দেশের স্বার্থে দুই প্রধানমন্ত্রী আপসহীন ছিলেন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফর শেষ হয়েছে। দুটি নিকটতম প্রতিবেশি রাষ্ট্রের মধ্যে নিয়মিত রাষ্ট্রীয় সফরের ধারাবাহিকতায় দ্বিপাক্ষিক এই সফরে যা যা হওয়ার কথা ছিল ঠিক তাই-তাই হয়েছে। একটু কমও নয়, একটু বেশিও নয়। এই সফরকালে পুরোটা সময় দিল্লিতে ভারতীয় পক্ষের একাধিক কর্তাব্যক্তি, থিঙ্ক ট্যাংক-এর সদস্য, সাংবাদিক ও ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপকালে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের একাধিক মাত্রা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে যেসব আলোচনা হয়েছে তা দিয়েই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর সম্পর্কীয় বিশ্লেষণের ইতি টানতে চাই।

কী ছিল প্রত্যাশা?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘ভারত’ একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় বটে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকে উপমহাদেশের পূর্বাংশের এই ক্ষুদ্র অঞ্চলটুকু যখন থেকে পাকিস্তানের অংশ হয়েছে ঠিক তখন থেকেই এখানে ‘ভারত-বিদ্বেষী রাজনীতির’ সূচনা হয়েছে। মূলত ভারত-পাকিস্তান বিভাজনে দু’পক্ষই এই বিভাজনের রাজনীতির ধারাবাহিকতা সেই শুরু থেকেই জীবিত রেখেছে এবং এর ওপর ভিত্তি করে ভারতে খুব প্রবলভাবে না হলেও প্রচ্ছন্নভাবে ‘বিদ্বেষ’ একটি জায়গা দখল করে আছে, আর পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির মূলনীতিই যে ভারত-বিরোধিতা তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং ১৯৪৭ সালে এই ভূখণ্ডে যে ভারত-বিরোধিতা রাজনীতিতে আসন নিয়েছিল তা স্বাধীন বাংলাদেশেও সমপরিমাণে রয়েছে কিংবা বলা ভালো যে, এই বিদ্বেষ উত্তরোত্তর বেড়েছে। যদিও ১৯৭১ সালে ভারতের অকৃপণ সহযোগিতা আমাদের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছিল। কিন্তু সেটা এদেশের ভারত-বিরোধী রাজনীতিতে কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি আজও অবধি। বরং সেটা যে একটি নেতিবাচক অধ্যায় ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে এবং যখনই দু’দেশের নেতৃত্বের দু’দেশে সফরের কোনও ঘটনা ঘটে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এলে যে ভয়ঙ্কর তাণ্ডব এদেশে দেখা গেছে তাতে মনে হতে পারে যে, ভারতই এদেশের একমাত্র শক্র দেশ। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকে কেন্দ্র করে একের পর এক নেতিবাচক প্রচারণা যেমন ছিল তেমনই তার ফিরে আসার পর থেকে একথাই বার বার শোনা যাচ্ছে যে, তিনি খালি হাতে ফিরে এসেছেন এবং ভারতের কাছ থেকে কিছুই আদায় করতে পারেননি। প্রত্যাশা বলতে এরকম উড়ো কথাই এদেশের রাজনৈতিক ও বিশ্লেষক মহলে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে শোনা গেছে। অথচ বৈশ্বিক এই ভয়ঙ্কর সময়ে ভারতে শেখ হাসিনার সফরকে ঘিরে বহুমাত্রিক প্রত্যাশা ও অর্জন কাম্য ছিল এবং এ নিয়ে রাজনীতির বাইরে ব্যাপক আলোচনা হওয়ার কথা থাকলেও সেরকম কিছুই হয়নি, শুধুমাত্র চাপান-উতোর ছাড়া।

কী আলোচনা হলো? কী পাওয়া গেলো? কী দেওয়া হয়েছে?

