X
শনিবার, ১৮ মে ২০২৪
৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
সরেজমিন দুবলার চর

‘সরকার কোটি টাকা নেয়, কিন্তু সুবিধা দেয় না’

নুরুজ্জামান লাবু, সুন্দরবন থেকে ফিরে
০৯ নভেম্বর ২০২১, ১১:০০আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০২১, ১৬:৫৬

একদিকে কুঙ্গা, আরেক দিকে পশুর নদ। সুন্দরবনের দক্ষিণে বিশাল এক চর। নাম দুবলার চর। বছরের সাত মাস এই চর থাকে ফাঁকা। কোনও জনবসতি থাকে না সেখানে। বাকি পাঁচ মাস লোকে লোকারণ্য। বসত গড়ে তোলেন জেলেরা। সাগর ও নদী থেকে ধরে আনা মাছ সেখানে শুকানো হয় রোদে। তারপর প্রক্রিয়াজাত করে সেই শুঁটকি ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। দুবলার চরের শুঁটকি রফতানি হয় বিদেশেও। সরকার প্রতিবছর দুবলার চরের শুঁটকি পল্লি থেকেই তিন কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আয় করে। কিন্তু বিনিময়ে জেলেদের জন্য কোনও সুবিধা নেই সেখানে। সম্প্রতি দুবলার চর ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে।

দুবলার চরের জেলেরা বলছিলেন, একদিকে সিন্ডিকেট বা সাহেবরা খায় লাভের অংশ, আরেক দিকে সরকার আয় করে রাজস্ব। কিন্তু জেলেদের নিয়ে কেউ ভাবে না। জেলেদের ভালো হবে—এমন কোনও উদ্যোগ নেই কারও পক্ষ থেকে। শীত মৌসুমে দুবলার চরে জেলে ও অন্যান্য কর্মী মিলিয়ে প্রায় ২০-২৫ হাজার লোক বাস করেন। কিন্তু এখানে কোনও মেডিক্যাল ক্যাম্প নেই। কেউ অসুস্থ হলে তাকে নিকটবর্তী মোংলা পর্যন্ত নিতেও ৭-৮ ঘণ্টা লেগে যায়। এছাড়া দুবলার চরে সুপেয় পানিরও ব্যবস্থা নেই। জেলেপল্লির বাসিন্দাদের দূর থেকে পানি এনে পান করতে হয়।

নরেন চন্দ্র নামে এক জেলে বলেন, ‘সরকার শুধু কোটি কোটি টাকা নেয়। আমাগো জন্যে কিছু করে না। এহানে একটা মেডিক্যাল ক্যাম্প করলি আমাদের জন্যি ভালো হতো। একটা নৌ-অ্যাম্বুলেন্স থাকলি ভালো হতো। কিন্তু এডি করবি কিডা। সবাই তো শুধু নিজেগো জন্যি খাই খাই করে।’

সরেজমিন সুন্দরবনের দুবলার চর ঘুরে দেখা গেছে, অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে থেকে এখানে শুরু হয়েছে জেলেদের বসতি। বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে এই চরে অস্থায়ীভাবে ঘর তোলা যায়। করা যায় দোকানপাটও। নদী ও সাগর থেকে ধরে আনা মাছ শুকানো শুরু করেছেন জেলেরা। এই মাছ শুকিয়ে ও প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি করা হবে। মাছ ধরা, শুঁটকি বানানো, প্রক্রিয়াজাত ও বিকিকিনির এই কর্মযজ্ঞ চলবে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত।

দুবলার চরের জেলেরা বলছেন, সুন্দরবনের নদী ও সাগরে মাছ ধরতে বন বিভাগের অনুমতি লাগে। বন বিভাগ থেকে লাইসেন্স নিয়ে মাছ ধরতে হয়। মাছ ধরার পর আবার সরকারি রাজস্ব দিয়ে সেই মাছ বিক্রি করা যায়। কিন্তু সাধারণ জেলেরা কেউ দুবলার চরের মাছের প্রক্রিয়াজাত করার লাইসেন্স পান না। স্থানীয় প্রভাবশালীদের কাছে এই লাইসেন্স বিক্রি করা হয়। সরকারি ফি ১০ হাজার টাকা হলেও এই লাইসেন্স নিতে তদবির ও অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হয়। তবে এবারই প্রথমবারের মতো প্রান্তিক জেলে হিসেবে বেলায়েত সরদার নামে এক ব্যক্তি লাইসেন্স পেয়েছেন।

বন বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছর দুবলার চরে ঘর নির্মাণসহ মাছ প্রক্রিয়াজাতের জন্য ১৫ জনের নামে লাইসেন্স দিয়েছে বন বিভাগ। তারা হলেন—কামাল উদ্দিন আহমেদ, আফিয়া বেগম, খান শফিউল্লাহ, শেখ মইনুদ্দিন আহমেদ, আরিফ হোসেন, রেজাউল শেখ, এবিএম মুস্তাকিন, ইদরিস আলী, হাকিম বিশ্বাস, জালাল উদ্দিন আহমেদ, সুলতান মাহমুদ, কামরুন নাহার, শাহানুর রহমান, আসাদুর রহমান সরদার ও বেলায়েত সরদার। এরমধ্যে এক-দুই জন ছাড়া সাধারণ জেলে নেই বললেই চলে। স্থানীয় সূত্র বলছে, সুন্দরবনের দুবলার চরের শুঁটকি ব্যবসা একসময় পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করতেন প্রয়াত মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন। এখন তার আত্মীয়-স্বজনরা নিয়ন্ত্রণ করেন।

