X
বুধবার, ২১ মে ২০২৫
৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
দস্যু জীবনের রোমহর্ষক বর্ণনা

‘লিডারকে গুলি করে নৌকা দখলে নিয়েছিলাম’

নুরুজ্জামান লাবু, সুন্দরবন থেকে ফিরে
০৫ নভেম্বর ২০২১, ২১:৫৯আপডেট : ০৬ নভেম্বর ২০২১, ০০:১৫

‘একবার আমরা মিয়ানমার সীমান্তের দিকে নৌকা নিয়ে গেলাম ডাকাতি করতে। মিয়ানমার সীমান্তে ইলিশের ট্রলার বেশি পাওয়া যায়। একটা ট্রলার ডাকাতি করতে পারলে ৩-৪ লাখ টাকা পাওয়া যায়। আমরা ছিলাম ১০ জন। এই ১০ জনের হাতেই ১০টা অস্ত্র। কিন্তু ডাকাতি না করে আমরা তিন জন বেইমানি করলাম সহযোগীদের সঙ্গে। সবার অস্ত্র ক্লোজ করে নিলাম কৌশলে। সুন্দরবনে ফিরে এসে আক্রমণ করলাম লিডারের নৌকায়। সবাই পলাইলো। নৌকা আর অস্ত্রের দখল নিয়ে গঠন করলাম নতুন বাহিনী। নাম দিলাম মাস্টার বাহিনী।’

এক নিশ্বাসে নিজের দস্যু জীবনের বর্ণনা করছিলেন বছর ত্রিশের সোলাইমান শেখ। হালকা-পাতলা ছিপছিপে গড়নের সোলাইমান তরুণ বয়সেই নাম লিখিয়েছিলেন দস্যু দলে। অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন দস্যু বাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগেই, রাজনীতি করতে গিয়ে। ছোটবেলা থেকেই ভীষণ ডানপিটে আর সাহসী সোলাইমান ফিরে এসেছেন স্বাভাবিক জীবনে। ২০১৬ সালের ৩১ মে সাংবাদিক মোহসিনুল হাকিমের মাধ্যমে র‌্যাবের কাছে আত্মসমপর্ণ করেন তিনি। এখন গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের রামপাল শ্রীফলতলায় মুদি দোকান করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে কয়েক দশক ধরেই জলদস্যুরা আস্তানা গড়ে তুলেছিল। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিন বছরে ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন দস্যু ৪৬২টি অস্ত্র নিয়ে র‌্যাবের কাছে আত্মসমপর্ণ করেন। ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করেন। দস্যুমুক্ত সুন্দরবনের তৃতীয় বর্ষ উপলক্ষে বাগেরহাটের রামপালে আত্মসমপর্ণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সাবেক দস্যুদের বিভিন্ন সহায়তা দেওয়া হয় র‌্যাবের পক্ষ থেকে। সেখানেই কথা হয় সোলায়মান শেখের সঙ্গে।

দস্যু বাহিনীতে যোগ দেওয়ার কাহিনি জানতে চাইলে সোলাইমান শেখ বলেন, ‘আমি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলাম। ছোটবেলা থেকেই দুষ্টু আর সাহসী ছিলাম। এলাকায় রাজনীতি শুরু করেছিলাম। এই রাজনীতিই আমাকে দস্যু বাহিনীতে ঠেলে দিয়েছে।’

‘সালটা ছিল ২০০৯। এলাকায় রাজনীতি করতে গিয়ে আধিপত্য ধরে রাখা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আধিপত্য ধরে রাখতে আমি একটা অস্ত্র কিনি। মায়ের গয়না বিক্রি করে বেনাপোল থেকে এক লাখ টাকা দিয়ে একটা নাইন এমএম পিস্তল কিনি। ওটা আমার সঙ্গেই থাকতো। একদিন আক্রোশের বশে এলাকার জামু চেয়ারম্যানকে লক্ষ্য করে ভয় দেখানোর জন্য গুলি করেছিলাম। গুলি তার শরীরে লাগেনি, কিন্তু আমার নামে মামলা হলো। তখন থেকেই শুরু হলো পলাতক জীবন’, বলছিলেন সোলাইমান শেখ।