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর শেষে যে যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হয়ছে তাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখ করার মতো বিষয় হচ্ছে কুশিয়ারার পানি-বন্টনে দু’দেশের ঐকমত্যে পৌঁছাটা। এর সঙ্গে সীমান্তে হত্যা নিয়ে দুই নেতা একে শূন্যে নামিয়ে আনার ব্যাপারে একমত হলেও অদূর ভবিষ্যতে যে এটি হওয়ার নয় সেটা বুঝতে দু’দেশের সম্পর্ক বিষয়ে পণ্ডিত হওয়ার দরকার নেই। কিন্তু আমি এখানে যৌথ বিবৃতি নামক প্রকাশ্য বিষয়াদি নিয়ে কথা না বলে দিল্লিতে যাদের সঙ্গে কথা বলেছি এই সফর বিষয়ে তা নিয়ে আলোচনা করতে চাইছি। স্বীকার করে নিতেই হবে যে, তিস্তা চুক্তি নিয়ে এবার আলোচনা হয়নি কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতে যে প্রেস ব্রিফিং হয়েছে তাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উল্লেখ করেছেন যে, তিনি তিস্তা বিষয়ে তার দাবি থেকে সরে আসেননি এবং তিনি এবারও সেটি প্রকাশ্যে জানিয়ে গেলেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, যে কোনও সময় এই চুক্তিটি সম্পাদিত হবে। ভারতের পক্ষ থেকে বিনা মাশুলে তৃতীয় দেশে বাংলাদেশের পণ্য পরিবহন বা ট্রান্সশিপমেন্টের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ তাতে সাড়া দিয়ে সঠিক কাজটি করেছেন বলে সকল বিশেষজ্ঞ একমত হয়েছেন। একই সঙ্গে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া বা কলম্বোর বন্দর ব্যবহার না করে ভারতের চেন্নাই বন্দর ব্যবহার করলে বাংলাদেশের ক্ষতি বা লাভ কী হবে সে বিষয়ে আলোচনা শুরু করার বিষয়ে কথা হয়েছে বলে জানা যায়। ভারত প্রস্তাব দিয়েছেন মেঘালয় থেকে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে একটি মহাসড়ক তৈরির। আর বাংলাদেশ নিশ্চয়তা চেয়েছে ডিজেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ভারতের সহযোগিতার। এই দু’টি ক্ষেত্রেই দু’পক্ষ সহযোগিতা ও সক্রিয় বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছে।

কিন্তু আমার মতে এবারের সফরে দুই প্রধানমন্ত্রীর আলোচনায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বৈশ্বিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়টি। এটি কেবলমাত্র যৌথ বিবৃতির একটি/দু’টি বাক্য হিসেবে নয় বরং, এর একটি রূপরেখাও দুই প্রধানমন্ত্রীর আলোচনায় স্থান পেয়েছে বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কূটনীতিক জানিয়েছেন। বিশেষ করে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংকশনসহ ভবিষ্যতে অর্থনীতি এবং বাণিজ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভারত-বাংলাদেশ কী করে একে-অপরের পাশে থাকতে পারে সে বিষয়ে দুই নেতার আলোচনা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ফলপ্রসূ। ২০১৮ সালে প্রস্তাবিত কম্প্রিহেন্সিভ ইকনোমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট বা সেপা, যা ২০০৯ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ভারত সই করেছে সেই একই আদলে বাংলাদেশকেও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু এখনও সেটি আলোর মুখ দেখেনি। কেন দেখেনি তার উত্তরে প্রত্যেক বিশ্লেষকই দু’দেশের আমলাতন্ত্রকে দোষ দিয়েছেন। ভারতের পক্ষ থেকে সংযুক্তি বা কানেক্টিভিটির ওপর জোর দেওয়া হলেও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তা কার্যকর করার আগ্রহ কতটা আছে তা নিয়ে প্রশ্নও উঠেছে। কানেক্টিভিটির সঙ্গে জ্বালানি ও খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি যৌথ বিবৃতিতে থাকলেও ভারতের কাছ থেকে উদ্ধৃত্ত জ্বালানি বিশেষ করে ডিজেল প্রাপ্তির বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে আলোচনায়। একই সঙ্গে আদানী গ্রুপের কাছ থেকে ঝাড়খণ্ডে উৎপাদিত বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে বিশেষ অগ্রগতি হলেও তা পরিবহনে যথাযোগ্য ব্যবস্থা বাংলাদেশের আছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ থাকায় বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও থেকে যাচ্ছে অনুল্লেখিত। বাংলাদেশে যে বিদ্যুৎ পরিবহনে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং নাহলে নেপাল বা ভুটানে উৎপাদিত বিদ্যুৎও যে এদেশের গ্রিডে যুক্ত করা যাবে না, এই বাস্তবতা মাথায় রেখেও ভারত এ বিষয়ে তাদের আগ্রহের কথা জানিয়েছে।