বন বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, গত বছর দুবলার চর থেকে তারা তিন কোটি ২২ লাখ টাকা রাজস্ব আয় করেছে। চলতি বছরও  প্রায় সমপরিমাণ রাজস্ব আদায় করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

দুবলার চরের জেলেরা বলছেন, অন্যান্য বছরের মতো এবারও এখানে একজন গ্রাম্য চিকিৎসক একটি দোকান দিয়েছেন। প্রায় ২৫ হাজার বাসিন্দার জন্য ওই চিকিৎসকই একমাত্র ভরসা। সুন্দরবন-কেন্দ্রিক নদী ও সাগরে জেলেরা প্রায়ই সাপের কামড়ে আহত হন। এছাড়া বনে বা নদীতে কাজ করতে গিয়ে আহত হওয়ার ঘটনাও নিত্যনৈমিত্তিক। কিন্তু বন বিভাগ রাজস্ব আদায় করলেও নাগরিক সুবিধার অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে মেডিক্যাল ক্যাম্প করার চিন্তাই করে না।

জানতে চাইলে সুন্দরবনের দুবলার চর বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রহ্লাদ চন্দ্র রায় বলেন, ‘মেডিক্যাল ক্যাম্প করার চিন্তা আমাদের মাথায় আছে। যদিও এবার করা হয়নি। আগামী বছর সুরক্ষা প্রজেক্টে এই বিষয়টি প্রাধান্য দেওয়া হবে। তবে সুপেয় পানির জন্য চারটি পুকুর সংস্কার করা হয়েছে। এছাড়া নতুন দুটি পুকুর খনন করা হয়েছে।’

সাধারণ জেলেদের লাইসেন্স না পাওয়া প্রসঙ্গে বন বিভাগের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘সবাই তো সরকারি ফি দিয়ে লাইসেন্স নিতে পারেন না। বেশিরভাগ জেলে ও মহাজন দাদন নিয়ে ব্যবসা করেন। যারা লাইসেন্স নেন তাদের হয়ে কাজ করেন।

সুন্দরবন নিয়ে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজ করে আসা সাংবাদিক মোহসীন-উল হাকিম বলেন, ‘প্রান্তিক জেলেরা সবসময় শোষণের শিকার হন। তারা কোটি কোটি টাকার মৎস্য আহরণ করে অর্থনীতির গতি সচল করে ঠিকই, সরকারকে বিপুল পরিমাণ রাজস্বও দেয়, কিন্তু তারা নাগরিক সুবিধা পান খুবই সামান্য। সুন্দরবনের জেলেদের জীবনমান উন্নয়ন ও নাগরিক সুবিধার ব্যবস্থার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসা উচিত।’

/এপিএইচ/আপ-এমএস/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সিটি টোলের নামে চাঁদাবাজি বন্ধের আহ্বান সাঈদ খোকনের
সিটি টোলের নামে চাঁদাবাজি বন্ধের আহ্বান সাঈদ খোকনের
আর কে মিশন রোডে ব্র্যাক ব্যাংকের শাখা উদ্বোধন
আর কে মিশন রোডে ব্র্যাক ব্যাংকের শাখা উদ্বোধন
মেহেরবানি করে আমাদের মতো থাকতে দিন, ভারতের প্রতি অলি
এলডিপির সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি নেতামেহেরবানি করে আমাদের মতো থাকতে দিন, ভারতের প্রতি অলি
জমি নিয়ে বিরোধে চাচার ছুরিকাঘাতে প্রাণ গেলো ভাতিজির
জমি নিয়ে বিরোধে চাচার ছুরিকাঘাতে প্রাণ গেলো ভাতিজির
সর্বাধিক পঠিত
অতিরিক্ত ডিআইজি মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ ইসির
অতিরিক্ত ডিআইজি মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ ইসির
যাত্রীর জামাকাপড় পুড়িয়ে পাওয়া গেলো সাড়ে চার কোটি টাকার স্বর্ণ
যাত্রীর জামাকাপড় পুড়িয়ে পাওয়া গেলো সাড়ে চার কোটি টাকার স্বর্ণ
৩০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির দাবি তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের
৩০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির দাবি তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের
দাম কমেছে সবজি-মাংসের, তবু পরিস্থিতি অস্বাভাবিক
দাম কমেছে সবজি-মাংসের, তবু পরিস্থিতি অস্বাভাবিক
সুপ্রিম কোর্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের স্থান পরিদর্শন প্রধান বিচারপতির
সুপ্রিম কোর্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের স্থান পরিদর্শন প্রধান বিচারপতির