অশান্ত বান্দরবা‌ন, দুই মাসে ১৮ খুন

তিন পার্বত্য জেলার (রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি) মধ্যে সবচেয়ে ‘শান্ত’ বলা হয় বান্দরবানকে। কিন্তু এই জেলাটি হঠাৎ অশান্ত হয়ে উঠেছে। দুই মাসে খুন হয়েছেন ১৮ জন। এই পরিস্থিতিতে পাহাড়ের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে সাধারণ মানুষ।

প্রশাস‌নিক সূ‌ত্রে জানা গেছে, গত ৩ জানুয়ারি থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপের আঞ্চলিক সংগঠনের সদস্যসহ মোট ১৮ জন নিহত হয়েছেন। অধিকাংশ হত্যাকাণ্ড পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনের চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঘটেছে।

৩ জানুয়ারি লামা উপজেলার রূপসীপাড়ার অংহ্লা পাড়ায় শ্বশুরবা‌ড়ি‌তে বেড়া‌তে আসেন রাঙামাটির রাজস্থলীর বাঙ্গালহালীয়া এলাকার বাসিন্দা মংক্যচিং মার্মা (৩৫)। রাতে সন্ত্রাসীর গুলিতে তিনি নিহত হন। ৬ জানুয়ারি সদর উপজেলার রাজ‌বিলায় রেথোয়াই মারমা‌র স্ত্রী সিংয়ানু মারমাকে (৩০) কুপিয়ে হত্যা ক‌রে দুর্বৃত্তরা।

আরও পড়ুন: নিহত ৩ সন্ত্রাসীর লাশ নেয়নি স্বজনরা, বেওয়ারিশ হি‌সে‌বে সৎকার

২ ফেব্রুয়ারি বান্দরবা‌নের রুমা জোনের (২৮ বীর) রাইক্ষিয়াং লেক সেনাবাহিনীর ক্যাম্পের টহল দল‌কে লক্ষ্য ক‌রে জেএসএস (মূল) দ‌লের সদস্যরা গুলি চালায়। এতে সেনা কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান নিহত হন। আত্মরক্ষার্থে সেনা সদস্যরা পাল্টা গুলি চালা‌য়। পরে ঘটনাস্থল থেকে জেএসএস মূল দ‌লের তিন সদস্যের লাশ উদ্ধার করা হয়।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রুমা উপজেলার দুর্গম গ্যালেংগ্যা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের আবুপাড়ায় বাবা ও চার ছেলেকে কুপিয়ে-পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ সময় ওই ব্যক্তির আরেক ছেলে পালিয়ে প্রাণে বেঁচে যান। নিহতরা হলেন—আবুপাড়ার পাড়াপ্রধান কারবারী ল্যাংরুই ম্রো (৬০) এবং তার চার ছেলে রুংথুই ম্রো (৪০), লেংরুং ম্রো (৩৭), মেনওয়াই ম্রো (৩৫) ও রিংরাও ম্রো (২৫)।

আরও পড়ুন: ‘স্বপ্নে পাওয়া নির্দেশে’ বাবা ও চার ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা

এ ঘটনায় আবুপাড়ার ২২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর পুলিশের কাছে পাড়াপ্রধান ও তার চার ছেলেকে হত্যার চাঞ্চল্যকর তথ্য দেয় তারা। প্রাথমিকভাবে হত্যার দায় স্বীকার ক‌রে‌ তারা জানায়, ‘স্বপ্নে পাওয়া নির্দেশ’ ও তন্ত্রমন্ত্রের গুজব ছড়িয়ে তাদেরকে হত্যা করে।

২৬ ফেব্রুয়ারি রোয়াংছ‌ড়ি‌ উপজেলায় বাড়ির পাশে সন্ত্রাসীর গুলিতে নিহত হন জেএসএসের সাবেক সদস্য মং‌চিং শৈ (৪০)। তিনি রোয়াংছ‌ড়ি সদর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের নতুন পাড়ার নিসামং মারমার ছেলে।

একই উপজেলায় গত ৪ মার্চ জুম ক্ষেত থেকে ফেরার পথে মিষ্টি কুমড়া চুরির অপবাদ দি‌য়ে এক নারীকে (৪৫) সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পর গলা কেটে হত্যা করা হয়। এদিন উপজেলার নোয়াপতং ইউনিয়নের মহিলা কারবারি পাড়া এলাকার ঝিরি থেকে থেকে লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

আরও পড়ুন: রোয়াংছড়িতে নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগ

পরদিন (৫ মার্চ) রোয়াংছ‌ড়ির তারাছা ইউনিয়নের তালুকদার পাড়ার উপরে নয়াপাড়া এলাকায় পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠন জেএসএসের মূল দ‌লের সশস্ত্র গ্রুপের নেতা অনুমং মারমা‌কে (৫০) গুলি ক‌রে হত্যা করা হয়।

একই দিন রুমা উপজেলার পাইন্দু‌ সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনের দুই পক্ষের গোলাগু‌লিতে চার জন নিহত হয়। পরদিন সকালে রোয়াংছ‌ড়ির মংবাতং এলাকার সাঙ্গু নদীর তীরে তাদের লাশ পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন: সাঙ্গু নদীর তীরে মিললো ৪ জনের গুলিবিদ্ধ লাশ

ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক) জেলা সেক্রেটারি উবামং মারমা বলেন, দিন দিন অশান্ত হ‌য়ে উঠছে পাহাড়। আমরা এমন পরিবেশ বান্দরবানে দেখ‌তে চাই না। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধ হওয়া জরুরি।

জেলা যুবলীগের সভাপতি কেলু মং মারমা বলেন, বান্দরবা‌নের পরিস্থিতি এতই খারাপ যে, কোথাও যে‌তে ভয় পাচ্ছি। যেকোনও মুহূর্তে আমা‌দের ওপরও হামলা হ‌তে পা‌রে। আমরা এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ চাই।

আরও পড়ুন: ‘বান্দরবানের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ পর্যায়ে পৌঁছেছে’

বান্দরবানের পুলিশ সুপার (এসপি) জে‌রিন আখতার জানান, বান্দরবা‌নের বর্তমান পরিস্থিতি তেমন ভালো নয়। ‌এক সময় তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ ছিল বান্দরবান। সবাইকে বর্তমান পরিস্থিতিতে নিজের নিরাপত্তার বিষয়‌টি চিন্তা ক‌রে চল‌তে হবে।

সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘বান্দরবানের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ পর্যায়ে পৌঁছেছে। পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠন, সামাজিক কুসংস্কারসহ বিভিন্ন কারণে এসব অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে। আঞ্চলিক সংগঠনের নেতারা মনে করছেন, তাদের হত্যাকাণ্ডগুলো স্বাভাবিক।