আমরা জানি যে, ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরকে কেন্দ্র করে যে ভৌগলিক বাস্তবতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্য-তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সেখানে ভারত একটি প্রধান অংশীজন। এই ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটিজিতে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে তা পশ্চিমা বিশেষ করে মার্কিন সরকারের একটি বেশ আলোচনার বিষয়বস্তু। এবারের সফরে এ বিষয়ে আলোচনা কিছু হয়েছে কি? এরকম প্রশ্নেও সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক মহল স্বীকার করেছেন যে, এ বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছে এবং বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ধীরে চলো নীতির কথাও পুনর্ব্যক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার বিষয়টি বর্তমান সরকারের মৌলিক নীতির অংশ। চীন-যুক্তরাষ্ট্র-ভারত, এই ত্রয়ী সম্পর্কের সমীকরণে বাংলাদেশের অবস্থান ‘কারো শত্রু নয়, সকলের সঙ্গে বন্ধুত্বই’ যে শ্রেয় পথ একথা ভারতের বুদ্ধিজীবীরাও স্বীকার করেন। বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ ও অংশীদারীত্ব নিয়ে ভারতের সকল মহলে উদ্বেগ থাকলে সরকারের বিশেষ করে কূটনৈতিক মহলে থাকবে না তা হতে পারে না। ফলে এবারের সফরেও তার পূর্ণ প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই আশ্বাস দেওয়া হয়েছে যে, এ বিষয়ে ভারতের উদ্বেগের কোনও কারণ নেই বরং বাংলাদেশের ভারতের বিনিয়োগ বাড়ানোটাই হবে এরকম অস্বস্তি কাটানোর মূল পথ। ভারতীয় বিশ্লেষকদেরও অনেকেই স্বীকার করেছেন যে, চীন যে আগ্রাসী নীতি ও অর্থ বরাদ্দ নিয়ে বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে তার সঙ্গে তুলনায় ভারতের পক্ষে এত বিনিয়োগ-প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ফলে একটা টানাপড়েনের সুযোগ থেকেই যায়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রশ্ন হলো, এই টানাপড়েন মোকাবিলায় ভারত-বাংলাদেশ কতটা বুদ্ধিমত্তা ও সহনশীলতার পরিচয় দেবে? বা দিতে পারছে?

আরও একটি প্রসঙ্গ এবারের সফরকালে সর্বত্রই আলোচিত ছিল বোদ্ধা মহলে। সেটি হলো, দু’দেশের আমলাতন্ত্রে একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস, বিদ্বেষ এবং অসহযোগিতাসুলভ নেতিবাচক প্রপঞ্চগুলো ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে বলে লক্ষ্যমান। প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে গৃহীত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করে থাকেন দু’পক্ষের আমলাগণ। এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরকালে দু’দেশেই দু’জন হাই কমিশনারকে মেয়াদ পূর্তির আগেই ডেকে নেওয়ার তোড়জোড় চলছে, তারা যে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেননি সেটাও আলোচনায় এসেছে। অপরদিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর শেষ মুহূর্তে সফর-তালিকা থেকে বাদ পড়া কিংবা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিবের এই সফরের একদিন আগে দেশে ফেরার মতো ঘটনাও দু’পক্ষের মধ্যে আমলাতান্ত্রিক টানাপড়েনে উল্লেখ করার মতো নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছে বলে দৃশ্যমান হয়েছে।

কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একটি দ্বিপাক্ষিক সফর শেষ করে সুস্থ শরীরে দেশে ফিরেছেন। নির্বাচনি বছর আগত প্রায়, এমতাবস্থায় এই সফরকে রাজনৈতিক রং দেওয়ার চেষ্টা থাকার পরও এই দ্বি-পাক্ষিক সফরে বাংলাদেশের স্বার্থই মূলত প্রাধান্য পেয়েছে। দুই নেতার রাজনৈতিক আলোচনায় যে হয়নি তা বলা যাবে না, কারণ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাতে যে বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণ্নকারী কোনও চুক্তি বা সমঝোতা হয়েছে তা মনে করার কোনও কারণ আছে বলে মনে করি না। কারণ, দু’পক্ষই আসলে দেশপ্রেম ও দেশের মর্যাদা রক্ষায় সমানভাবে ‘জাতীয়তাবাদী’, দেশের স্বার্থে আপস না করার দীর্ঘ ইতিহাস দুই প্রধানমন্ত্রীরই রয়েছে বলে আমরা জানি।

লেখক: এডিটর ইনচার্জ, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি

masuda.bhatti@gmail.com

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে মাসুদা ভাট্টির বিশ্লেষণ পড়ুন: