জাহিদের কাছ থেকে ঘুঘু ধরা শিখেছিলাম।
চৈত্রের দুপুরগুলো আমাদের ঘুঘু খুঁজতে চলে যেত।
এখন শৈশবগুলো ইটের বস্তার মতো বই বহন করে।
শিক্ষা বেঘোরে ঘুমায় ইশকুলের আলোকিত অন্ধকারে।
উপেক্ষার অংক শিখে আমি ঝরা পাতাদের সংসারে 
কালকেউটের প্রশ্বাসের গন্ধ নেই। 
রিকশার হুডগুলো তবু ঝুলে থাকে মৃত মানুষের মতো।
উপেক্ষার ঘোর ভেঙে দাঁড়াতে চায়—পারে না।একদম না।
জগদ্দল পাথরের মতো উপেক্ষাগুলোও উপেক্ষিত জানালায় মরিচা ধরা শিক, 
মাকড়সার জাল ময়লা ধরা বেডশিট। টেবিলভর্তি শূন্যতা,
গভীর রাতে সড়কের একাকিত্ব নিয়ে কুকুর কুণ্ডুলী হয়ে পড়ে থাকে। 
বিশ্বের সতেজ ঘুমগুলো তখনও 
জেরুজালেমের রাষ্ট্রীয় বুটের শক্তির কাছে নতজানু হয়ে থাকে।


দিতে পারি

দিতে পারি, সাত পুরুষের রক্ষিত ধন, চোখের আলো, হৃৎপিণ্ডে শেষ হয়ে আসা শব্দগুলো, সেতারের গমকের মতো যেগুলো সুরের মূর্চ্ছনাকে গতিময়ম-বাঙময় করে, আঙুলের বিশদগুলো তাও। দিতে পারি একগুচ্ছ সাজানো অক্ষর। বাইবেলে ওর্ড স্টামেন্টের মতো যা সারা দিন তাকিয়ে থাকে সাধু থমাসের গির্জাগুলোয়। কপিলাবস্তু নগরীরে বুদ্ধ বাড়ির শীতলতা কিংবা বুদ্ধ গজার নির্বাণ লাভের সেই বোধি বৃক্ষের পাতা। শরীরের বল্কলগুলো হাঁসের পাখনার মতো ছিঁড়ে দিতে পারি। মায়ের রাখা গহনাগুলো তাও দিতে পারি। দিতে শিখেছি না পাওয়ার বৈভবে দুলতে দুলতে।
শীত আসছে, পাতাগুলো দিচ্ছে বৃক্ষ, এখনি। আমি বৃক্ষের কাছ থেকে উজাড় হতে শিখেছি, দিতে শিখেছি। এভাবে বিলীন হলে তুমি শুধু হাসপাতাসের ধবল কাপড়ে একটু শান্তি-সুখেরে স্তব দিয়ো। যতদূর মনে পড়ে, আমি কখনো সুখে ছিলাম না।


মায়ের আলাচালধোয়া হাতখানা

সেই শৈশবে আমার গুলতি, ঘুঘুর বাসা খোঁজা, যাত্রা-রয়ানির রাত পুড়ে গেল
মায়ের শ্মশানে। আমি স্বচক্ষে পুড়তে দেখেছি আমার অনাগত দিন, বাজপাখির প্রহর নির্ধারণ করা রাতে আাঁধারে বস্তির ঝুপড়ির মতো পুড়ে যাচ্ছে আমার অনন্ত সময়।
সান্ধ্য আকাশে প্রদোষ আলোর স্নিগ্ধতা নিয়ে চিল ওড়ে। ধানখেতে শিরদাড়ার মতো আলপথ মাড়িয়ে নাইওরে যায় মেয়ে। লাল শাড়ি ঢাকা মোহনীয় দিন। বিয়েতে পাওয়া টেপ রেকর্ডার চালিয়ে চলা জামাই। কোনো কিছুর প্রতি আগ্রহ ছিল না। দিন দিন মোহহীন হয়ে ওঠাই যেন জীবন। 


সে নদীটা তুমি

মনে পড়ে? আমি আকাশ মেঘের পদাবলি পড়ে নদীর গান গাইলাম—জলেশ্বরী আমার-সে নদীটা শুধু তুমি। ধল পাহাড় ফেটে নেমে আসা ঝর্নার শাস্ত্র পড়ে আমি তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি তোমার চোখে একশো নদী ঘুমিয়ে আছে। আমি নদীর ঘুম ভাঙাতে চাইনি বলে তোমার কাছেই ফিরে আসলাম। তোমার নামে আমি ভাসছি—ভাসছি আর ভাসছি—
যতটুকু সাজে মোহন বাঁশি বেজে ওঠে তুমি ততটুকু সাজো। ওটুকুতেই আমি ইলোরা-অজন্তা গুহাচিত্রের সচিত্র দৃশ্য দেখি—আনন্দ পাই। তোমায় না দেখা কষ্ট কখনো অভিমন্যু হত্যার শোক ছাপিয়ে যায়। তবু দশ মাস দশ দিন পরে তোমার এ কথাগুলো শোনার লোভে আামি শব্দকে শানিত করি কর্ণের অভ্রভেদি তিরের মতো।


রাত্রি নীল

রাত্রি নীল অপেক্ষা করো, আর একটু পরে মানুষ ঘুমিয়ে যাবে। 
ক্যাসিওপিয়া নক্ষত্রটা হেলে যাবে দক্ষিণ শিয়রে। 
পাতাদের ঘরে শোক। 
ঝরে যাবে সব। 
যাওয়ার আগে তারা বৃক্ষদের সঙ্গে এক মৌন মিছিলে অংশ নেবে।
তারা এখন ঝরে যাবে আর শোকে লীন।
প্রত্যেকটি রাত বড় যন্ত্রণামুখর, বড় বিদায়ী। 
প্রহর বদলায় পাতা ঝরে যায়। 
কি রিক্ততা বুকে নিয়ে বেঁচে থাকে বৃক্ষরা। 
জন্মের প্রতি আজন্ম আত্মশ্লাঘায় পাতারাও।
জোয়ার নেমে যাবে ভাটায়। পাতা বদলাবে, বদলাবে বৃক্ষের ভাষা।
তবু তুমি বদলাবে না। শুধু তুমি...

/জেডএস/
সম্পর্কিত
প্রিয় দশ
দোআঁশে স্বভাব জানি
প্রিয় দশ
সর্বশেষ খবর
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