স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সোলাইমান শেখ বলেন, ‘আমার নামে একে একে চারটি মামলা হলো। পুলিশের ভয়ে বাড়িতে থাকতে পারি না। ছেঁড়া লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে পালিয়ে চলে গেলাম রাঙামাটি। সঙ্গে সেই নাইন এম এম পিস্তল। রাঙ্গামাটিতে কাজ করতাম। সেখানেও পাহাড়ি একটি সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে পরিচয় হলো। তাদের দুজনকে নিয়ে দুটি অস্ত্রসহ ছয় মাস পর ফিরে গেলাম সাতক্ষীরার মুন্সীগঞ্জের শ্যামনগরে। শ্যামনগরে পাহাড়ি দুই জনকে একটি দোকানে বসিয়ে রেখে অস্ত্র দুটি নিয়ে আমি ভেগে গেলাম। পরদিন অবশ্য ২০ হাজার টাকা পাঠিয়েছিলাম ওদের কাছে।’

নিজের জীবনের গল্প শোনাতে গিয়ে সোলাইমান শেখ বলেন, ‘প্রথমে আমি সবুজ নামে একটা গ্রুপের সঙ্গে নৌকায় উঠলাম। আমার কাছে তিনটা অস্ত্র। আমার কদর আছে। আমরা তিন জনে মিলে একটা নৌকা নিয়ে নদীতে ছিনতাই শুরু করলাম। প্রথম তিন মাসেই আমাদের ১২-১৪ লাখ টাকা আয় হলো। এভাবেই শুরু হলো আমার জঙ্গলে দস্যু জীবন।’

র‌্যাবের পক্ষ থেকে সোলাইমান শেখের হাতে উপহার সামগ্রী তুলে দিচ্ছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান

সোলাইমান শেখের মতোই সুন্দরবনের দস্যুতা করে বেড়ানো বেশিরভাগই রাজনৈতিক নানারকম প্রতিহিংসা ও আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে মামলায় জড়িয়ে দস্যুতার খাতায় নাম লিখিয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে পলাতক জীবনযাপন করতে গিয়ে কেউ কেউ নিজেই দস্যু বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। কেউ কেউ সেসব বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। ডাকাতি আর জেলেদের অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায় করাই ছিল তাদের কাজ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভয়ে কেউ নিজের এলাকায় ফিরতে পারতেন না। স্বজনদের সঙ্গে গোপনে সাক্ষাৎ হতো দূরের কোনও এলাকায় গিয়ে।

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সুন্দরবনের জেলে ও দস্যুদের নিয়ে কাজ করে আসা সাংবাদিক মোহসীন-উল হাকিম বলেন, ‘দস্যুদের একেকজন একেক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে দুস্য জীবনে গিয়েছিল। এখন তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। এখন তাদের সমাজে পুনর্বাসন করতে হবে। একই সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে, যাতে কোনও পরিস্থিতির শিকার হয়ে কেউ আবারও দস্যু জীবনে ফিরে না যায়।’

দস্যু জীবন থেকে ফিরে আসা সোলাইমান শেখ বলেন, ‘‘একপর্যায়ে আমি অস্ত্রসহ নোয়া মিয়া গ্রুপে যোগ দিলাম। কিন্তু নোয়া মিয়া ভাগের টাকা কম দিতো। আমিসহ মোস্তফা শেখ, সোহাগ আকন্দ, আমাদের গুরুত্ব দিতো কম। আমাদের প্রতি বৈষম্য করা হতো। এ অবস্থায় একটা ডাকাতির জন্য গেলাম গভীর সমুদ্রে। নৌকায় ছিলাম আমরা ১০ জন। সঙ্গে ১০টা অস্ত্র। আমি, মোস্তফা শেখ ওরফে কাদের মাস্টার আর সোহাগ মিলে বুদ্ধি করলাম, নোয়া মিয়ার বাহিনী ছেড়ে দেবো। তার অস্ত্র সব নিয়ে নেবো। পরিকল্পনা মতো আমরা নৌকায় থাকা সবার অস্ত্র ক্লোজ করে ডাকাতি না করেই ফিরে এলাম বনে। তখন ভোর ছিল। বনের মধ্যে নোয়া মিয়ার নৌকার কাছে ফিরে এসে সিগন্যাল দিলাম অপারেশন সাকসেস হয়েছে। নোয়া মিয়া অস্ত্র ছাড়াই নৌকার কেবিনের ওপরে উঠে আসতেই আমরা এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করলাম। এতে সবাই লাফিয়ে পানিতে পড়ে পালিয়ে গেলো। ওরা কেউ অস্ত্র হাতে নেওয়ার সময়ই পায়নি। নৌকায় শুধু নোয়া মিয়ার ভাই মানজুরের হাতে গুলি লেগেছিল। বোট দখলে নিয়ে আমরা নতুন বাহিনী গড়ে তুললাম। নাম হলো ‘মাস্টার বাহিনী’। মোস্তফা শেখ ওরফে কাদের মাস্টার আমাদের নেতা ছিল। সোহাগ আকন্দ ছিল সেকেন্ড ইন কমান্ড।’’

