X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

ছড়িয়ে দিলেন স্বর্ণমুদ্রা

জাহিদ সোহাগ
১৫ নভেম্বর ২০২১, ২৩:৪৩আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০২১, ০০:৪৩

আগস্টে উন্নত চিকিৎসার জন্য হাসান আজিজুল হক ঢাকা এলেন এবং রাজশাহী ফিরেও গেলেন। তখন আমি কবি হারিসুল হকের চেম্বারে বসে চিকিৎসাজনিত দরকারে গিয়ে আড্ডায় গুলজার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে হারিস ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে ছিলেন হাসান স্যার, তিনি বললেন, ‘বাঁচবেন না। কোনো ওষুধই হাসান আজিজুল হক নিতে [গ্রহণ] পারছেন না।’

নিশ্চিত খবরটা শুনে পেশাগত-নিষ্ঠুরতা—কথাটা বলেছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী, কবি রফিক আজাদের মৃত্যুর সংবাদ শুনে তাকে ফোন করে অনুভূতি চাইলে তিনি কাঁদছিলেন আর একইসঙ্গে আমাকে ধমকাচ্ছিলেন, ‘এ অবস্থায় কীভাবে আমার অনুভূতি জানতে চাও?’ আমি নিজের কান ধরেছিলাম, এমনটা আর কখনো করব না। আসাদ ভাই কিছুক্ষণ পর ফোন ব্যাক করে বললেন, ‘সাংবাদিকদের জন্য এটাই স্বাভাবিক। তুমি কিছু মনে করো না।’

এমন একটা নিষ্ঠুর প্রস্তুতি রেখে আমি নাফাখুম পাহাড়ে গেলাম। সারাটা সময় মনের মধ্যে কু ডাকতে থাকল। কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ নেটওয়ার্কের বাইরে আসায় বিচ্ছিন্নতার চাবুকে রক্তাক্ত হচ্ছিলাম। ভ্রমণ শেষে থানচি ফিরে প্রথম ফোনটিই ছিল হাসান স্যারের খবর নেওয়া, তারপর অন্যকিছু।

বেঁচে থাকার সংবাদ শুনে ভাবছিলাম, হারিস ভাইয়ের মন্তব্য উপেক্ষা করে তাহলে হাসান স্যার বেঁচেই গেলেন। কিন্তু মানুষ আর বাঁচেই-বা কীভাবে! এরই মধ্যে স্যারের ছেলে ফোন করেছেন একটা বইয়ের অনুবাদ প্রসঙ্গে। আর কী কী অফিসিয়াল দরকারে আমিও ফোন করেছি। বাড়তি জীবন পাওয়ার পর কখনো সরাসরি স্যারকে ফোন করার সাহস করিনি।

আজ মাত্রই কথাশিল্পী আকতার হোসেন ফোন করে খবরটা দিলেন। আমিও নিশ্চিত হতে এদিক-ওদিক ফোন করলাম। আর হাসান আজিজুল হকের ধানকলের মতো ঠা ঠা শব্দের হাসি করোটির ভেতর জেগে উঠল।

দুই
ঢাকা লিট ফেস্টের গেস্ট হয়ে হাসান স্যার হোটেল সোনারগাঁয়ে উঠলেন, ফরাসিবিদ চিন্ময় গুহও, আমি কবি শামীম রেজার ছায়ায় থেকে কাজ করছি। রাতে আমরা হাসান স্যারের রুমে হাজির। তিনি ঘুমাবেন বলে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু আড্ডা জমে গিয়ে মধ্যরাত পেরিয়ে যাচ্ছে। তার টেবিলে যা যা খাবার আছে আমরা সাবার করছিলাম, খাবার বলতে আপেল, কমলা। হাসান স্যার খেতে চাইলেন জুস। ফোন করে বললাম, এলো-ও, আপেলের জুস। কিন্তু গভীর রাতে তিনি তা পান করার ঝুঁকি নিলেন না। তিনি তা সবাইকে অফার করে করে শেষে আমাকেই বয়সজনিত কারণে চেপে ধরলেন। আমার যথেষ্ট উদরপূর্তির পর ওই জুস গেলাও কঠিন, তবে লোভও হচ্ছিল, একবার গ্লাসটি হাতে নিয়ে আবার টেবিলে রেখে বললাম, সকালটা আপেলের সঙ্গে শুরু করা ভালো।

সকালে তার রুমে গিয়ে দেখি গ্লাসের মুখ র‌্যাপিং করা জুস পড়ে আছে। র‌্যাপিং ছিঁড়ে ঘ্রাণ নিতে যাচ্ছিলাম, তিনি ‘খেও না, খেও না’ বলে উঠলেন। আমি তাকে আস্বস্ত করে বললাম, ‘পচে কেমন এলকোহল হয়েছে তাই দেখছিলাম।’

