করতোয়ার পাড় থেকে শ্মশান ঘাট, লাশ আর লাশ

দুই দিন পর মঙ্গলবার করতোয়ায় ঢলের স্রোত কিছুটা শান্ত হয়েছে। নিস্তরঙ্গ হয়ে উঠেছে নদী। স্থানীয়দের কাছে হাঁটুজলের নদী হিসেবে পরিচিত করতোয়া এখন এক আতঙ্কের নাম। চিরপরিচিত এই নদীটি কেমন যেন অচেনা হয়ে পড়েছে তাদের কাছে। হবেই না কেন, গত তিন দিনে এই নদীর পানিতে ডুবে প্রাণ হারানো ষাট জনেরও বেশি প্রিয়জনের মরদেহ সৎকার করেছেন স্থানীয়রা। করতোয়া তাই এখন তাদের কাছে প্রিয়জন হন্তারক। যদিও এত প্রাণহানির জন্য কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা ও ঘাট ইজারাদারের অবহেলাকে দায়ী করেছেন তারা।

আরও পড়ুন: একের পর এক ভেসে উঠছে লাশ

মহালয়া উপলক্ষে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়নের আউলিয়ার ঘাট ও এর আশপাশের এলাকায় এখন অর্ধগলিত লাশের উৎকট গন্ধ। স্থানীয়দের সহায়তায় একের পর এক মরদেহ উদ্ধারের পর তা মাড়েয়া ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরে নিয়ে আসছেন ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা। পচন ধরা লাশের গন্ধ উপেক্ষা করেই প্রিয় স্বজনকে শনাক্ত করতে ছুটে আসছেন পরিবারের সদস্যরা। শনাক্ত হতেই আঁতকে উঠছেন, বিলাপ করছেন। বুকে পাথর আর মুখে গন্ধ নিবারক কাপড় চেপে মৃত স্বজনের মরদেহ নিয়ে যাচ্ছেন বাড়িতে। সেখানে পরিবারের সদস্যদের একপলক দেখার সুযোগ দিয়ে মরদেহ নিয়ে ছুটছেন স্থানীয় শ্মশানঘাটের দিকে। পঞ্চগড়ের করতোয়া ঘাট থেকে গ্রামের শ্মশানঘাট, শুধু লাশ আর লাশ!

আরও পড়ুন: ‘মা ফিরেছে লাশ হয়ে, বাবা তো ফিরলো না’

স্বজনরা মরদেহ নিয়ে ছুটছেন স্থানীয় শ্মশানঘাটের দিকে (ছবি: আরিফুল ইসলাম রিগান)মাড়েয়ার নিকটবর্তী রাঙ্গামাটি শ্মশানঘাটে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে নৌকাডুবির ঘটনায় উদ্ধার হওয়া মরদেহ সৎকারের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। কোনও মরদেহ পোড়ার ছাই পড়ে আছে, আবারও কোনও মরদেহ পোড়ানোর জন্য চিতায় নেওয়া হয়েছে। পঞ্চগড়ের বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন শ্মশানের চিত্র একই। করতোয়া থেকে একের পর এক মরদেহ উদ্ধার করে তা সৎকারের জন্য শ্মশানে নিচ্ছেন স্বজনরা। আগুনে স্বজনদের মরদেহ পুড়লেও তাদের শোক পোড়াবেন কীভাবে, সে প্রশ্ন তাদের চোখে-মুখে।

মাড়েয়ার বটতলি গ্রামের বাসিন্দা মনোরঞ্জন বলেন, ‘একের পর এক মানুষের লাশ ভাসছে। এ লাশ ভাসা কখন থামবে কে জানে!’

আরও খবর: দেড় মাস আগে বিয়ে, করতোয়ায় বিচ্ছেদ

মাড়েয়ার বাসিন্দা ও ওই ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য মাহবুব আলম প্রধান বলেন, ‘এর আগে এমন নৌকাডুবির ঘটনা এ এলাকায় কখনও ঘটেনি! এত মানুষের প্রাণহানি এই এলাকায় কখনও হয়নি! আমার ষাট বছরের জীবনে তো বটেই আমার বাপ-চাচারাও এত মৃত্যু একসঙ্গে দেখেননি।’

তিনি আরও বলেন, ‘মানুষের মৃত্যু হবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এভাবে মৃত্যু মানা যায় না। এই পরিবারগুলো যে ক্ষতির সম্মুখীন হলো তা কোনও কিছু দিয়ে পূরণ হওয়ার নয়।’

আরও খবর: নৌকাডুবির দায় কার?

মাড়েয়া বামনহাট ইউ‌নিয়ন প‌রিষদ কার্যাল‌য়ে স্থা‌পিত জেলা‌ প্রশাস‌নের জরুরি তথ্য ও সহায়তা কে‌ন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, রবিবার করতোয়ায় নৌকাডুবির ঘটনায় মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত ৬৭ জন পুণ্যার্থীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এরমধ্যে অনেক পরিবারের একাধিক সদস্য রয়েছেন। এখনও নিখোঁজ রয়েছেন কমপক্ষে পাঁচ জন। স্থানীয় প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে মরদেহ সৎকারে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে।

আরও খবর:

ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ যাত্রী ছিল নৌকায়, নদীর পাড়ে আহাজারি

যে কারণে করতোয়ায় ভয়াবহ নৌকাডুবি