২০১৬ সালের ৩১ মে এই মাস্টার বাহিনীই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। ৯ জন সদস্য, ৫২টি অস্ত্র এবং পাঁচ হাজারেরও বেশি গুলিসহ আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে ছিলেন সোলাইমান শেখও। এই আত্মসমর্পণের পুরো ব্যবস্থাটা করেছিলেন সাংবাদিক মোহসীন-উল হাকিম। আলাপচারিতায় সোলাইমান শেখও জানালেন, ‘মোহসীন ভাই-ই আমাগো জঙ্গল থিকা ডাঙ্গায় নিয়া আইছে। উনি না থাকলে হয়তো আমরা কেউ আর পরিবারের কাছে বা এলাকায় ফিরতে পারতাম না।’

/এপিএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
র‌্যাব সদস্যদের অতীত ভুলে নতুন উদ্যমে কাজ করার আহ্বান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার
অ্যাম্বুলেন্সে করে গাঁজা পাচার, যুবক গ্রেফতার
মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নেওয়া শিশুকে উদ্ধার করেছে র‍্যাব
সর্বশেষ খবর
শেখ হাসিনাসহ ৩৯৩ জনের বিরুদ্ধে করা মামলা তুলে নিলেন বিএনপি নেতা
শেখ হাসিনাসহ ৩৯৩ জনের বিরুদ্ধে করা মামলা তুলে নিলেন বিএনপি নেতা
সবার ঐক্যবদ্ধ থাকা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ: মঈন খান
সবার ঐক্যবদ্ধ থাকা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ: মঈন খান
হাতকড়া নিয়ে পালিয়েছেন দুই আসামি
হাতকড়া নিয়ে পালিয়েছেন দুই আসামি
সুফিউর রহমানের দায়িত্ব পরিবর্তন হতে পারে
সুফিউর রহমানের দায়িত্ব পরিবর্তন হতে পারে
সর্বাধিক পঠিত
কক্সবাজারে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিলো মার্কিন সেনা-বিমান বাহিনী
কক্সবাজারে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিলো মার্কিন সেনা-বিমান বাহিনী
ধানমন্ডি থানা থেকে ৩ জনকে ছাড়িয়ে নেওয়ার ঘটনায় হান্নান মাসউদকে শোকজ
ধানমন্ডি থানা থেকে ৩ জনকে ছাড়িয়ে নেওয়ার ঘটনায় হান্নান মাসউদকে শোকজ
কে হচ্ছেন নতুন পররাষ্ট্র সচিব 
কে হচ্ছেন নতুন পররাষ্ট্র সচিব 
পাসপোর্টের সেই বিতর্কিত তিন পরিচালকের ‘বিদায়ঘণ্টা’ বাজছে
পাসপোর্টের সেই বিতর্কিত তিন পরিচালকের ‘বিদায়ঘণ্টা’ বাজছে
‘ফ্যাসিবাদের সহযোগী’ আখ্যা দিয়ে তালিকা প্রকাশ জুলাই ঐক্যের
‘ফ্যাসিবাদের সহযোগী’ আখ্যা দিয়ে তালিকা প্রকাশ জুলাই ঐক্যের