রাতের বিচ্ছিন্ন আলাপে আমি ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ ও আবু ইসহাকের প্রসঙ্গ তুলেছিলাম তার মতামত জানার জন্য। কিন্তু তিনি তেমন গুরুত্ব দিলেন না উপন্যাসটিকে। তখন দেবেশ রায়ের এই উপন্যাসটি সংগ্রহ করার কথা বললাম। তিনি ঢাকা ক্লাবে উঠে বিশ্রাম না নিয়ে আজিজ মার্কেটে এসেছিলেন উপন্যাসটি কিনতে। প্রশংসাও করছিলেন। হাসান স্যার বললেন, ‘দেবেশ রায় ও আমার মতামত তো এক নাও হতে পারে। তোমার কেমন লেগেছে তাই বলো।’ এমন জিজ্ঞাসার মুখে আমার কথা জড় হয়ে গেছে সেটা হাসান আজিজুল হক বলেই। অন্য কেউ হলে তো কথার ঢেউ দিয়ে জলোচ্ছ্বাস বইয়ে দিতাম।

তিন
স্যারকে যখনই ফোন করেছি জেমকনের কথা বলে ফোন করেছি, তাতে সহজেই তিনি সহায়তা করেছেন। বারবার আমার নাম ও ফোন নম্বর লিখেও রাখতেন ফোন কানে রেখেই, কিন্তু সেটা বের করে সরাসরি ফোন করা তার সম্ভব হয়নি। ফলে অন্যকোনো মাধ্যমে জানার পর আমি তাকে ফোন করেছি। ইংরেজি অনূদিত ‘সাবিত্রি উপ্যাখ্যান’ প্রকাশের সঙ্গে আমি দূতালির কাজ করেছিলাম কিন্তু বইটির পরিণতি সম্পর্কে আমি এখনো ঠিক জানি না।

একবার ধাক্কাও খেলাম। লিটফেস্ট সম্পর্কে তার মতামত নিতে গিয়ে। তিনি সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ সেশনে ছিলেন এবং দর্শকের চেয়ার কানায় কানায় পূর্ণ থাকত তার কথা শোনার জন্য। প্লেনের টিকিট ও হোটেলে থাকার বিষয়গুলোর সঙ্গে আমি যুক্ত থাকতাম, কিন্তু হঠাৎ কী হলো? তিনি ভীষণ রকম কঠিন গলায় আমার সমস্ত অনুরোধ উড়িয়ে দিচ্ছেন। যেসব কথা বললে সহজ হতেন তা বলেও তাকে সহজ করতে পারছি না। এমন সদাহাস্য দরাজ গলার মানুষটির মুড অফ! কদিন পরে অবশ্য একই দরকারে ফোন করে দেখি তিনি স্বচরিত্রে ফিরে এসেছেন। তখন ভাবছিলাম বয়স এবং অসুস্থতা মানুষের নৌকাখানি সবসময় স্থির রাখে না।

আমাদের চোখের সামনে এই প্রজন্মটি নাই হয়ে যাচ্ছেন, এবং প্রায় একযোগে। হাসান আজিজুল হকের স্মৃতিচারণ করবেন দেবেশ রায়—তিনিও নেই। বন্ধুকে শোকসভায় উপস্থিত থাকার সুযোগ না দিয়ে সবাই চলে যাচ্ছেন। কালো কাপড়ের ব্যানারের সামনে চোখের নিচে অশ্রুর ঝাড়বাতি লুকিয়ে রাখা বন্ধুরা কোথাও নেই। তাদের জীবন দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ, সামরিক শাসন, গণতন্ত্রহীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, কত বড় বড় ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে শিল্পের সুষমায় অগ্রসর হয়েছে, কিন্তু অতিমারির পাঁকে যেন তারা এক লহমায় হারিয়ে যেতে বসেছেন।

তাদের প্রজন্মের প্রায় সবাই হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরে যেতে পারেননি, তিনি জীবন ঘষা আগুনের আলোয় ফিরে গেলেন রাজশাহী, উজানে, শেষে চিরদিনের পাতালে হাসপাতালে।

বাংলা ছোটগল্পের রাজপুত্র পথে পথে ছড়িয়ে দিলেন সমস্ত স্বর্ণমুদ্রা।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
শিলাবৃষ্টিতে ফুটো হয়ে গেছে ঘরের চাল, ফসলের ব্যাপক ক্ষতি
শিলাবৃষ্টিতে ফুটো হয়ে গেছে ঘরের চাল, ফসলের ব্যাপক ক্ষতি
ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক
ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক
ন্যাটোর অংশীদার হতে আগ্রহী আর্জেন্টিনা
ন্যাটোর অংশীদার হতে আগ্রহী আর্জেন্টিনা
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পুকুর থেকে ৬ মাসের শিশুর লাশ উদ্ধার
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পুকুর থেকে ৬ মাসের শিশুর লাশ উদ্ধার
সর্বাধিক পঠিত
এএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
রেস্তোরাঁয় ‘মদ না পেয়ে’ হামলার অভিযোগএএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার